সানিয়া-৫/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
সানিয়া/পর্ব-পাঁচ
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^^
সানিয়াকে
পাঁজা কোলে তুলে নেয় ভগলু কাকা। হই হই করতে করতে ট্যাপরা, গজেন, ল্যাপারা
প্রতিমার মত করে তাকে নিয়ে আসে শোবার ঘরে। বাশের চাংরির উপর বসিয়ে ভাতের
থালাটা সামনে এনে দিল গজেন। হাতে জল ঢেলে দিচ্ছে ল্যাপা। কি হচ্ছে এসব
চারপাশে? সে যা দেখছে সত্যি তো? মিথ্যে হয়ে যাবে না তো ভোরের স্বপ্নের মত?
মিটিমিটি চোখে বড় বড় পলক ফেলে পরীক্ষা করে নেয় সানিয়া। তার পাশে দাঁড়িয়ে
রয়েছে তিন মৈষাল। তাকিয়ে রয়েছে তার দিকেই। সানিয়ার দু’চোখ বেয়ে ঝরে পরা
সুখের নদী দুটি শুকিয়ে গেছে একটু আগেই। যন্ত্রনাক্লিষ্ট কচি হাতটা লজ্জা
পেয়ে বারেবারেই মুছে ফেলার চেষ্টা করছে দুই নদীরেখা। একটু স্নেহের পরশ যে
ভরা নদীকে এভাবে থামিয়ে দিতে পারে; জানা ছিল না মৈষাল বন্ধুদের।
সানিয়ার
অস্বস্তি হচ্ছিল। বুঝতে পারে মৈষালরা। তারা সানিয়াকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে
গিয়ে যে যার মত মহিষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। মৈষালরা সরতেই ভাতের থালাটা হাতে
নিয়ে সানিয়া চলে আসে রাজা-রাণীর কাছে। ডিমের ঝোল মাখা বাকী ভাতটুকু
রাজা-রাণীকে দিয়ে থালা হাতে ছোটে তিস্তার দিকে। পাড় ঘেঁষে পরে রয়েছে
পেল্লাই এক শালের খুঁটি। আধডোবা খুটির উপর বসে সে তিস্তাকে সুখের খবর
শোনায়। আনন্দে কাটা আঙুলটাই সে ডুবিয়ে দেয় ঠান্ডা জলে। ব্যাথায় শরীর শিউরে
উঠলেও সে ব্যাথা সইবার শক্তি রয়েছে তার। এই শক্তি আজ জুগিয়েছে মৈষালদের
ভালোবাসা । এক মুঠ বালি তুলে সে থালা ঘষে চলে। আনন্দে সে আজ আত্মহারা। জলে
পা দুলিয়ে দুলিয়ে সে তার আনন্দের খবর পৌঁছে দিতে চায় বাবার কাছে,
ভাই-বোনের কাছে। মা তো নেই। মরে গেছে অনেকদিন আগে। সে আর ফিরে আসবে না।
তবুও মায়ের কথা খুব মনে পরছে। খুব ইচ্ছে করছে মায়ের আদর খেতে। কিন্তু ওই
আকাশ থেকে মা আর ফিরবে কি করে?
তেলমারো,
বানাহার, ডুগডুগি, গারাল, রাইতচরাদের সে দেখে প্রতিদিন। ওদের এক এক জনের
এক এক রকম সংসার। কেউ অলস আবার কেউ ভীষণ পরিশ্রমী। এক এক জন ওড়ে আবার এক এক
রকম করে। তবে চকোয়ার ওড়ার ভঙ্গীমাটাই সানিয়ার বেশী পছন্দের। জল ছিটিয়ে পত
পত করে কেমন করে উড়ে যায় আকাশে। ধনুকের মত বাঁক খেতে খেতে মেঘের মধ্যে ঢুকে
পরে। ভগলু কাকা বলেছে ওরা নাকি অনেক দূর থেকে উড়ে আসে। উড়ে আসে ভীনদেশ
থেকে। আবার চলেও যাবে শীত পেরোলে। নদীর মাছে ছোট্ট একটি বালিচরে গুটিকয়েক
চকোয়া হেটে হেটে বেড়াচ্ছে। কতরকম ডাক তাদের। ওদের ভাষা বোঝেনা সানিয়া। তাই
সে আওয়াজ সুখের না দুখের বুঝবে কি করে? তবে ওদের মত হতে চায় সানিয়া। ওদের
মতই ডানায় ভর করে উড়তে চায়। সেও যদি নাথুয়ার ঘরে গিয়ে এভাবেই দিনেদিনেই
ফিরে আসতে পারতো তবে কতই না ভালো হতো।
মাথার
উপর সূর্যটা বলে দেয় বাথানে বিকেলের দুধ দোয়াবার সময় হয়েছে। এ সময় পরুদের
সামলে রাখতে হবে তাকেই। তাই আর দেরী না করে সে চলে আসে পরুর ঘরে। মৈষালরা
চিতি, মাঞ্জন, বড়মাঈ, ছোটমাঈ বলে একে একে ডেকে নিচ্ছে মায়েদের। চিতি বলে
ডাকবার সাথে সাথেই সানিয়াও চিতিকে দরজার বাঁশ তুলে বের করে দেয়। বাথানের
মহিষদের মায়ের নাম ও তার ছেলে মেয়ের নাম একই রাখা হয়। এত্ত মহিষ ও তাদের
আলাদা আলাদা নাম এখনও মুখস্ত হয়নি সানিয়ার। তাইতো মাঞ্জনের ডাক পড়লে এগিয়ে
দেয় বড়মাঈকে। মাঞ্জন তেড়ে আসে বড়মাঈ-এর দিকে। সে কেনই বা দুধ খাওয়াবে
অন্যের মেয়েকে? ভয় পায় সানিয়া। এ ভয় মৈষালের গালি খাবার। কিন্তু গতকালের মত
আজ আর তাকে গালি খেতে হয়না। বিন্দুমাত্র তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেনা তাকে
মৈষালেরা। বাবা-মায়ের মত ভালোবাসা মাখা নির্দেশ কানে আসে তার।
-সানিয়ারে,
ম্যালা দিনতো হইল। এলাও ভঁইষ চিনিবার পারিলো না। এইলা না শিখিলে চলিবে?
আরো মেলা কাম তোক শিখিবার নাগিবে। তোর নেঙ্গুলটা ঠিক আছে তো রে? অসুবিধা
হোলে চলি যা। কনেক জিরা ঘরত বসিয়া। আজি আর তোক কাম করিবার নানায়।
আন্ধারু মৈষাল এসে পরুর ঘরের দায়িত্ব নিয়ে সানিয়াকে বলে,
-যা তুই যা ঘরে।
হঠাৎ
করে কোন যাদুবলে আশপাশের সবকিছু বদলে গেলো বুঝে উঠতে পারেনা সানিয়া।
মৈষালদের থেকে এমন ব্যবহার সে পাবে তা একটি বারের জন্যও মনে আসেনি। ঘরের
বিছানায় এসে শুয়ে পরে সানিয়া। চড়ুইগুলি তার বিছানা নোংরা করে চলে গেছে
তাদের নিজের বাসায়। বাঁধা মুরগি দুটি ডিম পেরেছে বালির ভেতর। পাখনা দিয়ে কত
যত্নেই না তারা সেটাকে ঢেকে রেখেছে। ওরা জানে একটু পড়েই দুটি রাক্ষুসে হাত
এসে ডিম দুটি কেড়ে নেবে তাদের থেকে। তবুও শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পদটুকু কেই
বা না আগলে রাখতে চায়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴