"জনে জনে নানাগে। মোইদ্যতে একটা ভক্তি দ্যাও বারে।"
দুপুরের পরে পরেই নিমন্ত্রিতরা বসেছেন খেতে। উঠোনে চারদিকে কাঠের তক্তা পেতে বসার আয়োজন। সবই চেয়ে-চিন্তে জোগাড় করা। যেদিকে তক্তা কুলায়নি সেদিকে পাটের বস্তা ফেলে বসার ব্যবস্থা। মালতীকে বিয়ের শাড়িটাই পরিয়ে ওড়না মাথায় দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে আনা হয়েছে। খালি পা, পায়ে নতুন করে পরানো আলতা। পরিবেশন শেষ, দুই একটা বাচ্চা ব্যাপার না বুঝে খেতেও শুরু করে দিয়েছে। এই সময়ে সুকোবালা আর কয়েকটি মেয়ে মিলে মালতীকে নিয়ে উঠোনে মাঝখানে ঢুকল। ভয়ে-লজ্জায় জড়সড় মালতী ধূপ ধরিয়ে উঠোনে গেঁথে দেয়। তারপর দস্তার গ্লাস থেকে ফুলজল নিয়ে ধূপের গোড়ায় দিয়ে প্রণাম করে। সুকোবালাই পরপর নিচু গলায় নির্দেশ দিতে থাকে।
"ফুলজলগিলা ঘুরি দিয়া এলা চাইরো পাখে ভক্তি দেক।"
মালতী ধূপের গোড়ায় ফুলজল দিয়ে ওর নির্দেশমতো চারদিকে প্রণাম করে। তার মধ্যে একজন বয়স্ক মানুষ ব্যস্ত হয়ে বলে,
"নানাগে বারে অতলা ভক্তি দিবার। ওটে মইদ্যতে একটা দ্যাও তাইলে হোবে।"
প্রণাম করে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেককে ভাত পরিবেশন করে মালতী। বৌভাতের দিন প্রায় প্রতিবারই সবার পাতে ভাত পরিবেশন করতে হল মালতীকে। অনভ্যাসে শরীর খারাপ লাগতে থাকে ওর। কিন্তু উপায় নেই। মালতীর বাপের বাড়ি থেকেও কয়েকজন আসবে আজকে নিমন্ত্রণ খেতে। মনে মনে সেই অপেক্ষায় আছে।
পাঁচ-সাতজনের দলটির প্রথমের সাইকেল আরোহীর কাছে একটা লম্বা টর্চ, মাঝে একজনের হাতে আর একটা আর সব শেষের জনের হাতে একটা করে তিনব্যাটারীর টর্চ। কথা বলতে বলতে আড্ডার মেজাজে সবাই প্যাডেলে চাপ দেয়। একজন পেছন থেকে বলে,
"এ মামা। তোমরা যাছেন ভোল। সাগাইমেলার কাথাটা কয়া আইসেন।"
মালতীর ছোট মামা টেনে টেনে বলে,
"যাবে না কওয়া বারে। হোটে যাছি কি খালি খাবার ত্যানে। মাইকো দেকিমু ক্যামোন আছে। ওদি আল্লাপ সাল্লাপও হোবে। সোগায় আছি, হবে এলায়।"
পাড়ার লোকের খাওয়ার পাট প্রায় শেষ। গ্রাম্য পরিবেশ। সন্ধের মুখেই নিমন্ত্রিত মানুষ-জন খেয়ে চলে গেছে। এর মধ্যে মিষ্টি, খাস্তাসহ কনের বাড়ি থেকে আসা পাঁচ-সাতজনের ছোটখাট দলটা উঠোনে এসে দাঁড়াল। সবাই সমাদর করে উঠোনেরই এক কোণে পেতে রাখা বেঞ্চ আর বাঁশের খাটে বসাল।
বাড়ির লোককে দেখে মালতীর বুকটা হুহু করে উঠল। ইচ্ছে করছিল সঙ্গে চলে যায়। আসলে এত আনন্দ উৎসবের মধ্যেও ওর ভেতরে একটা ভয় কাজ করছিল। খাওয়া শেষে কূপীর আলোয় মালতীর শ্বশুর পঞ্জিকা হাতে বসল। বলল,
"হিসাবে তো উদিনকায় সাগাইমেলা করির নাগে বারে। কিন্তুক উদিনকা যে আরো দোমাসি পড়েছে বারে। তালে তো পাছে দিবার নাগে!"
একটা চ্যাংরা মাঝখান থেকে বলল,
"তোমার আরো দোমাসি আছে, কতয় নিয়াম। তে কালি কইল্লে না হয় বারে।"
"হু হু! কালি কইল্লে হয়! তোমরা আজি কালিকার চেংরাগিলা কোনোয় মানির না চান। কালি যে আমাবোইস্যা ধরিবে আরো ফির! সাঞ্জোতে ধরিবে, ছাড়িবে উদিনকা সাকালে।"
মালতীর শ্বশুর একটু থামলে ঘটক বলে,
"বাফোই রে, বাপ-ঠাকুদ্দার নিয়াম না মানিলে চলে!"
পরদিন অমাবস্যা। রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফিরতি পথে সবার কেমন আলস্য লাগে। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে মালতীর মামা বলে,
"গাড়ি এলা একখান নাগে। তোমার পাড়াত আছে ঝুনি বারে?"
ইচ্ছে না থাকলেও কান্তেশ্বর এসেছে বৌভাত খেতে। সে বলল,
"গাড়ি না আছে। তোমাক হুলা ভাবির নানাগে। পাড়ারে ছাওয়াটার বিয়াও হইল। এমনিয়ে যাবে। ভাড়া দিবার নানাইগবে।"
সবার সাগাইমেলা বিয়ের একদিন পরে হলেও মালতীর দুদিন পরে হল। একেই বলে নিয়মের গ্যাঁড়াকল। এই দুই দিনে বুড়িটা পাড়ার প্রায় সব বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে। সবার সাথে আলাপ পরিচয় শেষ। শিবানী অবশ্য কোথাও যায়নি। কাছে-পিঠে দু-একটা বাড়িতে মালতীর শাশুড়ি নিয়ে গেলে গেছে, সারাক্ষণ মালতীর সঙ্গেই ছিল। বাড়িতে বারবার করে বলে দিয়েছে,
"কোনোটে যাবু না। মাইর নগত নবু। ঘর-বর বনিলে আর বচ্ছরে ভোল তোরও বিয়াও নাগামু। আও ঝুনি না শুনোং!"
শিবানী মেয়েটাও শান্ত। মালতীর শ্বশুর বাড়িতে এসে এর মধ্যে কার সঙ্গে বা মালতীর হয়ে ঝগড়াও করেছে একপ্রস্থ। সাগাইমেলার আগের দিন হাটবার ছিল। সুবোধ অনেক অনুরোধেও শিবানীকে হাটে নিয়ে যেতে পারল না। শেষে দুই মিস্তর মিলে বুড়িটাকেই সাইকেলের পেছনে বসিয়ে হাটে গেল। বুড়ি তো কিছুতেই উঠবে না। সে এক ঝক্কি। এর মধ্যে মালতীকে প্রাণভরে হাসতে দেখে সুবোধের মনটা খুশিতে ভরে যায়। সবার চোখ এড়িয়ে দুজনের একটু চকিত চাহনি বিনিময় ঘটে।
দুই হাতে বড়া ভাজা, গোপভাজা নিয়ে বুড়ি সাইকেলে চেপে হুস করে বাড়িতে ঢোকে। দেখতে বেশ একটা চমৎকার দৃশ্য মনে হলেও বুড়ির চিৎকারে লোকের ভুল ভাঙে,
"মাইল্লেক বারে। মরলুং আজি। দ্যাখো তো মাও তোমার ব্যাটা মোক মারি ফেলাইল বোদায়।"
বুড়িকে একটা সাদা থান আর শিবানীর জন্য হাট থেকে একটা মিডি ধরণের জামা এনেছে সুবোধ। কিন্তু জিজ্ঞেস করে করে হয়রাণ হলেও পছন্দ অপছন্দ জানতে ব্যর্থ হল বেচারা। পরে অবশ্য মালতীর মারফত জানল জামা খুব পছন্দ।
পঞ্জিকার গেঁড়ো কেটে অবশেষে যাওয়ার সময় উপস্থিত। মল্লিকা একা একাই সেজেগুজে রেডি। তাই দেখে সুবোধ ঠাট্টা করে,
"আজি এলা বাপের বাড়ি যাবে, কইনা সোগারে আগোত সাজি আছে। মুকখানও হাসেছে। নাহালে, আসিবার দিন থাকি মুকখানোত হাসি নাই।"
সাগাইমেলা উপলক্ষে আজকেও বাড়ি সরগরম। কাছে-পিঠের আত্মীয়-স্বজন, পাড়ার দু-চার ঘর মানুষ মিলে আর একটা ছোটখাট আয়োজন।
মালতীদের বাড়ি থেকে রওনা হতে হতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটাই গরুর গাড়িতে কয়েকজন পাড়ারই মহিলাসমেত গাড়োয়ান রওনা হল। মালতীর মা ব্যস্ত হয়ে প্রায় ধমক লাগাল,
"বিরাও তো বারে। এত এখেরে সাজোন গোজোন। মুখ আন্ধারিয়ে নাগেছে। যাবেন কী এলায় নিশার আতি পহর আতি?"
আসলে মায়ের মন! ওদিকে মালতীও ছটফট করছে বাড়ি আসার জন্য। খাওয়া-দাওয়া সারতেই অনেক রাত হয়ে গেল। সদ্য অমাবস্যা গেছে। রাত এখন ঘন অন্ধকার। গরুর গলায় ঘন্টা বাজছে টুংটাং। ছইয়ের নিচে লন্ঠন ঝোলানো। মালতীর বর আর ওর মিস্তর গাড়ির পেছন দিকটায় পা ঝুলিয়ে বসেছে, গাড়োয়ানের পাশে মালতীর এক পাড়াতুতো কাকার ছেলে। এর মধ্যেই শাশুড়ি কেমন, শ্বশুর কেমন, মানুষগুলো কেমন, শাশুড়ি আদর করে কিনা কয়েক প্রস্থ প্রশ্নে মালতী অস্থির। যথা সম্ভব ভালোটাই বলে। এক প্রবীণা মন্তব্য করে,
"এলাইতে আর কী বুজিবে মাও! সোমায়খান আসুক!"
দেখতে দেখতে দুটো দিন কাটিয়ে মালতীরা যাওয়ার জন্য রেডি হয়। এই কদিন কোনো কোনো দিন দুপুরেই দুই বাড়িতে ভাত খেতে হয়েছে ওদের। কেউ ছাড়বে না। যাওয়ার দিন নিজের বাড়িতে দুপুরের ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রেডি হয়। মালতীর মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে মেয়েকে বিদায় দেয়। মালতীর জন্য একটা শাড়ি আর জামাই এবং জামাইয়ের মিস্তরের জন্য দুটো প্যান্টের কাপড় বের করে দেয়। সবাইকে প্রণাম করে ওরা রওনা দেয়, সেদিনের গরুর গাড়িটাতেই।
............................................................
উদিনকা - পরশু দিন
দোমাসি - মাসের শেষ দিনটি
সাগাই মেলা - বিয়ের পর প্রথমবার মেয়ের বাড়ি থেকে এসে মেয়ে-জামাইকে নিয়ে যাওয়া।