ধরণীপুর সুরেন্দ্রনগর (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
ধরণীপুর সুরেন্দ্রনগর (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
-------------------------------------------
ধরণীপুর, সুরেন্দ্রনগর কাজ সেরে চ্যাংমারিতে প্রবেশের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ইচ্ছাটাকে পরিপূর্ণ হতে দিল না সুরেন্দ্রনগর এবং ধরণীপুর, রেডব্যাঙ্কের শোচনীয় অবস্থা। কি ভয়ঙ্কর দূর্গতির মধ্যে আছে এই রুগ্ন বাগানের শ্রমিকগুলো তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তাই ২ রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিনে সাপ্তাহিক দায়িত্বের জায়গা থেকে নাগরাকাটা থে যখন ফিরলাম তখন অনেক রাত। যখন কলম ধরছি তখন বাগিচা শ্রমিকদের মজুরী আন্দোলন এবং পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি আমাকে উদবুদ্ধ করল শ্রমিকদের মজুরী আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখতে। তাই কলম ধরা। ভারতের দুই প্রধান চা উৎপাদক অঞ্চল অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকরা মূলত আদিবাসী। ঔপনিবেশিক বাগান মালিকেরা আজ থেকে একশো পন্চাশ বছরেরও আগে এদের পূর্বপুরুষদের ঝাড়খন্ড, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা এবং মধ্যপ্রদেশের মত রাজ্যগুলি থেকে জোর করে তুলে এনে এই বাগানগুলোতে কাজে লাগিয়েছিল। সারা দেশের ১৬৮৬ টি টি এস্টেট এবং এক লক্ষ সাতান্ন হাজার পাঁচশো চারটা ছোট বাগিচার মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩৫ লক্ষেরও বেশি। এর বেশিরভাগই মহিলা। পরিসংখ্যান বলছে চা শিল্প শ্রমিক সংখ্যার দিক থেকে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম। চায়ের বাজারে ভিড় করে আছে মধ্যস্বত্বভোগীরা এবং তাদের মাথায় বসে আছে করপোরেটরা। এই পিরামিডের সবচেয়ে দূর্বল এবং ভঙ্গুর বিন্দুতে যে চা শ্রমিকেরাই থাকবেন তা বুঝতে আলাদা বুদ্ধি লাগে না। এখানে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। থাকলেও খুবই সামান্য। ফলে বিশ্ব বাজারে চায়ের দাম শিখর স্পর্শ করেছে। কিন্তু চা শ্রমিকরা সাম্প্রতিককাল থেকে বাজারের মূল্যনিরিখে বিচার করলে ৩০ বছর আগে যে মজুরি পেতেন এখনও প্রায় তাই পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে সেটাও কমে গেছে।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে একটা বাগানের ভালো দাম পাওয়া নিশ্চিত করতে মালিক, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট সকলের দায়িত্ব আছে। সঙ্গে অবশ্যই এটাও নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিকরা যেন তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। সমস্ত চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি আবশ্যিক তো বটেই, তার সঙ্গে তাদের সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্যান্য চাকরিগত সুযোগ সুবিধাগুলিকেও নিশ্চিত করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্প নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। পৃথিবীর চা উৎপাদনের ২৬ শতাংশ উৎপাদকের স্থান ভারতের। আবার এই দেশে চা চায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। দার্জিলিংয়ের পাহাড় এবং উত্তরবঙ্গের সমতল এবং ডুয়ার্স মিলে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষ রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ আয়তনের এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এদের পরিবার এবং চা বাগান সংশ্লিষ্ট জীবিকা বা পেশাগুলি ধরলে এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ। রাজ্যে প্রায় সাড়ে চারশো চা বাগান আছে ছোট-বড় মিলিয়ে এবং কার্যত উত্তরবঙ্গের এক বড় অংশের অর্থনীতি চা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রাজ্যে বড় বড় কোম্পানি মালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও টাটা টি, গুডরিকস, ডানকানস, অ্যান্ড্রু উইলস, জয়শ্রী টি ইত্যাদি ভালো ভালো কোম্পানির ভালোই উপস্থিতি আছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় বাগিচা শিল্পের মতো আমাদের দেশের চা শিল্পেও এক ধরনের বৈপরীত্য বিরাজ করে। চা বাগানের পরিচালকেরা একদিকে আধুনিক আমলাতন্ত্র এবং অন্যদিকে দাস মালিকের ভূমিকা একই সাথে পালন করে। এই বাগানে কাজ করা শ্রমিকেরা মজুরিতে নিযুক্ত শ্রমিক হলেও তাদের নিয়োগ, পরিচালনা, বাগানে ধরে রাখা ইত্যাদি করা হয় জোর জবরদস্তির মাধ্যমে।
পরাধীনতার যুগে মালিকদের হাতে শ্রমিকদের শাসন করার অধিকার ছিল। এমনকি অত্যধিক কাজের চাপ এবং বসবাসের নারকীয় ব্যবস্থার ফলে শ্রমিকরা বাগান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ধরে এনে জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করার অধিকার মালিকদের ছিল। যেটা তারা হামেশাই প্রয়োগ করতো। সময়ের সাথে সাথে শাসন করার এই সুসভ্য অধিকারগুলি থেকে মালিকেরা বঞ্চিত হলেও শ্রমিক রীতিনীতি একই রকম থেকে গেছে। অর্থাৎ শ্রমিকদের ভয়াবহ অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের এক ধরনের বাধ্য করা হচ্ছে কম পয়সায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে। আসলে উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স, তরাই এবং দার্জিলিংয়ের এই মনোরম চা বাগানের অন্তরালে যে নিষ্ঠুর শোষণ সর্বদা বিরাজমান তা খালি চোখে ঠাহর করা মুশকিল। এই শিল্পের সওয়ারী হয়ে মালিক থেকে শুরু করে স্থানীয় দালাল এবং বিভিন্ন প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা লাখপতি বা ক্রোড়পতি হয়েছে। কিন্তু যাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে এই শিল্পের বিপুল উৎপাদন এবং বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সেই শ্রমিকেরা কিন্তু যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেও নেই। তারা মানব জীবনের একেবারে তলার সারিতে কোনরকমে টিকে আছে। এই মাগ্যিগন্ডার বাজারেও বছর কয়েক আগে শ্রমিকদের মজুরি ছিল দৈনিক ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এটা অস্বীকার করা যায় না বেড়ে সেটা হয়েছিল ২৩২ টাকা। তারপরে জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন ঘোষণা অনুযায়ী সেটা হয়েছে দৈনিক ২৫০ টাকা। অবশ্য সব বাগান মালিকেরা যে এই পয়সা দেবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। হাজারো সত্যি-মিথ্যে মেশানো গল্প বানিয়ে মালিকরা মজুরি চুক্তি থেকে কম পয়সাতে লোক খাটিয়ে নেয়। আসলে খাতায়-কলমে সংগঠিত শিল্প হলেও চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের থেকেও খারাপ। না হলে যেখানে রাজ্যের অসংগঠিত শিল্পে সরকার ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরি ২০৬ টাকা সেখানে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে এমন একটি শিল্পের শ্রমিকরা কি করে অর্ধাহারে এবং অনাহারে থাকার মত কোন একটা মজুরি পেয়ে যুগের পর যুগ গাধার খাটনি খাটতে বাধ্য হয়?
এই শিল্পের শ্রমিকদের তিন বছর অন্তর অন্তর মজুরি চুক্তি যেটা হয় সেটাও এক ধরনের প্রহসন। বাইরে থেকে দেখলে প্রক্রিয়াটা গণতান্ত্রিক বলে মনে হয়। মালিক এবং শ্রমিক দুই পক্ষই সুন্দর সরকারি উপস্থিতিতে যৌথ দর কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছেন। আসলে শ্রমিকেরা তিন বছর অন্তর অন্তর নিজেদের পাওনা গন্ডা বুঝে নেন না। মালিকদের দাবিগুলির আইনি মান্যতা দেন। এই মজুরি চুক্তিগুলো এখনো পর্যন্ত হয়ে এসেছে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য নয়। মজুরি চাপা দেওয়ার জন্য। না হলে ভাবা যায় এই পদ্ধতিতেই কখনো বারো আনা, কখনো দু টাকা বা কখনো পাঁচ টাকা মজুরি বেড়েছে শ্রমিকদের। আখেরে যে মজুরি নির্ধারিত হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য এবং যেভাবে অতীতে চা-শ্রমিকদের মুলধারার সভ্যতা থেকে দূরে সরিয়ে এনে চা বাগানের গহীনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই বিস্তর ফারাক রেখে দেওয়া হয় তাদের মজুরিতে। অন্য শিল্পের শ্রমিকদের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি থেকেছে ধারাবাহিকভাবেই কম। ১৯৮৭ সাল থেকে চুক্তিগুলোর দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার যে মজুরি বৃদ্ধি হলেও সেই সময়কালের মূল্যবৃদ্ধির থেকেও সেটা কম থেকেছে। অর্থাৎ টাকার অংকে মজুরি বৃদ্ধি ঘটলেও শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা আগের থেকেও কমেছে। সমাজের যে অংশের মানুষ কোনোক্রমে নুন আনতে পানতা ফুরানোর মজুরি পান তাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা ভয়ংকর। মজুরি বৃদ্ধি সেই সময়ের মূল্যবৃদ্ধির ওপর কোনভাবে ভেসে থেকেছে। ২০১১-১৪ সালের মূল্যবৃদ্ধি আগের থেকে অনেক বেশি দেখাতে লাগলেও এর ফলে সামগ্রীক অবস্থা বা গতিপ্রকৃতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এই বৃদ্ধি হয়েছিল আদিবাসী চা শ্রমিকদের এক উত্তাল আন্দোলনের ফলে। এছাড়াও এই বৃদ্ধির হার খুবই নিম্ন আয়ের ওপর নির্ভর করে হয়েছে এবং পরবর্তীকালে এই বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে।
এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির দূর্গ ছিল জেলার চা বাগিচাগুলি। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল মালবাজার এবং মেটেলিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সেই ভিত আজ আর নেই বলাই বাহুল্য। জাতপাত, সম্প্রদায়গত সংঘাত নেই বললেই চলে। কিন্তু অবক্ষয়, চোখরাঙানি, বিরোধী দমননীতি শাসকশ্রেণীর প্রাধান্যকে যে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই তথ্য দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। প্রকৃতপক্ষে বাংলার চা শ্রমিকদের মজুরি উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই অন্যান্য সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের মজুরির থেকেও কম। গত দেড়শ বছর ধরে ওদের মজুরি যা ছিল বা আজও যা আছে তা শুধুমাত্র বাংলা নয়, সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতে কমবেশি একই অবস্থা। তবে সুযোগ সুবিধা প্রদানের প্রশ্নে বলা যায় বাংলায় শোষণের পরিমাণ বেশি। চা শিল্প যখন গড়ে উঠেছিল তখন ওদের কত মজুরি দেওয়া হতো তা জানা যায় না। দান খয়রাতিতে আপাতত ক্ষিদের যন্ত্রণা মিটলেও বাগানের মানুষগুলি চায় বাগান ফের চালু হবার মতো স্থায়ী সমাধান অথবা জীবন যাপনের জন্য ন্যূনতম মজুরি। কারণ এতদিনে তারা সবাই জেনে গেছে এই সমস্যা বাগান মালিকদের নিজেদের তৈরি চা শিল্পের নয়। এটুকু অনুমান করাই যায় দীর্ঘ বঞ্চনার কষ্ট এবং শ্রমিক নেতাদের ভন্ডামি গুন্ডামি সহ্য করার পর ডুয়ার্সের চা বাগানে আর উচ্ছ্বাস নেই। নেতাদের প্রতি আস্থা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। তাই শ্রমিকদের বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবি নিয়ে বাগিচার মজদুর নেতাদের আরো জোরালো সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। অথচ অবস্থাটা তো সত্যিই এরকম হবার কথা ছিল না। কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের এক নম্বর সংগঠিত শিল্পে চাকরি পাওয়া একসময় ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করা হতো। অবশ্য শ্রমিকদের আর্তনাদ এবং হাহাকার চিরকালই ছিল চা বাগানের নয়ানাভিরাম দৃশ্যপটের তলায় চাপা। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে সেই কঙ্কালসার চেহারাগুলো মাটির তলা থেকে উঠে এসে জানান দিচ্ছে তারা বেঁচে আছে।
চিন্তা করলে গা ঘিনঘিন করে যে সংগঠিত শিল্প বলা হলেও এই শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা অসংগঠিত শিল্পের থেকেও খারাপ। এই শিল্পে কোন ন্যূনতম মজুরির বালাই নেই। অবশ্য ধারাবাহিক আন্দোলন এবং ঘরে বাইরে বিভিন্ন চাপের ফলে সরকার ন্যূনতম মজুরির ঢোক গিলে এ বিষয়ে কিছু করার জন্য ২০১৫ সালে একটা কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেই লোক দেখানো কমিটি এখনো কোন সদর্থক ভূমিকা রেখেছে বলে জানা যায়নি। কমিটিতে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা তো একসময় অভিযোগ জানান যে দু বছরে তাদের মাত্র তিনবার কমিটির সভায় ডাকা হয়েছে। বলা যেতে পারে এই কমিটিকে জন্ম থেকেই পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। কারন মালিক বাহাদুরেরা কোন খিল্লি না করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে কোন অবস্থাতেই তাঁরা ন্যূনতম মজুরি দিতে ইচ্ছুক নন। সরকার অথবা মালিকপক্ষ যে বিষয়টা জানে না তা কিন্তু একেবারেই নয়। অনেক পয়সা খরচ করে তারা লোক পোষে শ্রমিকদের পয়সা মারার মামলা ঘেঁটে ঘ করে দেওয়ার জন্য। তাঁরা জানেন যে তাঁরাই শেষ কথা। কারণ প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলি এবং তাদের নেতারা ফুটানি করে তাদেরই পয়সায়।চা নিয়ে যে কোনো আলোচনায় একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে কৃষিনির্ভর এই শিল্প অত্যন্ত শ্রমনিবিড়। অর্থাৎ শ্রমিক বাদ দিয়ে কোন কিছুই হবে না। সে যত আধুনিকতায় একে মুড়ে ফেলা যাক না কেন, মূল কাজ অর্থাৎ দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলার কাজে মেকানাইজেশন নৈব নৈব চ। শ্রমনিবিড় শিল্প হওয়ার ফলে এখানে লোক খাটিয়ে পয়সা। কিন্তু শ্রমিকদের পেছনে যে খরচা হয় তা এস্টেটের ৪০ শতাংশের বেশি নয়। বাকি পয়সা যায় অফিস, ম্যানেজার এবং তার অধস্তনদের রক্ষণাবেক্ষণে, অফিস চালানোর খরচা এবং লভ্যাংশ হিসেবে মালিকদের পকেটে। কোন ধরনের সরকারি বিধিনিয়ম বা নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই শিল্পে মজুরি অত্যন্ত কম হওয়ার জন্য সাধারণভাবে শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।
ন্যূনতম মজুরি চাইতে গেলেই মালিকেরা আওয়াজ তোলেন যে চা শিল্প সংকটে এবং তাঁরা বাগান বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। মোদ্দা কথাটা হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পের মালিকেরা বেশ রশেবসেই আছেন। আসলে যারা সংকটে পিষ্ট তারা হল এই শিল্পের সাথে যুক্ত শ্রমিক এবং তাদের পরিবার পরিজন। দুটো বিষয়ের দিকে নজর দিলে এই শিল্পের শ্রমিকদের সামগ্রিক পরিস্থিতি দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ন্যূনতম মজুরির কথা তো আগেই বলেছি। শ্রমিকেরা যেহেতু বাগানে থাকেন তাদের বাসস্থান এবং অন্যান্য মৌলিক বিষয় সুরক্ষিত রাখাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট ১৯৫১ অনুযায়ী। এই আইনের ফলে শ্রমিকদের পাকা বাড়ি, স্বাস্থ্য পরিসেবা, ক্যান্টিন, ক্রেশ, শ্রমিকদের বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা, রেশন এবং চা পাতা, শুকনো জ্বালানি কাঠ, পানীয় জল, মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি দেওয়ার কথা। কিন্তু একে এই আইনের ফাঁকফোকর প্রচুর, তাছাড়াও মালিকেরা এই আইনকে যথেচ্ছ বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যেখানে সেখানে শ্রমিক শোষণ চালাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকেও এই আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আসলে এই মানুষগুলো কোনরকমে বেঁচে আছে। তাদের নিত্যদিনের সাথী অনাহার, অপুষ্টি, চিকিৎসা এবং ছেলে মেয়েদের শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। দাঁড়িয়ে থেকে ৮-১০ ঘন্টার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম যাদের দস্তুর, তারা কম পারিশ্রমিকে নিরুপায় হয়ে চা বাগানে কাজ করতে বাধ্য। এদের অন্য কোন বিকল্প বাসস্থান নেই। চা বাগানের ভেতরে তারা থাকে। সাহেবরা তাদের যেখান থেকে ধরে এনে বা চুরি করে নিয়ে এসে তাদেরকে দিয়ে ঘন জঙ্গল কাটিয়ে চা-বাগানের পত্তন করেছিল, সেখানে তাদের ফেরার উপায় নেই। বাগানে কাজ না করলে তাদেরকে সেখানে থাকতে দেওয়া হবে না এবং তাদেরকে বের করে দেওয়া হবে। তাই একটু আশ্রয়ের জন্য হলেও তারা কম পারিশ্রমিকে এই কাজ করতে মজবুর। এর সুযোগ নিচ্ছে মালিকেরা।
চা বাগান ছেড়ে শ্রমিকেরা দলবল নিয়ে অন্য কোথাও ভাগ্যান্বেষণে যে পা বাড়িয়ে দেবেন তারও কোন পুরোপুরি উপায় নেই। চা বাগানের কোয়ার্টারে থাকা এই মানুষগুলোর ভিটেমাটি উচ্ছেদ হয়ে যাবে যদি সংসারের একজন বাগানে মালিকদের গোলামী না করে। যেখান থেকে তারা এসেছিলেন সেই ছোটনাগপুর মালভূমিতে যে তারা ফিরে যাবে তারও উপায় নেই। ছলে-বলে-কৌশলে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা চোখ রাঙিয়ে অথবা গায়ের জোরে নানাভাবে তাদেরকে ধরে আনা হয়েছিল উত্তরবঙ্গ এবং আসামের চা বাগিচাগুলিতে। এদের বেশিরভাগ জানে না তাদের দেশ কোথায়। গাঁও কোথায়। কোথায় তাদের আদি নিবাস। কোথায় ফিরবেন তারা? কে ডেকে নেবে তাদের? অবশ্য এভাবে ভিটেমাটি উজার করে লোক চালান দেওয়া সারা পৃথিবী জুড়ে বাগিচা শিল্পের বৈশিষ্ট্য। সময়ের তালে হয়তো অনেকরকম আধুনিকতার মোড়কে সেজেছে এই শিল্প। কিন্তু মোটের ওপর বিষয়বস্তুটা একই রকম আছে। আসলে যে কথাটা বলা হয়নি সেটা হল চা বাগান এক মগের মুল্লুক। শিল্পপতি মালিকের পোশাকের আড়ালে বেচু এবং বেনিয়াদের মৃগয়াভূমি। শিল্পপতির তকমা আঁটা এই ফড়ে বা দালালরা যাবতীয় সরকারি সুযোগ নিয়ে কার্যত লুটপাট চালাচ্ছে। সোনা ফলানো এই শ্রমনিবিড় শিল্পটিকে প্রায় লাটে উঠিয়ে দেবার দায় তাই শুধুমাত্র অলস শ্রমিক এবং ইউনিয়নবাজির ওপর ঠেলে দিয়ে মালিক সংগঠনগুলো আজও পর্যন্ত হিসাবকিতাবহীন ফায়দা লুটে চলেছে সরকারি অজ্ঞতা, দায়িত্বহীনতা, দায়বদ্ধহীনতা কিংবা উদাসীনতার কাঁধে চেপে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴