চ্যাংমারী চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
চ্যাংমারী চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------
শারদোৎসবের মহালগ্ন সমাগত। ২৮ টা বাদে অধিকাংশ বাগিচাতেই বোনাস পর্ব মোটামুটি শান্তিতেই মিটেছে। তবুও এর মাঝে কিছু কিছু চা বাগানে লকআউট ঘোষিত হয়েছে। মহালয়ার ছুটিটাকে কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম নাগরাকাটা বানারহাট। প্রকৃতি মাঝে মাঝে রক্তচক্ষু দেখালেও ডুয়ার্সে এখন কাশফুল শরতের মৃদু সমীরণে দোল দিচ্ছে। তাই আজ স্মৃতিপটে চা বাগিচার দুর্গাপুজো নিয়েই কলম ধরলাম। সেই সময়কার দুর্গাপুজো আর এই সময়কার দুর্গাপুজোর মধ্যে আসমান জমিন ফারাক। তবুও তারই মাঝে মা আসেন এবং চা বাগিচাতেও মানুষ মাতেন উৎসবের আনন্দে। মালঙ্গি চা-বাগানে থাকত ছোট মেসো ৷ এক শারদোৎসবের প্রাক্কালে মাসির আমন্ত্রণেই বাবা-মায়ের হাত ধরে সেই প্রথম ডুয়ার্সে আসা। আমি তখন মাধ্যমিক পাশ করেছি সবে। মনে আছে, সম্ভবত হ্যামিলটনগঞ্জ পর্যন্ত রেল চলাচল ছিল। ওল্ড হাসিমারায় রেল স্টেশন ছিল। মনে আছে মেসোর পরম সুহৃদ হেলথ সেন্টারের যতীন ডাক্তার, পরবর্তীকালে আমার যতীন মেসোর সঙ্গে আমরা ভ্যান রিক্সা করে হাসিমারার মালঙ্গি চা-বাগান পৌঁছেছিলাম। আমরা লেবার লাইনের এক বাড়িতে প্রবেশ করেছিলাম। শ্রমিক বস্তির পরিবারের লোকজন ভাঙা চেয়ার, মোড়া এনে আদর করে বসতে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় পৌঁছেছিলাম মালঙ্গি চা-বাগানের মাসির বাড়িতে। মালঙ্গি চা-বাগানে মাসির বাড়ির কাছেই ছিল চারদিকে চা-গাছ। কী সুন্দর পরিবেশ, না দেখলে বোঝা যাবে না। বেশ কয়েকদিন ছিলাম মালঙ্গিতে। আসলে মালঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে এটাই আমার দেখা প্রথম চা-বাগান। পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন এবং পরবর্তীকালে কর্মজীবনের প্রথম লগ্নে সাংবাদিকতা এবং দ্বিতীয় পর্বে শিক্ষকতা তথা লেখালেখি চর্চার ফলে আমার স্মরণে-শয়নে-স্বপনে ডুয়ার্স এবং তরাই সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। আসলে আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি আর বর্তমান চেহারার মধ্যে কোনও তালমিল খুঁজে পাইনি ক্ষেত্রসমীক্ষায় এসে।
কোথায় হারিয়ে গেল দুর্গা পুজোর দিনগুলিতে মেলা, নাগরদোলা, যাত্রাগান বা কবিগানের আসর? কোথায় হারাল ধামসা মাদলের দ্রিমিদ্রিমি আর ধিনতা ধিনাকের সঙ্গে দলবদ্ধ গান-নাচের অপূর্ব সুরমূর্ছনা ? আর তাই মনে হয়, বিকেলবেলার চা-বাগানের চা-পাতার সেই মদির গন্ধ এবং আমেজ খুব তাড়াতাড়িই হারিয়ে গেল। মালঙ্গি বাগানে এখনও গেস্ট হাউসটি পুরনো আভিজাত্যের প্রতীকরূপে দণ্ডায়মান। মালঙ্গির ফ্যাক্টরি সংলগ্ন হেল্থ সেন্টারের পাশাপাশি ভার্নোবাড়ি, সাঁতালি ও মালঙ্গির সম্মিলিত সেন্ট্রাল হসপিটাল আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মুরগি লড়াই, সপ্তাহে একদিন ফ্যাক্টরি সংলগ্ন মাঠে বড় পর্দায় সিনেমা শো চলত, আর পরদার সামনে-পিছনে মাঠের মধ্যে বসে শ্রমিকরা তারিয়ে তারিয়ে সিনেমা দেখত— এসব দৃশ্য কোথায়? ধাপগঞ্জ গভঃ স্পনসর্ড আশ্রম টাইপ হাইস্কুলে আমি পড়াই। জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি সড়কে জলপাইগুড়ি থেকে ৯ কিমি দূরবর্তী এই বিদ্যালয়ে কৃষিজীবী পরিবারের তফসিলি ছাত্রদের পাশাপাশি সুদূর কুমারগ্রাম থেকে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া — এই বিস্তৃত চা-বাগিচা অঞ্চলের আদিবাসী ছাত্ররাও পড়াশোনা করে। আশ্রমিক আবাসিক এই বিদ্যালয়টিতে ১৮০ জন ছাত্র আবাসিক, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান'-এর মিনি ডুয়ার্স আমাদের ছাত্রাবাস। কে নেই? ইসলামপুরের অগাস্টিন হেমব্রম, রাহুল মুর্মু, ধনিয়াল হাঁসদা, খড়িবাড়ির বুধুরাম বেসরা, কুমারগ্রামের জিতেশ লাকড়া, মেটেলির অনীশ ওঁরাও, আলিপুরদুয়ারের বিজন তির্কি, ভাণ্ডারপুর শিকারপুরের আকাশ মুন্ডা, সোনাপুর-চোপড়া-বিধাননগরের সমর কিসকু, সুনীল মার্ডি, পরিমল সোরেনরা, হলদিবাড়ি সাতকুড়ার অশোক মুর্মু, বিষ্টু হেমব্রম, বিশনাথ এক্কা, বারোবিশার রাজকুমার হেমব্রম— সকলেই চা-বাগিচার সন্তান। বিশুরামের বাড়ি নাগরাকাটার ধরণীপুর চা বাগানে। রেডব্যাঙ্ক, স্রেন্দ্রনগর, ধরণীপুর দীর্ঘদিন বন্ধ।
-কী রে বিশুরাম, পুজোতে কী নিবি ?
চুপ করে থাকে বিশুরাম। ছোট্টখাট্টো মিশকালো চেহারা। মুক্তোর মতো সাদা দাঁতগুলো বার করে হাসে বিশুরাম। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
—কিছু লিবো না স্যার, বাবার পয়সা নাই।
–কেন, পয়সা নেই কেন? কী করে তোর বাবা?
—চা-বাগানে কাম করে। বাগানের কামকাজ হয় না, বাবার পয়সা নাই বলেছে, ইবার পুজোয় জামাকাপড় দিবেনি।
–কয় ভাই, কয় বোন তোরা ?
—দুই ভাই, এক বোন।
বিশুরামের বাবা বুধুরাম জানাল, কী পাব জানি না। পুজোয় ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা-জুতো কিনে দিতে পারব কি না জানি না। সবই ভাগ্য।' অসহায়তা শুধু বিশুরামের বাবার নয়, বন্ধ চা-বাগানগুলির লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পরিবারের। প্রতি বছরই দেখি মহালয়ার আগে পরীক্ষা পর্ব মিটে গেলেই ছেলেদের বাড়ি যাওয়ার তর সয় না। কারণ ওরা জানে বাবা-মায়ের হাতে বোনাস বা উপার্জনের পয়সা এসেছে। এবার জামা-জুতো মিলবেই। তাই যদি বলা যায় আর কয়েকদিন পরে ছাড়া হবে, এখন ছুটি দেওয়া যাবে না, তাহলে কেঁদেকেটে ব্ল্যাকমেল করে অভিভাবক নিয়ে এসে ছুটি আদায় করে। কিন্তু অত্যন্ত শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন বিশুরাম ছুটিও চাইতে আসেনি। হয়ত বিশুরামের মত সহজ-সরল সাদাসিধে এই শিশুগুলোও বুঝে গিয়েছে ওদের নিদারুণ দারিদ্র্য আর অভাবের কথা। তাই বাড়ি যাবার, বাবা-মায়ের কাছে যাবার তাগিদ নেই এ জন্যই যে, ওরাও জানে বাড়ি গেলে আশ্রম হস্টেলের এই ডাল-ভাতটুকুও হয়ত জুটবে না।
ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত চোখে পড়ল কুমারগ্রাম, সংকোশ আর নিউল্যান্ডসে। নিউল্যান্ডসের আদি নাম ধুমপাড়া। বাগানের প্রাকৃতিক শোভা অসাধারণ। এখানে চা-পাতার মদির গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। শ্রমিক লাইনে শোনা যায় মাদলের শব্দ। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে তারা গান গায়, দূর থেকে তা শোনা যায় কুলি লাইনের পাশ দিয়ে গেলে। নিউল্যান্ডসের রাধাগোবিন্দ মন্দিরের উৎসব, দুর্গোৎসবে সাত দিনব্যাপী মেলা সর্বজনবিদিত। নিউল্যান্ডস বা ধুমপাড়ার মেলায় বারোবিশা, কামাখ্যাগুড়ি, এমনকি কলকাতা, আসাম, পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকেও পসারিরা আসত এবং এখনও আসে। মেলায় আসে ছোটখাটো সার্কাস, নাগরদোলা, টয় ট্রেন, গানের দল, নাচের দল। নিউল্যান্ডস থেকে রায়ডাক নদী ১ কিলোমিটারের মতো, হেঁটেই যাওয়া যায়। রায়ডাকের তীরে কুলবনে অগুনতি পাখির ঝাঁক। নিউল্যান্ডস থেকে সেই হাড় হিম করা কালীখোলা, যা একদিন কেএলও দের গুপ্ত ঘাঁটি ছিল, তা বড়জোর ৪-৫ কিলোমিটার হবে। গেলাম আমার ছাত্র রায়ডাক চা-বাগানের জিতেশ লাকড়াকে নিয়ে। পথে পেলাম অগুনতি বানর আর বনমুরগি। কালীখোলা সংকোশ নদীর ঝিরঝিরে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে এক অনির্বচনীয় পুলক, এক অজানা আনন্দ দেহ-মনে শিহরণ তোলে। কুমারগ্রাম বাগান থেকে বাগানের নিজস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ সংকোশ পর্যন্ত গিয়েছে। কুমারগ্রাম এবং সংকোশ গুডরিক গ্রুপ-এর সাবালক বাগান। তিনটি বাগানেরই চা উৎপাদন ভাল। শ্রমিক ও বাবুরা খুশি মনেই কাজ করে। বাগান তিনটি কোনও দিনই বন্ধ হয়নি। স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল। তবে চা-বাগিচার বাবু বা কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছে। আজ তারা অনেক পিছিয়ে পড়ছে। এসব বাগানের আগের সেই জৌলুস আর নেই। পুজোর সময়ে শহরের দোকানদারেরা বোনাসের উপর কিছুটা নির্ভরশীল থাকলেও সর্বাংশে নয়। কারণ শহর ও গ্রামগঞ্জের মানুষের হাতেও এখন পয়সা এসেছে।
শুধুমাত্র নিকষকালো অন্ধকারই প্রদীপের নিচে থাকে না। প্রদীপের আলোকরশ্মির মধ্যে উজ্জ্বলতাও থাকে। উত্তরের চা-বাগিচাগুলিতে দুর্গা পুজোর প্রচলন কিন্তু ব্যাপক। কুলি লাইনের আদিবাসী ও অধিবাসীদের পুজো এলাকাভিত্তিকভাবে নিজস্ব স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। লোক দেখানো বাহ্যিক আড়ম্বর নেই, আছে সমর্পণের মাধুর্য। বাৎসরিক এই শারদোৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উচ্চপদ-নিম্নপদ, উচ্চজাত-নিম্নজাত, শ্রমিক-কর্মচারী-মালিক— সকলের পরিবারবর্গ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়ে মাতৃ আরাধনায়। মালিকানার হাতবদল হলেও বাৎসরিক দুর্গাপুজো হয় চিলাপাতা ফরেস্ট সংলগ্ন মথুরা বাগানে। প্রতি বছর মাতৃ আরাধনায় মথুরাবাসী অংশগ্রহণ করেন অফিস ও ফ্যাক্টরির চৌহদ্দির ভিতরে বাঁধানো মণ্ডপে। বাহ্যিক আড়ম্বর থাকে না মথুরাসহ ডুয়ার্সের ছোট ছোট বাগানে। সকলের সঙ্গে সকলেই আনন্দের ভাগীদার হয়ে ওঠে। আসলে যত ছোট পুজোই হোক না কেন, আন্তরিকভাবে মাকে ডাকলে সেই ডাক যে সরাসরি মায়ের দরবারে গিয়ে উপনীত হবে, তাতে তাদের কোনও সন্দেহই নেই। যেমন সরস্বতীপুর বা ডেঙ্গুয়াঝাড় বা বেলাকোবার শিকারপুর চা-বাগানের বিভিন্ন ধর্মীয় পরব বা পুজাপার্বণ সুশৃঙ্খলার সঙ্গেই পালিত হয়ে থাকে বলে সাম্প্রদায়িক সদ্ভাবনায় এখনও পর্যন্ত কোনও কমতি হয়নি। মহালয়ার পরদিন থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যেত সরস্বতীপুর বাগানে। মালিক স্বর্গত কিষাণ কল্যাণী জলপাইগুড়িতে থাকতেন। বনেদি পরিবার। ফলে চা-বাগিচা ব্যবসাটা বুঝতেন ভালই। মারা যাওয়ার পর ছেলেরাই বাগান দেখাশোনা করে। বেশ বড় বাগান। সমস্যা আছে, আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানও হয় চটজলদি। প্রাণ আছে সরস্বতীপুর বাগানে। এই বাগানেরই মহিলা এবং পুরুষদের চা শ্রমিক দল রাজ্য রাগবিতে কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করে আসছেন ধারাবাহিকভাবে। বাগানে রাগবি খেলার কোচও নিয়োগ করা আছে। দুর্গাপুজোর সময়ে ঠাকুরদালান ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করেন মহিলারা। নতুন রঙের প্রলেপ আর রংবেরঙের শিকলি কেটে সাজানো হয় মণ্ডপ। বাগানে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার ফলে এখন ঝোলে রঙিন এলইডি টুনি বাল্ব।
মাদারিহাটে কুমারী কুজুরকে হারিয়ে সেবার প্রথম বিধায়ক হয়েছেন মনোজ টিপ্পা। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিজেপির নির্বাচিত বিধায়ক। ২০০০ সাল থেকে চা-বাগানের কর্মী। মাদারিহাটের একটি চা-বাগিচার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পদে যোগদানের পরও কিন্তু বাগানের পুজোয় আগাগোড়াই জড়িয়ে থাকেন তিনি। মাদারিহাট, রাঙ্গালিবাজনা, শিশুবাড়িসহ প্রত্যন্ত চা-বাগানের পুজোগুলিতেও পুজো কমিটির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হয়েছে মনোজকে। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিংঘানিয়া চা-বাগানেই কাজ করে রুজির জোগাড় করতেন মনোজ। মনোজের বাবাও ছিলেন একই চা-বাগানের কর্মী। চা-বাগিচাতে জন্ম, চা-বাগানের বিদ্যালয়েই পড়াশোনা করা মনোজের পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বীরপাড়ার সিংঘানিয়া চা-বাগান, মণ্ডপের পাশে ধামসা মাদলের তালে তালে গান আর নাচে জমানো আসর। জাতীয় ঐক্যের এক অনন্য নিদর্শন পাওয়া যায় ডুয়ার্সের চা বাগিচায় যেখানে কোচ, মেচ, মদেশিয়া, নেপালি, ভুটানি, রাজবংশী, দক্ষিণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত, বাঙালি-অবাঙালি সব সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করছেন। আর তাই একসময়কার কালচিনির বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারির একটাই পরিচয়— তিনি ভারতীয়। তিনি নিজে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের, কিন্তু স্ত্রী সাকিনা মুসলিম সম্প্রদায়ের। তৎকালীন জয়গাঁ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং বিধায়ক উইলসন চম্প্রমারি ছোটবেলায় বাবা সুবীন চন্দ্রমারি এবং মায়ের সঙ্গে চা-বাগানের পুজোয় মেতে উঠতেন। সেই স্মৃতি এখনও হাতছানি দেয়। এখনও মন চলে যায় বাগান আর কালজানি নদীতীরে দুধসাদা কাশবনে। শারদোৎসবের প্রাক্কালে মজুরি এবং বোনাস নিয়ে চা-বাগিচা ক্ষেত্রগুলিতে প্রতি মুহূর্তেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। হয়ত ২০ শতাংশ বোনাসের দাবি সনদের সমাধান হয়ে বাগিচা শ্রমিকদের মুখে হাসি ফোটে, অথবা আপোষ মীমাংসার মাধ্যমে যা পাওয়া যায় তাই লাভ ভেবে সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর অথবা বিস্তীর্ণ চা-বাগিচা জুড়ে ধর্মঘট-অশান্তি-অরাজকতা।
প্রাক্-পুজো পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলাম ছুটির দিনে চা-বাগিচা পুজো পরিক্রমায়। ২০১৩ সালের পুজোর মুখ থেকেই বন্ধ ছিল বানারহাট সংলগ্ন রেড ব্যাঙ্ক চা-বাগান। সম্প্রতি খুলেছে। জানিনা আবার বন্ধ হবে কি না। অথচ বাগান বন্ধ থাকাকালীন মাথাপিছু ২০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে বাগানের অর্ধসমাপ্ত পুজোমণ্ডপেই দুর্গা পুজোর আয়োজন করেছিল বাগানের ‘আট থেকে আশি’র প্রত্যেকেই। নিষ্ঠাভরে হয়েছিল মায়ের পুজো, মহাষ্টমীতে বাগান খোলার আর্জি নিয়ে দেবীর কাছে অঞ্জলিও দিয়েছিলেন প্রত্যেকে। পুজো করতে গিয়ে প্যান্ডেল, দশকর্মা, মুদিখানার সামগ্রী সরবরাহকারী দোকানদারের মতো অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ সুশীল সরকারের চোখে তাই ঘুম ছিল না। দুশ্চিন্তায় মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম হয়েছে। গত দু'বছর ধরে ব্লক প্রশাসন পুজোর আর্থিক সহযোগিতা করতেন। কিন্তু ২০২২ সালে সেই সাহায্য আসেনি। ফলে চাঁদা উঠিয়ে যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা দিয়ে পুজোর সমস্ত খরচ মেটানো যায়নি। পরে আস্তে আস্তে মিটিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চমী এসে গেলে মায়ের ঘরে আসার পালা। শিকারপুর চা-বাগান থেকে লরি চলে যায় বেলাকোবার মৃৎশিল্পীর কুমোরটুলি থেকে মৃন্ময়ী প্রতিমাকে সপরিবারে মণ্ডপে নিয়ে আসতে। বাগানে কাজ চলে, সঙ্গে চলে মাকে সপরিবারে আনার জরুরি কাজ। শেষ করতে হয় বাগান থেকে চা-পাতা ফ্যাক্টরিতে আনার ফাঁকেই। একই সঙ্গে ফুলফল-সবজি-আনাজ- ভোগপ্রসাদের বাজারও সেরে ফেলা হয়। ষষ্ঠীতে বোধনের পুজোর তোড়জোড়ে ধূপ, ধুনো, পঞ্চপ্রদীপ ও নৈবেদ্য সম্ভার, এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। ঢাকে কাঠি পড়ে, সঙ্গে উচ্চকিত কাঁসর-ঘণ্টা। শুরু হয় নানা উপাচারে মায়ের আরাধনা। শামিল হন মালিক-কর্মচারী- শ্রমিকদের পরিবার-পরিজন। পরবর্তী চারটি দিন মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী রূপে বিরাজ করেন মণ্ডপে। বরাভয় প্রদান করেন সবুজ চা-বাগিচার মঙ্গল কামনায়, আশীর্বাদ দেন পরম ভক্তদের। অবশেষে বাপের বাড়ি থেকে বিদায় পর্ব সাঙ্গ হয়। চা-বাগিচাতেও বেজে ওঠে বিষাদের সুর। শূন্য, রিক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মণ্ডপ। কী এক হারানোর বেদনায় গুমরে কেঁদে ওঠে ভক্তপ্রাণ। আবার শুরু হয় সেই একঘেঁয়ে, বৈচিত্রহীন পথচলা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴