সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

11-September,2023 - Monday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 673

রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা ( দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
--------------------------------------
২০১৩ সালের ১৯ অক্টোবর কর্তৃপক্ষ বাগান ছেড়ে চলে গেলে ২০১৪ সাল থেকে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যায় ডুয়ার্সের অতি পরিচিত বিতর্কিত রেডব্যাঙ্ক চা বাগান। বাগান জুড়ে তখন ছিল শুধুই নিস্তব্ধতা। অভাবের তাড়নায় কাজের খোঁজে শ্রমিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে শুরু করে। বাগানের শ্রমিক বসতি এলাকায় নেমে আসে অপুষ্টির ছায়া। পর্যায়ক্রমে ৪৬ জন শ্রমিক মারা যায়। বাগান খোলার দাবিতে আন্দোলন হলেও কোন লাভ হয়নি। বাগানে নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে আর সেই নিস্তব্ধতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাঝে মধ্যেই সেখানে আশ্রয় নিচ্ছিল চিতাবাঘ, হাতি-সহ অন্যান্য বন্য প্রাণীরা। সারা দুনিয়ার শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরির দাবি আদায়ের জন্য যখনই লাল ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে তখনই মালিকপক্ষ তাদের পোষা গুন্ডাদের নামিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে নেমেছে। শ্রমিকের রক্ত ঝরিয়ে প্রাণ কেড়ে নিয়েও শ্রমিক আন্দোলন ভাঙতে পারেনি। শ্রমিকের রক্ত ভেজা মাটি থেকেই শ্রমিক ঐক্য এবং আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেই ধারা বহন করে চলেছে ডুয়ার্সের বানারহাট থানার বন্ধ চা বাগান রেডব্যাঙ্ক। ১৯৯৩ সালের ১৫ জুন এই বাগান দেখেছিল ঘাতক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা। এই ঘাতকেরা ছিল সব মালিকের পোষা গুন্ডা। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির গাছের সবুজ পাতা সেদিন ভিজেছিল ১৩ চা শ্রমিকের রক্তে। বাতাসে মিশেছিল বারুদের গন্ধ আর শ্রমিকদের যন্ত্রণা বিদ্ধ করুণ আর্তনাদ। সেদিন এই বাগানের মালিক রবীন পালের কাছে বাগান শ্রমিকদের দাবি ছিল ন্যায্য মজুরি আবাসনের দাবি, চিকিৎসার দাবি। মালিক শ্রমিকদের জোট দেখে ভীত হয়ে মদত যুগিয়েছিল ঘাতকবাহিনীকে। অভিযোগ ছিল ১৫ জুন লাল ঝান্ডার শ্রমিকদের মিছিলে হামলা করা হয় কংগ্রেসের শ্রমিকদের সাথে পোষা গুন্ডাদের মিশিয়ে দিয়ে। সেদিন পড়ন্ত বিকালে মিছিলে আচমকা বন্দুক ছোরা বল্লম টাঙ্গি দিয়ে হামলা করা হয়। ঘটনা স্থলেই চা বাগানের মাটিতে প্রাণ হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন ১৩ জন শ্রমিক।

চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের রেডব্যাঙ্ক বাগান ইউনিটের সম্পাদক সোমরা লাকড়া, সভাপতি সিতে শর্মার কাছ থেকে শুনলাম রেডব্যাঙ্ক চা বাগানের করুণ ইতিহাস। নাগরাকাটা ব্লকে রেডব্যাঙ্ক গোষ্ঠীর ছিল ধরণীপুর চা বাগান। গোষ্ঠীর আরও একটি বাগান ছিল সুরেন্দ্রনগরে। ২০১২ সাল থেকে রেড ব্যাংক গ্রুপের রেডব্যাংক, সুরেন্দ্রনগর ও ধরণীপুর বাগান তিনটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে রেড ব্যাংক ও ধরণীপুর চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলনে শামিল হন।  দ্রুত রেডব্যাংক গ্রুপের তিন বন্ধ বাগান খোলার দাবিতে ফ্যাক্টরিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান চা শ্রমিকরা। বাগান না খুললে বড়সড়ো আন্দোলনের হুশিয়ারি দেন তাঁরা।  চা বাগান বাঁচাতে ২০১৪ সালে উদ্যোগ নেয় সরকার। বাগান অধিগ্রহণ করা হয়। বাগান খুললেও ফের তা বন্ধ হয়ে ‌যায়। দেখা যায় বাগান মালিক নিজে বাগান চালাতে চান না, আবার কাউকে বাগানের সত্বও দিতে চান না। এই রকম দোটানা পরিস্থিতিতে সরকার আরও কড়া পদক্ষেপ না নিলে ঐতিহ্যের রেডব্যাঙ্ক চা বাগান হয়তো হারিয়ে ‌যাবে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলে বাগান দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে রেডব্যাঙ্ক চা বাগানে প্রশাসনের তরফে লিজ বাতিলের নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ভূমি রাজস্ব দফতরের কর্তাদের নিয়ে রেড ব্যাঙ্ক বাগানে যান তৎকালীন জলপাইগুড়ির মহকুমা শাসক সীমা হালদার, মালবাজারের মহকুমা শাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি, ধূপগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীপিকা ওঁরাও প্রমুখ। প্রশাসনের কর্তারা শ্রমিকদের সরকারি নোটিসের বয়ান পরে শোনান। সেই সঙ্গে জানান, যতদিন না বাগান চালু হচ্ছে সরকারি যে সমস্ত সাহায্য দেওয়া হত সে সব চালু থাকবে। এর পরে তাঁরা দুটি বাংলো, কারখানা, অফিস চত্বর ঘুরে দেখেন এবং নোটিস ঝুলিয়ে সেগুলি সিল করা হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা যায় ১৩৭৬.৫৬ একর জমির উপরে গড়ে ওঠা রেড ব্যাঙ্ক চা বাগানের পুরো এলাকা এদিন রাজ্য সরকারের তরফে অধিগ্রহণ করা হয়। সেই সময়ে বাগানের শ্রমিক সংখ্যা ৮৮৬ জন বলা হলেও জনসংখ্যা বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি ছিল।

২০১৪ সাল থেকে এই বাগান পুরোপুরি বন্ধ। বহু শ্রমিক অনাহার অপুষ্টিতে মারা গেছেন, কিন্তু শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো কোনো বছর বাদ যায়নি। প্রতিবছর এই দিনটি মর্যাদায় পালিত হয়। সকালে কাজ খুঁজতে যাবার আগে একে একে শ্রমিকরা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা এসে শহীদ স্তম্ভ ঘিরে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। লিজ বাতিলের খবর পেয়ে শ্রমিকেরা খুশি হলেও লালু তাঁতি, বিন্না ওঁরাও-র মতো শ্রমিকদের দাবি ছিল শুধু লিজ বাতিল করলে হবে না, দ্রুত বাগান খোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব প্ল্যানটেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের শীর্ষ নেতা মণি দার্নালও মনে করেন “লিজ বাতিল করা অথবা বন্ধ বাগান অধিগ্রহণ করা সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ নয়। তাড়াতাড়ি নতুন মালিকের ব্যবস্থা করে বাগান খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।” চা বাগান মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল আলমের মত ছিল, “বাগান খোলার ব্যবস্থা করাটাই মুখ্য হওয়া উচিত ছিল।” শ্রমিক নেতাদের ভয় অন্য জায়গাতে। তাদের বক্তব্য বামফ্রন্ট বন্ধ কাঁঠালগুড়ি এবং রামঝোরা বাগানের লিজ বাতিল করেছিল। নতুন মালিক আসার পরে প্রচুর শ্রমিক ছাটাই করে। শ্রমিক নেতৃত্বের প্রশ্ন রেডব্যাংক চা বাগিচাতেও ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না তো।? তখনকার বাগানের ম্যানেজারের বাংলো আজও রয়েছে। গার্ডেন চেয়ারে ধুলো জমেছে। কিন্তু আজও কেউ হাত দেয়নি সে চেয়ারে। ফুল ফোটে ম্যানেজারের ভাঙা বাংলোয়। সরল সাদাসিধে শ্রমিক মহল্লার মানুষগুলো আজও অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর দয়া নয়, এবার ঠিকঠাক চলুক তাঁদের ঐতিহ্যের রেডব্যাঙ্ক চা বাগান। অন্য বন্ধ বাগানগুলি খুলে যাচ্ছে বা খোলার প্রক্রিয়ায়। অথচ সেই তালিকায় সাপ লুডু খেলার পরিস্থিতি তাদের। তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। আয়ের কোনও উৎস নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে বসেছে। সরকারি সাহায্য থাকলেও ফাওলই, ১০০ দিনের কাজ বা জিআর অনিয়মিত। এমন পরিস্থিতিতে তাঁরা কাজ করে বাঁচতে চান। মালিক খুঁজে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে বাগান খোলার হয়ে সওয়াল করেছেন তাঁরা।

এসে দাঁড়ালাম ডায়নার ধারে। রুটিরুজির অন্যতম অবলম্বন ডায়না নদী থেকে ট্রাকে বোল্ডার বোঝাইয়ের কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাঝখানে। বালি মাফিয়াদের প্রতি রাজ্য সরকার কঠোর মনোভাব নেওয়ার ফলে এই অঞ্চলে হিতে বিপরীত হয়েছে বেশি। শুনলাম বর্ষার মরশুমে রয়্যালটি প্রদান বন্ধ থাকায় অথবা একশো দিনের কাজের প্রকল্প বা ডায়না নদী থেকে ট্রাকে বালিপাথর বোঝাইয়ের কাজ খুইয়ে রোজগার হারিয়ে সম্পূর্ণ বেকার হয়ে গেছে প্রায় পাঁচশো শ্রমিক। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের পকেটে একটি টাকাও নেই। মনে পড়ল সেই ২০১৭ সালের কথা। আমার প্রথম চা বাগিচার প্রতি ভালোবাসা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্ম হয় “ এখন ডুয়ার্স” পত্রিকার মাধ্যমে যখন প্রথম বাগান সমীক্ষা শুরু করি সেই সময়কাল থেকে। সেই সময়ে রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচাতে এসে প্রথম পর্যায়ের সমীক্ষা করেছিলাম। তখন ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকার পক্ষ থেকে অবৈতনিক বিশেষ সংবাদদাতা হিসাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি বাগিচা থেকে বাগিচাতে। উত্তরের চা বাগিচার সেই সময়কালীন দারিদ্র্য, অনাহার, অনশন, মৃত্যুর অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন এবং ডুয়ার্সের চা শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করলাম সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে। এরকমভাবেই একদিন ডায়না নদীর তীরে পাথর ভাঙ্গারত অবস্থাতে আবিষ্কার করি রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচার জয়ন্তী, অঞ্জলি এবং  নিকিতা, বাসন্তী ওঁরাওদের যারা বানারহাট স্কুলের নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্রী হলেও পড়াশুনা থেকে প্রায় ড্রপআউট হয়ে গিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের কারণে পাথর ভাঙতে বাধ্য হচ্ছিল ডায়না নদীতে। তুলে ধরি ওদের করুণ কাহিনী ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকাতে। মানবিক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাড়া পড়ে যায় চারিদিকে। অনেকেই ব্যাক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বিস্তাড়িতভাবে জানতে চান আমার কাছে, কেউ কেউ সরাসরি সাহায্য করতে চান মেয়েগুলিকে, কেউ আমাকে সঙ্গী করে এদের কাছে যেতে চান। যেটুকু সহযোগিতা করার সেটুকু করেছিলাম সকলকে। কিন্তু সেই সাহায্য ছিল এককালীন। জানতাম তাতে দুচারদিন অভাব মিটবে, কিন্তু চিরস্থায়ী সমাধান হবে না কোনপ্রকারেই। আবার তিনদিন বাদে পাথর ভাঙতে চলে যাবে মেয়েগুলো।

কিন্তু ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি/ মেয়েরা নয় হাতের চুড়ি’ এই আপ্তবাক্যকে সম্বল করে সমাজসেবী নারী অর্পিতা বাগচী সেই সময়ে  দিদি হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ডুয়ার্সের বন্ধ রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচার ছ ছয়টি মেয়েকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার সাধনা নিয়ে। জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্সের একটি সামাজিক সংস্থা ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাডস’। কর্ণধার অর্পিতাদি আমাকে একদিন সকালে ফোন করে জানালেন ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকাতে আমার লেখা পড়ে তিনি এতটাই মর্মাহত যে তিনি এই ধরনের বন্ধ বাগিচাগুলির কয়েকজনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে চান। তখনও বুঝতে পারিনি যে তিনি তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং যতদূর পর্যন্ত তারা পড়াশুনা করতে চায় তিনি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করবেন। তিনি আমার কাছে এই ধরণের তিনজন মেয়ের নামের তালিকা চান যাদের তিনি সাহায্য করবেন। আমি সবিনয়ে জানালাম মাত্র একদিন বাগিচা সফর করে কে সত্যিকারের দরিদ্র সেটা কেমন করে বুঝব? তাই শরণাপন্ন হলাম তৎকালীন টাই এর ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক রাম অবতার শর্মাজীর। তাঁর পরামর্শেই পরবর্তীকালে অর্পিতাদির সঙ্গে প্রাথমিক সমীক্ষা করতে যাই রেডব্যাঙ্কে। সেখান থেকেই প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হল জয়ন্তী, সোনিয়া, অঞ্জলীকে যারা তিনজনেই ছিল সেই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী। তখন সম্ভবত পরীক্ষার মাস পাঁচেক বাকি ছিল। শুরু হল অর্পিতাদির একক লড়াই এবং জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য মেয়েগুলির সমষ্টিবদ্ধ লড়াই। প্রত্যেকমাসে অর্পিতাদি ১০০০ টাকা করে পাঠাতেন এদের তিনজনের পড়াশুনার জন্য। মনে রাখতে হবে সমীক্ষা করতে গিয়ে জেনেছিলাম ডায়না নদীতে সকাল সাতটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত রোদে পুড়ে পাথর ভেঙে অঞ্জলি এবং তার পরিবারের পাঁচজন মিলে এক ট্রাক পাথর বোঝাই করে দিতে পারলে সাকুল্যে মিলতো একেকজনের গড়ে ১০০-১২০ টাকা। তাই প্রতিমাসে ১০০০ টাকা ডুয়ার্সের একজন নারী চা শ্রমিকের কাছে যে কতটা আর্থিক সাহায্য সেটা হয়তো আলাদা করে বলে দিতে হবে না।

২০১৭ সালে রেডব্যাঙ্কের জয়ন্তী, অঞ্জলী এবং চ্যাংমারীর সোনিয়াকে মাসে ১০০০ টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কাজ শুরু হয়। শুরু হয় ওদের পড়াশুনা। এরপর ডায়না দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। মাঝখানে অর্পিতাদি হয়েছিলেন প্রচন্ড অসুস্থ। শুনেছিলাম তিনি যেতে পারেন না বাগিচা সফরে। তাই ভেবেছিলাম সম্ভবত প্রজেক্টের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর যা হয়, বাস্তবতার নিরিখে কর্মব্যাস্ততাতে বেশি আর খবর রাখতে পারিনি। তারপরে তো ভয়ঙ্কর সেই সময়কাল আমাদের গৃহে অন্তরীণ করে দিয়েছিল।  কিন্তু অর্পিতাদি টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেননি। গতবছর ২০২২ এর ২৫ শে ডিসেম্বর অর্পিতাদির সঙ্গে শীতবস্ত্র দিতে গেলাম শ্রমিক পরিবার এবং তাদের সন্তানদের। সামগ্রীক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করল “টু লিভস অ্যান্ড এ বাডস” এর মানসকন্যা অঞ্জলি যাকে সামনে রেখে শুরু হয়েছিল প্রজেক্টের কাজ । খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সে এখন কলেজ ছাত্রী। মাধ্যমিকে ফেল করার পরে অঞ্জলি বলেছিল সে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, রোজগার করতে না পারে তাহলে তার পিতাজী মরে যাবে। কারণ গার্ডেন বন্ধ। তাই সে ফেল করলেও আবার পড়াশুনা করতে চায়। সে জোর দিয়ে বলেছিল অবশ্যই সে পাশ করবে এবং রোজগার করে সংসারের দায়িত্ব নেবে। ২০১৮ সালে অঞ্জলি মাধ্যমিক পাশ করল। ইতিমধ্যেই ‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’ সাহায্য করতে শুরু করল আরো পাঁচটি আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর মেয়েকে যারা বানারহাট স্কুলের মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থিনী ছিল। যখন এই প্রতিবেদন লিখছি তখন অঞ্জলি মালবাজার পরিমল মিত্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আর রিম্পা ওঁড়াও, রোশনী গুরুং, প্রতীক্ষা মারাং, পাখি ওঁরাও, অনুজা ওঁড়াও বানারহাট স্কুলে কেউ একাদশ আবার কেউ বা দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছে। প্রত্যেক রবিবার বা কোন ছুটির দিন অর্পিতাদি এদেরকে ফোন করে কারো কোন ধরণের সমস্যা হচ্ছে কিনা তা শুনে নেন। 

‘টু লিভস অ্যান্ড এ বাড’ উপলব্ধি করেছিল একবার যদি টাকা বা বৃহত্তর স্বপ্নিল জীবনের স্বাদ চা বাগিচার কিশোরী বা নারীরা  পায় তাহলে মূলস্রোতে তার ফিরে আসাটা খুবই প্রতিকূল হয়ে দাঁড়ায়। সেই বছরে জয়ন্তী, অঞ্জলি, সোনিয়া তিনজনেই ফেল করেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষাতে। জয়ন্তী পড়াশুনা ছেড়ে দিল। অর্পিতাদি অসুস্থ হবার পরে সেভাবে আর যেতে পারতেন না ডুয়ার্সের বাগিচাগুলিতে। কিন্তু প্রতি বছরের ২৫ শে ডিসেম্বর তাঁর টিম পৌঁছে যেত ডুয়ার্সের কোন এক বন্ধ চা বাগিচাতে সেখানকার মানুষের জন্য জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী বা অন্য কোন উপহার সামগ্রী নিয়ে। অর্পিতাদি মনে করেন সমাজে এখনো লিঙ্গ বৈষম্য প্রবল। এর ফলে মেয়েরা অর্থনৈতিক অবহেলা এবং শোষণের শিকার। মেয়েরাও পড়াশুনা করতে চাইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সমর্থন এবং সহযোগিতা পাওয়া যায় না। পারিবারিক সম্পদ এখনো উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষের হাতে যায়। তাই অর্পিতাদি অঞ্জলিদের শিখিয়েছেন ১০০ টাকা হলেও পরিবারের হাতে তুলে দিতে যাতে তারা মনে করেন আগামী দিনে তাদের মেয়ে রোজগার করলে এইভাবেই তাদের সাহায্য করতে পারবে। আসলে এই লড়াই একদিকে চা বাগিচার নারী শ্রমিকদের লড়াই নয়। এই লড়াই আমার, আপনার, সকলের। সামগ্রীক পরিকল্পনা শুনে এবং নিজের চোখে দেখে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে, ভালোবাসায় আপনা থেকেই এক অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে। এখন না হয় রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচা খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চলছে নিরন্তর প্রয়াস। তাই অঞ্জলিদের এই লড়াই ডুয়ার্সের অন্য ছাত্রীদের যাতে প্রভাবিত করে সেটাকে তুলে আনা প্রয়োজন। এই লড়াই মানবদরদী শুভানুধ্যায়ী মানুষের লড়াই যে লড়াইতে একজন সংবেদনশীল এবং চা শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন মানুষ হিসাবে, একজন শিক্ষক হিসাবে, একজন লেখক হিসাবে কিভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছিলাম অর্পিতাদির সংগঠনের জন্মের প্রথম লগ্নে। দারিদ্র্য থেকে অভাবগ্রস্ত পরিবার মেয়ে সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। তাই পরিবারে নারীশক্তির আত্মমর্যাদার যে লড়াই শেখাচ্ছেন অর্পিতাদিরা তার গুরুত্ব কম নাকি? 

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri