আসিয়া মেচেনি মাও মোর/দুয়ারে দিলেক পাও/আগো বাড়ি শুদ্ধি কর বিধুর বাপো মাও"
গান গাইতে গাইতে মহিলাদের দলটা একটা বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির বউটি তাড়াতাড়ি করে একটা পিঁড়ি ধুয়ে উঠোনে রাখল। এই গরমে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছে। কারো কারো সিঁদুর গলে সিঁথি থেকে নাক বেয়ে নেমে লেপ্টে গেছে। মারেয়া সুরেনের বউ ছাতাটা সাবধানে পিঁড়িটিতে নামিয়ে রাখে। মেচেনি পূজায় এই ছাতাটির ভূমিকাই প্রধান। একটা বড় ছাতাকে ফুলের মালা আর সিঁদূর দিয়ে সাজানো হয়। মনে করা হয় এই ছাতাটিই মা মেচেনির প্রতিনিধি। ছাতাটি রেখে সুরেনের বউ একপাশে পেতে রাখা বাঁশের খাটে বসতেই বাকিরাও বসে পড়ে। তবে বেশির ভাগই কুয়োয় ঝপাঝপ বালতি নামিয়ে ঠান্ডা জল টেনে তুলে আঁজলাভরে জল খেতে থাকে। একটা এনামেলের থালায় চাল দুটো লঙ্কা আর সব্জি রেখে প্রণাম করে গৃহর্কতৃ আন্তরিকতার সঙ্গে মুখে হাসি টেনে বলে,
"বোইসো বারে, চা খাও।"
"এমন গরমোত না খাই বারে চা। কাজ্জি আচে তে কনেক সরপোত বানে খোয়াও।"
সরবতের আব্দারে বউটা খুশিই হল।
"নন বারে, দুইটা জামুরি ছিঁড়ি আনি অস করোং।"
সরবৎ করতে করতে জানতে চায়,
"তোমরা আর বচ্ছরও পূজা করিসেন বারে। হামার এদি নাই।"
দলের ভেতর থেকে একজন সবার হয়ে উত্তর দেয়,
"না হয়। হিকান অয় সুরেন কাকা ঘরের মানসিয়া পূজা।"
একটা নাদুসনুদুস বাচ্চা উঠোনের একপাশে দাঁড়িয়ে সসংকোচে দলটাকে দেখছিল। বাচ্চাটাকে দেখে সুরেনের বউ অবাক হয়ে বলল,
"হুটা আরো কুন ছাওয়া মাই? এখেরে গুটকিয়া পারোর মতোন দেকা যাছে?"
"মোর বড় নননটার বেটা বারে। সেদিন গেইসে তে উয়ার মামার পাছোতে আইচ্চে। ছাওয়ার উমার যে আদর! উয়ার ঠাকুমা এখেনা কান্দির না দে। এলাং কোলাত নেয়।"
পরপর তিনদিন পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে মাগন বা ভিক্ষা করে মারেয়ার বাড়িতে পুজো। শেষের দিন তিনবার হাট প্রদক্ষিণ করতে হয়, সঙ্গে থাকে একজন ঢাকী। ছোট্ট কলার ভেলা বানিয়ে রঙিন কাগজ আর ফুল দিয়ে সাজিয়ে হাট প্রদক্ষিণ শেষে নদীর ঘাটে গিয়ে পুজো করে ভেলাটি ভাসিয়ে দেওয়াই নিয়ম। রসবালা আর বসমতীর উৎসাহের অন্ত নেই। ভেলা ভাসিয়ে নদীতে ডুব দিয়েই যে যার বাড়ির পথে হাঁটা লাগায়। বসমতী রসবালাকে বলে,
"পূজার ওটে কত্থন যাবু কইনা? একে নগত যামু এলায়। একেলায় এলায় পাবেকে না। কনেক হাতে পাতে করি না দিলে হয়!"
সন্ধ্যা হতেই পাড়া সরগরম হয়ে উঠল ঢাকের আওয়াজ আর উলুধ্বনিতে। সঙ্গে মেচেনি মায়ের গান। মূল গিদালী যেমন যেমন শিখিয়ে দিল সেভাবেই কলার ছড়া দিয়ে থাতি সাজিয়ে পূজা বসাল সুরেনের বউ। গিদালী এবার জিজ্ঞেস করে,
"তোমার কী মানসিক আছে বারে? ওদি ফুলজল ঘুরাইতে ঘুরাইতে মনে মনে কও।"
মেচেনি পূজা মানে শুধু তো মেচেনি পূজা নয়, বাড়ির সব ঠাকুরেরই পূজা করতে হয়। পূজা শেষ করে আবার একটা কলার ভেলা সুন্দর করে সাজিয়ে রাতেই ঢাক বাজাতে বাজাতে নদীর ঘাট। নদীর ঘাটে আর এক প্রস্থ পূজা করে ধীরে ধীরে ভেলাটিকে ভাসিয়ে সবাই নদীতে ডুব দিল। সুরেনের মায়ের চোখে জল। যেন মেয়ে বিদায় হল। তারপর ছাতাটি, হাতের ঘটিটা জলে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে বাড়ির পথ। বাড়িতে তখন একদিকে খিচুড়ি প্রসাদের গন্ধ, অন্যদিকে চটের উপর, বেঞ্চের উপর গোল হয়ে বসে গল্প চলছে।
বসমতী এ বেলা আর স্নান করেনি। নদীতে নেমে গায়ে মাথায় জলের ছিটে দিয়ে নিয়েছে। রসবালাও তাই। পুজো শেষ। খিচুড়ি হতে আর একটু দেরি। ওরা একটা বেঞ্চে বসল। বসমতী আপন মনেই বলে,
"কয়দিন হাতে পূজা পূজা করি দিনগিলা কাটিল, আজি হাতে শ্যাষ!"
রসবালা একটু চুপ করে শুনে বলে,
"মেচেনি পূজা খালি হামারে এদি চল, হেনা দি?"
"আচে বা আরো কুদি কুদি। মেচেনি হইল হামার মাও। হামার তিস্তা মাও। মাও আগ হইলে ছাওয়া-ছোট নিয়া কী হামরা খাবার পাই? অ্যাই ত্যানে পূজা করিয়া মাওক তুষ্ট করির নাগে মাই!"
তারপর একটু থেমে বলে,
"ঝুনি বেশি বানাও না হয়, ঝুনি বেশি খোরাও না দেয়। তবেসিনি জমি-জাগা আবাদ-সুবাদ করি নোবার পারিমো।"
রসবালা এবার বলে,
"হিদি আজুঘর তো মানসিয়া পূজা কইচ্চে। দশংগতিয়াও না করা যায়। তে এইকান পূজাতে সোগায় আসি, আলাদা পূজা করিরে নাগে না।"
পাড়ার বৃদ্ধ মানুষেরা গুড়ুক গুড়ুক হুঁকা টানছেন আর রামায়ণের গল্পে মশগুল। বাচ্চারা তার মধ্যে আব্দার করছে,
"হামাক এখেনা ভাল চায়া কিচ্চা কও খেনে বারে।ও ঠাকুদ্দা। ক খেনে, তুই ক একান।"
বুধেশ্বরের বাপ এবার হুঁকা নামিয়ে বলে,
"ন্যাও বোইসো। তোমাক আবনের কিচ্চা কং।"
গল্পের সাথে সাথে অনেক বাচ্চাই ঘুমিয়ে পড়ে। খিচুড়ি খাওয়ার সময় সবগুলোকে তুলে তুলে খেতে বসিয়ে দিতে হল। কাঠের তক্তা পেতে বসার ব্যবস্থা। কলার পটুয়ায় গরম খিচুড়ি ঢালা মাত্র গড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটতে শুরু করেছে পাত ছেড়ে মাটির দিকে। বুড়ো বুধেশ্বর নিজের খাওয়াই সামলাতে পারে না, পাশে বসিয়েছে নাতিকে। পাতের খিচুড়ি হাত দিয়ে টানতে টানতে নাতিরটাও একটু হাত দিয়ে টেনে পাতের মাঝখানে এনে বলে,
"নে বাউ, হোরোৎ হোরোৎ করি খা। পালে যাছে ভোল।"
...............................................................
মারেয়া - যিনি পূজার প্রধান
কাজ্জি - কাগজী লেবু
হিকান - এটা
গুটকিয়া পারো - পায়রা দম্পতির একটিমাত্র বাচ্চা থাকলে বলে গুটকিয়া পারো
আজুঘর - দাদুরা
দশংগতিয়া - বারোয়ারী
কিচ্চা - কিসসা বা গল্প।
হোরোৎ হোরোৎ - ঝোল টেনে খাওয়ার শব্দ।
...............................................................
ছবি : জবা রায়