ক্যারণ টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
ক্যারণ টি গার্ডেন
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------
লুকশান থেকে প্রবেশ করলাম ক্যারন চা বাগানে। অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক শোভা। পাশাপাশিভাবে ততটাই সমস্যা জর্জরিত বাগান। নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারণ টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী ছিল বাসু টি প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু পরবর্তীকালে বাগানের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। তারপর থেকে বাগানটিতে সমস্যা লেগেই আছে। বাগানটি ডিবিআইটিএ এর সদস্য। বাসু টি কোম্পানি লিমিটেড ২০০৪ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে এবং বাগানটিকে ক্রমাগত ধ্বংস করে তোলে শোষণ করতে করতে। বাগানে সেই সময় মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ছিল চারজন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বর্তমানে বাগানটিতে সর্বশেষ ক্ষেত্রসমীক্ষা অনুযায়ী কোন ম্যানেজমেন্ট ক্যাডারের লোক ছিল না এবং শ্রমিক নেতৃত্ব চা বাগিচার পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিল সমবায়ের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে শেষ ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় বাগানের ম্যানেজার ছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস এবং প্রিয়ব্রত ভদ্র। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন ছিল দুটি যেগুলি হল এনইউপিডব্লিউ এবং পিটিডব্লিউইউ। ক্যারন বন্ধ হয়ে যাবার পরে নাগরাকাটা ব্লকের তৎকালীন জেলা পরিষদের মেন্টর অমরনাথ ঝায়ের উদ্যোগে মূলত ক্যারন টি এস্টেটে একজন "নতুন বিনিয়োগকারী" আসেন। তথাকথিত বিনিয়োগকারী আলিপুরদুয়ার জেলার বীরপাড়ার বাসিন্দা সম্বিত দত্ত বাগান থেকে চা কিনে তার খদ্দেরদের কাছে বিক্রি করতেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সাথে অনুষ্ঠিত আলোচনার ভিত্তিতে তিনি ক্যারণ বাগানে বিনিয়োগ করতে সম্মত হন। চুক্তি হয় শ্রমিকরা পাবে তাদের নিয়মিত মজুরি এবং বিনিময়ে চা পাতা বিক্রির আয় থেকে হবে মালিকের উপার্জন। বাগানটি পুনরায় চালু করার জন্য ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় প্রশাসনিক আধিকারিকরা উপস্থিত থাকলেও বাগানটির উন্নয়নের বিষয়ে মালিক বা তার প্রতিনিধিরা উপস্থিত হননি। ৭১৪ জন স্থায়ী কর্মী নিয়োগকারী এস্টেটটি ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে বন্ধ ছিল।
পি কে বাসু বাগানের মালিক থাকাকালীন হরিশ মুখার্জি রোড কলকাতায় ছিল কোম্পানির হেড অফিস। শেষ যখন ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছিলাম বাগানে গিয়ে তখন নিয়ে এসেছিলাম বাগিচার সামগ্রীক তথ্য। ক্যারন চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদি ক্ষেত্র ৫৯২.১ হেক্টর। প্রায় ২৮১ হেক্টর জমি সেচবিহীন। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল এবং পাশাপাশিভাবে চাষযোগ্য উৎপাদন ক্ষেত্র ছিল ৩০২.৮৬ হেক্টর। প্রায় ১১১.০১ হেক্টর অকৃষি ব্যবহারে রয়েছে। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং ড্রেন ও সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১১২৫ কেজি করে কাঁচা চা পাতা উৎপাদিত হতো। ক্যারন চা বাগিচার সাব স্টাফের সংখা ৩৫ জন এবং করণিক ৭ জন। ক্ল্যারিক্যাল ও টেকনিক্যাল স্টাফ পাঁচ জন। বাগানে বর্তমানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৫৮৬ জন এবং মোট জনসংখ্যা ৪৮১৩ জন যাদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা আছে যাদের অসুর সম্প্রদায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। তাদের একটা বৃহৎ অংশের মানুষ চা বাগানে বসবাস করেন যারা অত্যন্ত বিপর্যস্ত এবং দৈব দুর্বিপাকের মধ্যে রয়েছে। বাগিচার মোট স্থায়ী শ্রমিক ৬৫৪ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পেত। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা সর্বমোট ৫৫ জন এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১৩ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ৭৫৭ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৪০৫৬ জন। ক্যারন চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ২৭৪ টি। সেমি পাকা বাড়ি ৩১০, বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস নেই। সরকারি সহযোগিতাতে তৈরি বাড়ি ২০। মোট শ্রমিক আবাস ৬০৪। শ্রমিক সংখ্যা ৭৫৭। চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ৭-৮ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা গড়ে ২ লাখ কেজি উৎপাদিত হয়। ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে।
বাগিচায় শ্রমিক আবাসের সংখ্যা ৬০৪। মোট শ্রমিক ৭৫৭ জন। বাগানে শতকরা ৮০ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ থাকলেও সেগুলির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। শ্রমিক আবাসে আলাদা শৌচাগার থাকলেও তার ব্যাবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে। চা বাগিচায় হাসপাতাল ১টা। বহুদিন আগে বরুণ বিশ্বাস নামে অল্টারনেটিভ মেডিসিনে এমবিবিএস করা একজন ডাক্তার ছিল। সাম্প্রতিককালে আছে কিনা জানা যায় নি। প্রশিক্ষিত নার্স নেই। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ১ জন। কম্পাউন্ডার এবং স্বাস্থ্য সহযোগী ২ জন করে। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড ১ টি করে। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স নেই ২০০৪ সাল থেকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও নেই। ক্রেশের সংখ্যা ২ টি। অ্যাটেনডেন্ট ৪ জন। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব নেই, খেলার মাঠ আছে। এবারে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ক্যারনে গিয়ে কথা বললাম তৃণমূল-সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়নের নেতা অরুণ চিক বরাইকের সঙ্গে। জানলাম ২০১৯ এর এপ্রিল মাস থেকে নতুন মালিক প্রাথমিকভাবে বাগানটি যখন চালাচ্ছিলেন তখন তিনি শ্রমিকদের পি এফ তহবিল জমা করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি শুধুমাত্র মজুরি প্রদান করতে শুরু করেন, পিএফ নয়। চা বাগিচার শ্রমিক রবীন্দ্র বরাইকের কাছ থেকে জানলাম, প্রতি মাসের ৭ ও ২২ তারিখে শ্রমিকেরা মজুরি পান, কিন্তু বকেয়া মজুরি এখনও অবধি পরিশোধ করা হয়নি। ক্যারন থেকে ঘুরে আসার পরপরই শুনেছিলাম ক্যারন চা বাগানের ম্যানেজমেন্ট বাগানে কাজ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। শ্রমিকরা কিন্তু তাদের বকেয়া পাওনার জন্য চা বাগানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আশ্রয় নিয়েছিল। শ্রমিকরা কারখানার গেটের সামনে জড়ো হওয়ার সময় তারা বাগানে কাজ স্থগিত রাখার বিষয়ে একটি নোটিশ দেখতে পান। তারা বিক্ষোভ শুরু করে যা চলে বিকেল পর্যন্ত। এই সিদ্ধান্তে ৭০০ জনেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে।
ক্যারন চা বাগান জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকে অবস্থিত। এটি নাগরাকাটা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লকের অধীনে । ক্যারন চা বাগানে ৬০৭ টি বাড়িতে ২৬০৯ জন লোক বাস করে যাদের মধ্যে ১৩০০ জন মহিলা এবং ১৩০৯ জন পুরুষ।এখানে ২৩৭ জন তফসিলি জাতি রয়েছে যার মধ্যে ১১৬ জন মহিলা এবং ১২১ জন পুরুষ। এখানে ১৩৬০ জন তফসিলি উপজাতি রয়েছে যার মধ্যে ৬৭৯ জন মহিলা এবং ৬৮১ জন পুরুষ। ডুয়ার্সের চা বাগানের একটি বড় সমস্যা পানীয় জলের অভাব। উত্তরবঙ্গের ভুটান লাগোয়া বেশ কিছু অঞ্চলের চা বাগানগুলি পানীয় জলের কোনো সুবিধা না থাকায় এই বাগানগুলি ভুটানি কর্তৃপক্ষকে তাদের জলের জন্য অর্থ প্রদান করত। বান্দাপানি বাগান, ক্যারন এবং লঙ্কাপাড়ার মতো কিছু বাগান প্রতিবেশী দেশ ভুটান থেকে সরবরাহকৃত জল সংগ্রহ করত। দলমোর চা বাগানে ৬০% পরিবার কলের মাধ্যমে জল পায়, তবে বাকিদের এক কিলোমিটার বা তার বেশি যেতে হয়। ক্যারনের মহিলাদের দিনে দুবার প্রায় ১.৫ কিমি দূরে সামতসে জেলার নৈনিতালের একটি পাথরের তৈরি কূপ থেকে জল সংগ্রহ করতে হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভুটানের সামতসে জেলা কর্তৃপক্ষের একটি চিঠি পৌছায় পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার বান্দাপানি চা বাগানের অফিসে। এস্টেটের ম্যানেজারকে সম্বোধন করে চিঠিতে সামতসে জেলা কর্তৃপক্ষ ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে ভুটানের বান্দাপানি চা বাগান কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি পাঠিয়ে ভুটান থেকে সংগৃহীত জলের জন্য জল ভাড়া দাবি করে। বান্দাপানি চা বাগানে এর আগে শ্রমিকেরা ভুটান থেকে জল পাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে বন্ধ থাকা বান্দাপানি চা বাগানে ম্যানেজার এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এস্টেট ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে শ্রমিকরা একটি তহবিল গঠন করে অর্থ প্রদান করত ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত। এখন তারা আর এই টাকা জোগাড় করার মতো অবস্থায় নেই। বাগানের
বান্দাপানিই একমাত্র বাগান নয় যেটি প্রতিবেশী দেশের জলের ওপর নির্ভরশীল। ভারত ও ভুটানের সীমান্তবর্তী লঙ্কাপাড়া যার প্রায় ভোটার প্রায় ৭০০০, মাকরাপাড়া যার ভোটার ২০০০ এবং ক্যারন যার ভোতার ৩৫০০ তাদের অবস্থাও একই প্রকারের। বাগানের হিসাবরক্ষক সুরজমান তামাং, যিনি হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতেন এবং কাজ ছেড়ে যাননি তিনি আশা করেন ভুটান সহানুভূতির কারণে লাইনটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবে না। চারিদিকে হিমালয়ের পাদদেশে মনোরম পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ক্যারণ টি এস্টেটে জীবন কঠিন। এই এস্টেটের মেয়েদের জল আনতে প্রতিদিন প্রায় তিন কিমি পথ পাড়ি দিতে হয়। আন্তর্জাতিক সীমান্তে সিমেন্টের পোস্ট দিয়ে চিহ্নিত কোনো পাহারাদার নেই। বান্দাপানিতে ভুটান থেকে জল আনা পাইপলাইনটি সীমান্তের ওপারে গোমটু শহরের কাছে তিনধারে গ্রামে একটি পাহাড়ে একটি সিমেন্ট ট্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। ট্যাঙ্কটি দিয়ে ভুটানের পাহাড় থেকে জল ফিল্টার হয়ে আসে বলে পাইপলাইনের মুখ জাল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মালিকদের সাথে বিরোধের কারণে কয়েক বছর আগে ভুটানের কর্তৃপক্ষ ক্যারনের সাথে জলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। লঙ্কাপাড়া ও মাকড়াপাড়া এস্টেটেরও একই পরিণতি হয়েছে। ক্যারণের শ্রমিকেরা বছরের পর বছর সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বামফ্রন্ট সরকার সুরাহা করেনি এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রশাসন কয়েকটি হ্যান্ডপাম্প খনন করেছে যা মাত্র ৩০-৭৫ ফুট গভীর। অন্তত ২০০-২৫০ ফুট গভীরে গভীর টিউবওয়েল দরকার। ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাথে যুক্ত আরএসপির শ্রম শাখা ডুয়ার্স চা বাগান ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতা গোপাল প্রধান অভিযোগ করেন, স্থানীয় পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ যে হ্যান্ডপাম্প খনন করেছে তার জল লাল। এতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আয়রন। এটি পান করা এবং এমনকি রান্নার জন্য ব্যবহার করাও কঠিন। মালিকের অনুপস্থিতিতে বাগানটি চালানোর চেষ্টা করছিল একটি শ্রমিক সমবায়। তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট অশোক টপ্পোর কাছ থেকে জানলাম, ক্যারনে জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগ জল সরবরাহের জন্য কল স্থাপন করেছে। কিন্তু পাইপগুলি বাগানের সমস্ত অংশে পৌঁছায়নি এবং জল সরবরাহ প্রতিদিন মাত্র এক ঘন্টার মতো ছিল যা শুধুমাত্র অপর্যাপ্তই ছিল না, কিছু দিন সরবরাহ না থাকায় অনিয়মিতও ছিল।
রাস্তা থেকে চা বাগান ঢুকতেই সশস্ত্র সুরক্ষা বলের ক্যাম্প অফিস ছাড়াতেই সরু পথ ধরে হেঁটে যাওয়া একজনকে পেয়ে গেলাম। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। পথ আটকে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনার নাম কী ? এখানেই থাকেন তো?' উত্তর এল ‘ওমর অসুর, এখানে বস্তিতেই আমার বাস'। গায়ের রং বেশ কালো, চোখেমুখে অপুষ্টির ছাপ। ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে গেলাম। বাড়িতে লোকজন থাকলেও ইশারায় কাউকে বের হতে বারণ করে দিল আর আমাদের জানিইয়ে দিল সবাই বাইরে কাজে গিয়েছে। তারপর ওমর নিজেও উধাও। ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর সে দেখা দিল। তারপর ওমর অসুরই সমস্ত বস্তি ও লাইন ঘোরালো আমাদের। প্রথমে কথা বলতে না চাইলেও একটু সময় দিতেই সবাই এক এক করে এগিয়ে এলেন, কথা বললেন এবং ছবির জন্য বেশ পোজও দিলেন দলবেঁধে। তবে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে এই সখ্যতা গড়ে তুলতে। দুপুর পেরিয়ে শেষ বিকেলে আমি ও আমার দুই সঙ্গীকে নিয়ে বস্তির কচিকাঁচাদের সঙ্গে বেশ মেতে উঠলাম। সব মিলিয়ে এই গ্রামে জনা তিরিশ অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর শেষ পর্যন্ত মুখ খোলেন ওমর। জানলাম এখানকার কেউই নাকি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন না। ওমরের কথাতে, তারা দুর্গার এই অসুর না। তাদের পূর্বপুরুষরা যেখানে থাকেন সেখানকার সমাজই তাদের সমাজ। দেখলাম এখানকার একজন মেয়ে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ, নাম সেবন্তি অসুর। তাসুর জনজাতির প্রকৃত উৎস ঘাঁটলে দেখা যাবে অন্য এক বাস্তব। বরিষ্ঠ সাহিত্যিক ও গবেষক রমেন দের কাছ থেকে শুনেছিলাম, প্রায় ৬০০ বছর আগে প্রাকজ্যোতিষপুর অর্থাৎ আজকের যেটা আসাম সেখানকার রাজা ছিলেন নরকাসুর ও ঘটকাসুর। এদের বংশধররাই অসুর বলে পরিচিত। আসাম থেকে ডুয়ার্স পর্যন্ত এলাকাকে তখন বলা হত কিরাত। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য ঋকবেদেও ‘অসুর’-এর উল্লেখ আছে। উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে আর্যরা অনার্যদের পরাস্ত করে ভারতে প্রবেশ করে। ভারতের অনার্যদের তারা আখ্যা দেন ‘অসুর’ বলে।
একেবারে ভুটান সীমান্তের যে স্থানে অসুরদের বসবাস সেই জায়গাটিতে ৪৫ টি পরিবার বসবাস করে। বাড়ির মহিলারা প্রত্যেকেই বাগান শ্রমিক। পুরুষদের মধ্যে যাদের বাগানে কাজ নেই তারা পাশের নৈনিতাল ভুটানে দিনমজুরি খাটতে যায়।ক্যারন চা বাগানের অসুর সম্প্রদায় এক পাহাড়ি ঝোরাকে পাতাল গঙ্গা নামে সম্বোধন করে। তাদের নিজস্ব কুলি লাইনের মহল্লা থেকে প্রায় ৪০০ মিটার পাহাড়ি পথে পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলা এই ঝর্ণাই এখানে পানীয় জলের তৃষ্ণা মেটাতো। শুধু তাই নয়, বন্ধ এই বাগানটির অসুরেরা পানীয় জলের জন্য পাশের ভুটানের ঝোরার ওপরেও ভরসা করে থাকেন। শ্রমিক বস্তির বাসিন্দারা পানীয় জলের জন্য পাতালগঙ্গার উপরে ভরসা করে। এলাকার পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে অবশ্য বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে। বছর তিনেক আগে এখানে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর বা পিএইচই এর জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়। কয়েক কিলোমিটার দূরে জল যাতে জমিয়ে রাখা যায় সেজন্য কারি লাইনে দুটি মাঝারি ধারণ ক্ষমতার ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়। তবে সেই জল সরবরাহ ব্যবস্থা অনেক সময় অচল থাকত এবং এখনও থাকে বলে নিয়মিত জল মেলে না। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম ভৌগোলিক কারণে সব সময় এখানে জল পৌঁছায় না। আবার দুটি পাম্পের মধ্যে কোনটা বিকল হয়ে পড়লেও কারী লাইনে পিএইচইর জল সরবরাহ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। অসুর সমাজের উপদেষ্টা তথা এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা জগন্নাথ সিংকে পেয়ে গেলাম কারি লাইনেই। বললেন,সারা সপ্তাহের মধ্যে তিন দিনই জল আসে না। পিএইচ এর পাশাপাশি পঞ্চায়েত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারী লাইনে রিজার্ভার তৈরি করে দেওয়া আছে। সেই রিজার্ভারের জল খাওয়া যায় না। তাই পাহাড়ের নিচ থেকে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ঝোরার ওপর অসুরদের নির্ভর করতে হয়। কয়েক কদম এগোলে ভুটানের ঝোরাও রয়েছে। এই জল কখনো শুকায় না। ওখানে মাঝেমধ্যে যেভাবে পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে নিচে নেমে জল সংগ্রহ করতে হয় তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
( প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্বে ক্যারনের অসুর সমাজের আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কিছু দিকের কথা আলোচনা করব)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴