পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৫০
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নগ্গন গিঁটো
"ছায়া মন্ডপটা তো ভালে বানাইসে। কায় বানাইসে বারে?"
এক
বয়স্ক বরযাত্রী মহিলা কলার ঢোনা কেটে ফুল টুল গুঁজে যত্ন করে বানানো
মন্ডপটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে। ভেতরের আল্পনাটিও প্রশংসনীয়। কাগজ কেটে
ছাপ বানিয়ে আল্পনাটা করেছে আসলে। জিজ্ঞেস করলেও বৃদ্ধা অবশ্য উত্তরের
অপেক্ষা না করেই বলে,
"হামার সোমায় তো অ্যাত ঢক করি কুনোদিনো বানায় নাই। এলা এখেরে নয়া নচক দেখির নাগে বারে।"
মতিবালা হাসতে হাসতে বলে,
"হামারে এত্তিকার চেংরালা বানাইসে বারে। ঢক নাগেছে না! তে তোমরা কায় হন তে পাত্রর?"
বুড়িটা মতিবালার দিকে তাকিয়ে হাসে। ছোট্ট লাল গামছায় বাঁধা পান-গুয়ার টোপলা খুলতে খুলতে বলে,
"আবো হং বারে। তোমরা বৈরাতী কোইনার বাড়ির।"
তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে,
"এএ আসিরে না চালুং। হর মাইটা হামার ছাড়ে না। নাতির বিয়াও কয়ঝোনে
দেখিবার পাঋ। যা দেকি আইসেক। মোর হেটে শরীলে চলে না। তাও আসিলুং!"
পুরোহিত মহাশয় হাঁক দেয়,
"কোটে কোইনার বাড়ির বৈরাতী। কোইনার বাপোক ড্যাকে আনো। কায় সম্প্রদান করিবে?"
"বাবায় না করিবে! উমার বংশোত আর বড় কাহোয় নাই।"
মতিবালা
ডাকার আগেই মালতীর বাপ এসে পিঁড়িতে বসে। এবার ছেলের বাড়ির বৈরাতীর ডাক পড়ে
ছেলেকে নিয়ে আসার জন্য। ছেলের বাড়ির বৈরাতীও বেশ চটপটে আর মুখরা বোঝাই
যাচ্ছে। সে আবার হাঁক পাড়ে,
"ওটে পাত্রর বোইনাটা কুন কামোত আচে। পাত্রর বগলোত বসি নোইলে হোবে?আইসো এত্তি পাত্রক ধরি।
শুরু
হয় পঞ্চ দেবতা ও যজ্ঞেশ্বরের পূজা। বরকে এনে মালতীর বাবার ডান দিকে বসানো
হয়। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে পূজা শেষ হলে মেয়ের বাবা ছেলেকে
প্রথমে বিস্তর দান করবে। বিস্তর হল বিছানা-পত্র। একটা সস্তার নারকেল পাতার
পাটি, একটা সুতির চাদর আর দুটো বালিস। এরপর সম্প্রদানের বাসনগুলো একটা একটা
করে দেওয়া হলে পুরোহিতের নির্দেশে মালতীর বাবা টোপরটা ছেলের মাথায় তিনবার
ছুঁইয়ে পরিয়ে দিল। বরযাত্রী কনেযাত্রী মিলেমিশে মন দিয়ে সবাই এখন বিয়ে
দেখছে। তার মধ্যেই ছেলের পিসি এসে কাঁসার থালা-বাটি-গ্লাসগুলো হাতে নিয়ে
একটু পরখ করে দেখল কাঁসাটা খাঁটি কিনা। মুখরা মতিবালা বিদ্রুপের ছলে বলল,
"অত না দ্যাখেন বারে। না নাড়িয়াও না দেকা যাছে হুলা ভরোট কাঁসা নোহায়।"
সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলা গায়ের রঙ, রোগা-পাতলা দেখতে ছেলের বাড়িল বৈরাতী গা টা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল,
"না দেকিমু তে কী! দেকি না নিলে হোবে। খারাপ দিয়াও পরে সেলা কবেন ভালে না দিসি।"
ঝগড়া
লাগার উপক্রম হতেই দুই পক্ষের বড়রা দুদিক থেকে ধমকে বিষয়টা সামলে নেয়।
কিন্তু ছেলের পিসির মুখ কালোই থেকে গেল। এদিকে ততক্ষণে ব্রাহ্মণ বরণ শেষে
বিয়ের পরের পর্বে ঠাকুর মশাই ঢুকে পড়েছেন। মেয়েকে মন্ডপে আনানো হয়ে গেছে।
মতিবালা ঝগড়া করতে করতেই মালতীকে গিয়ে ধরে। মন্ডপে কনে আসার পর মাঝখানে
একটা বিছানার চাদর ধরে দুই পক্ষ মিলে পরস্পরের দিকে খই ছিটাতে থাকে।
মতিবালা ফিসফিস করে বলে,
"খইলাত ধান আর পাতান বেশি করি দ্যাও। ঝগড়িগিলার গা'ত নাগুক কনেক বিষ্যি।"
মালতীর
এমনি শরীর দুর্বল লাগছে। ও আর কতটুকু ছিটাচ্ছে, ওকে একপাক করে ঘুরিয়েই
মতিবালা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মহা উৎসাহে যুদ্ধে নেমে পড়েছে। ছেলের বাড়িও কম
যায় না। ওরা খইয়ের সাথে চাল মিশিয়ে এনেছে, যাতে ছিটালে গায়ে খুব লাগে।
এইভাবেই সাতপাক ঘোরানো শেষ হলে শুভদৃষ্টির আয়োজন। ছেলের বাড়ির বৈরাতী
জিজ্ঞেস করল,
"এলা কী করিমু বারে, মালা বদল না শুভদৃষ্টি?"
পুরোহিত বলে,
"মুই না জানোং। মালা বদল করিবার পান, শুভ দৃষ্টিও করিবার পান।"
তবে
মাথার উপরটা কাপড়ে ঢেকে শুভ দৃষ্টিটা হয়ে গেল। তারপর মালাবদল। তিনবার করে
দুজনের মালা বদল হল। মতিবালা এবার মালতীকে নিয়ে এসে মালতীর বাবা আর বরের
মাঝখানে বসায়। প্রথমে মালতীকে বসানো হল পশ্চিমদিকে মুখ করে। ওভাবে তিনবার
ফুল দেওয়ার পর ওকে পূর্বদিকে মুখ করে ঘুরিয়ে বসালো। সারাদিনের না খাওয়া আর
সমানে কাঁদার ফলে মালতী খুব দুর্বল হয়ে কেমন নেতিয়ে আছে। মতিবালা ওকে অবশ্য
ধরে রেখেছে আর আস্তে আস্তে বলে যাচ্ছে,
"মাই, ভয় না খাইস। হামরা আছি সোগায়।"
মালতী কিছু বলে না। সারাদিন কাঁদার ফলে এখন চোখও শুকনো। পুরোহিত হাঁক দিলেন,
"আংটি আনো।"
বসার আসর থেকে কেউ একজন জোরে ডাক দিল,
"ছিরি আংটিটা আনো বারে।"
কলার
পাতা দিয়ে একটা মুখবন্ধ পাতিলের ভেতর পাতলা গড়নের একটা আংটি, উপরে একটা
লাল পাথর বসানো। বরের নাম জানা গেল সুবাস। বরের সঙ্গে থাকা সম্ভবত বরের
জামাইবাবু বরকে নির্দেশ দিল,
"নে সুবাস, হাতটা ঢুকাতো এদি হাঁড়িটাত। আংটিটা বাকরে আন।"
আংটি বেরিয়ে এলে এবার নির্দেশ হল,
"পিন্দেক তো। হাতোত দেক। হচে না বড় হয়?"
সামান্য বড়ই হল আংটিটা। বৈরাতী বিশেষজ্ঞর মতো একটু নেড়েচেড়ে দেখে নিদান দিল,
"হবে, একিনা বড় চলিবে। সুতা পল্টেয়া পিন্দিস কয়দিন। আপনে না মোটা হবু। বিয়ার জন পড়িলে কুত্তিকার দেহা কুত্তি যাবে এলায়!"
পুরোহিত হাঁক দিল,
"কোটে, বৈরাতী কোটে গেল, কনেক জোগার টোগার দ্যাও। এইবার কোইন্যা সম্প্রদান হবে।"
সম্প্রদানের
বাসনপত্র থেকে একটা গ্লাস বের কেরে এনে বর-কনের মাঝখানে রেখে কুশ-ব্রাহ্মণ
দ্বারা বর-কনের হাত বেঁধে দেওয়া হল। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে
কন্যার পিতা বসলেন সম্প্রদান করতে। মতিবালা তাকিয়ে দেখল মালথীর বাবার চোখ
লাল। ভেতরের কান্নাটা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মালতীর ভাইকে ডেকে আনা
হল। মতিবালা দেখিয়ে দিতে লাগল,
"নে বাউ, তোর
দিদির ওন্নাখান আর তোর বোনুর পাঁচরাখানোত গিঁটো দেক। শক্ত করি বান্দি দিস
ঝুনি খুলে না। নগ্গন গিঁটোটায় হোইল আসল।"
মুখ কাঁচুমাচু করে লজ্জায় মাথা নিচু করে কোনোমতে একটা গিঁট দিয়েই ছুট।
"কোটে বারে ঠাকুর। আইসো এলা। তোমার গানখান কর।"
বরের জামাইবাবু হাসতে হাসতে বলে,
"আর না আইসেন তে কও। কোইনার ভাইটায় না আছে।"
তারপর মালতীর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
"কী বাউ, পালালুকে যে। তোর আরো এখেনা কাম বাকি আছে, আয় আরো এদি কনেক।"
বোকাসোকা মালতীর ভাই কথা না বুঝে আসতে যাচ্ছিল। ওকে টেনে আটকে রাখে ওর থেকে একটু বড় একটা ছেলে।
"হোউর, তোর না হয়, নাপিতের কাজ। তুই এখেরে কোনোয় বুজিন্না!"
ততক্ষণে
রামদেও ঠাকুর এসে গৌরবচন পড়া শুরু করে দিয়েছে অবশ্য। গরীবের বিয়ে। রামদেও
একটা মোটা টাকা মুখে দাবী করলেও অল্পতেই মানল, হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে
গেল। পুরোহিত মশাই এবার মালতীর বাবাকে বললেন,
"বেটিক তোমরা কী দিবেন এলা দ্যাও যৌতুক। গোত্রচ্ছেদন করি দ্যাও এলা।
মালতীর বাবা কম্পিত হাথে কয়েকটা কাঁচা টাকা তুলে দেয় মেয়ের হাতে। তারপর
গোত্রচ্ছেদন করে দেয়। ভেতরে ভেতরে বুকটা কষ্টে মুচড়ে ওঠে। চারদিকে সভার
উদ্দেশ্যে প্রণাম করে মালতীর বাবা ধীরে ধীরে আসন থেকে উঠে বাড়ির দিকে চলে
যায়। একজন বয়স্ক মহিলা সঙ্গে সঙ্গে যাঋ। বাড়ির ভেতরে এসে মালতীর বাবা মাথায়
হাত দিয়ে এবার অন্ধকার বারান্দাটায় ধপ করে বসে কেঁদে ফেলে।
.............................................................
নয়া নচক - নিত্য নতুন
আবো - দিদা
পাতান - নষ্ট ধান
বাকরে আন - বের করে আন