অন্তহীন আকাশের নীচে/৬
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ৬
দেবপ্রিয়া সরকার
--------------------------------
“...ভুবনও মোহনও গোরা
কোন মণিজনার মনোহরা
ওরে রাধার প্রেমে মাতোয়ারা
চাঁদ গৌড় আমার, রাধার প্রেমে মাতোয়ারা
ধুলায় যায় ভাই গড়াগড়ি।
যেতে চাইলে যেতে দেব না, না না না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না...”।
দরাজ গলায় খমক বাজিয়ে গান গাইছিলেন বাউল সুজন খ্যাপা। রাধাবিনোদ মন্দিরের দাওয়ায় বসে ভিক্টর একমনে তাঁর গান শুনছে আর একদৃষ্টে চেয়ে আছে স্বয়ংদ্যুতির দিকে। যেন ভিক্টরের মনের কথাগুলোই গান হয়ে ঝরে পড়ছে সুজন খ্যাপার গলা থেকে। পাশে দাঁড়িয়ে পুরো গানটা ক্যামেরা বন্দি করছে স্বয়ংদ্যুতি। অজয় নদের ধারের ছোট জনপদ কেন্দুলি যা কিনা জয়দেব নামে পরিচিত তা এখন এই ভরা চৈত্রে প্রায় সুনসান। কিন্তু মকরসংক্রান্তিতে এর ছবি পুরোপুরি বদলে যায়।
“শুনেছি মকরসংক্রান্তির দিনই মা গঙ্গা ‘গীতগোবিন্দ’র স্রষ্টা অসুস্থ কবি জয়দেবের ডাকে সাড়া দিয়ে উজান বয়ে অজয়ের কেন্দুলি পর্যন্ত এসেছিলেন। ওই দিন নাকি অজয় নদে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের পুণ্যলাভ হয়। তাই পূণ্যার্থীরা দলে দলে এসে অজয়ের সামান্য জলে শরীর ভিজিয়ে পুজো দেন এই রাধাবিনোদ মন্দিরে” ।*
গান শেষ করে বলছিলেন সুজন খ্যাপা।
-এই রাধাবিনোদ মন্দির তৈরি করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচাঁদ বাহাদুর গো, মা জননী। কিন্তু এখন এই মন্দিরকে সকলে জয়দেবের মন্দির নামেই চেনে। জয়দেব হল গিয়ে বাউল গানের পীঠস্থান। পাগল রামদাস, কবি কুমুদ কিঙ্কর, পূর্ণদাস বাউল আরও কত নামী অনামী বাউল সাধকের চরণধূলি আছে গো জয়দেবের মাটিতে। আমি তো সামান্য মানুষ। আমার গুরুজি অনাথবন্ধু ঘোষের কাছ থেকেই গানের তালিম নিয়েছি। কোনও দিন সুযোগ পেলে চলে আসবেন মা জননী গুরুজির গলায় ‘গীতগোবিন্দ’ শুনতে। অন্ধবাউলের ওই গান সারাজীবন আপনার কানে বাজবে, কথা দিচ্ছি।
সুজন খ্যাপার কথা শেষ হলে স্বয়ংদ্যুতি ক্যামেরা তাক করল জয়দেবের মন্দিরের ঠিক উল্টো দিকে থাকা ধর্মমঙ্গল কাব্যের ইছাই ঘোষের দেউলের দিকে। ভ্লগের জন্য কনটেন্ট খুঁজতে খুঁজতে আজ অজয় নদের ধারের এই জনপদে ভিক্টরকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছে স্বয়ংদ্যুতি। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতেই মন্দিরের কাছে দেখা পেয়েছে সুজন খ্যাপার। গাঁজার ছিলিমে টান দিয়ে একে একে গান শুনিয়ে চলেছেন তিনি আর রসদ যোগাচ্ছেন স্বয়ংদ্যুতিকে ভ্লগ বানানোর।
সুজন খ্যাপাকে ছেড়ে তারা আরও খানিকক্ষণ ঘুরে দেখল পুরো গ্রামটা। বাউল সংস্কৃতি নিয়ে লখনউ প্রবাসী স্বয়ংদ্যুতির তেমন কোনও ধারণা ছিল না। ভিক্টরই তার মাথায় ঢোকায় হাতের নাগালে থাকা জয়দেব নিয়ে ভ্লগ তৈরি করার বুদ্ধিটা। এবং আইডিয়াটা যে দারুণ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই স্বয়ংদ্যুতির। খ্যাপা বাউলের গান থেকে শুরু করে জয়দেবের ঘর, দুয়ার, মন্দির, দেউল, আখড়ার ছবি তুলে এখন ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে নিজে। অজয় নদকে পেছনে রেখে বলে চলেছে, বন্ধুরা আমরা আজ এসেছিলাম বীরভূমের ইলামবাজার থানার মধ্যে থাকা একটা গ্রাম জয়দেব-কেন্দুলিতে। মকরসংক্রান্তির বিখ্যাত বাউলমেলার কারণে এই নাম আপনাদের খুব পরিচিত। আশা করি ভিডিওটা সকলের ভাল লাগবে। পছন্দ হলে লাইক এবং শেয়ার করতে ভুলবেননা কিন্তু। আরও এমন ইতিহাস ছোঁয়া ভিডিও দেখার জন্যে সাবস্ক্রাইব করে ফেলুন স্বয়ংদ্যুতিস ড্রিম ওয়ার্লড। খুব তাড়াতাড়ি আবার আসব নতুন জায়গা আর নতুন কিছু ভ্লগ নিয়ে। গুড বাই, হ্যাভ আ নাইস ডে।
শুটিং শেষ করে ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল স্বয়ংদ্যুতি। পাশের দোকান থেকে ভিক্টর মাটির ভাঁড়ে চা আর গরম গরম আলুর চপ নিয়ে এসেছে। আয়েশ করে বসে বলল, খেয়ে নে গরম আছে এখনও। লাঞ্চ তো সেই কখন হজম হয়ে গেছে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে।
হাত বাড়িয়ে চায়ের ভাঁড়টা নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি লম্বা চুমুক দিল। বলল, আহ্! চা টা দারুণ করেছে। বাই দ্য ওয়ে জয়দেব আসার আইডিয়াটা সত্যি ইউনিক ছিল। এরজন্যে তোর একটা বিগ থ্যানকস্ প্রাপ্য।
-ধুস! থ্যানকস্ আবার কীসের? তোর ভ্লগের জন্য নতুন কিছু আইডিয়া দিতে পারলে আমার ভালই লাগবে। এরপর কী করবি? কিছু ভেবেছিস?
হাতে ধরা আলুর চপে কামড় বসিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, নেক্সট ভিডিও শ্যুট আর এ তল্লাটে হবে না।
-মানে? কোথায় যাবি শ্যুট করতে?
-কোচবিহার যাচ্ছি আগামী সপ্তাহে। পরের ভ্লগটা ওখানে গিয়ে বানাব।
-কোচবিহার! হঠাৎ?
-হঠাতের কী আছে? অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম যাব কিন্তু এবার ফাইনালি প্ল্যানটা করেই ফেললাম।
-একাই যাবি?
-এখান থেকে একাই যাব কিন্তু মা বাপিও পরে জয়েন করবে। আসলে দারুণ একটা সুযোগ আচমকাই পেয়ে গেলাম সকলকে এক জায়গায় আনার। এই চান্স কোনওভাবেই মিস করা যাবে না।
-চান্স? সেটা কীরকম? কী করতে চাইছিস একটু খোলসা কর প্লিজ।
ভাঁড়ের শেষ হয়ে আসা চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, সেদিন সেমিনার শেষে হস্টেলে ফিরে মায়ের সঙ্গে কোচবিহার নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখনই জানলাম বিষয়টা। আগেকার দিনে গাঁ ঘরে মেয়েদের জন্মদিন কেউ সেভাবে মনে রাখত না। কিন্তু দিদার জন্ম এমন একটা দিনে হয়েছিল যে সবার দিনটা খেয়াল থাকে। পয়লা বৈশাখ হল দিদার জন্মদিন। আর মায়ের হিসেব অনুযায়ী এবার দিদা নিরানব্বই বছর পূর্ণ করে একশোয় পড়বে। জাস্ট ইমাজিন! একজন মানুষ একশোটা বছর এই পৃথিবীতে কাটালো। ইট ডিমান্ডস্ আ গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন, তাই না?
-বাহ্! সেঞ্চুরি! দারুণ ব্যাপার তো! অবশ্যই সেলিব্রেট করা উচিৎ।
-মায়ের মুখ থেকে কথাটা শোনার পরই কোচবিহার যাবার প্ল্যান ছকে ফেললাম। এই বাহানায় একটা জবরদস্ত ফ্যামিলি রিইউনিয়নও হয়ে যাবে ভেবে কথা বললাম ডাব্বুদাদা আর দিভাইয়ের সঙ্গে। ওরাও রাজি হয়ে গেল। দিভাই আর জিজু আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরছে। থাকবে মাস খানেক। কলকাতা থেকে ডাব্বুদাদা আর বৌদিও আসছে। মেজমামা এখন সিঙ্গাপুরে থাকে। ওঁর সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ আছে ডাব্বুদাদার। ওঁকেও আসার জন্যে রিকোয়েস্ট করেছে। দেখা যাক আসতে পারেন কিনা। খুব এক্সাইটেড লাগছে জানিস? কত্তদিন পর আবার সকলে একসঙ্গে এক জায়গায় জড়ো হব৷ খুব মজা হবে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন ভিডিও উপহার দেব আমার ভিউয়ারদের। এবার বল কেমন লাগল প্ল্যানটা?
-ঝক্কাস! পুরো কাঁপাকাঁপি ব্যাপার।
কথাটা বলে খানিকক্ষণ স্বয়ংদ্যুতির দিকে তাকিয়ে থাকল ভিক্টর। আশা করেছিল হয়তো স্বয়ংদ্যুতি তাকেও বলবে সঙ্গে যেতে। কিন্তু না, তেমন কিছু বলল না উল্টে জানাল অনির্বাণ স্যারকে সে জানিয়েছে কোচবিহার যাবার কথাটা। স্যার তাকে দারুণ উৎসাহ দিয়েছেন এমনকি তাঁর পরিচিত কোনও এক রিসার্চ স্কলারের কনট্যাক্ট নম্বর দিয়ে বলেছেন কোচরাজ্যের ইতিহাস ডিটেইলসে জানার জন্যে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এসব কিছু নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি খুবই উত্তেজিত। পারিবারিক অনুষ্ঠান বলেই বোধহয় সে এড়িয়ে যাচ্ছে ভিক্টরকে। অথচ এই ভিক্টরই এতদিন ছায়ার মতো আগলে রাখত তাকে, বর্ধমানের রাজবাড়ি হোক বা হাজারদুয়ারি প্যালেস, জব চার্নকের সমাধি হোক বা ব্যান্ডেল চার্চ যেখানেই স্বয়ংদ্যুতি ভিডিও শ্যুট করতে গিয়েছে তাকে অনুসরণ করেছে ভিক্টর। স্বয়ংদ্যুতির সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজেকে ওর থেকে আলাদা ভাবতে ভুলেই গিয়েছিল সে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে সম্পর্কটা সহপাঠীর গণ্ডি ছাড়িয়ে আর বেশি দূর এগোয়নি। অন্তত স্বয়ংদ্যুতির দিক থেকে তো নয়ই। কথাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভিক্টরের বুকের ভেতর থেকে।
ফেরার সময় সারা রাস্তা স্বয়ংদ্যুতি অজস্র কথা বলল কিন্তু ভিক্টর চুপচাপ শুনে গেল শুধু। চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে চোখে পড়া লাল কাঁকর ভরা রাস্তাটাকে যেন অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছে এখন। পথ যেন ফুরোতেই চাইছে না। দিগন্তের কাছে ডুবন্ত সূর্যের লালিমা মেখেছে আকাশ। শুকনো দখিনা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে ভিক্টরের চোখে মুখে। একটা অজানা মনখারাপের অনুভূতি ছুঁয়ে আছে তাকে। কিছু কি হারাতে বসেছে সে?
*তথ্যসূত্রঃ ‘নেশাতেই তো ভাব আসে গোঁসাই’- বিধান রায় (রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা ১/১/২৩)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴