সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

103.চায়ের নিলাম ব্যবস্থার বিধি সরলীকরণ হোক/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

102.এখনো মনে দোলা দেয় চা বলয়ের ফুটবল খেলা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

101.বাগিচার প্রান্তিক জনপদগুলির সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

100.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতিচর্চা (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

99.আদিবাসী জনজীবনের সংস্কৃতি চর্চা (প্রথম পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

98.চা বাগিচাতে গ্রুপ হাসপাতাল একান্তই জরুরি/গৌতম চক্রবর্তী

14-August,2023 - Monday ✍️ By- গৌতম চক্রবর্তী 914

ক্যারন টি গার্ডেন ( দ্বিতীয় পর্ব )/গৌতম চক্রবর্তী

ক্যারন টি গার্ডেন (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
--------------------------------------

গত সপ্তাহে ক্যারন চা বাগিচা নিয়ে লিখতে গিয়ে তুলে ধরেছি ক্যারন চা বাগিচার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। ক্যারন চা বাগিচার সহকারি ম্যানেজারের সক্রিয় সহযোগিচায় এবং এখানকার ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সাহায্যে ক্যারন চা বাগিচার অসুরদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলাম। ডুয়ার্সের অত্যন্ত সংবেদনশীল জনজাতি এই অসুর সম্প্রদায়। আজকের বাগিচা সফরে আর্য জাতির প্রতিনিধি হিসাবে কলম ধরলাম ডুয়ার্সের পিছিয়ে পড়া অত্যন্ত সংবেদনশীল অসুর জনজাতির মানুষজনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। আসলে ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা। তাতে থাকে গৌরবগাথা। পরাজিতরা মুছে যায়। হিন্দু-মিথিওলজির রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীর পাতায় রয়েছে মহান চরিত্রদের বিজয়গাথা। দেবতারা অপার্থিব মহান ব্যক্তি। অসুর বলতে অত্যাচারী ভয়ানক কিছু বোঝায়। কিন্তু অসুর শব্দের অর্থ বীর, যে যোদ্ধা। পুরাণে অসুর কোনো নিন্দাসূচক শব্দ নয়। বরং বহুবার প্রশংসাসূচক ও অভিবাদনরূপে বর্ণিত। শারদোৎসবের মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গার জয়গান। দুর্গার পদতলে মুমূর্ষু কিন্তু পেশিবহুল প্রবল এক পুরুষ আছেন। যার নাম মহিষাসুর। তিনি আসলে কে? ভয়ানক দানব? যাকে নিধন করেছিলেন দেবী? নাকি এক অসামান্য বীর? ভূমিপুত্র, রাজা? যাকে এই ধরণীর বহিরাগত সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে 'খুন' করেছিলেন? পৌরাণিক স্বর্গরাজ্য থেকে নেমে আসা যাক বাস্তবতার মর্ত্যধামে। দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল, তার বংশধর রয়েছে। ভারতবর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের আদিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই ভাবেন। ভারতবর্ষের ৪০ টি সিডিউল ট্রাইব গোষ্ঠীর মধ্যে একটা হলো 'অসুর' যারা মহিষাসুরকে নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ পূর্বপুরুষ মনে করে। তাদের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা তথ্য। লোকসংস্কৃতির গবেষক রণজিৎ দেব ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু জানতে পেরেছেন তা হল এই অসুরবংশীয় মানুষদের আবাস প্রাগজ্যোতিষপুরের আসাম রাজ্যের একটি অংশ এবং উত্তরবঙ্গের একটি অংশে।

অসুরদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত হয় মাঝেরডাবরি চা বাগিচাতে। ডুয়ার্সের চার্চ নিয়ে কাজ করার সময়। পঞ্চমী থেকেই অন্ধকার নামে আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা-বাগানে। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল লুনিস, সুরভী, গিদাররা শরত এলেই কেমন যেন মিইয়ে যায়। কাশফুলের দোলায় মনখারাপের দিন শুরু হয়। ঢাকের বোলে আগমনীর সুর উঠলেই কানে হাত চাপা দেয় সুরভী, 'আমাদের পূর্বপুরুষকে হত্যা করেছে গো! দুর্গাপুজো আমরা মানি না।' লুনিস একটু আধুনিক। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্সবের মরসুমে দুর্গাপুজোর নামে কুৎসা রটালে যদি বাবুরা রাগ করেন তাই একটু সামলে নিয়ে সে বলে, 'পুজোর চারদিন আমরা ঘরে বসে শোকপালন করি। এটাই প্রাচীন রীতি। বাপ-দাদারাও করতেন। আমরা যে অসুর গো!' মাঝেরডাবরি চা-বাগানের কুলি লুনিস অসুর। এখানকার ৭০টি পরিবারের সকলেরই পদবী অসুর। আর অসুর মানেই তারা মহিষাসুরের বংশধর, এমন ধারণাই বদ্ধমূল লুনিস, সুরভী, সুকরামদের মনে। আলিপুরদুয়ার ছাড়াও জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা, বানারহাট, ক্যারন, চালসাতেও এই অসুরদের বাস। নিজেদের অসুর-সম্প্রদায় বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ এরা। উমার বোধনে গোটা বাংলা যখন মহিষমর্দিনীর উপাসনায় ব্যস্ত, উত্তরবঙ্গের এই জনগোষ্ঠী তখন আড়াল করে রাখে নিজেদের। পরনে ওঠে সাদা থান। বাড়িঘর মুড়ে ফেলে কালো পর্দায়। উৎসবের আনন্দ দূরে ঠেলে যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয় উত্তরবঙ্গের সবকটা অসুর-গ্রাম। সেখানে ঢাকের বোল প্রবেশ করতে পারে না। আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত হয় বিষাদের সুর। 'আগে গ্রামে দুর্গাপুজোর সময় শোকগাথা পাঠ হত। এখন আর এতটা হয় না। তবে আমরা মনেপ্রাণে অসুর,' অনাবিল সহজ, সরলতায় বলে লুনিস। আরও এক অন্য শারদীয়া। ব্যতিক্রমী শারদীয়া। অসুরদের এই উৎসবকে ব্রাত্যই রেখেছে উচ্চবর্ণের সমাজ। লুনিস জানিয়েছেন, এখনও অনেকে এই সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিব্রত বোধ করেন, যুগ বদলে যাওয়ার দোহাই দেন, কিন্তু আমরা আমাদের এই প্রথার প্রতি গর্বিত।

উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় অসুর সম্প্রদায়ের একটা অংশের বাস। জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটার ক্যারন, গুরজংঝোরা বাগান, আলিপুরদুয়ার জেলার মাঝেরডাবরি, নিমতিঝোরা এবং শিলিগুড়ির নকশালবাড়ি চা-বাগানে মোট ৬০০টি অসুর পরিবার বাস করে। তার মধ্যে শুধু ক্যারন চা-বাগানেই বাস ৫০০টি অসুর পরিবারের। মূলত চা-বাগানের সাদরি ভাষা বোঝেন তাঁরা। বাংলা-হিন্দি খুব ভালো বোঝেন না। শহুরে মানুষ এড়িয়ে চলাই পছন্দ। কিন্তু যুগ, সমাজ, সংস্কার পরিবর্তিত হচ্ছে। আর তাই মাঝেরডাবরি চা-বাগানের আনন্দ অসুর বলেছিলেন, 'আমরা মহিষাসুরের বংশধর। দু'বছর আগেও দুর্গাপুজোর পঞ্চমী থেকেই নিজেদের গৃহবন্দী করে রাখতাম আমরা। এখন ছেলেমেয়েরা আর সে সব মানছে না।' একই কথা শুনলাম ক্যারন চা-বাগানের বয়োজ্যেষ্ঠ সঞ্চুরুয়া অসুরের কাছ থেকে। নিজের ভাষায় বললেন, 'এখন সময় বদলেছে। চা-বাগানের বাইরে বিভিন্ন কাজে যাচ্ছে অসুর সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা। পড়াশোনা শিখে বাগানের গণ্ডীর বাইরে বের হচ্ছে। তাই আধুনিকমনস্ক হয়ে পড়ছে।' লুইস অসুরের মতে 'প্রবীণেরা আজও দুর্গাপুজোর সময় বাড়ির বাইরে বের হন না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সব দিক থেকেই আধুনিক হচ্ছে। তাই নিজেদের দেবতাতুল্য মহিষাসুরকে অবজ্ঞা না-করেও দেবী দুর্গার মণ্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে অসুর ছেলেমেয়েরা। প্রতিমা দেখতে বের হয়। মেলাতেও যায়।' কালচিনির সমাজসেবী সাজু তালুকদারের কাছ থেকে জেনেছিলাম, 'এত দিন মহালয়া থেকেই নিজেদের গৃহবন্দী করে রাখতেন অসুররা। মহিষাসুরের বংশধর বলে দুর্গার মুখ দর্শন করতেন না তাঁরা। এখনও বৃদ্ধবৃদ্ধারা দুর্গাপুজোর সময় বাড়ি থেকে বের হন না। তবে নতুন প্রজন্ম স্কুল যাচ্ছে। সকলের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে। পুজোয় ঘুরতেও যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে নতুন প্রজন্ম।' ক্যারন চা বাগানের আট বছরের নিক্কা অসুর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। নিক্কা জানাল, গতবার পুজোয় বাবার সঙ্গে লুকসানে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিল সে। প্রসাদও খেয়েছিল।

এই 'অসুর' সম্প্রদায় বিহারের একটি জনজাতি। ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল গুলমা ও লোহারডাগা জেলায় এদের বসবাস। সেখানে তারা লোহা গলানোর কাজ করতো। মহিষাসুরের সঙ্গে এদের কোনও যোগসূত্র রয়েছে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত করতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। তবে মনে করা হয় এরা মূলত অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। অষ্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও বর্তমানে তারা আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলে থাকে। বর্তমান প্রজন্ম হিন্দি, সাদরি ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ।  ১৯৯১ এর জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে 'অসুর' সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৪৮৬৪ জন। তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মাঝেরডাবরি চা-বাগানে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো 'অসুর' সম্প্রদায়েরও একাধিক গোত্র রয়েছে। প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবজন্তুদের নামে এইসব গোত্রের নাম। যেমন-কাছুয়া (কচ্ছপ), কেরকেটা (পাখি বিশেষ), নাগ (সাপ), শিয়ার (শেয়াল), টিরকি (পাখি বিশেষ), বারোয়া (বন বেড়াল), আইল্ড (পাকাল মাছ), বাসরিয়ার (বেল) এসবই অসুর জনজাতির গোত্র। মহিষাসুরই এদের পূজ্য দেবতা। এদের আর এক গ্রামদেবতার নাম 'মহাদানিয়া'। ইতিহাসবিদরা বলেন, 'অসুর' সমাজে-অনার্য ভাব যতটা প্রকট, ঠিক ততটাই আর্য-প্রাধান্যও রয়েছে। ধারাবাহিক বিবর্তন ও আত্মীকরনের মধ্য দিয়ে 'অসুর' সমাজের একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ধর্মের বিভেদও আছে। এই সম্প্রদায় আজও উচ্চবর্ণের কাছে ব্রাত্য। তার উপর মহিষাসুরের পুজো করায় এরা অনেকটাই উপেক্ষিত। বিরল জনজাতির তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে অসুর সম্প্রদায়।

আদিকাল থেকে অসুরদের ভাষা ‘আসুরি’ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বাংলা কথ্য ভাষা বা প্রাকৃত ভাষা । অক্ষর তৈরির আগে নিজস্ব যে লিপি ছিল তা ‘কিউনিফর্ম’ অর্থাৎ ‘কিলকাক্ষর’ বলে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলার ইতিহাস’ বইতে লিখেছেন। এই আসুরি লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে ১১২০ খৃস্ট-পূর্বাব্দে ‘আসিরিয়ার টিপলাথ-পিলেসারে’ এক শিলালেখাতে। যাতে লেখা আছে – ‘হাত্তির সামনে আরাজিকির কাছে মিত্তানি মরুভুমিতে আমি লোহার তির ও বিশাল ধনুক দিয়ে ৪ টি বন্যপ্রানী মেরেছি’ ! এই আসিরিয়া দেশই হল মুল অসুর সভ্যতার আরেক নিদর্শন। আর এরাই তিন চারটি পর্যায়ে ভারতে আসে যাদেরকে ‘অ্যালপাইন’, ‘আদি নর্ডিক’ ইত্যাদি নাম দেওয়া হয়েছে। অসুরদের আদি ঈশ্বর হলেন ‘মহাদনিয়া’। মহাদনিয়াই মহাদেব বা শিব নামে পুজো পেয়ে থাকেন। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা বলেন ‘রুদ্র’ ভারতবর্ষের ‘আদি ঈশ্বর’। আর সবচেয়ে চতুর বা ছল চাতুরিতে দক্ষ ঈশ্বর হলেন ‘বিষ্ণু’ বা নারায়ণ। ইনি হলেন মুন্ডাদের ‘সিং বোঙ্গা’ । এঁর ওপর ভিত্তি করে লেখা হয় একপেশে পুরাণ, ইতিহাস, মহাকাব্য ও গীতা। আসলে ইতিহাস তো অ্যাবসল্যুট সত্য নয়। ইতিহাস একক শব্দ  নয়। প্রত্যেক কালেই কয়েকজন পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ মিলে যে সিদ্ধান্ত নেন তাই চাপিয়ে দেওয়া হয় ইতিহাস নামে। কাজেই আসুরিক ইতিহাস মিলবে সাধারন ইতিহাসের প্রচলিত কাহিনীর সঙ্গে। এই ইতিহাস পড়তে হলে ‘ঋক-বেদ’ ও পুরানের সঙ্গে আসুরিক পুরাণ কাহিনী খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। সংস্কৃত ভাষার আদি যুগে ‘অসুর’ শব্দের অর্থ ছিল ‘প্রাণবন্ত তেজদ্দীপ্ত পুরুষ’ । অসুর শব্দের উৎপত্তি ‘অস’ ধাতু থেকে যার মানে হল শক্তি, ছোড়া ও এগোনো। এই অস ধাতু থেকেই এসেছে অসি, অস্ত্র ইত্যাদি। সুপ্রাচীন কালের সুর-অসুরের লড়াই যে নিছক কাল্পনিক তা বোঝাই যায়। সমুদ্র মন্থনের পর সুর-অসুরের লড়াই ও দুর্গার মহিষাসুর বধের কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। সায়নাচার্যের মত অনুসারে অসুর জাতি সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক উন্নত ছিল। অসুর শব্দের অর্থ তিনি করেছেন ‘বলবান’, ‘প্রজ্ঞাবান’।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে অসুর গোষ্ঠীকে ‘নিষাদ’ বলা হত যার মানে করলে দাঁড়ায় ‘যাদের মধ্যে কোন খাদ নেই’ – অর্থাৎ যারা পাঁচ মিশেলি জাতি নয় । তাই খৃস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকে পাণিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ তৈরির সময়ে লিখেছিলেন ‘নিষাদপঞ্চমা পঞ্চ জনাহ’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য শূদ্র ও নিষাদকে ধরে সমাজে পঞ্চবর্ণ হয়। পরে পুরাণকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জাঁকিয়ে বসলে ‘নিষাদ’ গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে চতুর্বর্ণ ও জাতিভেদ প্রথা চালু হয়। ইতিহাস, পুরাণ, লোককথা, নৃতত্ত্বের আলোচনা যাই হোক না কেন, বাংলার ভূমিপুত্ররা মহিষাসুরকে তার স্বমহিমাতে ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট প্রায় ১৫ বছর ধরে। শুরু জলপাইগুড়ির চা বাগানে চরণ বেসরার হাত ধরে। ২০০৩-এ ভারতের নানা জায়গায় মহিষাসুরের সপক্ষে আর হিন্দুত্ববাদের বিপক্ষে এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু হয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম, ২০০৩ সাল থেকে পুরুলিয়ার ভুলুরডিতে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অসুর পূজো। দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মহিষাসুর সাহদত দিবস’ পালন করে ইতিহাসের গবেষক ছাত্রছাত্রীরা। বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং মূলনিবাসী বহুজন সমাজ নিজেদের মহিষাসুরের উত্তরসুরী বলে চিহ্নিত করে।নৃতাত্বিকদের মতে বাংলা অঞ্চলের প্রাচীণ জনগোষ্ঠী, নিষাদ, কোল, ভীল গোষ্ঠীর মানুষেরা অসুরজাতি, অনার্য। এরাই ভারতের ভূমিপুত্র। এই আদিবাসী গোষ্ঠী বিশেষত সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও সম্প্রদায়ের যুবকরা স্ত্রীলোকের সাজ-পোশাকে দাশাই নাচ করতে করতে গ্রামের পথে ভিক্ষা করে বেড়ায়। কুড়মি কোবিলা, কোড়া কোবিলা, বাউড়ি, সহিস, মুদি এইসব জাতির মধ্যেও দাশাই বা কাঠি নাচের প্রচলন রয়েছে। দুর্গা পূজোয় এই নাচকে আনন্দ উৎসবের অঙ্গ হিসেবে দেখলেও এই দাশাই নাচ দুর্গার বিরুদ্ধাচরণ করে নাচা হয়। আদিবাসী লোককথা অনুযায়ী ‘হুদুড়দুর্গা ঘোড়াসুর’ অর্থাৎ রাজা মহিষাসুর যুদ্ধে বিদেশী আর্যরমণীর হাতে পরাজিত হয়ে রাজ্যপাট হারায়। ভারতের প্রকৃত শাসক বিদেশী আর্যদের দ্বারা পরাজিত হয়ে নারীর ছদ্মবেশে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ভিক্ষান্নে তাদের জীবন চলতে থাকে। সেই ঘটনা স্মরণ করে দুর্গা তথা আর্যদের বিরুদ্ধে ‘দশাই পরব’ পালন করে ভারতের ভূমিপুত্রেরা।
মহিষাসুরের আরাধনা করেন এমন এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মুখিয়া হলেন সুষমা অসুর৷ সুষমা অসুরের বক্তব্য, “আমরা সবাই একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্মেছি৷ তাই কে অসুর আর কে দেবী, আর কে দলিত অথবা কে উচ্চবর্ণ তা নিয়ে ঝগড়া করার কোনও অর্থ হয় না৷ আমরা মনে করি, অসুর আমাদের রাজা ছিলেন আর দেবী দুর্গা তাঁকে হত্যা করেন৷ সবসময় তাঁকেই অশুভ শক্তি বলে কেন দেখানো হয় জানি না৷” সত্যিই ভারতে বেশ কিছু আদিবাসী এলাকায় ভগবানরূপে পূজিত হন মহিষাসুর৷ এই আদিবাসীরা মনে করেন, ‘সত্যি’-টা কোনওরকম ভেদাভেদ ছাড়াই সামনে আসা উচিত ৷ অসুর পূজার নিয়মাবলীর বিষয়ে সুষমা অসুর বলেন, “আমাদের কাছে মহিষাসুরের কোনও মূর্তি নেই৷ তিনি আমাদের হৃদয়ে থাকেন৷ তবে অনেক জায়গায় তাঁর মূর্তিও পুজো করা হয়৷” সুষমা অসুর এবং তাঁর আদিবাসী গোষ্ঠী ঝাড়খণ্ডের লাতেহার জেলার সখুপানি গ্রামের বাসিন্দা৷ সুষমা অসুরেরা দেবী দুর্গার পুজো করেন না৷ মহিষাসুর বধের দিন অর্থাৎ দশমী বা দশেরা অন্যরকমভাবে পালন করে অসুর সম্প্রদায়৷ দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে মহিষাসুরের দেহের যে যে জায়গা থেকে রক্তপাত হয়েছিল, অসুর সম্প্রদায়ের সব লোক দশমী বা দশেরার দিন নিজের নাভি, কান, নাক সহ নিজের শরীরের সেই সব জায়গায় তেল লাগান৷ এর পর ৯ দিন ধরে চলে শোক পালন৷ 'অসুর' বংশের সদস্য সুষমা অসুরের একটি লেখা থেকে জেনেছিলাম এক সময় খনি থেকে লোহা তোলার কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই অসুর উপজাতির সদস্যরা। তাদের কথায় 'মগধ' সাম্রাজ্যে তারা সেই কাজ করলেও কালের বিবর্তনে এখন আর তাঁরা তা করেন না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উপজাতিভুক্ত মানুষদের চা-বাগানের কাজে লাগানো হয়। সেই সময়ই অসুরদের অনেকে সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তবে, আগের থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। বর্তমানে অসুর বংশের কেউ কেউ নিজেদেরকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসছেন। যদিও নিজেদের রীতি, রেওয়াজ সবকিছুই যেমন সেদিন ছিল, তেমনই রয়েছে আজও। 

শিলাদিত্য পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় সুষমা অসুরের লেখা একটা নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ পড়তে পড়তে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরিশ্রম করে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যের জোরে বাস্তবের ওপর ভিত্তি করে পুরনো অনেক আজগুবি ধারনা বা ফ্যান্টাসি ভেঙ্গে দিয়ে আসল সত্য প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর ধরে অসুর জাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। যতই আমরা মহালয়ার সকালে ‘ইয়া দেবী’ বলে নানান অস্ত্র সামগ্রী দিয়ে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বন্দনা করি না কেন, কাল্পনিক ঐ দেবীর সত্যি কি কোন ক্ষমতা থাকে ভারতের ভূমিপুত্র অসুর জাতিকে নিকেশ করার? কাল্পনিক দেব-দেবী যতই শক্তিমান হোক না কেন, এই বাস্তব পৃথিবীতে কখনও কোন জলজ্যান্ত মানুষকে খতম করতে পারে না। অসুর জাতিকে কেউ যে নিকেশ করতে পারেনি তার বড়ো প্রমাণ হল ৬,০০০ খৃস্ট পূর্বাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত এই আট হাজার বছর ধরে একমাত্র অসুররাই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও রক্তধারা নিয়ে আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে। ম্যাস্কমুলার ও এএল ব্যাসাম ও তাদের অনুগামী কিছু শ্বেতাঙ্গ পণ্ডিত আর্যতন্ত্র বলীয়ান হয়ে যতই বোঝানোর চেষ্টা করুক দেবতাদের সঙ্গে নাকি অসুরদের লড়াই হয়েছিল, ইতিহাসের আধুনিক পাঠ সাব অল্টার্ণ অ্যাপ্রোচ কিন্তু তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। ক্যারন চা বাগান থেকে ফিরে আসার সময় ভাবছিলাম ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ ইত্যাদি আমরা মুখে বলি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচিত্রতার ধারা আমরা রক্ষা করে চলি না। নাগরিক সমাজ যখন তাদের শারদীয়া পূজায় আনন্দে মাতে, তখন মহিষাসুরের বিরুদ্ধে জয়ধ্বনি দিয়ে এবং তাকে উপলক্ষ করে ‘অসুর’ নামক একটা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বুকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ করাটা কি খুবই জরুরি? উল্লেখ্য,  আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত খেড়ওয়াল আদিবাসীর মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতির পুরুষরা ‘দাশাই নাচ’-এর ‍মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস নেয়। তাদের মহান নায়কের বীরগাথার মধ্যেই হয়তো প্রকাশিত হয় মানুষ হিসেবে তাদের নিজেদের সুগভীর বঞ্চনা ও অবহেলার ক্ষোভ।

তথ্যসূত্রঃ ১) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় - ‘বাংলার ইতিহাস’ ২) শিলাদিত্য পুজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত সুষমা অসুরের প্রতিবেদন। ৩) ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ৪) বিভিন্ন পেপার কাটিং ৫) এখন ডুয়ার্স পত্রিকা ৬) অসুর জনজাতিদের নিয়ে লেখা প্রমোদ নাথের গ্রন্থ ৭) বিমলেন্দু মজুমদারের লেখালেখির অংশবিশেষ

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri