সুকোবালার সঙ্গে মতিবালার মোটামুটি একটা সমঝোতামূলক সম্পর্ক হয়ে গেছে। এতক্ষণ একসঙ্গে দুজনে মিলে কাজ করতে করতে একটু আলাপ-পরিচয়টাও ঝালিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিক ঝগড়া আর যুদ্ধং দেহী মনোভাবটা দুজনেই ত্যাগ করেছে। অবশ্য তার কারণ বড়দের তদারকি। একবার এক বিয়েতে দুই বৈরাতীর ঝগড়ায় বরযাত্রী কনেযাত্রী পযর্ন্ত গড়িয়ে বিয়ে প্রায় ভাঙে ভাঙে। সেজন্য এবার মতিবালার উপর কড়া নির্দেশ ছিল,
"উমরা বরের বাড়ি কী কয় কোউক। কনেক সবু। উমা যে নিয়ামে কবে তে নিয়ামে বিয়াও হবে। বিয়াওখান হোইলে হোইল।"
আসলে সেদিন বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে বড় করেই আলোচনাটা হয়েছে। তাতে একজন ঠাকুর মশাইয়ের কাছে জানতেও চেয়েছে।
"তোমরায় কও তো ঠাকুর। একে নিয়াম, তাও আরো অ্যাকোঠে অ্যাকোমতোন! নাগি যায় সেলা ঝগড়া।বিয়াও বাড়িখান এখেরে কাউয়া-কাস্যাং এ সার হয়!"
পুরোহিত মহাশয় তাঁর অসমিয়া টানে স্থানীয় ভাষায় উত্তর দেন,
"বুইজলেন তো বাপু, বিয়াও হোইল দুই নিয়ামে। যর্জুবেদের নিয়ম থাকে আর কিছু দেশাচার নিয়ম। দেশাচার তো জাগায় জাগায় আলদা হবেই। হইলে গন্ডগোল নাগি যায়।"
নিয়াম একটা মানিলে হোইল। তখনই বৈরাতীকে ডেকে সবাই বুঝিয়েছে, ছোটখাট নিয়ম নিয়ে বেশি ঝামেলা করার দরকার নেই। সেজন্য মতিবালা অনেকটাই সুকোবালার বলা নিয়ম মেনে নিয়েছে, ওর মতামত দেয়নি। তাতে সুকোবালাও খুশি। সুকোবালা মতিবালার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পাশে বসা পাত্রের জামাইবাবুকে একটা কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলে,
"তোমরা আরো ক্যামন বহনাই তো! পাত্রটাক ওটাও কেনে। সেন্দুর পেন্দা হোইল এলা হোমের ওটে নিগির নাগিবে না?"
লোকটা হা হা করে হাসে। তারপর বলে,
"তোমরা না ভাউজটা আছেন! তে কোলাত করি নিগাওখেনে!"
সুকোবালা উত্তেজিত হয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে, মুখ বেঁকিয়ে হাত নাড়িয়ে ঝগড়ায় নামে,
"আয় তো রে বাউ! ক্যামোতন না পাং কোলাত নিবার। মুইয়ে তোক নিগাছোং"
কান্ড দেখে পাত্র এবার মনে মনে প্রমাদ গণে। তাড়াতাড়ি উঠতে যায়। ওর জামাইবাবু হাতটা ধরে হেসে হেসে সুখবালাকে বলে,
"ন্যাও ন্যাও, গাওখান অতবারি না ঝোকোলাইস এখেরে। হামার পাত্র একেলায় উটির পায় ঝুনি।"
রাত নিঝুম হতে থাকে। বিয়ের আসর প্রায় ফাঁকা। বাচ্চারা যেখানে সেখানে চটের উপর গড়িয়ে পড়েছে। বয়স্ক ঠাকুমা-দিদিমাদেরও একই অবস্থা। পাড়ার লোক যে যতক্ষণ পেরেছে থেকেছে, অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। রান্না হচ্ছে পাশেই মতিবালাদের বাড়ির খোলানে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় এটা সুবিধা। নইলে মালতীদের ওইটুকু বাড়িতে এতকিছু করা সম্ভব হত না। খাওয়া-দাওয়াও ওদের উঠোনে। ওখানে রাঁধুনি ক'জন ছাড়াও ঠায় বসে আছে মালতীর বড়মামা। খাওয়া-দাওয়ার পুরো আয়োজনটাই ওনার তদারকিতে হচ্ছে।
সুকোবালা মতিবালার থেকে একটু বয়সেও বড়। সেজন্য একটু দিদিভাব চলেও এসেছে ওর কথা-বার্তায়। পাত্রের জামাইবাবুকে ছেড়ে এবার মতিবালাকে বলে,
"নে মাই, একখান নিয়োজ পাতোত কলার ঝুকি একটা ওঠেয়া কোইনার হাতোত দেক।"
হোমাগ্নীর সামনে মালতীকে দাঁড় করিয়ে মতিবালা ওকে ধরে আছে। সুকোবালার কথা শুনে নিয়োজপাত আর কলার ঝুকি তুলে দেয়। পুরোহিত মহাশয় মন্ত্রপাঠ করতে থাকেন, পাত্র পেছন দিক থেকে সেই কলার ঝুকিটা ধরে থাকে, ডাক পড়ে আবার মালতীর ভাইয়ের।
নরেশের তখন ঘুম চোখ, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব কষ্ট করে জেগে আছে। মতিবালা ওর হাত দিয়ে কলার ঝুকিটায় খই দেওয়ালো। বর-কনে ঝাঁকি দিয়ে সেই খই হোমের আগুনে সমর্পণ করল, পরপর তিনবার।
"ন্যাও, এইবার কইনা-পাত্রোক বসাও এটে।"
পুরোহিতের কথামতো হোমাগ্নীর সামনে বর-কনেকে বসিয়ে দিলে পুরোহিত মহাশয় মন্ত্র পড়ে শান্তি করে দিলেন। কপালে ফোঁটা দিয়ে দিলেন। ঘন ঘন উলু দিতে থাকে সবাই। উলু আর শঙ্খের আওয়াজে অনেকেই নড়েচড়ে ওঠে। বর-কনে প্রণাম করে আবার ছায়া-মন্ডপের সামনে আসে। সুকোবালা বরকে বলে,
"নে বাউ, হাতের না আরশিখান দিয়া ন্যাকেক তো সাতটা 'চ'। একখেটানে নেকিবু।"
পুরোহিত ওখান থেকেই বলে ঔঠে,
"আটের মতোন করি ল্যাখো বারে।"
মন্ডপের সামনে এসে হাতের আরশিটা দিয়ে ইতস্ততভাবে আঁকাবাঁকা করে বর সাতটা চ লেখে। যদিও কোন ছোটবেলায় স্কুলে পড়েছে ওর এসব আর মনেই নেই। ওর লেখাগুলোর ওখানে মতিবালা সাত ভাগা পান সুপারি রাখে। ততক্ষণে মালতীর মাকে ডেকে এনেছে কেউ একজন। মালতীর মা একটা হাতপাখায় অল্প অল্প করে জল দিয়ে এগোতে থাকে, ওর সাথে সাথে আর বাকিরা সবাই বর-কনেকে নিয়ে মন্ডপ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। প্রথমবার প্রদক্ষিণের পর মতিবালা পান সুপারির কাছে এসে মালতীকে থামায়। তারপর বলে,
"তোর ডাইন ঠ্যাঙের ভুটি নেঙুলটা দিয়া গুয়া পানলাত খালি কনেক ঠেকা, নাড়িয়া যা, উয়ায় এলায় টানাবে।"
ছেলের বোনজামাই বলে ওঠে,
"এংকেরি মিলিমিশি দোনটা মানষি চলির নাগিবে এলা থাকি।"
লোকটা আসলে সারাক্ষণই বকবক করে চলেছে। পান খাওয়া মুখে হা হা হাসি চলছেই। দেখে মনে হয় রাগ বিরক্তি এক ফোঁটা নেই শরীরে। একটা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া আর ঢোলা পাজামা পরনে, পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া লালচে নেপাল জুতা বা উঁচু স্যান্ডেল। তবে সে স্যান্ডেল কোথায় যে ঢুকে আছে এখন বলা মুস্কিল। জল কাদায় যুদ্ধ করার চিহ্ন পায়ের গোড়ালি থেকে নখ পযর্ন্ত। কিন্তু মুখের হাসিটি প্রাঞ্জল।
মালতী ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে যে পান সুপারির ভাগাটা আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে পাত্রকে দিয়ে সুকোবালা সে সুপারির ভাগাটা সরিয়ে দিল। এইভাবে সাতবার সাতপাক ঘোরা হলে পুরোহিত মহাশয় মোটামুটি বিয়ে শেষ করে তার পোঁটলা-পুঁটলি গোছাতে থাকেন। বর-কনেকে একসঙ্গে জোড় বেঁধে সমাজকে প্রণাম করিয়ে ঠাকুর থানের দিকে নিয়ে যায় মতিবালা আর সুকোবালা। সুকোবালা ডাক দেয়,
"বাজনাঅলাগিলা বোদায় বেইশ এখেরে নিন পাড়েছে। ড্যাকে ওটাও তো! নিন পাইল্লে হবে! বাজের নানাগে?"
ওর কথা শুনে সবাই হাসলেও কেউ ডাকতে যায় না। আহা বেচারারা ঘুমোক একটু। জামাইবাবু বলে,
"নন, তোমরা চিন্তা না করেন। হিদি এইলা আগোত হোউকখেনে শ্যাষ। আপনে এলায় উটিয়া বাজাইতে দিশা না পাবে। আতি না পোয়াছেকে বাদে। আর যাবার টাইম হোইলকে।"
আসলে বিয়ে চলাকালীন বরযাত্রীর দল খেয়ে নিয়েছে। কেবলমাত্র যারা সারাক্ষণ বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিল তারাই এখনও খেয়ে উঠতে পারেনি। এখন বাকিটা মিটলে খাবে। মতিবালা, সুকোবালা, ছেলের বোনজামাই মিলে ঠাকুর থান তারপর গুরুজনকে প্রণাম করিয়ে বর-কনেকে নিয়ে বড় ঘরে ঢুকতে যায়। ততক্ষণে বড়ঘরে র্অথ্যাৎ যে ঘরে হর-গৌরি পুজো হয়েছে সে ঘরে মেয়েদের দলটা পুরো ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। মতিবালা এবার ছেলের বোনজামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
"ন্যাও, খিবে কাথা কোইলেন এতখান সোমায়টাত। এলা দেকিমু তো কেমন কাথা কোবার পান। চেংরিগিলাক ভেল্কি দ্যাকেয়া হামার ঢুকির বেবস্তা কর। কইনা পাত্রোক ভোক নাগাইসে বোল।"
লোকটা আর একবার হাহা হেসে বলে,
"মোক না কন বারে। অলিনের বেফার, অলিনে বুজুক। উয়ারে না শালি টালি হোবে। নে রে পাত্র, এলা তুইয়ে কাথা ক।" ভেতরে তখন গান শুরু হয়ে গেছে। সবাই গলা মিলিয়ে গান করছে একসঙ্গে। বাইরে মৃদু মৃদু হাসিতে মুখ ভরিয়ে কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পাত্রের বোনজামাই। সঙ্গে বর-কনেসহ বাদ বাকি সবাই।
...............................................................
কাউয়া কাস্যাং - ঝগড়ায় তোলপাড় হওয়া
নিয়োজ পাত - আগাটা না কেটে ফেলা আস্ত কলাপাতার প্রথম অংশ।
ভুটি নেঙুল - বুড়ো আঙুল