"কোয়ারি বান্দোং কিরকির
কোয়ারী বান্দোং হিড়হিড়
কোয়ারীর উপর দি টাকা নিম
তেমনি কোয়ারি ছাড়ি দিম"
সমবেত সুরে গান আর হাসির শব্দে শোরগোল পড়ে গেল। কে বলবে ভোর হয়ে আসছে। প্রতিটা চোখে রাত জাগার ক্লান্তি!মতিবালা হেঁকে বলে,
"ন্যাও বারে কায় কায় আছেন ছাড়ি দ্যাও।"
ভেতর থেকে উত্তর এল,
"তুই কেনে আও কাড়িছিত মাই। তুই হলু হামার মানষি। তুই চুপ করি ন।"
মতিবালা আবার বলে,
"তে হামাক খালি ঢুকির দ্যাও। পাত্র টাত্র নোউক অদি। মাইক হাপসি নাগাইসে। চাইট্টা খাবে ফির।"
"ও হো রে! তোমা আসিলে না পাত্রটাও আসিবে।"
ভেতর থেকে সমস্বরে আওয়াজ এল বাইরে। এসব ছাপিয়ে একটা মোটা গলার নির্দেশ ভেসে এল,
"ওই চেংরিগিলা। উমার কাথাত ভুলেন না। উমরা সোগায় সোমান। টাকা না দিলে কোয়ারি খুলা নাই।"
দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতর থেকে বাইরেটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। ছেলের জামাইবাবু এবার নাচার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
"নোউক তে তোমার ছাওয়া বারে। হামরা পাত্রোক ধরি চলি যাছি।"
এ কথাতেও মোটেই চিঁড়ে ভিজল না। ভেতর থেকে নানারকম গান, কথা ভেসে আসতে লাগল। এবার লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়টা নোট বের করে দরজার উপর দিয়ে ধরে। কিন্তু তাদের টাকা পছন্দ না হওয়ায় আবার হাসি, কথার হল্লা ওঠে। লোকটাও একটা একটা করে টাকা বাড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা নেয় যেন। অবশেষে বিরক্ত হয়েই হয়তো দরজা খুলে দেয়। ভেতরে নারকেল পাতার সস্তার পাটির উপর সুতির চাদর পেতে বিছানা করে বর-কনেকে বসানো হল। এবার মতিবালা বড় একটা গামলায় এক গামলা চাল নিয়ে এল। তারপর বলল,
"ন্যাও, আংটি দ্যাও।"
শুরু হল আংটি খেলা। ছেলের হাতের শ্রী আংটিটা চালের গামলায় বর একবার লুকিয়ে রাখে, কনে একবার। সুকোবালা হাই তুলতে তুলতে বলে,
"হোইসে বারে। আতিয়ে ফুরাছে। পাত্র কইনাক খাবার দ্যাও। হামরা বিদায় নিমু এলা।"
বড় ঘরে বা উত্তর ঘরে বসানোর সময়ই আঁচল গিঁটটা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এখন বর-কনে, দুই বৈরাতী আর ছেলের বোনজামাইকে একসঙ্গে খেতে দেওয়া হল। খাওয়ার পরেই বিদায়ের পালা। মতিবালার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। চোখের জল আঁচলে মুছে মালতীকে নিয়ে যায় অন্যঘরে। একজন বয়স্ক মহিলা এসে ফিসফিস করে মতিবালাকে নির্দেশ দেয়,
"মাই, ছাওয়াটাক এলা উয়ার মার কোলাত দেক। বৈরাতখান এলায় ছাড়ি দিবে বলে।"
মায়ের কোলে দিতেই মালতী বুঝে যায়। ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশের মতো হয়ে যায়। ওর মা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাকি সুরে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বলে কাঁদতে শুরু করে। মালতীর মামিরা, পাড়ার কম-বেশি সব মহিলাই ওদের গোল করে ঘিরে বসে কাঁদতে থাকে। ওর বড়মামি কাঁদতে কাঁদতে সুর করে বলতে থাকে,
"আজি থাকি কায় মোক মামি করি ডেকাবে বারে। আজি হাতে তুই পর মানষি হলু মাও।"
একজন ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে,
"তোমার যে কাথা। চুপ করো বারে। বিয়াও দিলে নিজের মানষিটা পর হয়া গেল!"
সরু মোটা নানা রকমের গলায় কারো কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু কান্নার দমকে ঘরে বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
ঘরে কান্না চললেও বাইরের পরিবেশ অনেকটাই তার প্রভাবমুক্ত। উঠোনে পাটির উপর সুতি চাদর পেতে একটা বসার জায়গা করা হয়েছে। সেখানে বর, বরের মিস্তর, আর বোনজামাইকে বসিয়ে আচ্ছা করে মাথায় সর্ষের তেল মালিশ করে গায়ের ফতুয়া আর পাজামায় তেল হলুদ মাখানো হচ্ছে। মিস্তর ছেলেটা একটু লাজুক। মৃদু প্রতিবাদ করছে, মিনমিন করে,
"না দেন বারে বেশি করি। হলদির দাগলা এলায় উটিবে কে না।"
তাকে থামিয়ে জমজমাটি রঙের শাড়ি পরিহিতা এক জাঁদরেল চেহারার মহিলা হাত দুলিয়ে নাচের ভঙ্গিতে বলে,
"নে নে, হলদি মাখিলে তোরও বিয়াওখান নগদে নাগিবে বাউ। মুই ভোল বৌদি হং। এটে আসিলে দেখা পাবু।"
কথার ফাঁকে আর একজন বয়স্ক মহিলা বলে,
"উয়াক থো তো। পাত্রর বহনাইটাক বেশি করি দেক।"
বলেই আচ্ছা করে তেল হলুদ হাতে নিয়ে মুখে জামায় মাখিয়ে দেয়। জামাইবাবু এবার লাফ দিয়ে উঠে বলে,
"খালি হামাকে দেছেন, হামাকে দেছেন। পাত্রটাক না নাগান হেনা! পাত্রটা তোমার মানষি তো!"
নতুন জামাই কথা শুনে মুখ নিচু করে হাসে। এবার মালতীর মামা এগিয়ে আসে। ছেলের জামাইবাবুকে ডেকে বলে,
"বাবা হে, হাজার দুয়েক টাকার মতোন বাকি আছিল। অ্যায় যে গণি ন্যাও।"
লোকটা এবার হেসে ইতস্তত করে বলে,
"দুই হাজার নানাগে বারে। দ্যাড় হাজার দ্যাও। এলা না সাগাই হলিকে। পাঁচশ হাজার নিয়া কী আছে আর।"
তারপর টাকা নিয়ে প্রণাম করে হাতজোড় করে নিমন্ত্রণ করে,
"তে যান বাহে আজি সাঞ্জোত। আন্দোন খাবার।"
বরপক্ষ কনেপক্ষ পরস্পরকে প্রণাম প্রতি প্রণাম শেষ করে। এবার উঠোনের মাঝখানে মালতীর বাবা আর বরের বাবা পরস্পরকে একসঙ্গে প্রণাম করে। এটাই নিয়ম। কেউ বড় কেউ ছোট নয়। মালতীর দিদা একটা হাটে যাওয়ার নাইলনের ব্যাগে নিজের সাদা ধুতি গুছিয়ে মালতীর এক বান্ধবী শিবানীকে বলে,
"দে মাই। তোর কাপড়ালাও এঠে দে। দুইটা ব্যাগ করির নানাগে।"
বরযাত্রীর সবাই মোটামুটি গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। গাড়োয়ান গাড়িতে গরু জুতিয়ে অপেক্ষায়। বরপক্ষের একজন এসে উঠোনে হাঁক পাড়ে,
"আগরাটুকির কায় কায় যাবেন বারে, আইসো এদি। মুই নিগি গাড়িত বোসাং।"
মালতীর দিদা আর শিবানী বেরিয়ে এসে লোকটার সঙ্গে গাড়িতে চাপে। সমস্যা হল মালতীকে বের করবে কে! যে আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদছে তাতে একজন নয় দুজন লোক লাগবে। অবশেষে মালতীর জামাইবাবু আর বরের জামাইবাবু একসঙ্গে গিয়ে ওই ঘরটায় ঢোকে। ওদের দেখে কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। দুজনে মিলে জোর করে মায়ের কোল থেকে মালতীকে একপ্রকার জোর করে ছিনিয়ে আনে। মালতী চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। দেখে মনে হ।য় যেন এখনি দমটা বেরিয়ে যাবে।
"আস্তে বোলান গাড়িরে গাড়িয়াল
ধীরে বোলান গাড়ি
আর এক নজর দেখিয়া ন্যাং মুই
দয়াল বাপের বাড়ি
আস্তে বোলান"
গাড়ির ছইয়ের উপর মাইকটা সেট করা হয়েছে। সমস্ত কান্নাকে পেছনে ফেলে দরিয়ার সুরে বাতাস ভারী করে ধীরে ধীরে দুখানা গরুর গাড়ি গ্রামের সীমানে পেরিয়ে আরো দূরের পথে এগোতে থাকে।
.............................................................
কোয়ারি - দরজা
আও কাড়িছিত - কথা বলছিস
বৈরাতখান - বরযাত্রী
আগরাটুকি - চাল বা হলুদ গুড়র অবশিষ্টকে আগরা বলে। এখানে প্রতীক অর্থে যারা মেয়ের সঙ্গে যায় তাদের বলে।