লুকসান টি গার্ডেন/গৌতম চক্রবর্তী
লুকসান টি গার্ডেন
গৌতম চক্রবর্তী
-----------------------
সমস্ত হাট শেডই জরাজীর্ণ। কোনোটির আবার স্রেফ কাঠামোটুকুই পড়ে রয়েছে। এর উপর অবৈধ দখলদারির জন্য হাটের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসছে। সবমিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে শতবর্ষ প্রাচীন লুকসানের সাপ্তাহিক হাট যা ডুয়ার্সের একটি অন্যতম প্রাচীন হাটও বটে। সাতটি চা বাগান ও প্রতিবেশী দেশ ভুটান মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের বিকিকিনির অন্যতম ভরসা ওই হাটটি। আজ এসেছি লুকশান চা বাগিচা ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। পরিকল্পনা ছিল শতাব্দীপ্রাচীন লুকশান হাটে যাব। স্বাধীনতারও তিন দশক আগে লুকসানের হাটটি চালু হয়। সেখানে ফি রবিবার আশপাশের চ্যাংমারি, ক্যারন, লুকসান, গ্রাসমোড়, গাঠিয়া, ধরণিপুর ও কাঁঠালধুড়া চা বাগানের শ্রমিকদের পাশাপাশি কালীখোলা, লালঝামেলা, ভুট্টাবাড়ি, ঘাসমারি ও পিটি বস্তির মতো মোট ১২টি চা বাগানের এলাকার বাসিন্দারা কেনাকাটার জন্য ভিড় জমান। এমনকি পাশের ভুটানের নৈনিতাল ও গুমৌনির মতো এলাকার বাসিন্দারাও লুকসানের হাটেই শুধু কেনাকাটা করেন না, শাকসবজি বিক্রিও করতে আসেন। ঘটনাচক্রে রবিবার এসেছি বাগিচাতে শুধুমাত্র হাট দেখার তীব্র বাসনাতে। কারণ এর আগে শনিবার মহরমের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম শুক্রবার এবং শনিবার গ্রাসমোড়, ঘাটিয়া, লুকশানে ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ম্যানেজারদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে নিয়েছিলাম। হাটের ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে জানলাম মোট ৫০টি হাট শেডের মধ্যে সেখানে ৪০টিই বহুদিন ধরেই ব্যবহারের অযোগ্য। প্রায়ই জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশেই ব্যাবসায়ীদের বসে পড়তে হয়। বৃষ্টি নামলে সেখানে হুড়োহুড়ির কারণে মাটিতেই দোকান নিয়ে বসা ব্যবসায়ীদের বহু জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। গোটা হাট চত্বরে নেই শৌচালয় কিংবা পানীয় জলের ব্যবস্থা। রবিবারের হাটের পর নরককুণ্ডে পরিণত হয়ে ওঠে এলাকা। অবাধে গোরু-ছাগল চরে বেড়ায় সেখানে। একজন মাত্র সাফাইকর্মীর পক্ষে এমন হাট পরিষ্কার রাখা দুষ্কর কাজ হয়ে ওঠে। ভাঙা হাট শেডগুলি এখন ভবঘুরেদের রাত কাটানোর জায়গা হয়ে উঠেছে।
পেয়ে গিয়েছিলাম বিগত গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য কাজি পান্ডেকে। তাঁর কাছ থেকে জানলাম যা পরিস্থিতি তাতে ব্যবসায়ীরা আর এখানে আসতে চাইছেন না। শেডগুলি যখন তখন ভেঙে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় মাটিতেই জলকাদায় মাখামাখি হয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। জায়গা দখল হতে হতে এমন অবস্থা হয়েছে হাটের ভিতর ঢোকার রাস্তাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাট সংস্কারের দাবি জানিয়ে একটি নমুনা পরিকল্পনা তৈরি করে প্রশাসনকে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তখনও কিছু হয়নি। ইংরেজ আমলের ওই হাটটির বর্তমানের হতশ্রী দশায় লুকসানে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। ডুয়ার্সের নানা স্থানের হাটগুলি নতুন করে তৈরি করার কাজ চলছে। অথচ এত পুরোনো একটি হাটের কথা সরকারি অফিসার কিংবা নেতাদের মাথায় কেন আসে না তা বোধগম্য নয় বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ ঝরে পড়ল একান্ত আলাপচারিতায়। হাট থেকে রওনা দিলাম বাগিচার দিকে। নাগরাকাটা ব্লকের লুকসান টি গার্ডেন এর পরিচালক গোষ্ঠী গিরিরাজ প্ল্যান্টেশন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। বাগানটি ডিবিআইটিএর সদস্য। বর্তমান কোম্পানি ২০০৫ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ২০০৫ সাল থেকে দীপক বেরেলিয়া, হর্ষ বেরেলিয়া, গৌরব বেরেলিয়া, সুশীল কুমার বেরেলিয়া ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হিসাবে যৌথ দায়িত্বে বাগান চালাচ্ছেন। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৯ জন। কোম্পানির মালিকের নাম নরেন্দ্র বেরেলিয়া এবং কোম্পানির ঠিকানা বেরেলিয়া কমপ্লেক্স, দো মাইল, সেবক রোড, শিলিগুড়ি। কোম্পানির হেড অফিস শিলিগুড়িতে। বাগানে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তিনটি। এগুলি হল সিবিএমইউ, পিটিডব্লিউইউ এবং এনইউপিডব্লিউ। লুকসান চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৭৪৬.৫৬ হেক্টর। এক্সটেনডেড জমির পরিমাণ ৪৯১.২২ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৪০.৩৪ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র অঞ্চল ৪৯১.২২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৭৩৩ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়।
চা বাগানের নাগরাকাটা সার্কিটের যে অঞ্চলে কাজ করলাম অসাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদ এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। এলাম চা বাগিচার শ্রমিক লাইনে। চা বাগানের শ্রমিক লাইনের বাড়িগুলি জরাজীর্ণ। সেগুলি সংস্কারের দাবিও দীর্ঘদিনের। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ক্রান্তির জনসভাতে মুখ্যমন্ত্রী জানান জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষ চা শ্রমিককে ঘর দেওয়ার প্রকল্পও রাজ্য নিয়েছে। পাট্টা থেকে পর্যটনের হাত ধরে চা বাগানের কর্মসংস্থান, ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পে শ্রমিকদের আবাসনের ঘোষণাতে শ্রমিক মহল্লায় আশা এবং খুশীর বার্তা ছড়ালেও চা বাগানের মালিক পক্ষের প্রশ্ন বাগানে দেদার পর্যটন প্রকল্প হলে তা আখেরে চা শিল্পের ক্ষতি করবে না তো? মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, চা বাগানের ভিতর পর্যটন কেন্দ্র হলে তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান হবে, হোটেল বানানো হবে, দোকান হবে। সেই সঙ্গে চা শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়া হবে। শ্রমিকদের জন্য বাগানে নিজস্ব ঘর তৈরি করবে রাজ্য সরকার। বাগানের ভিতর চা শ্রমিকদের থাকার জন্য ‘চা সুন্দরী’ নামে আবাসন প্রকল্পে বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা ‘অভিনব’। চা শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়ার প্রস্তুতি চালাচ্ছে রাজ্য সরকার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে চা বাগান মালিকদের সঙ্গে রাজ্যের বৈঠক হয়েছিল। সেখানে পাট্টা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল একাধিক চা শ্রমিক সংগঠন। একইভাবে বাগানে পর্যটনের ক্ষেত্রেও তাঁদের একই বক্তব্য। চা মালিকদের সংগঠনের জনৈক কর্তার মতে মূল সমস্যা জমির। পাট্টা হোক বা পর্যটন কেন্দ্র, চা বাগানের ভিতর তা গড়তে হলে জমি নিতে হবে। সেই জমি রাজ্য সরকারের থেকে লিজ় নিয়ে রাখা। জমির কিছুটা অংশ ফিরিয়ে দিতে হলে চা উৎপাদনে ক্ষতি হবে। যদিও মমতার ঘোষণায় চা শ্রমিকেরা উৎসাহিত।
লুকসান চা বাগিচার সাব স্টাফ ৬৬ জন। করণিক ৯ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ৬১ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৫৫০ জন এবং মোট জনসংখ্যা ৪০৫০ জন। বাগিচায় স্থায়ী শ্রমিক ৯৬৭ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল গড়ে ২০০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৬৭ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং স্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৭০ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১১৭০ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ২৮৮০ জন। লুকসান চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ১৩২ টি। অন্যান্য বাড়ি ৭০৭ টি, বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাস নেই। সরকারি সহযোগিতাতে তৈরি বাড়ি নেই। মোট শ্রমিক আবাস ৮৩৯। শ্রমিক সংখ্যা ১১৭০। বাগিচায় শতকরা ৭২ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ। ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাংক এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার গিরিরাজ প্ল্যান্টেশন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ১.৮.২০২৫। চা বাগিচায় হাসপাতাল ১টি। ডিসপেনসারিও ১ টি। বাগিচায় ডাক্তার আছে। নাম পি কে ভৌমিক। অলটারনেটিভ মেডিসিনে এমবিবিএস। প্রশিক্ষিত নার্স ১ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ২ জন। কম্পাউন্ডার অথবা স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৬ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ১ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ২ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানের অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাগিচায় ওষুধ সরবরাহ আছে। উন্নত মানের পথ্য সরবরাহ এবং নিয়মিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হয়।
শুনলাম লুকসানের শ্রমিক মহল্লায় বেঁচে থাকার জন্য ঝোরার জলই ভরসা চা বাগানের কানি লাইন নামে শ্রমিক মহল্লার বাসিন্দাদের। শুধু গৃহস্থালীর কাজের জন্যই নয়, ওই জল পান করতে হয় তাদের। প্রশাসনের কাছে বিষয়টি জানিয়েও আজ পর্যন্ত সেখানকার পানীয় জল সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। এর ফলে পেটের রোগ লেগেই রয়েছে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। দেখলাম কানি লাইনে কয়েকটা কুয়ো থাকলেও সেগুলিতে জল থাকে না অথবা থাকলেও তা পানের যোগ্য নয়। এখানে কোনও টিউবওয়েলও নেই। চড়াই উতরাই পেরিয়ে নোংরা, চলাচলের অযোগ্য একটি রাস্তা দিয়ে বাগিচার নারী পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিকেরা এবং বাগিচার বাসিন্দারা ঝোরার পানীয় জল সংগ্রহের পাশাপাশি সেখানে জামাকাপড় ধোয়, বাসন মাজে, স্নান করে বলে এই ঝোরার জল দূষিত। ঝোরার জল সংগ্রহ করতে সকাল-বিকেল লাইনে দাঁড়ান মহিলারা। মহিলা শ্রমিকদের কাছ থেকে শুনলাম তারা এই জল খান এবং তা দিয়েই রান্না করেন। সমস্যার সমাধানের জন্য কতজনকে যে অনুরোধ করা হয়েছে তার কোনও ঠিক নেই। সবাই শুধু এসে দেখে যায়। নিজের চোখে দেখলাম বর্ষাকালে ঝোরার জল আর বৃষ্টির জল মিশে যায়। তখন জল সংগ্রহে আরও বেশি সমস্যা হয়। স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিশুদের রান্নার জলেরও একমাত্র ভরসা এই ঝোরা। রাতে জলের প্রয়োজন হলে বাড়ি থেকে এই অবধি আসতে ভয় করে। এলাকায় হাতি বেরোয়। লুকসান চা বাগানেরই একটি অংশে পানীয় জলপ্রকল্পের একটি কাজ চলছে। তবে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানালেন বাগানে যে জলপ্রকল্পটি হচ্ছে সেটা কানি লাইনে করা উচিত ছিল। যে জায়গাটিকে নির্বাচন করা হয়েছে সেখান থেকে ভৌগোলিক কারণে জল এ পর্যন্ত পৌঁছাবে না বলে তাদের ধারণা। নাগরাকাটার বিডিও অফিসের সাব অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে জানলাম ওই জায়গায় এর আগে রিগবোর টিউবওয়েল তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তবে গাড়ি ঢোকার জায়গা না থাকায় কাজটি করা সম্ভব হয়নি। জানতে পারলাম পাইপ দিয়ে কানি লাইনে জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা যায় কিনা তা দেখা হচ্ছে। নয়তো অন্য কোনও পদক্ষেপ করা হবে।
লুকশান চা বাগিচাতে লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসারের নাম নিরঞ্জন প্রসাদ। ১.৬.২০১২ সালে কাজে যোগদান করেছিলেন। জানিনা এখনও আছেন কিনা। কারণ ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় ওনাকে পাওয়া যায় নি। লুকশান চা বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ১ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা এবং শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা ট্রাক আছে। বাগানে খেলার মাঠ আছে। লুকশান টি গার্ডেনে পিএফ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় নি বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে কিনা নিয়মিত তাও জানা যায় নি। মজুরী এবং বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া হয় । পিএফ বা গ্র্যাচুইটি মাঝেমাঝে বকেয়া থাকে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। শতকরা ২০ শতাংশ হারে ১০১৪ জন স্থায়ী শ্রমিককে বছরে গড়ে ৫৪ লক্ষ টাকা বোনাস হিসাবে দেওয়া হয়। ফিরে আসবার সময়ে গেলাম সুরেন্দ্রনগর এবং ধরণীপুর। এগুলো নিয়ে আর আলাদা করে ক্ষেত্রসমীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো বন্ধ এবং রুগ্ন চা বাগিচা। যেগুলি সাম্প্রতিককালে খোলার চেষ্টা চলছে। উত্তরবঙ্গে বন্ধ ও রুগ্ন চা বাগানের দুর্দশার সুরাহা করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন বেসরকারি সংস্থা বাগান চালাতে না পারলে রাজ্য তা অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু তাঁর বাগান অধিগ্রহণের ভাবনার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ আইনি জটিলতায় এর আগেও এ ধরনের উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি বেসকারি মালিকের দায় কেন জনগণের করের টাকায় রাজ্য নেবে সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন অনেকেই।
আসলে রেডব্যাঙ্ক, সুরেন্দ্রনগর এবং ধরণীপুর, ডানকান গোষ্ঠীর উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু বাগানে দীর্ঘদিন ধরেই অচলাবস্থা চলছিল। অনেক বাগান বন্ধও ছিল। বেশ কিছু বাগান নিজেদের রুগ্ন প্রমাণ করতে ‘বোর্ড ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকনস্ট্রাকশান (বিআইএফআর)-এর দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সেখানে আবেদনের নিষ্পত্তি না-হওয়ায় বাগানগুলি সম্পর্কে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। সমস্যার কথা মানলেও ডানকান গোষ্ঠীর দাবি ছিল তাদের বাগানগুলি চালু রয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর ডানকানসের বিভিন্ন বাগানের বেশ কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় শুধু চা শিল্পই নয়, বঙ্গ রাজনীতিতেও তোলপাড় শুরু হয়। রাজ্যের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কায় এ নিয়ে মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রীও। মন্ত্রিগোষ্ঠীর অভিযোগ ছিল এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইন থাকলেও তারা হাত গুটিয়ে বসে। যদিও কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক ও তার অধীন টি বোর্ডের পাল্টা যুক্তি ছিল বাগান লিজে দেয় রাজ্য। শ্রমিক কল্যাণের বিষয়গুলিও রাজ্যেরই এক্তিয়ার। কোনও বাগান তা লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে রাজ্যই। চা বাগান মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের (আইটিএ) চেয়ারপার্সন নয়নতারা পালচৌধুরী এবং সেক্রেটারি জেনারেল অরিজিৎ রাহার কাছ থেকে জানতে পারলাম উৎপাদন খরচ বেড়েছে। চা শিল্প ইদানীং কার্যত লোকসানেই চলছে। তাও বাঁচোয়া চা শিল্পকে দেওয়া পুরনো ছাড়ের মেয়াদ ২০২২-২৩ এর রাজ্য বাজেটে আরও এক বছর বাড়িয়েছে রাজ্য। গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও শিক্ষা সেস মিলিয়ে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতায় ১২ পয়সা করে গুনতে হত বাগান মালিকদের। এ ছাড়াও মুনাফায় ৩০%-৬০% কৃষি আয়কর ধার্য হত। গত তিন বছর ধরে এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ছাড় দিয়ে আসছে রাজ্য। এবার বাজেটে নতুন কোনও কর তো চাপেইনি, বরং আগামী অর্থবর্ষের জন্যও ওই সব কর ও সেস মকুবের কথা জানিয়েছে রাজ্য। রাজ্যের এই সিদ্ধান্তে বাগানগুলির খরচের বোঝা কমবে। চা শিল্পের একাংশের অবশ্য মত সামনে জিটিএ-র ভোট ছিল বলে এই ছাড় আরও এক বছর বাড়ানোর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে একটা কথা বলা যায় যে সত্যিই যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে তাহলে এর সুফল জিটিএ ভোট থেকে শুরু করে সমতলের পঞ্চায়েত ভোট স্তরে ভালোই নিয়েছে তৃণমূল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴