পইলা সাঞ্ঝির কথা=৫৯/শুক্লা রায়
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৫৯
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
যত কষ্টই হোক, কর্তব্য তো থেমে থাকে না। কান্নাকাটির মধ্যেই কেউ একজন ভাঙা গলায় বলে উঠল,
"কাহো কনেক কলার পাতখান কাটি আনো বারে। বাবাক থাকের নাগে।"
ঝটপট তুলসীতলাটা গোবরজলে লেপে তার উপর সম্পূর্ণ গোটা একটা টাটকা কলার পাতা কেটে এনে পেতে দিল কেউ। যারা এসব কাজ করতে অভ্যস্ত তারা হুলুস্থুল কান্নাকাটির ভেতরেও নীরবে নিজের কর্তব্যটূকু করে যেতে থাকে। দুই একজন সাইকেল নিয়ে আশে পাশের আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি খবর দিতে ছুটল। আত্মীয় বলতে মেয়ের বাড়ি আর বুধেশ্বরের এক কাকা থাকে পাশের পাড়ায়। তবে খবর দিতে হয়নি, এ পাড়া ও পাড়া কথা চলাচল করে দ্রুত। বুড়োটাকে ভ্যানে বসিয়ে দুই ছেলে বৌমা, বাচ্চা-কাচ্চা সব এসে পড়েছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। একজন বলে,
"সাগাই সোদোরগিলা কায় কায় আসিবে আসুকখেনে। তার পাছে সেলা ঠাকুমারিত আনেন। এলা ওত্তি ঝালিখানোতে নৌক।"
এসব কথার মাঝেই বাইরে মেয়েলি কন্ঠের কান্নার আওয়াজে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। ভিড়ের ভেতর একজন মহিলা কান্নাধরা গলায় বলে,
"ওই তো মাইও আসিল। বুড়াটার বেটি। আগোতে কেংকেরি বা খবর পাইসে।"
জানা গেল ওদের পাড়ার কার অসুখ, দু তিনদিন থেকে ভর্তি ছিল। আজকেই ছাড়া পেয়ে বাড়ি গিয়ে খবর দিয়েছে।
"ইমার দুরন্তরিয়া সাগাই নাই। বগলোতে সোগায়। মাইও আসিল। বুধেশ্বরের শ্বশুর বাড়িও তো বগলোতে। খবর যাইতে না যাইতে উমরাও এলায় ধাও করি চলি আসিবে। তাবত্তে বুড়াটাক নিকলাও এত্তি। যতয় নবে, ততয় কান্দন এলায় থামিবেকে না।"
সুরেন বুড়োর কথায় সবাই সায় দেয়।
"এ বারে। সোগায় যুদি আইচ্চে তে কেনে আরো ফাকোতে দেরি করি। জোগোত জাগাত গতি করি আসি।"
ভিড়ের থেকে কেউ জোর দিল। বুধেশ্বরের বাপকে কলার পাতাটায় শোয়ানো হল। নতুন মার্কিন কাপড়ে শরীর ঢেকে। মুখটা শুধু বাইরে। কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো হাত দিয়ে ছুঁয়ে বন্ধ করে দিল। উপরে পেতে দিল তুলসীর পাতা। রসবালা কাঁদতে কাঁদতেই চন্দন বেঁটে নিয়ে এল। বসমতী চন্দন দিয়ে কপালে 'হরে কৃষ্ণ' লিখে দিল। মার্কিন কাপড়েরই একটা ছোট্ট ঝোলা হাতে সেলাই করে বানিয়ে কাঁধে দিল কেউ। ওটা দেখে একজন বৃদ্ধা নিঃশ্বাস ফেলল,
"ঝোলাঝুলি নিয়া এলা ভবের হাটোত বেচা কিনা করিবে বারে। ইমরা এলা হামার মানষি না হয়!" বাড়ির লোক, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন আস্তে আস্তে এসে মুখে ফুলজল দিয়ে প্রণাম করতে লাগল। একটা ঘটিতে সাদা ফুল আর জল রাখা। গলায় একটা সাদা ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছে কেউ।
"মনটা কছে বোদায় নিন পাড়েছে বারে। অসুখ নাই বিসুখ নাই, টাটকা মানষিটা গেল আজি।"
কথা বললে কথা চলতেই থাকবে। কান্নাও সহজে থামবে না। কিছু ডাকাবুকো লোক সব জায়গাতেই থাকে। হরেন ডাক দিয়ে বলে,
"ন্যাও হোইসে সোগারে ফুলজল দ্যাওয়া। দোলনাখান আনো। কায় কায় ঘাড়োত নিবেন বারে আইসো।"
মহিলারা এবার তৎপর হয়ে ওঠে। বুধেশ্বরের বাবার পায়ের পাতা দিয়ে বুধেশ্বরের মায়ের কপালের সিঁদূর মুছে হাতের শাঁখা ভেঙে দেয়। সবার চোখে জল।
বাঁশের মাচার মধ্যে কলার পাতাসহ বুড়োটাকে শুইয়ে দড়ি দিয়ে তিন জায়গায় বেঁধে রেডি করা হল। বুধেশ্বর, বুধেশ্বরের কাকার দুই ছেলে আর সুষেণ এসে মাচাটা কাঁধে তুলে নিল। সকলেই সাদা মার্কিনের থান কাপড় পরে নিয়েছে। 'বল হরি হরি বোল' হাঁক ওঠার সাথে সাথে বাড়িময় কান্নার বেগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বুধেশ্বরের মা আর বোন খোলা উঠোনে আছাড়ি-পিছাড়ি করে কাঁদতে লাগল। কীর্তনিয়াদের খোল-করতালের আওয়াজে আর কান্নার শব্দের মিশেলে এক অদ্ভুত বিষন্ন পরিবেশের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মৃতদেহকে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে আসতে লাগল। আগে আগে বাঁশের একটা ভারে একদিকে দুটো পাটকাঠির ছোট ছোট বোঝা, অন্যদিকে দুটো মাটির ডোগা ঝুলিয়ে নিয়ে একজন চলেছে। রসবালা বলে,
"মাটিরনা ডোকালাত কী কী নিলেক তো?"
বসমতী পাশেই ছিল। বলল,
"জানিন না? একটাত তুলসি ঠাকুর নিল, আর একটাত ওই তো চাইট্টা সোইষ্যা, চাইট্টা চাউল, কয়টা সুকাতি নিবার নাগে। হোটে নাইগবে এইলা জিনিস!"
কেউ খবর দিয়েছে হন্তদন্ত হয়ে ফুকন দেব শর্মা আর বলদেও ঠাকুর হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দলের সঙ্গে মিশে গেল। যেতে যেতে নিশান পুঁততে পুঁততে আর খই ছেটাতে ছেটাতে দলটা এগোতে লাগল। বাঁশের কঞ্চি ফাটিয়ে তার ফাঁকে তিনকোণা করে মার্কিন কাপড় ছিঁড়ে গুঁজে দিয়ে সেই নিশান বা পতাকা রাস্তার ধারে কয়েক জায়গায় গেড়ে দেওয়া নিয়ম।
শোভাযাত্রার মতো দলটা লাইন করে এগোচ্ছিল। রাস্তার পাশে যারাই দেখছে হাতজোড় করে প্রণাম করে রাস্তার পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে। সোজা বারবাঁক নদীর পাড়ে চিতা সাজাবে। শুকনো কাঠ, খড়ি, ঘি, মধু হাজারো জিনিস সাথে নিয়ে যেতে হচ্ছে। আর আছে বড় বড় করে কেটে আনা কাঁচা বাঁশ। আগুনে পড়লে সব নাকি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। পাশাপাশি দু তিনটে পাড়া মিলে শুধুমাত্র মড়া পোড়ানোর ওস্তাদ মানুষ আছে কিছু। এদের খবর দিতে হয় না। নিজে থেকেই একবার শুনলেই কোমরে গামছা বেঁধে চলে আসে। খৌব নরম মনের মানুষ হলে এই কাজ করা সম্ভব হয় না। সাহস এবং ধৈর্য্য দুটোই দরকার। সবাই একে একে বিদায় হলেও বাড়ির লোকের সঙ্গে শেষ পযর্ন্ত এরাই থাকে। যত রাত হোক, অন্ধকার, ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুতেই ছেড়ে যায় না।
শববাহী দলটা বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই রসবালা বুধেশ্বরের মাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। নিয়ম অনুযায়ী গোবর জল গোলানো মাটির হাঁড়ি একটা আছাড় মেরে ভাঙতে হয়। কিন্তু তাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। কেউ একজন বলল,
"বৌমা ভাঙিলো না হোবে।"
যাইহোক শেষ পর্যন্ত বুধেশ্বরের মাকে দিয়েই হাঁড়িটা ভাঙানো গেল। সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল বুকফাটা হাহাকার। সুকারুর বৌ তুলসীতলাটা আবার গোবর জল দিয়ে লেপে দিয়ে গোটা উঠোনটাই গোবরজলে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করতে লাগল। পরেশের বৌ গিয়ে কেটলিতে চা বসিয়ে দিল। দুই একজন বয়স্ক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। তাদের জন্যই এই আয়োজন। সবাই চলে যাওয়ার পর বুধেশ্বরের কাকাকে একটা ভ্যানে বসিয়ে নদীর দিকে নিয়ে যাওয়া হল। বুড়োর মুখে কোনো কথা নেই। একদম চুপ করে মাথা নিচু করে একভাবে বসে আছে। রসবালা আস্তে আস্তে বলে,
"ভাই মরার শোক! এখেনায় সার দাদা, তায় আজি চলি গেইল। বুড়াটার বুকোত বোদায় শ্যাল বসিসে। দ্যাখো তো কেমতোন তলমুয়া হয়া বসি আছে নিসপ্তা নাগি!"
...............................................................
ঝালি - কাঁচা বারান্দার উপর খড়ের চালা দেওয়া জায়গা
দোলনা - এখানে মৃতদেহ বহনের বাঁশের মাচাটিকে বোঝায়
সুকাতি - পাটপাতা পিঁড়িতে ডলে ডলে লম্বামতো করে গিঁট দিয়ে শুকায়। খাওয়া ছাড়াও নানা কাজে লাগে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴