মায়াপথের মীড়-৫/সৌগত ভট্টাচার্য
মায়াপথের মীড়/৫
সৌগত ভট্টাচার্য
গল্পটা শুনেছিলাম আমার সেজ মামার মুখে।
১৯৬২ সাল, চীন-ভারত যুদ্ধ বেঁধেছে। একদিন পরের খবরের কাগজে যুদ্ধের খবর আসে এই শহরে। আবেগহীন গলায় রেডিও নিয়ম মাফিক জানিয়ে দেয় চীনা সৈন্যর গতিবিধি ও ভারত সরকারের বক্তব্য। রেডিওতে খবরের শেষ ভাগে আবহাওয়ার খবরে আকাশ পরিষ্কার থাকার কথা জানালেও জলপাইগুড়ির আকাশে তখন শঙ্কার ধূসর মেঘ।
সদ্য পুজো শেষ হয়েছে, অক্টোবরের শেষ দিকে জলপাইগুড়িতে সদ্য ঠান্ডা পড়ছে, শহরের উত্তর দিকে তাকালে ঝকঝক করে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঢাকা চূড়া। তিস্তার শীতল হাওয়া শীতকাল নিয়ে আসে জলপাইগুড়ি টাউনে। দিলু ঘোষাল (অবশ্যই নাম পরিবর্তিত) ওর চ্যালা চামুণ্ডা নিয়ে যায় তিস্তার পাড়ে। সে সেখান থেকে দাঁড়িয়ে বরফ ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঠিক চীনের অবস্থানটা ঠিক কোন দিকে, জলপাইগুড়ি থেকে ঠিক কত দূরে! সে শুধু জানে হিমালয় পাহাড়ের ওপারে চীন। শুধু এটুকু ভূগোলকে সম্বল করে চীনের অবস্থান সম্পর্কে কিছু একটা আন্দাজ করে নেয় দিলু। চীনের সঙ্গেই তো সীমানা নিয়ে সমস্যা! চীনা সৈন্যরা যদি জলপাইগুড়ি আক্রমণ করে নিশ্চই বার্নিশ ঘাট হয়ে তিস্তা নদী পেরিয়েই ঢুকবে এই শহরে, এই চিন্তা দিলুকে খুব ভাবাচ্ছে।
দিলু ঘোষালকে জলপাইগুড়ির কে না চেনে! এই টাউনের সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান সে। বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও ম্যাট্রিক উৎরাতে পারেননি দিলু। সে নিয়মিত আদর্শ ব্যায়ামাগারে যায় শরীর চর্চার জন্য। ব্যামাগারের ঠিক উল্টো দিকে রূপমায়া সিনেমার পেছনের গেটে সাগরেদ নিয়ে দিলুর আড্ডা। ছোট্ট এই শহরের পাড়ায় পাড়ায় যত স্বনামধন্য মস্তান আছে, তাঁরা কেউ দিলুর প্রতিপক্ষ, কেউবা বন্ধু।
আজ নিজের দেশ যুদ্ধের মুখোমুখি। নিজের শহরকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কী ভাবে দেশ রক্ষা করবে ভেবেই পায় না দিলু। অনেক ভাবনার পর দিলু সব ভেদাভেদ আর পুরোনো শত্রুতা ভুলে শহরের স্বনামধন্য মস্তানদের ডাক পাঠান। আশ্চর্য শত্রু মিত্র সব মাস্তান দিলুর ডাকে সাড়াও দেন। সব তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতাকে সরিয়ে নিজের দেশ নিজের বাসভূমি নিজের শহরকে বাঁচানোর সময়!
সন্ধ্যায় রূপমায়া সিনেমার পেছনের গেটে হলুদ বাল্ব জ্বলা চায়ের দোকানে মিটিং শুরু হয়। পাড়ার সব মাস্তানরা সেখানে হাজির। দিলু সবিস্তারে চীন আক্রমণের কথা সবাইকে জানায়। কথাগুলো যদিও সবারই জানা। জলপাইগুড়িকে বাঁচাতে হবে। কী ভাবে বাঁচাতে হবে সেই নিয়ে একটা ব্লু প্রিন্ট তৈরি করার জন্যই এই মিটিং। শহরের এই অভূতপূর্ব ইমারজেন্সিতে তাদের কর্তব্য কী হওয়া উচিত তাই নিয়ে দিলু নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতাও দেন। কদমতলার সেই চায়ের দোকানে সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলে। সব শেষে দিলু বলে, নিজেদের মধ্যে সব বিভেদ ভুলে এটা জলপাইগুড়িকে রক্ষা করার সময়। না হলে বছরের পর বছর ব্যায়ামাগারে ডাম্বেল ভেজে লাভ কী, যদি চীনাদের অ্যাটাক আটকাতেই না পারি! সব শেষে নাকি দিলু বলেছিল, "ভোম্বলদা তুমি তোমার ছেলেদের রেডি হতে বলো, ওরা আজ থেকে আসাম মোড়, এ সি কলেজ, মাসকলাই বাড়ির মোড় পাহারা দেবে!" "তিয়াত্তর মোড় থেকে চার নম্বর গুমটি-কদমতলা পর্যন্ত বিশু তোর দায়িত্ব। কিভাবে কোথায় তুই তোর ছেলেদের পোস্ট করবি বুঝে নে। আর বুড়া রেসকোর্স-স্টেশন-তিন নম্বর ঘুমটি থেকে ভিতর পান্ডাপাড়া তুই দেখবি, সঙ্গে হারুকে নিয়ে নিস।" এক নিঃশ্বাসে চীন আক্রমনের হাত থেকে জলপাইগুড়িকে বাঁচানোর জন্য শহরের এলাকা ভাগ করে দেয় দিলু। ভোম্বল বলে, "তুই কী করবি?" এলাকা ভাগের পর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে দিলু বলে, " যদ্দূর খবর আছে চীনা ব্যাটারা আসলে তো বার্নিশ তিস্তার চর পার হয়েই আসবে, তিস্তার চর থেকে পাহাড়পুর-রায়কত পাড়া পর্যন্ত আমি বুঝে নেব তোমাদের চিন্তা করতে হবে না........"
চীন ভারত যুদ্ধের কথা ইতিহাসে লেখা আছে। এত বছর পর সেই যুদ্ধ নিয়ে কেউ আর কথা বলে না। মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে। তিস্তা দিয়ে যেমন জল বয়ে যায়, ঠিক সময় সে ভাবে চলে গেছে। সেটা আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর পঁচিশ আগের কথা। আমরা বিকেল হলে সাইকেল নিয়ে নিয়মিত তিস্তার পাড়ে আড্ডা দিতে যেতাম। প্রতিদিন দেখতাম, এক অশীতিপর বৃদ্ধ নদীর পাড়ে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে থাকতো নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। শরৎ এলে তিস্তার উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, বিকেলের শেষ সূর্যের আলো কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় পড়েই বিরাট পাহাড়টাকে কোথায় যেন ভ্যানিশ করে দেয়। এই সব ম্যাজিক চলতে থাকে বিকালে, তিস্তার পাড়ে। বৃদ্ধ বসে থাকতো। দূরের পাহাড় অদৃশ্য হলে বৃদ্ধ বেঞ্চ থেকে উঠে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওনা হত। যেমন করে যুদ্ধ সাজ ছেড়ে নিজের দেশকে ভালোবাসা এক সেনাপতি বাড়ি ফেরে। আমরা দেখতাম, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় একজন বৃদ্ধ সেনাপতি হেঁটে যাচ্ছে... তিস্তার ওই পাড়েই তো চীন...
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴