ভাস্কর্যের আঁতুরঘর/৫
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর পর্ব-৫
মৈনাক ভট্টাচার্য
--------------------------------
রামকিঙ্কর বেইজের ভাস্কর্য ‘পোয়েটস্ হেড’
রামকিঙ্কর বলতেন আর্টের সা রে গা মা হচ্ছে কোণ, সিলিন্ডার, স্ফিয়ার, ত্রিভুজ এই সবের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনা। অনুভূতির সাথে এই সা রে গা মা বাজলেই তো সৃষ্টি। সব মূর্তির দেখবে একই ব্যাকরন । নিজের কাজের রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা স্থায়িত্ব নিয়ে বরাবরই উদাসীন তিনি। তাঁর অয়েলের কাজগুলো প্রদর্শনীতে পাঠাতে হবে, তাই ঘরের চাল ছাওয়ার জন্য খড় কিনতে হল। ঘরের চাল ভেঙে পড়ছে। বড় বড় ক্যানভাস যেগুলো, সেগুলো উল্টে দেওয়া ছিল চালের যেখানে যেখানে জল পড়ে। রামকঙ্কর জানে তেল রঙের ক্যানভাস তাই উপরে কোনও ক্ষতি হবে না। চালের বৃষ্টি আটকাতে ওগুলোই ঝুলিয়ে দেন তিঁনি। ঋত্বিক ঘটকের তথ্যচিত্রে অকপট রামকিঙ্কর- “পেনশনের টাকায় ঘরের চাল ছাওয়ানো যে সম্ভব হয় না।”
ভাবা যায়! অথচ কাজ করার সময় একেবারে অন্য মানুষ। গুরুদেবের সেই যে বীজমন্ত্র -“যখন কাজ করবি কিঙ্কর, একেবারে বাঘের মত টুটি চেপে ধরবি-।” রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে শিখিয়েছিলেন শুধু ছবি আঁকলে আর মূর্তি বানালেই চলবে না। সেই সাথে প্রচুর পড়াশুনাও করতে হবে। জোর করে পড়তে দিতেন বিদেশী লেখকদের বই। ১৯৩৫এ ‘সুজাতা’ হল। গাছমানুষ এই ‘সুজাতা’ ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে শুধু নয়, রামকিঙ্করের জীবনেও একটা মাইল ফলক হয়ে আছে, একটা ‘মিরাক্যাল’। সে সময় ‘সুজাতা’ না হলে এই রামকিঙ্কর হয়ে উঠতেন কিনা কেউ বলতে পারেনা। সরোদ বাদক পন্ডিত আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব এসেছেন শান্তিনিকেতনে। বসে আছেন গুরুদেবের সাথে। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই রসিক মানুষ। নন্দলাল বসুকে ডেকে বললেন- “কিঙ্করকে বলো খাঁ সাহেবের মাথাটা রেখে দিতে।” আঁতকে উঠলেন শিল্পী আলাউদ্দিন খাঁ ভাব খানা এই যে- ‘এ কেমন অতিথি প্রীতিজ্ঞান’। আশ্বস্ত করলেন নন্দলাল। কিঙ্কর আপনার একটা হেড স্টাডি করবে। হাতে সময় নেই একদিনেই করতে হয়েছিল এই কাজ। দিল্লি সঙ্গীত অ্যাকাডেমিকে আজও আলো করে রেখেছে রামকিঙ্করের এই ভাস্কর্য। সুচিত্রা মিত্রের করেছেন, খাঁ সাহেবের করেছেন কিন্তু সাধ যে মেটেনা; কিঙ্করের মনে বড় সাধ, বিশ্বের কত মানুষ তাঁকে নিয়ে কাজ করেছেন আর শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক হয়ে সেই গুরুদেবকে নিয়ে একটা কাজ তিনিই বা করবেন না কেন। গুরুদেব কলা ভবনে এলে একদিন সাহস করে বলেও ফেললেন কথাটা। বেঁকে বসলেন ববীন্দ্রনাথ-“না,না। আবার সেই ক্যালিপার্স ফ্যালিপার্স- বার বার মুখের মাপ জোক-। আমার একদম ভাল লাগেনা। ঘটনার সুত্রপাত অন্য জায়গায়। ১৯২৬শে আমেরিকান ব্রিটিশ ভাস্কর জেকব এপস্টেইন (Jacob Epstein) লন্ডন থেকে শান্তিনিকেতনে এলেন রবীন্দ্রনাথের একটা পোট্রেট করবার বাসনায়। এপস্টেইন তখন বিশ্ব জুড়ে আধুনিক ভাস্কর্যের পাইওনিয়ার। রবীন্দ্রনাথ রাজিও হলেন। সিটিং-এও বসলেন। জেকব বার বার চোখ, কপাল, নাক সব ক্যালিপার্স স্কেল দিয়ে মেপে মেপে করেছিলেন। খুব অস্বস্থি হয়েছিল গুরুদেবের। এপেস্টাইনকে মানাও করতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯-এ এসেও ভুলতে পারেন নি সেই স্মৃতি। রামকিঙ্কর আস্বস্থ করলেন-“কোন যন্ত্রপাতি না, কোন মাপ জোকও নয়। আপনি আপনার মত বসে কাজ করবেন, আমি আমার মত কাজ করব।” এবার রাজি হলেন। শুভস্য শীঘ্রম। পরদিন থেকেই শুরু।
রামকিঙ্করে ভাষায়-“রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট টা করেছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। প্রথম যেদিন শুরু করি ডাঃ এন্ড্রুইসের শ্রাদ্ধ বাসরে উপাসনায় তিনি পাঠে মগ্ন। সেদিন ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম কি জানি যদি বিরক্ত হন, যদি কাজ করতে না পাই। সেদিন যতক্ষণ ছিলাম শুধু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি সে ওর নাক। ওর মুখে নাকটা একটা প্রধান দ্রষ্টব্য। প্রোফাইলে সেটা আর ও স্পষ্ট ধরা পড়ে খাড়ার মতো। ব্যক্তিত্বের অনেকটাই ঠাই নিয়েছে ওই নাকে। আর চোখ। যেন ভেতর অব্দি দেখে নেবে।” রামকিঙ্করের মতে-“আমার এই ব্রাস্টে অবশ্য চোখ নামানো কপাল আর ঘাড়েই পেলাম মনোযোগের মূর্তিকে। কাজ করি, ভেজা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রেখে আসি। মাঝে মাঝে গিয়ে আবার জল ঢেলে দিই, পাছে শুকিয়ে যায় মাটি। কখনো কোন সন্ধ্যাবেলায় তখন গান শেখাচ্ছেন পুরনো গান, চুপ করে বসে আছেন সব, উনি গাইছেন। মন্দিরে উনি ভাষণ দিতেন আচার্যের আসনে বসে, প্রতি বুধবার যেতাম খুব পেছনে বসে কথা শুনতাম আর দেখতাম। সেই দেখার স্মৃতি থেকে ওটা করা। গুরুদেবকে মন্দিরে যেমন দেখেছি, দেখা কল্পনা ভাবনা সব মিলেমিশে ওর ব্যক্তিত্বের নানা দিক ওখানে দেখতে পেতাম। ভক্তি খুব, আবার আত্মবিশ্বাসের জোর যেন বলছে দুনিয়া আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াক আমি টলছি না।”। কাজটা করার সময় রামকিঙ্কর জামার হাতার কাপড়ের কাজ করছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছিল না। কিঙ্করকে বলেই ফেললেন-“ লাইফ স্টাডির প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে জামা কাপরের দিকে মন দেওয়াটা কিন্তু শিল্পীর পক্ষ্যে একটা পাপের মত।” এর পর আর এই কাজে জামা কাপড় রাখা যায় না। রামকিঙ্কর হাতটাই উড়িয়ে দিলেন।
রামকিঙ্কর ভাবনার এক অতলে তলিয়ে শুধু উপাসনার ভাবটাকেই ধরে রাখলেন যা মনের এক স্তরের উত্তরণ না হলে পাওয়াই যায়না।
রামকিঙ্কর যখন এই কাজ করছিলেন রবীন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছে হয়েছিল মাটি দিয়ে উনিও একটা কাজ করেন। একদিন কাজ করে ঘরে ফিরবেন ভিজে কাপড় জড়াচ্ছেন কাজে। রবীন্দ্রনাথ বলেই বসলেন-“খানিকটা মাটি দিয়ে যাস তো আমাকে, ভুলিস না কিন্তু।” রামকিঙ্কর খুব উৎসাহ নিয়ে ঘার নাড়তে যাবেন এমন সময় দরজার কাছে প্রতিমা দেবী মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় নিষেধ করলেন-“ ভিজে মাটি ঘাটলে বাবা মশাইয়ের ঠান্ডা লেগে জ্বরজ্বালা হবে। শরীর একদম ভালো নয়, তুমি কিন্তু মাটি এনো না ওঁর জন্য কক্ষনো”।
এই ব্যাথা রামকিঙ্কর কোন দিনই ভুলতে পারেননি। তিনি ভাবতেন হত্যা করেছেন সৃষ্টির এক নব দিগন্তকে। ভেতরে ভেতরে বাকি জীবন এই ভাবনা নিয়ে তাই তিনি পুড়েছেন এক ইচ্ছেপোড়ায়। যে ভাবে শিল্পী মাত্রেই পোড়ে......
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴