রেডব্যাংক টি গার্ডেন (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
রেডব্যাংক টি গার্ডেন (প্রথম পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------------------------
একটা সময় ছিল যখন সাত সকালে বাগানের গেট খুলত আর সারিবদ্ধ হয়ে চা বাগানে কাজে লেগে পড়ত শ্রমিকরা। চা পাতা তোলা থেকে শুরু করে বাগানের পরিচর্যা সবই চলত পুরোদমে। কিন্তু এখন সেসব অতীত। নয় নয় করে কেটে গেছে প্রায় একটা যুগ। এখন আর বাগানের গেট খোলে না, তোলা হয় না দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ি ব্লকের বানারহাটের রেডব্যাঙ্ক চা বাগানে এখন শুধুই শূন্যতা আর হাহাকার। বাগানের মূল ফটকে ঝোলানো রয়েছে সরকারের বাগান অধিগ্রহণের নোটিশ। ডুয়ার্সের চা বাগানের এক অন্যতম ছিল এই রেডব্যাঙ্ক চা বাগান। খুব কম করে হলেও শুধু রেডব্যাঙ্ক বাগানেই কাজ করতেন হাজারেরও বেশি শ্রমিক। বাগানে ছিল ম্যানেজারের বড় বাংলো। সবকিছুই চলতো তার নিজের ছন্দে। কিন্তু ২০১১ সালে লোকসানের বহড় দেখিয়ে চা বাগানের মালিক রবিন পাল বাগান বন্ধ করে দেন। মাথায় হাত পড়ে শ্রমিকদের। সেই থেকেই লড়াইটা শুরু হয় স্থানীয় শ্রমিকদের। কাজ হারিয়ে পেটের তাগিদে চলে যেতে হয় ভিন রাজ্যে বা ভিন জেলায়। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটা করতে হয় কচিকাঁচাদেরও। পেটে খিদে নিয়েও এখনও পড়াশুনা চালিয়ে যায় জয়ন্তি, অঞ্জলি, ভগবতী, সুস্মিতারা। তবে তাদের জীবন রংহীন। এখন তাদের বাঁচতে হয় শুধু অন্যের দয়ায়। সরকার থেকে দেওয়া হয় চাল। তাও অনিয়মিত। পেট ভরেনা। কখনও কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পৌঁছে যায় শ্রমিক মহল্লায় ত্রাণ নিয়ে। তাতেই চলে কদিন। শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কথা একটাই, তাঁরা কাজ চান। দয়া নয়। একসময় বাগানের ভিতরে যে মণ্ডপে দুর্গাপুজো হতো সেখানে আজ আগাছা আর নেই রাজ্যের ঝোপ জঙ্গল। একবারের বেশি খাওয়া মিলবে না বলে তাদের চালাঘরে রান্না চাপে বিকেল চারটেয়। তবু ওদের মুখে হাসি ফোটে।
একসময়ে এখানকার বৈভব দেখে চক্ষু চড়কগাছ হত অনেকেরই। বলিউড-টলিউডের নায়ক নায়িকাদের অভিনীত একাধিক ছবিতে ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছে ডায়না পাড়ের এই বাগানেরই দৃশ্যপট। আস্ত চিড়িয়াখানা থেকে ঝাড়বাতির আলো ঝলমলে ডিরেক্টরস বাংলো। ফি বছর দুর্গাপুজোয় এলাহি আয়োজন। অতীতের ওইসব সোনালি স্মৃতিকে দূরে ফেলে রেখে রেডব্যাংক চা বাগান হতাশা আর দুশ্চিন্তার কালো মেঘ কাটিয়ে নতুন ভোরের সন্ধানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এবারের বাগিচা সফরে এসেছি রেডব্যাঙ্কে। কারণ রেডব্যাঙ্ক ঘিরে অনেকগুলি স্মৃতি জড়িত। আমার বেশকিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক কাজের সাক্ষী এই রেডব্যাঙ্ক চা বাগান। এখনও বাগানের অনেক জায়গাতে কার্যত কাঁটাঝোপের জঙ্গল, শেড ট্রির অস্তিত্ব নেই, শ্রমিকেরা বালি পাথর ভাঙার বিকল্প পেশা বেছে নিয়েছে। রেডব্যাঙ্ক, ধরণীপুর, সুরেন্দ্রনগর তিনটে বাগানই বন্ধ দীর্ঘদিন ধরেই। প্রচুর শ্রমিক লকডাউনের আগে বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভিনরাজ্যে। পরবর্তীকালে কিছু ফিরে আসে। কথা হচ্ছিল বাগানের প্রবীণ কর্মচারী সুশীল সরকারের সঙ্গে। জানালেন ‘নিজের চোখে মালিকের বাংলোর চিড়িয়াখানা দেখেছি। সেখানে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, অজগর সবকিছুই মজুত ছিল। অশোককুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত বনজোছনা ও হাটেবাজারে সিনেমার শুটিং তো এখানেই হয়েছে। সবই এখন ইতিহাস’। বাগানটিতে খোলা-বন্ধের সাপলুডো খেলা চলছিল ২০০২ সাল থেকে। পাকাপাকিভাবে বাগানে তালা ঝোলে ২০১২-র অক্টোবরের শেষে। তারপর নেতা-মন্ত্রী কিংবা আমলাদের আনাগোনা লেগে থাকলেও ফ্যাক্টরির মরচে ধরা তালার চাবির সন্ধান কিন্তু মেলেনি। শুধু সমান তালে বেড়েছে তাদের সমস্যা। বাগান খুললেও রেড ব্যাংকে এখনও অপ্রাপ্তির তালিকা বেশ লম্বা চওড়া। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা রেডব্যাংকের শ্রমিকদের অনটনের সমস্যা আরও বেড়েছে। আপার লাইনের এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বললাম। জানালেন শ্রমিকদের বেহাল দশা। রোজগারের সব রাস্তাই বন্ধ।
সুশীলবাবুর সঙ্গে এলাম বন্ধ জঙ্গলে ঢাকা গ্যারাজ ঘরে। অনাদরে পড়ে রয়েছে একদা আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠা গাড়ি। সে ছিল সোনাঝরা দিন। তখন হাতিশালে হাতি থাকত, ঘোড়াশালে ঘোড়া। চিড়িয়াখানায় গর্জন করত চিতাবাঘ। শিং বাড়িয়ে খাঁচা থেকে উঁকি দিত চিতল হরিণ। শুধু কী তাই! মালিকের বাংলোর লনে শোভা বাড়াত দেশি-বিদেশি গাড়ির হরেক সম্ভার। মাঝে মাঝেই সেখানে শুটিং হত বাংলা সিনেমার। অশোককুমার, বৈজয়ন্তীমালা, শমিত ভঞ্জ, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, ছায়া দেবী, কামু মুখোপাধ্যায়ের মতো দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শুটিংয়ে ব্যবহৃত হত সেইসব বনেদি চার চাকার গাড়ি। কয়েকটির অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে যা দশা, তা যেন গোটা বাগানেরই করুণ প্রতিচ্ছবি। ভীষণ ছবি তোলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু রবিবার ছিল বলে গ্যারাজঘর বন্ধ ছিল। চাবি গুদামবাবুর কাছে থাকে। বন্ধ রেডব্যাংক চা বাগানের মালিক ধীরেন্দ্রনাথ ভৌমিকের বৈভবের বাংলোটির ঠিক পাশেই থাকত তাঁর শখের গাড়ি। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া খ্যাতনামা পরিচালক তপন সিংহের ‘হাটেবাজারে'-র শুটিংয়ে ব্যবহৃত হয়েছিল সেইসব গাড়ি। তাতে এক ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অশোককুমার। সিনেমায় তাঁর নাম ছিল ডাঃ অনাদি মুখোপাধ্যায়। নায়িকার বাগান মালিকের গাড়িই ছিল হিরো অশোককুমারের গাড়ি। রেডব্যাংক ও লাগোয়া নানা জায়গায় শুটিং হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া আরেকটি বাংলা ছায়াছবি বনজ্যোৎস্নাতেও ব্যবহার করা হয়েছিল ওই সমস্ত গাড়ি। সেই ছবিতে ছিলেন শমিত ভঞ্জ, রুমা দাশগুপ্তরা। তাতে বাগানের নিজস্ব আস্তাবলের ঘোড়া ব্যবহার হয়েছিল ভিলেন কামু মুখোপাধ্যায়ের একটি শটে। বরেণ্য চিত্রগ্রাহক বীরেন গুপ্তর কথা ও শুটিংয়ের দৃশ্যপট ক্যামেরায় ধরে রাখার সুবাদে স্পষ্ট মনে করতে পারেন রেডব্যাংকের প্রবীণরা। ১৯৭৮-এ মুক্তি পাওয়া জর্জ বেকার ও রাখি গুলজার অভিনীত সাড়া জাগানো ছবি চামেলি- মেমসাহেবের শুটিং হয়েছিল রেডব্যাঙ্কে।
২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যায় ডুয়ার্সের অতি পরিচিত রেড ব্যাঙ্ক চা বাগান। সাম্প্রতিককালে কোনমতে ঠেকা দিয়ে বাগান চালাচ্ছেন মালিকপক্ষ। সত্যি কথা বলতে কি, মালিকপক্ষ না বলে সমবায় সমিতি বলাই ভালো। চা বাগানের শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। অনেকে যুক্ত নদী থেকে পাথর তোলার কাজে। বন্ধ বাগানের মধ্যে প্রায়শই ঘোরাফেরা করে চিতাবাঘ, হাতি-সহ বন্যপ্রাণীরা। যখন গিয়েছিলাম রেডব্যাঙ্কে তখন বাগানের বন্ধ কারখানায় মানুষের আনাগোনা ছিল না। তবে কারখানার গেট খোলা ছিল। কারণ বাগানের ভিতরের ডাকঘরে ঝাঁপ পড়েনি। বহু বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ডুয়ার্সের রেড ব্যাঙ্ক চা বাগান। তবে তখনও খোলা ছিল চা বাগানের ভিতরের ডাকঘর। দেখলাম ভেতরের ছোট কক্ষে কাজ করছেন পোস্ট মাস্টার বাদলচন্দ্র দাস। পরিচয় দিয়ে কথা বলার অনুমতি চাইলে বিস্মিত হয়ে ভেতরে যেতে বললেন। কথা প্রসঙ্গে জানলাম রেডব্যাঙ্ক চা বাগান থেকে বানারহাটের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। আশপাশে অন্য কোনও ডাকঘর না থাকায় চা বাগানের শ্রমিকেরা রেডব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসেই চিঠিচাপাটির জন্য আসতেন এবং এখনও আসেন। তবে এখন এই ডাকঘর থেকে রেডব্যাঙ্ক চা বাগানের পাশাপাশি ধরণীপুর এবং সুরেন্দ্রনগর চা বাগানের বাসিন্দারাও এখানে আসেন। ডাকঘরে প্রায় ৮৫০ টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে জানতে পারলাম। প্রতিদিন জঙ্গলের নিস্তব্ধতার মধ্যেই গ্রাহকেরা আসেন একাধিক যোজনার আওতায় টাকা জমা দিতে বা তুলতে। ডাকঘরেই পেলাম গ্রাহক চা বাগানের কর্মচারী রানা সরকারকে। যেহেতু তখন বাগান বন্ধ ছিল তাই ডাকঘর পরিষবার পাশাপাশি রেডব্যাঙ্ক চা বাগানও খোলা থাকলে উপকৃত হতেন বলে জানিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ওই ডাকঘর থেকে তখনও নিয়মিত পরিষেবা পাচ্ছিল স্থানীয়েরা। বাদলবাবু যথাসম্ভ আপ্যায়ন করলেন। বাদলবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুশীলবাবুর সঙ্গে চললাম বাগান ঘুরতে। কিছু তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টাতে।
ডিবিআইটিএ ম্যানেজমেন্ট সংগঠনের সদস্য রেডব্যাঙ্ক চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী দি রেডব্যাঙ্ক টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাট থানার অন্তর্গত নাগরাকাটা এবং বানারহাটের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই টি গার্ডেনটি ভয়ংকর রকমের রুগ্ন হয়ে পড়ে দীর্ঘ ৯ বছর বন্ধ থাকার ফলে। বাগানে বর্তমানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ বলে কেউ নেই। সমবায়ের ভিত্তিতে শ্রমিকেরাই বাগানের পাতাগুলি বিক্রির মাধ্যমে শ্রমিক সমবায় গড়ে তুলেছেন। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে কোম্পাণীর মালিক এবং বোর্ড অফ ডাইরেক্টর ছিলেন শিলিগুড়ির রোশন আগরওয়াল। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন একটাই ছিল। এটি হল সিবিএমইউ। জলপাইগুড়ি সদর মহকুমার অন্যতম রুগ্ন এই চা বাগানটির আইন-শৃঙ্খলা বানারহাট থানার পক্ষ থেকে দেখাশোনা করা হয়। রেডব্যাঙ্ক চা বাগানটির আয়তন ৫৫১.০৯ হেক্টর। মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদীক্ষেত্র ৩৬৮.৫৩ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য ড্রেন এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে আর চা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় না। রেডব্যাঙ্ক চা বাগিচার বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৯৮৯ টি। মোট জনসংখ্যা ৪৯৪৬। স্থায়ী শ্রমিক ৮১৯ জন যারা নির্দিষ্ট পরিমান পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরী পায়। সর্বমোট সাব স্টাফ ৫৬ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল শ্রমিক মিলিয়ে মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৩। মোট কর্মরত শ্রমিক ৮৮৮ জন। শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৪০৫৮ জন। চা বাগিচায় হাসপাতাল আছে। কিন্তু ভগ্নদশা। আবাসিক ডাক্তার নেই। ভিজিটিং ডাক্তার আসেন সপ্তাহে একবার করে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা মাত্র ১ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস, কম্পাউন্ডার অথবা স্বাস্থ্য সহযোগী নেই। ভাঙ্গাচোরা হাসপাতালে মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড নেই, মেটারনিটি ওয়ার্ড ১ টি । বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের অস্তিত্ব যে ছিল বোঝা যায়।
বাগিচায় এখনো অ্যাম্বুলেন্স আছে, কিন্তু কোন মেইন্টেনেন্স নেই। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করা হয়। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই ২০০১ সাল থেকে। স্থগায়ী ক্রেশের সংখ্যা ১ টি, অস্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ৩ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় নেই। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কতখানি ফলপ্রসূ হয় তা বলা দুষ্কর। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। বাগান বন্ধ থাকাকালীন টি গার্ডেন থেকে কাঁচা চা পাতা কতটা পরিমান সংগৃহীত হয়েছে এবং বটলিফ ফ্যাক্টরি বা অন্য বাগান থেকে পাওয়া দামের উপর নির্ভর করে শ্রমিকদের মজুরি বরাদ্দ করা হত। নিয়মিত পিএফ, গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়া ছিল গল্পগাথা যেহেতু বাগান বন্ধ ছিল। কেবলমাত্র রাজ্য সরকার প্রদত্ত রেশন এবং ফাউলাই এর টাকা এবং নদীর ধারে বালি পাথর ভাঙ্গার কাজ ছিল শ্রমিকের বিকল্প কর্মসংস্থান। তাও রোজদিন কাজ জুটতো না। যে অগতির গতি একশো দিনের কাজ ছিল শ্রমিকদের বেঁচে থাকার অন্যতম সম্বল সেটাও বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘ কয়েকমাস। সরকারি দু’টাকার রেশন মিলছে বটে, তবে তা পেতে গেলে যেটুকু টাকা লাগে সেটাও নেই বহু পরিবারে। অনেকদিন ধরে মিলছে না ক্যাশ জি আর। অভাব অনটনের কারণে প্রায় প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে বাগানের নানা জায়গায় একের পর এক ছায়াগাছ লোপাট হয়ে যাওয়া। কাটা পড়ছে একের পর এক পরিণত ছায়াগাছ। মেশিন দিয়ে ছায়াগাছগুলিও কেটে পাচার করার চেষ্টা চলছে অভাবের তাড়নাতেই। বিগত গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যা অনিতা ওরাওঁ এর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। আর্থিক সংকটে জেরবার শ্রমিকরা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
এবারে রেডব্যাঙ্কে দেখলাম অন্য স্লোগান। ‘হয় বাগান খোলো, নয়তো লিজের দাবি ছাড়ো’। বন্ধ চা বাগানগুলির মালিকানা পরিবর্তন করে যোগ্য মালিকদের হাতে সেগুলির পরিচালনা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে এখন। জলপাইগুড়ি জেলাতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ মানাবাড়ি, সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর, রেডব্যাংক এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় বান্দাপানি, ঢেকলাপাড়া, মধু। এছাড়াও রায়পুর, কালচিনি, রায়মাটাং, তুরতুরী, শ্রীনাথপুর ইত্যাদি রুগ্ন চা বাগানের সংখ্যা কম নয় যেগুলি মাঝেমাঝেই ঝাপ গোটায়। বন্ধ চা বাগানগুলির মালিকপক্ষের লিজ বাতিল করে উদ্যোগী মালিক দিয়ে এই বাগানগুলি চালু হলে দুই জেলা মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কর্মচারী উপকৃত হবে। জলপাইগুড়ির উন্নয়ন বিষয়ক কমিটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি তথা তৎকালীন বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী যখন ছিলেন তখন কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। জেনেছিলাম বাগান হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো অসুবিধা নেই। আগ্রহী প্রার্থীরা যদি বাগান পরিচালনায় রাজি থাকেন তাহলে সরকার নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মালিকপক্ষের পাশেই থাকবে। আগ্রহী এবং দক্ষ চা শিল্পপতি এনে তাকে দিয়ে বাগান পরিচালনায় অংশগ্রহণ করানো এবং সেইসঙ্গে তাকে সরকারিভাবে সহযোগিতার প্রশ্নে সেই সময় জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ফাইল নবান্নে পাঠিয়েছিল। ভূমি এবং ভূমি সংস্কার দপ্তর প্রতিটি বন্ধ চা বাগানের সম্পদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল বলে জানতে পেরেছিলাম। তখনই দাবি উঠেছিল বকেয়া মেটানোর দায়িত্ব না নিতে পারলে বাগানের দায়িত্ব নতুন হাতে তুলে দেওয়া হোক। বন্ধ এবং রুগ্ন চা বাগানগুলির মালিকপক্ষের লিজ বাতিল করে মালিকানা বদল করার দাবি তুলে বাগান খোলার এই সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল শ্রমিক সংগঠনগুলিও।
দীর্ঘদিন বাগান যখন বন্ধ ছিল তখন ফাওলাই এর নামে সরকারি মাসিক অনুদান একসময় ৮৫০ জন স্থায়ী শ্রমিক পেতেন। নিয়ম অনুযায়ী ৫৮ বছরের বেশি বয়স হয়ে যাওয়ার ফলে বহু পরিবারের নাম ফাওলাইয়ের তালিকা থেকে বাদ যাওয়ায় তাদের অনেকেই সেই অনুদান পাচ্ছেন না। খাতায়-কলমে ৮৮৬ জন শ্রমিকের মধ্যে অনেকের মৃত্যু ঘটার ফলে এখন সেখানে ফাওলাইয়ের টাকা পাচ্ছেন ৫৫০ জনের মত। অথচ সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি কিন্তু রয়েই গিয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারা। শুনলাম একশো দিনের কাজ চলতি আর্থিক বর্ষে একদিনও হয়নি। পঞ্চায়েতের কাছে জানতে পারলাম ১০০ দিনের কাজের জন্য সবাই এসে তাগাদা দিচ্ছে। শীতের শুখা মরশুমে আশপাশের বাগানগুলিতে অস্থায়ী বা বিঘা শ্রমিকের কাজ প্রাপ্তিও বন্ধ হয়ে যায়। লড়তে হয় পানীয় জলের সমস্যার সঙ্গেও। পরিচর্যার অভাবে জঙ্গলে পরিণত হওয়া চা বাগানের একাংশে এখন হাতির ডেরা। ভরদুপুরেও মাঝে মাঝেই বুনোদের দলকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সন্ধে হলেই শুরু হয়ে যায় বিস্তীর্ণ শ্রমিক মহল্লা জুড়ে তাণ্ডব। জঙ্গল ও ঝোপঝাড় সাফাই করার দাবি থাকলেও সেটা করা হয় না। কাজের মধ্যে শুধু হয়েছে বনদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের নিয়ে দুটি হাতি তাড়ানোর দল গঠন। মিলেছে চারটি সার্চ লাইট ও কয়েক বাক্স পটকা। তার পরিবর্তে এখন বেঁচে থাকার লড়াই। বাগানের পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। আর্থিক সংকটে পড়ে ক্রমশ বাড়ছে ছায়া গাছ কেটে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা। ফের নতুন করে শুরু হয়েছে কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার ঘটনা। পরিস্থিতি এমনই দু’টাকা কিলোর সরকারি রেশন ছাড়াতে যে পঞ্চাশ টাকার মত প্রয়োজন হয় সেটাও জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের ডায়না নদীর বালি-পাথরই এখন অনেকের রুটিরুজির মূল ভরসা। তবে সবার পক্ষে ওই কাজ করা সম্ভব হয় না।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত। দ্বিতীয় পর্বে চোখ রাখুন। অন্ধকারের মধ্যে পাবেন আলোর সন্ধান)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴