গ্রাসমোড় চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
গ্রাসমোড় চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
আজ নাগরাকাটা ছাড়িয়ে গ্রাসমোড়ের দিকে চলেছি। গত সপ্তাহে নাগরাকাটার বেশ কয়েকটি বাগিচা ক্ষেত্রসমীক্ষা করে আসার পর এই সপ্তাহের ডেস্টিনেশন গ্রাসমোর হয়ে ক্যারণ, লুকশান, চ্যাংমারি। তারপর সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর হয়ে লালঝামেলা বস্তি, সবশেষে রেডব্যাঙ্ক এবং ডায়না। দুইদিনের সফরে অনেককটা বাগান সার্ভে করতে হবে। নাগরাকাটা ছাড়াবার পর নামলাম গ্রাসমোড় চা বাগিচার মোড়ে। গ্রাসমোড় চা বাগিচার ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়াতে চায়ের সুবাস ভেসে আসে। প্রবেশ করি গ্রাসমোর চা বাগিচার ফ্যাক্টরিতে। গ্রাসমোরের উল্টোদিক দিয়ে ঘাটিয়া এবং লুকশান যাওয়া যায়। গ্রাসমোর টি এস্টেট মোড় থেকে একটা টোটো নিয়ে এলাম ঘাটিয়াতে। একদিন এইসব স্থান ছিল শুনশান। মুষ্টিমেয় জনসংখ্যার জন্য চা বাগানে একদিকে যেমন শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছিল, অন্যদিকে চা বাগিচার অফিসে কাজ করার মত শিক্ষিত এবং দক্ষ কর্মচারীর অভাব ছিল। ঠিকাদারের মাধ্যমে বিহার থেকে উপজাতি শ্রমিক সংগ্রহ করা হতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। কারণ ধরেই নেওয়া হয়েছিল তৎকালীন ডুয়ার্সের নরকতূল্য এবং বৈচিত্র্যহীন আবহাওয়ার সঙ্গে এরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে না। তাছাড়া বন থেকে সংগৃহীত সম্পদ তারা দক্ষিণ পশ্চিমের জনপদে বিক্রি করত। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় আর্থ-সামাজিক অবস্থা। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর আগমন উপজাতিদের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা নিজস্ব জমিজমা নিতান্ত স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে পাড়ি জমায় অন্য এলাকায়। বর্তমানে তাদের অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর পরিচয় আমরা পাই বামনডাঙ্গার কাছে তন্ডুগ্রামে। আধুনিক নাগরিক সভ্যতার আগমন এদের কাছে দেখা দিয়েছিল সর্বনাশা রূপে। গাঠিয়ার পাশেই লুকশান চা বাগিচা। জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের গ্রাসমোর টি গার্ডেন এর পরিচালক গোষ্ঠী অ্যারিহ্যান্ট প্ল্যান্টেশন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। বাগানটি টাই এর সদস্য।
বোর্ডে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা পরিচালক হলেন সুরেশ কুমার আগরওয়াল যিনি ২০ অক্টোবর ২০১৪ তে নিযুক্ত হন। সুরেশ কুমার আগরওয়াল ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে বোর্ডে রয়েছেন। অতি সম্প্রতি নিযুক্ত পরিচালক হলেন অমর খেমকা, যিনি ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সালে নিযুক্ত হন। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তিনটি। এগুলি হল এনইউপিডব্লিউ, সিবিএমইউ, এবং পিটিডব্লিউইউ। গ্রাসমোর চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৭৬৬.২৫ হেক্টর। এক্সটেনডেড জমির পরিমাণ ৪ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৩৬ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র অঞ্চল ৫২৯.৩৯ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ২২০০ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চা বাগানে নিজস্ব চা পাতা উৎপাদনের গড় ৪০ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ৮-৯ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে কাঁচা পাতা সংগৃহিত হয় না। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত চা ৮-৯ লাখ কেজি। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। গ্রাসমোড় চা বাগিচার স্টাফ সংখ্যা ৫৯ জন। করণিক ১৪ জন। ক্ল্যারিক্যাল ও টেকনিক্যাল স্টাফ ১৮ জন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১২২৬ জন। মোট জনসংখ্যা ৬৭৯৯ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১১৩৪ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৪১ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং স্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩২ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১২৬৯ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৫৫৩০ জন।
গ্রাসমোড় চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ২৪৫ টি। সেমি পাকা বাড়ি ১৫২, অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ৭৩। মোট শ্রমিক আবাস ৪৭০। বাগিচায় শতকরা ৩৭ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। চা বাগিচায় একটি ছোট হাসপাতালে মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৪ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৪ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ২ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ১ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানের পাশে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করা হয়। ২০১১ সাল থেকে বাগিচাতে ট্রেন্ড নার্স নেই। একজন করে মিড ওয়াইভস এবং কম্পাউন্ডার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ১ টি, অস্থায়ী ক্ৰেশের সংখ্যা ১ টি। ক্রেশে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব, খেলার মাঠ আছে। গ্রাসমোড় টি গার্ডেনে নিয়মিত পিএফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে কিনা সেই তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে ম্যানেজমেন্ট। বাগিচার ওয়েব সাইট থেকেও কোন তথ্য পাই নি। গড়ে ৫০ জন শ্রমিক বাবদ প্রায় ৬ লাখ টাকা গ্র্যাচুইটি প্রদান করা হয়। তবে মাঝেমাঝে গ্রাচুইটি বকেয়া থাকে বলে অভিযোগ আছে শ্রমিকদের। শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। ১৬-২০ শতাংশ হারে গ্রাসমোড় চা বাগিচাতে বোনাস দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে বোনাসের সময় ছোটখাটো সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা মিটে যায়। আজকে গ্রাসমোর, ঘাটিয়া, লুকশান, ক্যারন, রেডব্যাঙ্ক, চ্যাংমারি, ধরণীপুর, সুরেন্দ্রনগর বাগানগুলিকে নিয়ে আমার উপলব্ধিতে আসা আর্থ-সামাজিক কিছু পরিবর্তন নিয়ে কলম ধরলাম।
২০১৯ সালেও ওদের পিঠের ব্যাগে অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোলের বই ছিল না। বরং শুকনো পাতা আর টুকরো টাকরা জ্বালানি কাঠের অপ্রত্যাশিত ভিড় ছিল। যে কোনও দিন বিকেলের দিকে জঙ্গল লাগোয়া গ্রাসমোড়ের কাঠালধুরা এলাকায় গেলেই ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। শুকনো পাতা, গাছের ডালপালা ভর্তি বোঝা নিয়ে বাড়ি ফিরে চলেছে। তখন আমার শালাবাবু কাঠালধুরা চা বাগিচার ম্যানেজার। সেই সময়ে কথা বলেছিলাম ওখানকার স্কুলপড়ূয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। করোনার কোপে দীর্ঘদিন স্কুলে যাওয়ার পালা ছিল না। স্কুল ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাসের সেই শুরু। ভোরের আলো ফুটতেই ওরা পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। বেশিরভাগই জঙ্গলে জ্বালানি কাঠ কুড়োতে যেত। কেউ কেউ আবার মাঠেঘাটে গিয়ে বাবা-মাকে চাষের কাজে সাহায্য করত, কেউ বা গবাদি পশুর প্রতিপালন। সাত আট বছর বয়স থেকে এইভাবে কাঁচা পাতা ওদের হাতে এনে দিচ্ছে কাঁচা টাকা। এই প্রবণতা এখনও অধিকাংশ চা শ্রমিক পরিবারের বাচ্চাদের। নাগরাকাটা বানারহাটের চা বাগিচা অধ্যুষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদের পঠন পাঠনের এই হল সামগ্রীক চিত্র। প্রাথমিকের খুদে পড়ুয়ারাও একেবারেই পিছিয়ে পড়েছে। বিশেষত চা বাগান অধ্যুষিত এবং প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়াদের সমস্যাটাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেই খুঁজে পেলাম আলো। নাগরাকাটা বানারহাট বেল্টে কাজ করছি চা বাগিচা অধ্যুষিত সবুজ গালিচায়। ডায়না চা বাগানে দেখা হল মণিকা ছেত্রীর সঙ্গে। বাবা মারা গিয়েছেন। মা চা বাগানের সাধারণ শ্রমিক। বহুদিন ধরেই সংসারে অভাবের চোখরাঙানি। মণিকা ডরায়নি। উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সাংবাদিক নাগরাকাটার শুভজিতের লেখা থেকে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছিলাম। গ্রাসমোর, লুকশান, ক্যারণ, রেডব্যাঙ্ক, ধরণীপুর, ডায়না বাগানে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে করতে পেলাম মণিকাকে।
বানারহাট বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও বানারহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ভালোভাবে উচ্চ মাধ্যমিকের পর ২০১৫ সালে বীরপাড়া কলেজ থেকে সমাজবিদ্যায় অনার্স। প্রচুর প্রতিকূলতা সামলে ২০১৭ সালে ৫৯ শতাংশ নম্বর নিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রুরাল ডেভেলপমেন্টে মাস্টার্স। দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে রৌপ্যপদক প্রাপ্তি। বাড়িতে ফেরার পর জীবনে নতুন মোড়। ছোটরা এমনিতে দুষ্টু। বেশিরভাগ পড়াশোনার থেকে হুটোপুটিতেই ঝোঁক। কিন্তু মজার ছলে পড়ানোর জেরে হুটোপুটি বন্ধ করে বইখাতাতেই মন দেয় চা বাগিচার বাচ্চাগুলো। মণিকার তত্বাবধানে করোনার পরবর্তী সময়কাল থেকে নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে ব্যস্ত ছিল তারা সেটা নিজের চোখে দেখে এসেছিলাম। বানারহাটের ডায়না চা বাগানের মণিকা ছেত্রী রুরাল ডেভেলপমেন্টে নিজে সুশিক্ষিত হওয়ায় শিক্ষার মর্মটা ভালোমতোই বুঝত বলে শিক্ষাকে নিজের মধ্যে বন্দি না রেখে অন্তত পাঁচটি বাগানে ছড়িয়ে দেবার কাজে সচেষ্ট ছিল। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও তাঁর শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে খুদেরা সেই অভাব অনেকটাই ভুলেছে। প্রাথমিকের পড়ুয়াদের নিয়ে নিখরচায় বিশেষ কোচিং শুরু। সেটি এখন নিয়মিত পাঠশালায় বদলে গিয়েছে। মানব পাচার রুখতেও মণিকার ভূমিকা নিয়মিতভাবে প্রশংসা কুড়োয়। মণিকাকে ‘রোল মডেল' করে এই বাগানেরই বেশ কিছু যুবক-যুবতী জীবনে সফল হওয়ার রসদ খুঁজে পেয়েছে। বর্তমানে নাগরাকাটা বানারহাট সার্কিটের যে বেল্টে কাজ করছি সেটা অত্যন্ত সেনসিটিভ বেল্ট এবং লেখালখির প্রচুর রসদ আর আছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির অনেক অজানা এবং অনুল্লেখিত ইতিহাস। মণিকার মত দারিদ্র্যের মধ্যেও ভালো কাজ করার স্পৃহা যে অনেকের মধ্যেই আছে তার খবর কতজন রাখে?
অন্ধকারের মধ্যেই পাওয়া যায় আলো। সবই কি কেবলমাত্র কালো? বন্ধ চা বাগানের হাইস্কুলের পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ কোচিং শিবির চালু করেছিল জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন। ‘শিক্ষার পরশ’ নামে সেই প্রকল্পে যুক্ত ছিলাম আমিও প্রায় দ্বি-মাসাধিককাল জুড়ে। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট চা বাগান বিশেষজ্ঞ রাম অবতার শর্মার প্রতিক্রিয়া ছিল পড়ুয়াদের কাছে মাস্টারমশাইরা ছুটে যাচ্ছেন এমনটা চা বাগানের প্রেক্ষাপটে আগে কখনো দেখা যায় নি। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বাগানে গিয়ে নিয়মিত পাঠ দিতাম আমরা সরকারি স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা। ঠিক সেইরকমভাবে সিদ্ধান্ত হয় স্কুলের আগে কিংবা ছুটির পর মাসে ন্যূনতম কুড়ি দিন করে মাতৃভাষা, ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং অংক এই চারটি বিষয়ের ওপর কোচিং করানো হবে কোন বন্ধ বাগানে। ছয় বছর ধরে বন্ধ থাকা ধরণীপুরে চালু হয়েছিল কোচিং শিবির। পড়াতে যেতেন লুকসানের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্মারক বাংলা হিন্দি হাইস্কুলের মাস্টারমশাইরা। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে নিবিড়ভাবে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছিল। পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে শুরু হলেও তার সাফল্য দেখে অন্যান্য বন্ধ বা রুগ্ন চা বাগানে এই প্রজেক্ট চালু করা হবে বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু হায়! মাধ্যমিকে জলপাইগুড়ি জেলা শেষের দিকের স্থানে। চা বাগিচা বেল্টে শিক্ষার বহুবিধ সমস্যা। অথচ সরকারি স্তরে কোন পরিকল্পিত প্রয়াস নেই। যদি বাগিচাতে সামাজিক কাজ করা মণিকাদের সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য মাসোহারা বা একটা টকেন ইনসেনটিভ দেওয়া যেত তাহলে মণিকাদের মত প্রচুর ছেলেমেয়েরা যাদের কিছু করার আগ্রহ রয়েছে তারা অনুপ্রাণিত হত। জানিনা সরকার বাহাদুর এই বিষয়ে চিন্তা করবেন কিনা।
এলাম গ্রাসমোড়ের শ্রমিক লাইনে। মাঝখানে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল গ্রাসমোড়। এখন অবশ্য নতুন মালিকের তত্বাবধানে আবার চলছে বাগান। অপুষ্টি এবং দারিদ্র্যের শিকার হয়ে শ্রমিক এবং তাদের সন্তানদের কঙ্কালসার চেহারা। অনটন আর রক্তাল্পতা তাদের নিত্যসঙ্গী। অনেক সময় রেশন কার্ড থাকলেও খাদ্যসামগ্রী পান না শ্রমিকরা। হাজিরার কাজ করলে তবেই হাঁড়ি চড়ে। একথা ভাবলে কষ্টে বুক ফেটে যায় যে রাজ্য সরকার নাকি চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য “জয় জোহার” প্রকল্প চালু করেছে। বাগানের একজন শ্রমিকও সেই সুবিধা পায়নি। গীতাঞ্জলি প্রকল্প, বাংলার আবাস যোজনা সহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ঘরগুলিও চা-বাগানের কাউকে দেওয়া হয় না। কি নিঃসীম দারিদ্র্য। অথচ তার মধ্যেই সরলতা মাখা হাসিমুখ।এখানেই পেলাম একটি তথ্য। জানলাম অজ্ঞাতকারণে সিদ্ধ চালের বদলে চা বাগান শ্রমিকদের রেশনের যে চাল দেওয়া হয় সেটা আতপ চাল। ডিলারকে বারবার আতপ চাল দিতে মানা করা হলেও তিনি কেন শুনছেন না সেটা নিয়েও ছিল সাতপালা গান। আতপ চাল দিয়ে হাঁড়িয়া তৈরি করে বাগানের উঠতি প্রজন্মের একাংশ সেই হাঁড়িয়া খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সরকারি বরাদ্দ অনুযায়ী বাগানে বরাদ্দকৃত রেশন সামগ্রী আতপ এবং সেদ্ধ চাল মিলিয়ে মিশিয়েই বিলি করা হয়ে থাকে। তবে কথা বলে জেনেছিলাম স্থানীয় মিলগুলোতে আতপ চালের উৎপাদনের পরিমাণ বেশি বলেই আতপ চাল দেওয়া হয়। আর তার সুযোগ নিয়ে হাঁড়িয়ার নেশাতে বুঁদ হয়ে থাকছে উঠতি প্রজন্মের একাংশ। চা বাগান এলাকার কাঠালধুরা শ্রমিক লাইনের বাসিন্দা নারায়ণ ওরাওঁ বানারহাটের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্কুলে পড়াশুনা করে। ওর কাছ থেকে জানলাম সারাদিনে যা রোজগার হয় তার বেশিরভাগ চোলাইয়ের পেছনেই ব্যয় করে পুরুষ শ্রমিকেরা।
অত্যধিক চোলাই খাওয়ার জন্য নেশাগ্রস্ত অবস্থাতে পরিবারের বউ বাচ্চাকে মারধর করতেও কোনও দ্বিধা করে না শ্রমিক পরিবারের লোকেরা। চোলাইয়ের নেশায় বাড়িতে এসে অশান্তি করে। এভাবে চোলাইয়ের নেশায় বহু পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। চা বাগানের এলাকার ঘরে ঘরে চোলাইয়ের ঠেক চলছে। চোলাই খেয়ে এলাকার বহু মানুষ সারাদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকছে। ফলে পারিবারিক অশান্তিও বেড়ে গিয়েছে। তাই চোলাই বন্ধ করার জন্য এলাকার মহিলারা উঠে পড়ে লেগেছে। মণিকাদের মত বাগিচার অনেক শিক্ষিত মেয়ে বউরা পথ দেখাচ্ছে। খুব কষ্ট লেগেছিল যখন স্থানীয় স্কুল পড়ুয়া মনীষা ওরাওঁ এর কাছ থেকে জানলাম তার বাবা সবসময় নেশায় ডুবে থাকেন৷ কাজে যান না। মদের টাকার জন্য বাড়ির চাল, গম, আটা, বাসনপত্র পর্যন্ত বিক্রি করে দেন। এজন্য তার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে পড়েছে। ঘাটিয়া চা বাগিচার বাসিন্দা মেরি ওরাওঁ সরাসরি অভিযোগ করে জানালো চোলাইয়ের জন্য সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে। স্বামী সারাক্ষণ মদে ডুবে থাকেন। চোলাই বিক্রি বন্ধ করার কথা বললেই স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মেরির কাছ থেকে জানলাম গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে এখন চোলাইয়ের ব্যবসা শুরু হয়েছে। চোলাই খেয়ে গ্রামের বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লেও নেশা করা ছাড়তে চান না। এদিকে দিনদিন চোলাই বিক্রি বেড়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের আর্থিক অভাবকেই দায়ী করেছেন আরেক বাসিন্দা উর্মিলা মুন্ডা। তিনি বলেন এলাকার বেশিরভাগ বাসিন্দা বাগানের অস্থায়ী কর্মী। স্বল্প মজুরিতে তাদের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা চোলাই বিক্রি করছেন। এর ফলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কমবয়সি যুবকরা চোলাইয়ের শিকার হচ্ছে। দ্রুত প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রামে চোলাই বিক্রি বন্ধের দাবি তুলেছেন এলাকাবাসী।
বিধানসভা নির্বাচনের বেশ কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের চা শিল্প নিয়ে শ্রম দপ্তরের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে উত্তরবঙ্গ তথা রাজ্যের চা শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন। উত্তরবঙ্গে বন্ধ চা বাগান ক'টা আছে, করোনা আবহে চা বাগানগুলির কী অবস্থা, শ্রমিকরা কেমন আছেন, সরকারি বিভিন্ন ভাতা, প্রকল্পের সুবিধা শ্রমিকেরা কি রকম পাচ্ছে, বন্ধ চা বাগান খোলার বিষয়ে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এই সমস্ত বিষয়ে শ্রম দপ্তরের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক চা শিল্পের অবস্থা নিয়ে খোঁজখবর করে মুখ্যমন্ত্রীকে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। তখন জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি জেলার রায়পুর, রেডব্যাংক, ধরণীপুর, সুরেন্দ্রনগর, মানাবাড়ি চা বাগানের প্রায় চার হাজারের কিছু বেশি এবং আলিপুরদুয়ারের কালচিনি, রায়মাটাং, তোর্ষা, বান্দাপানি, ঢেকলাপাড়া, মুজনাই, বীরপাড়ার বন্ধ চা বাগানগুলিতে ৪৫৩৭ জন স্থায়ী নথিভুক্ত শ্রমিক আছেন যারা ফাওলই এর অধীনে মাসিক দেড় হাজার টাকা পায়। তখন জলপাইগুড়ি জেলায় বন্ধ চা বাগানের মধ্যে রেডব্যাংক চা বাগানে ৬৫৫ জন, সুরেন্দ্রনগরে ২৩১ জন, ধরণিপুরে ৩৭৭ জন এবং মানাবাড়ি চা বাগানে ২১৩ জন শ্রমিক অর্থাৎ মোট ১৪৭৬ জন স্থায়ী শ্রমিক ফাওলই পেতেন। আলিপুরদুয়ার জেলার বন্ধ বান্দাপানি চা বাগানের ২০০০ জন, ঢেকলাপাড়ার ৩৪০ এবং মধু চা বাগানের ৭২১ জন ফাওলই পেতেন। তৃণমূলের তরাই-ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের জেলার কার্যনির্বাহী সভাপতি স্বপন সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বন্ধ রায়পুর চা বাগানের ১২০০ শ্রমিকের ফাওলইয়ের জন্য ফর্ম ফিল আপ শুরু হবে। আসলে চায়ের শুখা মরশুমে আশপাশের অন্য বাগানে অস্থায়ী ভিত্তিতেও কাজ জোটে না বন্ধ এবং রুগ্ন বাগিচা শ্রমিকদের।
আয়ের আর কোনও সংস্থান না থাকায় তাই যাতে বিপাকে না পড়ে বন্ধ বাগানের শ্রমিকরা তাই রাজ্যের তরফে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে মাসে দেড় হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। কিন্তু মাঝেমাঝেই বন্ধ থাকে ফাওলাইয়ের টাকা। আবার চা শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বকেয়া ফাওলইয়ের দেড় হাজার টাকা করে জমা হয়ে যায়। চা শ্রমিকদের যৌথ সংগঠন জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম আহ্বায়ক জিয়াউল আলমের দাবি ছিল ২০১০ সালের পর থেকে ফাওলই এর পরিমাণে কোনও বৃদ্ধি করা হয়নি। দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে সেটা মাসিক ৭ হাজার টাকা করতে হবে। চা বাগান তৃণমূল কংগ্রেস মজদুর ইউনিয়নের সহ সভাপতি বাবলু মুখোপাধ্যায়ও জানিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই শ্রম দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। অথচ উত্তরবঙ্গে লোকসভা আসনগুলিতে কেন্দ্রীয় শাসক দল এবং বিধানসভা আসনগুলিতে রাজ্যের শাসক দল ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সুখে স্বচ্ছন্দে সংসার করছে। মাদারিহাট এর বিধায়ক কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের সৈনিক। অথচ বাগান না খোলার ফলে না খেয়ে মরার মত পরিস্থিতি শ্রমিকদের। তবে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সাম্প্রতিককালে রেডব্যাঙ্ক, বান্দাপানি, ধরণীপুর, মানাবাড়ি, সুরেন্দ্রনগর, মধু খুলে গেছে বা খোলার চেষ্টা জারি আছে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴