ট্রায়াল
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে নিতাইদের। এটা অবশ্য রীতি হয়ে গেছে স্কুলে। মিড ডে মিলের দিদিদের সকালে মুরগি টা কিনে দিয়ে গেছে নিতাই। স্কুল আজ পাঁচ পিরিয়ডের পর ছুটি হয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। নিরিবিলিতে ছেলেদের খাওয়ানো যাবে। বেশি কিছু না। ডাল ভাত ভাজা আর মুরগির ঝোল। প্রতিবার এটাই মেনু থাকে। শুধু মুরগির খরচটা চ্যাম্পিয়ন দলের কোচদের বহন করতে হয়। খেতে খেতে ছেলেরা খেলার মুহূর্তগুলো ফিরিয়ে আনছিল। জেতার আনন্দটাকে টেনে যতটা বাড়ানো যায় আর কি। মিহির, নিতাই সুবীর দিলীপ দাও মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছিল। খেতে খেতে শুভঙ্কর জিজ্ঞেস করল -" স্যার, স্কুল টিমের ট্রায়াল কবে হবে?" প্রশ্ন টা সুবীরের জন্য। -" সামনের সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যাবে। খবর পাঠান হবে। তোরা কেউ ট্রায়ালে আসবি নাকি রে? " তিনজন হাত তুলল - গৌরাঙ্গ, শাজাহান আর শুভঙ্কর।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি স্কুল ভিত্তিক টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে যায়। জোন পর্যায়, জেলা পর্যায়, রাজ্য পর্যায় - তিন ধাপে টুর্নামেন্ট টা চলে। বীর নগর স্কুল আর কোন দলগত খেলায় অংশ গ্রহন করে না বলে, এই টুর্নামেন্টকেই পাখির চোখ করেছে দিলীপ। এখনো পর্যন্ত স্কুলের সেরা পারফরমেন্স - জেলা পর্যায়ে সেমিতে পৌঁছনো। ওই টুর্নামেন্টের কথা মাথায় রেখেই হাউস ভিত্তিক টুর্ণামেন্টটা চালু হয়েছিল। টুর্নামেন্ট চলাকালীন ই পারফরমেন্স দেখে মোটামুটি স্কুল টিমের জন্য প্লেয়ার বাছাই হয়ে যায়। বাকি ঝাড়াই বাছাই ট্রায়াল এ করা হয়। এই সময় দম ফেলার সময় পায়না সুবীর। হাউসের খেলার পরের সপ্তাহেই ট্রায়াল। সিলেকশনের পর ফাইনাল টিম নিয়ে টানা দুই সপ্তাহ কঠোর অনুশীলন। তারপর টুর্নামেন্ট।
খাওয়া দাওয়ার পর সুবীরকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে মিহির বলল -" দেখিস, যদি সম্ভব হয়, এবার শুভঙ্করকে টিমে রাখিস। ছেলেটার মশলা নাই কিন্তু আগুন আছে।" সুবীর সায় দিল -"হ্যাঁ স্যার, টুর্নামেন্ট এ ওর খেলা দেখলাম তো। দারুন পরিশ্রম করতে পারে। আমার ও ওকে দলে রাখার ইচ্ছা।"
ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে। ট্রায়ালটা খুব সিরিয়াসলি করা হয়। প্রতিটা প্লেয়ারের ফুটবলে যা যা প্রয়োজন সব আলাদা ভাবে পরখ করে নেওয়া হয় - রিসিভিং, পাসিং, ড্রিবলিং, হেডিং, শুটিং, কন্ট্রোল, স্পিড, স্ট্যামিনা, স্ট্রেন্থ........ সওওব আলাদা আলাদা ভাবে দেখা হয়। তারপর ম্যাচ সিচুয়েশন এ ফেলে দেখা হয়। এবার জনা পঁচিশেক ছেলে এসেছে ট্রায়াল এ। এদের মধ্যে ষোল জন বেছে নিতে হবে। সুকান্ত, গোবিন্দ, হরিশংকর টুর্নামেন্ট এ কাঁপিয়ে দিলেও ট্রায়াল এ আসেনি- ওরাও জানে শুধু গায়ের জোরে বড়জোর স্কুল টুর্নামেন্ট এ বাজি মারা যায়!
ট্রায়াল চলছে। মিহিরের নজর শুভঙ্করের ওপর। ছেলেটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু…., ট্রায়াল এ চান্স পাবে কি? ওই দিনের পর দেবজিত দিন সাতেক স্কুলে আসেনি। কিন্তু ট্রায়াল শুরুর প্রথম দিনই চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন হিসেবে ওর ওপরেই দিলীপ দা দায়িত্ব দিয়েছেন ট্রায়াল কন্ডাক্ট করার জন্য।
চূড়ান্ত টিম বাছাই এর কাজ প্রায় শেষ। পনের জন সিলেক্টেড। বাকি একজনের জন্য লড়াই বিকাশ আর শুভঙ্করের মধ্যে। দিলীপ দা ও দ্বিধায় পড়ে গেছেন। বিকাশের স্কিলের তুলনা হয়না। কিন্তু বয়স আর চেহারা দুটোতেই বড্ড ছোট। ম্যাচে কিন্তু ওখানেই মার খেয়ে যাবে। আগামীবার থেকে বিকাশ অটোমেটিক চয়েস - এটা অবশ্য এখুনি বলে দেওয়া যায়। শুভঙ্করের আবার শুধু ফুটবল টাই নাই। বাকি সব আছে। সুবীর ও বুঝতে পারছে না, কোনটা ভালো হবে। শেষ পর্যন্ত টিম ক্যাপ্টেন দেবজিত কে ডেকে পাঠানো হল। ক্যাপ্টেন হিসেবে ওর মতামত নেওয়া উচিত- বিশেষতঃ মাঠে যখন দেবজিত কেই খেলতে হবে।
দেবজিত মাটির দিকে চেয়ে আছে। দিলীপ দা বললেন -"কি রে, দেবজিত বল। তুই টিমের ক্যাপ্টেন, এই সিদ্ধান্তটা পুরো তোর উপরে।" লজ্জা পেয়ে দেবজিত বলল -"সার, আপনারাই ঠিক করে নেন।" দিলীপদা -" আচ্ছা, তুই তোর পছন্দ বল। তারপর না হয় আমরা সিদ্ধান্ত নেব।"
-"সার, শুভঙ্কর তো বুটে কোনদিন খেলেই নি। তাছাড়া সার, বিকাশের পাশে মাঝমাঠে অঞ্চলের খেলায় খেলেছি। আমার খেলা ও বুঝতে পারে।" এটুকু বলেই দেবজিত আবার মাটিতে চোখ নামাল।
একে একে সিলেক্টেড প্লেয়ারদের নাম ঘোষণা হয়ে গেল। ষোলতম খেলোয়াড়ের নাম ঘোষণার আগে পর্যন্তও শুভঙ্কর তীব্র আগ্রহে কান খাড়া করে সুবীরের দিকে চেয়ে ছিল। চোখের পলক পর্যন্ত একবারের জন্য পড়েনি। বিকাশের নাম ঘোষণা হতেই ও চোখ নামাল।
পরদিন স্কুলে গিয়ে শুভঙ্করের খোঁজ নিল মিহির। শুভঙ্কর স্কুলে আসেনি।
অনুশীলন পুরো দমে শুরু হয়ে গেছে। ফুটবলারদের পাশাপাশি এথলিট রাও প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছে। ডিসেম্বরে জোনাল এথলেটিক মিট হয়। তাই ফুটবলারদের সাথে এথলিট দেরও এই সময় ডেকে নেওয়া হয়। আর কিছু না হোক শরীরের আড় তো ভাঙবে। ফিজিক্যাল ট্রেনিংটা ফুটবলার আর এথলিট দের একসাথেই হয়। সাতদিন হয়ে গেল শুভঙ্কর প্র্যাকটিস এ এখনো আসেনি। স্কুলেই আসেনা। লং জাম্পে শুভঙ্করের একটা প্রাইজ ধরা আছে। কিন্তু প্র্যাকটিসে না এলে কি ভাবে হবে?
শুভঙ্করের বাড়ি সুবীরের বাড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে। সাতদিন পরেও না আসায়, সুবীর একদিন স্কুল ফেরতা শুভঙ্করের বাড়ি ঢুকল। ওদের বাড়িটা এই অঞ্চলের আর পাঁচটা বাড়ির মতোই। মাটির উঠোন ঘিরে একদিকে দুটি শোবার ঘর, একদিকে রান্না ঘর, একদিকে বাথরুম- সরকারী প্রকল্পের টাকায়, আর একটা কুয়ো। কুয়োর পার টুকু বাঁধানো - সম্ভবত বাথরুম বানানোর সময় ওটা বাঁধানো হয়েছিল। আর একদিকে ছোট্ট তুলসী বেদী- এদিকটা বাঁশের বেড়া দেওয়া। এদিক দিয়েই বাড়িতে ঢুকতে হয়। বাথরুম আর কুয়োর পাড় বাদে বাকী বাড়িটা মাটির। মাথায় টিনের দোচালা। রান্নাঘরে অবশ্য একচালা। শুভঙ্করদের বাড়ির অবস্থা ভালো না। তিন বিঘা জমির উপর গোটা সংসার টিকে আছে। শুভঙ্কর বাড়িতেই ছিল। সুবীরকে বসার জন্য বেঞ্চি বের করে দিল ওর মা। শুভঙ্কর বাইরে বেরিয়ে সুবীরকে দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
-"কিরে, প্র্যাকটিসে আসিস না কেন? খবর পাসনি, এথলেটিক্স-এর প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে?"
কোন উত্তর নাই। ওর মা জবাব দিল -" কি যে হয়েছে কে জানে? কথা তো বলেনা। স্কুলে যায়না, টিউশন এ যায়না। লেখাপড়াও বাদ দিয়েছে। সারাক্ষন গুম হয়ে বসে থাকে। কিছু বললে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে।"
সুবীর বলল -"কাল যেন স্কুলে দেখতে পাই। নাহলে কাল আবার আসব।" সুবীর উঠে পড়ল। শুভঙ্করের মা বলল - "চা বসাচ্ছি সার।" সুবীর চা করতে মানা করে বেরিয়ে পড়ল। শুভঙ্কর ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।