গরমে আর রোদে হাঁসফাস দশা কদিন থেকে। রসবালা একা একা গজগজ করে,
"কায় কবে হেকান শনমাসিয়া দিন! দ্যাওয়াটা কনেক চিলকায়ো না। নে, না বষ্যিস তে না বষ্যেক। কনেক ম্যাগ তো নাগের পাইস। অউদোত এখেরে মানষিলাক সুক্টা শুকাছিত!"
"কুদি কুদি বলে বানায় ভাসেছে মাই। আর হামার এদি মানষিলা শুকান কাদো ধরি মরেছে।"
পেছনে কখন বসমতী এসেছে টের পায়নি। গলা শুনে পিছন ফিরে তাকালো।
"কায় কোইল?"
"কায় আরো কবে, তোর দাদা সাকালে উটি সাড়ে সাতটার খবরখান দিনাও শুনে। কতয় কং বলে ছাওয়ালার পড়া আংশাং হয়, সাকালে উটি মোর বাপের মাতাটা না দ্যান ছাড়ি। তে হুটা মানষি কী শুনে!"
তারপর একটু থেমে বলে,
"নেক তো কাজ্জি দুইটা। চুয়ারনা ঠান্ডা জল তুলেক। এখেনা সরপোৎ খাই। কাগজোত করি এখেনা চিনি আনসুং। ভাল করি বানা।"
রসবালা গরমে ঘামতে ঘামতে তরকারি কাটছিল। দুপুরের রান্না। বসমতীর কথা শুনে গিয়ে লেবু দূটো আর চিনির পোঁটলাটা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,
"ভালে হোইল দি। মোকোও সরপোৎ খাবার মনটা গেইসে। হামার জামুরীটার কেনে বা এইবার ফলে আইসে নাই। খাবার এখেনা আশা নাই।"
বসমতী কাটা তরকারিগুলোর দিকে থাকিয়ে বলে কী আন্দিবু মাই, ঝালের শাক?"
"না হয় দি। এমন গরমোত না আন্দোং ঝালের শাক। আইন্না আন্দিম। আর কয়টা কুন্দুলি ভাজিম।"
"তে উসুনি যে দ্যাখেছোং?"
বসমতীর কথায় রসবালা শুষণি শাকগুলো দেখিয়ে বলে,
"হিলার কাথা কছিত? বৌমা আনি দিল। কী যে আন্দোং!"
বলতে বলতে সরবৎ বানানোও হ
য়ে যায় রসবালার। বাড়ির ছেলে-পিলে কেউ বাড়িতে নেই। রসবালা সরবৎ খেতে খেতে বলে,
"আদুরা কাজ্জিখান ভাল করি থং। বাউঘর আসিলে এখেলা জলৎ ঘটলে দিম এলায় চিনিকেনা দিয়া। এমন অউদখানোত তিনো বাপ বেটায় টিনের না ভার বানেয়া ভারোত করি জল উবির ধোইচ্চে ওয়াবাড়িত। ওয়াখান জল আবিনে নাল নাইগসে। শুকি যাবার ধৌইচ্চে।"
বসমতী জিজ্ঞেস করে,
"কোটে থাকি জল নিগাছে?"
"ওত্তি, মনসরের বাড়িখান বগলোত হয়, উমারে চুয়া থাকি। দেহা পিটিলা এখেরে বিষে সার হবে এলায় তিনোঝনেরে।"
বসমতী কষ্টটা বুঝতে পারে। ওদের জমিতেও দুদিন আগে লোক দিয়ে জল দিয়েছে, কিন্তু আবার ধানজমি শুকিয়ে ফাটা ফাটা হয়ে আছে। প্রকৃতি বিরূপ হলে মানুষের কষ্টের অন্ত থাকে না। দুজনেই কিছুটা সময়ের জন্য নিজের নিজের ভাবনায় হারিয়ে গেছে যেন। তারপর রসবালা রাঁধতে বসে। বসমতীও ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। বেশিদূর না যেতেই হঠাৎ বুধেশ্বরের বাড়ি থেকে প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি, অস্পষ্ট মহিলা কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। বসমতীর পা ওখানেই আটকে গেল। একটুখানি থেমে আবার উল্টোমুখ করে ফিরে এল। দেখল রসবালাও রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে। রসবালা ওকে দেখে বলল,
"উমা বাড়িত বা কী হোইল দি, চল তো দেকি আসি!"
বলেই রান্নাঘরটা একটু গুছিয়ে উনুনের আঁচটা একটু কমিয়ে বের হয়ে আসে।
বুধেশ্বরের বাড়ি ততক্ষণে লোক জমে গেছে। যে যেখানে কাজ করছিল, চিৎকার শুনে কাজ ফেলে ছুটে এসেছে। ঘনবসতি পাড়ার এই এক সুবিধে। বুধেশ্বরের বাপ বুড়ো হলেও মোটেই বসে থাকতে চায় না। বুধেশ্বরের মা পই পই করে বারণ করেছে,
"এমন অউদখানোত না যান দোলা। মুই যাছোং। তোমরা মাতা ঘুরি পড়ি যাবেন!"
বুড়ো কী শোনে কথা! জেদ। বলে,
"নয়া হালুয়াটা সগাকে ঢিসায়। তুই পাবু না। মুই যাং। কোনোটে না বান্দোং, জল খোয়া গোরুগিলিক কনেক ছায়া চাপাং। এমন অউদখানোত হ্যাসপেসাছে বোদায়! অয় দ্যাকেক, বাড়ির ভিত্তি খালি চায়া আছে!"
সে গরু আনার পর গরুগুলো শুধু জলে মুখ ডুবিয়েছে মাত্র, বুড়ো টলমল করে। বুধেশ্বরের মা তখনি চিৎকার করে বৌমাকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে গেছে,
"কনেক এদি আইসো বারে! হর কী হোইল, তোমার বাপ কেমন উল্টাং ভাল্টাং করেছে, পোইল বোদায়!"
তারপর দুজনের মিলিত চিৎকারে বাকিরা সবাই জমায়েত হয়েছে। বুধেশ্বরের বাবাকে ধরতে ধরতেই বুধেশ্বরের মার হাতেই অজ্ঞান হয়ে গেছে। শাশুড়ি -বৌমা মিলে ধরাধরি করে এনে চালার নিচে শুইয়ে দিয়েছে। মাথায় জল ঢালার পর একটু চোখ পিটপিট করে তাকালেও জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। বুধেশ্বরের মা বুক চাপড়ে কাঁদছে,
"বাউটা হামার বগদুল পাড়াত কাজোত গেইসে বারে। কাহো এখেনা খবর দ্যাও। উয়ার বাফোক হাসপিতাল নিগাউক।"
ভিড়ের মধ্য থেকে সুকারু বলে ওঠে,
"হাসপাতাল নিগালে এলায় নিগিরে নাগে। উয়ায় খবর পাইতে আর আসিতে মেলা দেরি।"
সুষেণ বলে,
"মুই ভ্যানখান নিকলাছোং। কায় কায় নগত যাবেন এডি হও। আর একটা ব্যাগোত কাপড়-চোপর ন্যাও বারে। আতিটা নোবার নাগির পায়। বুদেশ্বরদা আসিলে এলায় পরে সাইকোলোত যাবে।"
সুষেণের কথা শুনে রসবালার মায়ের মন অস্থির হয়।
"এমন অউদখানোত অতখান জল উবিয়া এলা তুই নিগির পাবু বাউ? ভ্যান ঠেলাও তো কম পরিশ্রমের না হয়!"
সুষেণ সংক্ষেপে বলে,
"পাইম। বাড়িত কী আছে চাইট্টা খাবার দে তো মা, ধাও করি খায়া ন্যাং। প্যাটের ভোক ধরি গাড়ি ঠেলির না পাইম।"
সুকারু বলে,
"মুইয়ো যাং। দোনোঝনে এলায় বদলা বদলি করি চালামু।"
বুধেশ্বরের বৌ একটা ব্যাগে কিছু কাপড়-চোপর, একটা তেলচিটে বালিশ সাজিয়ে দেয়। বুধেশ্বরের মাবাড়ির কাপড়টা পাল্টে অপেক্ষাকৃত একটা ভালো কিপড় পরে। ভ্যানের পাটাতনে বস্তার উপর একটা কাঁথা পেতে বিছানা করে ব্যাগ থেকে তেলচিটে বালিশটা বের করে সবাই মিলে ধরাধরি করে বুধেশ্বরের বাপকে শোয়ানো হল। বুধেশ্বরের মা সুপারি গাছের খোলা দিয়ে বানানো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। ধীরে ধীরে ভ্যানটা বেরিয়ে গেল। ভ্যানটা যাওয়ার পনেরো মিনিট পরে বুধেশ্বর খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফিরল। ফিরেই দুটো ভাত মুখে দিঋএ সাইকেল নিয়ে ও ও হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হল। আস্তে আস্তে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। লোকজন অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে যে যার বাড়ি গেল না, রাস্তার পাশের একটা বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ভিড়ের অনেকটা অংশই এসে থিতু হল। কেউ একজন বলল,
"হিটা বুড়া আজি বোদায় ঠেকাবে। যেমতোন দেখিলুং।"
মহিলাদের সাধারনত দয়ার মন। সত্য হলেও তা মুখে স্বীকার করতে চায় না। বসমতী বলল,
"হির বাউ! থুবরা মুকখান দিয়া না কোইস তো!"
যাকে বলে, সে হেসে বলে,
"মুই থুবুরা না হং বারে। তোমরা হাসালেন।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"মানষিটা ঘুরুক, সোগায় না চায়! থে বস হোইসে না জ্যাটোর খিবে। মোর বাফের থাকি বেশি। মোর বাপ তো কদ্দিনে গেইসে। হিটা ভাবো তে এলা!"
আর একজন বলে,
"হয় না হয়! তে একে তে বুড়া মানষি, তায় এই ঊগুনের মতোন অউদখানোত দোলা গেইসে। বুড়া দেহাত কী এলা সয়! উমাকো এখেনা ভাবির নাগিল হয়!"
বসমতি বলে,
"বাড়ির মানষি বলে যাবারেনাই দেয় বারে। তাও গেইসে।"
সন্ধ্যা হতে হতে সবাই খবর পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। এখনও কেউ ফেরেনি। বুধেশ্বর পরে গেছে। ও তো আজকে ফিরবে না। কিন্তু ভ্যানটারও দেখা নাই। সুষেণ আর সুকারুর ভর্তি করে দিয়েই চলে আসার কথা। অন্ধকার এখন পুরো ঘন হয় না। একটা ফিকে আস্তর যেন। সেই আস্তর ভেদ করে রুগী সমেত ভ্যানটি ফিরে আসে। বুধেশ্বরের মায়ের বুকফাটা কান্নায় সাঅআ পাড়া সচকিত হয়ে ওঠে। সবাই একসঙ্গে তাদের প্রতীক্ষারও উত্তর পেয়ে যায়। কেউ কেউ কোমরে গামছা বেঁধে তৈরি হয়েই বের হয়, কেউ কেউ কিছু না ভেবে আগে শুধু দেখতেই চলে আসে। ক্রন্দনরত বুধেশ্বরের মাকে নিয়ে ভ্যানটা বাড়ি ঢূকলে বুধেশ্বরের বৌও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বুড়োটা সবার বুকেই কমবেশি ছিল বোঝা যায়। কারণ মৃতদেহ দেখে অনেকেই ডুকরে কেঁদে ওঠে।
................................................................
চিশকায়ো না - ঝিলিক দিয়েও ওঠে না
উসুনি - শুষণি শাক
ধাও করি - চট করে
ঠেকাবে - ঠেকিয়ে দেবে
থুবুরা - অবিবাহিত কে বোঝায়। প্রচলিত বিশ্বাস থুবুরা মুখের কথা ফলে যায়। তবে এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্বাস।
................................................................
ছবি ময়ূখ রায়