শূন্য আমি পূর্ণ আমি/৫
শূন্য আমি পূর্ণ আমি
পর্ব : ৫
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^
এক মায়ের কথা বলতে বলতে আর এক মায়ের কথা মনে এল। তিনি শ্যামা মা। প্রচ্ছন্নে আমার জীবন পরিবর্তনে তিনি ছিলেন এবং আছেন কি! আমার নতুন কবিতার বইয়ের নাম 'প্লাস্টিক পলিটিক্স ও আমার শ্যামাসঙ্গীত'। আমি আমার জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠি! জেনকিন্স স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বন্ধুরা মিলে স্কুলে যাই, পথে নিউ সিনেমা হল। বড় বড় পোস্টার দারা সিং কিং কং রাজেন্দ্র কুমার দেবানন্দ ...! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোস্টার দেখতাম। হলের দরোজা খুলে রাখত, দেখতাম। ব্যস্ নেশা ধরে গেল। ২০ পয়সা হলেই হলের গেটম্যান, নাইট শো। তখন পড়াশুনার জন্য একটা আলাদা ঘর পেয়েছিলাম। ৮:৩০ হলে মন মানে না। ঘরের বাইরে একটা মোম দেশলাই রেখে ছুট সিনেমা হলে। রাত বারোটা ফেরার পথে ঝড় বৃষ্টি ভূত তবু ঢিসুম ঢিসুম নেশা। তোর্ষা নদীর পাড়ে সেগুলির অনুকরণ। শরীরে বেশ ক' জায়গায় ছুরিকাঘাত। না জানিয়ে সলতে পুড়িয়ে ঘা সারানো। মা জানেন না। আমি বখে গেলাম। সংসার চলে না আর আমি ২০ পয়সা খরচ করে যাচ্ছি। রেজাল্ট খারাপ হল অষ্টমে। আর এক রাতে বারোটায় ফিরে রান্নাঘর খুলে মোম জ্বালিয়ে মায়ের ঢাকা দেওয়া ভাত সবে মুখে তুলেছি, বাবা এলেন। আগেই বলেছি বাবা বাড়িতে খড়ম পরতেন সেটা বৈলা অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুল আটকানোর কাঠের গুটলি। বাবা রেগে গেলে ওটাই পিঠে ভাঙেন, আবার পুরোহিত বলে আরো পেয়ে যান। এবার পিঠে ক ঘা দিয়ে বলতে থাকেন - "সিনেমা দেখা! কয় ছটাক পড়েছ? আরো যাবি?" না না, সেদিন আর খাওয়া হল না। মা কাঁদলেন।
... মা, বড় কম সময় পেয়েছি তোমাকে। কত সকালে উঠতেন মা। সকলে ওঠার আগে উঠোন ঝাঁট গোবরছড়া। আমরা উঠিনি, পাখিরা উঠেছে, বুলবুলি দোয়েল শিষ দিয়েছে আমি শুনিনি, জবা ফুলের কলি সূর্যের সামনে মেলে ধরেছে আমি দেখিনি। মা ডেকে যাচ্ছেন আমি ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি। মা স্নান সেরে রুটি বানিয়ে ঝোলাগুড় মাখিয়ে বিছানার কাছে এসেছেন। এক লাফ দিয়ে উঠেছি। আজ সকাল দেখি, ব্রেকফাস্ট করি কিন্তু সেই সকাল আসে না - মা আর ঝোলাগুড় রুটি।
বাবার মার খেয়েও প্রতিজ্ঞা করতে পারলাম না যে আর সিনেমা দেখব না। বরং সিনেমা দেখার ভাবনা পাল্টাল। সিনেমা দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করি কাহিনি কার লেখা। ততদিনে পড়ার বইয়ের মাঝে স্বপনকুমার। আর একটা সিনেমা গুমনাম। এরকম কাহিনী লিখতে হবে। মনে মনে বাবাকে বলেছিলাম "দেখো আমিও সিনেমা বানাব।"
কথা রাখতে পারিনি তবে পৌঁছেছিলাম টালিগঞ্জ। অঞ্জন চৌধুরী থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বারান্তরে বলব। সিনেমা দেখব কাহিনি লিখব কিন্তু পয়সা! কপাল ভালো অষ্টমে উঠেই টিউশনি। যাকে পড়াতে শুরু করলাম অর্থ পেতাম না চুল কাটা হত!
তবে ব্যবসা করতে হবে। চাল কিনে বিক্রি সবজি বিক্রি। সাতজনের সংসার বাবার মাইনেতে কুলোয় না! সংসারে সাহায্য হবে আমার সিনেমা দেখাও হবে।
ইংরেজী প্রবাদটাই কি সত্যি! মানুষ ভাবে এক ভগবান ভেবে রাখেন আর এক! একটা সাইকেল ভাড়া নিয়ে শুকটাবাড়ি কলাকাটা হাওড়াহাট। চাল কেনা সবজি কেনা। তারপর বৌবাজারে বিক্রি করা। ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত। কিন্তু ঐ যে বিধাতা ঠিক করে রেখেছেন অন্য কিছু। ৭১এ এশিয়ায় মুক্তি সূর্য। পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থ শংকর রায়। আন্তঃজেলা কর্ডনি়ং ।কে যে নিল আমার চাল আজো জানি না। শুধু পুলিশের ভয়ে পালিয়েছিলাম। সেই পুলিশ ধরল আরো ছোট সময়ে। ভারত চীন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নকশাল আন্দোলন শুরু। চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা কারা যেন খাতা কেড়ে নিল! নবমে হিউম্যানিটিজ ব্লক। রাতারাতি কচুপাতা দিয়ে রাঙিয়েছে মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিন স্টালিন হো চি মিন মাও সেতুং। একটা সিনেমা এসেছিল 'হকিকৎ', চীন ভারত যুদ্ধ - হলে বোম পড়ল। ধরপাকড়।
জীবনের কিছু কথা জলে ভাসিয়ে দিই। মা বলতেন কুকথা জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। আর এক মা তিনি কালীমাতা। আমাদের গৃহদেবী। মা ঘট বসিয়েছেন। যাকে বলেছি - সেদিন তো না খেয়ে ইস্কুলে গেলাম পায়ে জুতো নেই মাথায় ছাতা নেই কচু পাতা। তুমি তো দেখেছ। স্কুল ড্রেস ভিজে গেল আমি মা মা করে কান্না। "তুই কোথায় ছিলি শ্যামা? সেদিন তুই কি রমা নাম ধরে এলি, হাত ধরে নিয়ে গেলি, মাথা মুছিয়ে আসন পেতে অন্ন দিলি আলুসেদ্ধ ফেনা ভাত, পরম মমতায় মাথায় হাত?" সেদিন থেকেই ভেতরে আমার বাউলগান। বুঝেছি পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন শেখাচ্ছ, শেখাচ্ছ ভয়ের চর পেরোলেই আলোকভূমি! তোমার ইচ্ছেয় সবজিওয়ালা থেকে শিক্ষক আমি! 'ইচ্ছেময়ী তারা তুমি/চতুরঙ্গে তুমিই অন্তর্যামী।'
সকাল থেকেই মা উপোস থেকে মাটি ছেনে প্রদীপ বানাতেন। আমাদের দীপান্বিতা। ভাষার আগ্রাসনে দিওয়ালি। আমরা ভাইরা ছোট ছোট দুটো কলাগাছ জোগাড় করে বাড়ির সামনে গেট বানিয়ে পুঁতে দিতাম। বাঁশের বেড়া, সেই বাঁশের বাতা কেটে কলাগাছে লাগিয়ে তার ওপর মাটির প্রদীপ।এই আমাদের দীপাবলি। বাজি পটকা কোথায় পাব! জর্দার কৌটা আর কার্বাইড।দশ পয়সাতেই হয়ে যেত। জর্দার কৌটোর পেছনে ফুটো করে কার্বাইড ভেতরে রেখে থু থু দিয়ে ঝাঁকাতে হত। তারপর পাটকাঠি দিয়ে সেই ফুটোয় আগুন দিলেই বুম। আমাদের হাততালি। এই আমাদের দিওয়ালি।
পাঠক শুভ দীপাবলি। এক গুচ্ছ শুভেচ্ছা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴