দু একটা হ্যারিকেন, কূপীর আলোয় চারপাশ ততটা উজ্জ্বল নয়। তার মধ্যে বিয়ে দেখার জন্য পাড়ার লোকজন আর বরযাত্রীর লোকেরা মিলে মন্ডপ ঘিরে আছে। তবে বাজনদারদের এখন আরাম। খড়ের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। গোত্রচ্ছেদন হয়ে গেলে বিয়ের পরবর্তী অংশ শুরু হয়। এই সময়টায় বৈরাতীদের ভূমিকাই বেশি। মতিবালা মালতীর ভাইকে ডাকে।
"এ বাউ। আয় তো আর কনেক। আর এখেনা কাজ করি দিয়া যা।"
মালতীর ভাই নরেশ এবার সহজে আসে না, অবিশ্বাসী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে লাজুক লাজুক ভঙ্গীতে শরীরটা বেঁকিয়ে বলে,
"না যাং মুই। ফাকোতে ডেকাবু এলায়।"
এবার অনেকেই সমস্বরে বলে,
"না হয়, না হয়। যা কেনে বাউ, ওটে কাশিয়ার গিঁটোটা তোকে খুলি দিবার নাগে।"
কাঁচুমাচু মুখে লজ্জা পেতে পেতে নরেশ এসে কোনোমতে কুশব্রাহ্মণের মতো করে বানানো কাশের গিঁটটা খুলে দিল। দিয়েই আবার দ্রুত স্বস্থানে ফিরে গেল। এবার বর-কনেকে তুলে নীচে পাটি পেতে তার উপর সুতির চাদর পেতে বসালো। মতিবালা যথারীতি ডাক দিল,
"ন্যাও বারে পাত্রের ঘর, তোমার মিস্তর ধরিবে নাকি, আইসো। কায় ধরিবে, আনো এত্তি।"
সভাস্থলে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল,
"কায় বারে মিস্তর!"
রোগা-পাতলা একটা লাজুক মতো ছেলে এসে মন্ডপে দাঁড়াল। মতিবালা বরাবরই প্রগলভ। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
"কী বারে, তোমরায় মিস্তর ধরিবেন?"
ছেলেটা লাজুক হেসে টেনে টেনে বলল,
"হ্যাঁ, নাগে বলে মোকে মিস্তর ধরির। বাচ্চা হাতে হামার মিল তো! সোকা পাথের চান্দাসি তে ওই তো সেলায় সোগায় কোইল, যার আগোত বিয়াও নাগিবে, মিস্তর ধরেন!"
মন্ডপে কলাগাছের গোড়ায় বসানো ঘট থেকে আমের পল্লব দিয়ে জল ছিটিয়ে মিস্তর ধরা পর্ব। হাসি-ঠাট্টা আর মজায় সভা ভরে উঠল। পুরোহিতও মন্ত্র পড়তে পড়তে সেসব মস্করায় যোগ দিল। বয়স্ক মানুষটাকে দেখে মনেই হচ্ছে না এত কষ্ট করে রাত জেগে বিয়ে করাচ্ছেন। পাত্রের মিস্তর সর্বপ্রথমে বিয়েতে উপহার দেবে। এটাই নিয়ম। মতিবালা বলে,
"দেখং তো কী আনিসেন তোমরা তোমার মিস্তিরানির জোইন্যে!"
তবে উপহার মন্দ নয়। ছোট্ট একটা হাতঘড়ি। হাতঘড়ি দেখে মতিবালা খুশী হয়।
"ভালে তো পছন্দ আছে তোমার। মাই হামার এলা হাতোত ঘড়ি পিন্দিবে!"
ঘড়ি দেখে অবশ্য মহিলামহলের অনেকেরই মুখ বেঁকে যায়, বিশেষত বয়স্কাদের। একজন বলেই ফেলে,
"এত ইচিত বিচিত জিনিস থাইকতে দান আইনসে একখান ঘড়ি! ঘড়ি কী পিন্দিবে! মানষি খারাপ কবে না! কোটেকার আরো দিদিমণিখান হোইল নগতে!
এটা অনেকেরই মনের কথা। তাই কেউ প্রতিবাদ করল না। কিন্তু মতিবালা ছাড়ার পাত্রী না।
"দিদিমণিগিলায় কী খালি ঘড়ি পিন্দে বারে? আইজকাল সোগায় পিন্দে। মাইর হামার পড়াশুনা আছে কনেক। ঘড়ি-টড়ি তামাল্লায় দেকির পায়।"
ওকে থামাতে তড়িঘড়ি মালতীর মামা ধমক দেয়।
"বৌমা, কাথা কনেক কম কওখেনে বারে। তোমা হুদি দেখো, বামনঠাকুর কী কয়!"
এরপর জলছিটা। এবার পুরোহিত নিজেই ডাক দিল,
"এইবার জলছিটা। পাত্রের বাড়ির জলছিটা কায় আছেন, আইসো।"
নীল তাঁতের শাড়ি পরিহিতা শ্যামলা গায়ের রঙ একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলেন। কী যে মন্ত্র পড়া হল, শোনাই গেল না ঠিকমতো। কলাগাছের গোড়ার ঘট থেকে জল নিয়ে তিনি দুজনের মাথাতেই ছিটিয়ে দিলেন। বর-কনে প্রণাম করল। এবার উনি কাঁসার থালা-বাটি গ্লাস দান দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। এবার মতিবালা নিজেই বসমতীকে ডাকল।
"এলা তোমরা আইসো মাও।"
বসমতীর জলছিটা হয়ে গেলে একটা দড়ির টুকরো বর-কনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
"বাচ্চি বাছুর এখনা দিলুং বারে। নাড়ি চাড়ি মানষি করেন। এখেরে ছোট না হয়। পরের বার আসি ধরি যান।"
জলছিটার দান দেওয়া শেষ হলে একে একে সবাই দান দিয়ে গেল। ততক্ষণে ব্রাহ্মণ যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন। মতিবালা চারদিকে তাকিয়ে ডাক দেয়,
"আর কাহো আছেন নাকি বারে দান দিবার। থাকিলে আইসো। নাহাতে হামরা এলা অইন্য কাজ করিছি।"
ছেলের বাড়ির বৈরাতী মতিবালাকে বলে,
"নাই মাই আর কাহো। টান হিলা এলা।"
বিয়ের একটা পর্ব মোটামুটি মিটল বলা যায়। এবার ছেলেপক্ষের বৈরাতী ঝলমল ঝলমল হাসিতে মুখ ভরিয়ে গা টা নাড়িয়ে, ঝাঁকিয়ে বলল,
"ন্যাও, কোটে আয়না কাঁকই, আনো তো! এইবার দেকিমু তোমার কোইনা কৈমন যত্তন করির জানে।"
মতিবালাও কম যায় না।
"অত গাও ঝকলে কাথা কোবার নানাগে। হামার মাই ভোল সবলায় পায়। তোমার চেংরাক দেকিমু।"
এরপর মতিবালা মালতীর হাতে ছোট্ট কাঠের চিরুনিটা দিয়ে নিজেই ওর হাতটা ধরে ছেলের মাথায় একটু চিরুনি ছোঁয়ায়। ওরকম করে ছেলের বাড়ির বৈরাতীও ছেলেকে দিয়ে কনের মাথায় চিরুনি করিয়ে দেয়। কেউ একজন ডাক দিল,
"মাই সুকোবালা, এলা উমার কোইনা আগোত আয়না দেকাবে সেলা বাউ।"
জানা গেল ছেলের বাড়ির বৈরাতীর নাম সুকোবালা। এসব চলতে চলতেই পুরহিত হোমের মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। সবাই প্রবল আগ্রহ নিয়ে বিয়ের এই আনন্দময় অনুষ্ঠানটি দেখছে। এবার মতিবালা মালতীকে দিয়ে ছেলের চোখে কাজল পরিয়ে দিল। সুকোবালা এবার ছেলেকে নির্দেশ দিল মেয়েকে সিঁদূর পরাতে। হোমের অগ্নীকে সাক্ষী রেখে বর এবার কনেকে সিঁদূর পরিয়ে দিল। সিঁদূর পরানোর পর শুরু হল কড়ি খেলা। মতিবালা খুব চটপটে। মালতীর হাতে কড়ি দিয়ে নিজেই ওর হাত দিয়ে প্রথম চালটা দিল। সঙ্গে সঙ্গে সুকোবালা হুমড়ি খেয়ে পড়ল,
"দেখং দেখং কয়টা সোজা কয়টা উল্টা?"
মনে মনে গুণে মতিবালা তাড়াতাড়ি কড়িগুলোকে এলোমেলো করে দিয়েই বলল,
"ছয়টা, ছয়টা।"
সুকোবালাও ছাড়ার পাত্রী না।
"মুই চাইরেখেনা দেকিলুং! কোটে হোটে ছয়টা! তোমরা এখেরে এত মিছা কাথা কন।"
ছয়টা চারটার ঝগড়া বাড়তে না দিয়ে ঘটক ওখানেই থামিয়ে দিয়ে বলে,
"নে মাই, তুই চালেকখেনে বাউক দিয়া। তোর এলায় বেশি পড়িবে!"
মিথ্যে স্তোকবাক্য! ওরও চারটাই পড়ল। কিন্তু ঝগড়া করে মতিবালা আগে আগে জিতে থাকল। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সবাই কড়িখেলাটাই বন্ধ করে দিল। যদিও তিন চার বারের বেশি এমনিতেও কড়িখেলা হয় না। অত রাতে সময় থখন ছুটছে। তবে যে যতই রাগ করুক মতিবালার মুখে মুচকি হাসি কারো নজর এড়ালো না।
সুকোবালা এমনিতেই বিরক্ত। বিরক্ত বিরক্ত গলাতেই হাঁক দিল,
"ন্যাও, শালি-টালি কায় আছেন আইসো তো। পান খোয়ালে খোয়াও, নাহালে কইনা-বরোক ওঠাছি হামরা।"
মালতীর ছোট্ট মামাতো বোনটার সাথে একদল মেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চলে এল। বোঝাই যাচ্ছে সব তৈরী হয়েই ছিল। একটা প্লেটে দুটো পান বানানো। ব্যপার দেখে সুকোবালা সাবধান হয়।
"নন তো চেংরিগিলা। পানোত তোমরা কোনো নাই দ্যান তো! হামার পাত্রোক ঝাল নাগিলে এলায় বুজেন!"
সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে,
"কোটে বারে! আইসো তো। দ্যাকো তো।"
কিন্তু পরীক্ষা করে বরের পানে লংকা পাওয়া গেলই। ধমক টমক দিয়ে সে পান পাল্টিয়ে আনা হল।
মালতীর মামাতো বোন তিনবার পান ছোঁয়ালো বর-কনেকে। শেষবার পানটা মুখ থেকে নিয়ে ফেলতে হবে। শুরু হল দর কষাকষি। পাঁচশ টাকার কমে পান ফেলানো যাবে না। অবশেষে সেটা একশ টাকায় নামল।
............................................................
বাচ্চা হাতে - ছোটবেলা থেকেই
হুদি - ওদিকে
বাচ্চি বাছুর - মেয়ে বাছুর