পইলা সাঞ্ঝির কথা/৫
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৫
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঘর ছোঁয়ানি
^^^^^^^^^^^
‘ভোজি, ও ভোজি’ ডাক শুনে বসমতী বুঝতে পারে এটা শেল্টু মড়ার ডাক। কতদিন কান্তেশ্বরকে বলেছে হাটের দিন বাইরের দরজাটা খোলা রাখতে, ও জানেই শেল্টু আসবে। তামাকের দোকান শেল্টুর। হাটে হাটে বসে তামাক বেচে। সাথে একটা ছোট জাতি থাকে, কেউ চাইলে তামাক কুটে দেয়, চুন তুলে দেয়। দোকানে একপাশে একটু চুনও রাখে। রোদের আঁচ থাকতে থাকতেই হাটের পথে রওয়ানা দেয়। কাঁধে গামছার উপর বসানো বাঁকের দুই দিকে সমান ওজনে নেওয়া তামাক, কেজির পাল্লা-পাথর, একটা বহু ব্যবহারে জীর্ণ বাজারের ব্যাগ, বসবার জন্য বস্তা। দোকানটা কাউকে একটু দেখতে বলে চট করে বাজারটা সেরে নেয়। তারপর অপেক্ষায় থাকে পাড়ার চেনা মানুষের, পেলেই অনুরোধ করে বাড়িতে একটু পৌঁছে দিতে। ওর ফিরতে ফিরতে তো সেই রাত। আর রাত করে ফেরে বলেই বসমতীর কাছে আগুন চেয়ে নেয় বাঁশতলাটা পেরোতে। বসমতী ডাকের উত্তর দিতেই বাইরের দরজাটা ঠেলে মুখটা ঢুকিয়ে এক গাল হাসে। তারপর বলে, "দেওখেনে তোমার নম্ফটা কোনেক, উকাটা ধরাও, আর বিড়িটাত টান দিতে দিতে বাঁশের থোপটা পার হও। এইখানোক কোনেক ভয় নাগে বারে।" বাঁশঝাড়টাকে সবাই কম-বেশি ভয় পায়। আছে নাকি কে একজন, মাঝে মাঝে জানান দেয়। বসমতী কখনও দেখেনি, বোঝেওনি। শেল্টু উঠোনে এসে দাঁড়ালে বসমতী কেরোসিনের কূপীটা ধরিয়ে দেয়। হাটের দিন করে ফিরতে বেশ দেরি হয়, ততক্ষণে গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া শেষ, বেশিরভাগই শুয়েও পড়ে। জেগে থাকলেই ‘বাতি-গোছা’ জ্বালিয়ে রাখতে লাগে। অত কেরোসিন কোথায় পায়। গ্রামের সবাই সব সপ্তাহে রেশন তুলতে পারে না, পয়সার অভাবে। এক সপ্তাহে তুললে পরের সপ্তাহ বাদ যায়, অনেকে তুলে কেরোসিনটা আর একটু বেশি পয়সায় পাড়ার অবস্থাপন্ন কারো কাছে বেচে দেয়। তাই জীবন মানে অনেকের কাছে কিছুটা কষ্টকর সাশ্রয়ও বটে।
বাঁকের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে শেল্টু আয়েস করে বিড়িটা ধরিয়ে বকবক করতে থাকে। একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কোমরটা সোজা করে। তারপর ঝোলাটা উঠিয়ে নিয়ে এক গোছা পাটকাঠিতে একদিকে আগুন ধরায়। তারপর গলাটা তুলে সামনে দাঁড়ানো বসমতীকে অপ্রয়োজনীয়ভাবেই একটু বেশি জোর গলায়, "গেলুং ভোজি" বলে বাড়ির পথ ধরে। বসমতী হাসিমুখে সেদিকে একটু তাকিয়ে হাই তোলে। ঘরে এসে শোয়ার আয়োজন করে। তখনও শেল্টুর গলার গুনগুন গান শোনা যায়। বসমতী জানে, আসলে ভয়েই গান করছে শেল্টু। বেশিক্ষণ হল না, আকাশ একেবারে ঝেঁপে নামল। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই, ঘুম ভাঙল অস্পষ্ট একটা ডাক শুনে। ততক্ষণে কান্তেশ্বরও উঠে পড়েছে। বড় টর্চটা হাতে নিয়ে ছাতা মাথায় উঠোনের দিকে গেল দেখতে। বসমতীর ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করছে। এত রাতে কে ডাকে? কোনো অপদেবতা টেবতা নয় তো? ডাকাতও হতে পারে, কিন্তু গলা তো মেয়েদের মতো লাগল। বসমতী বিছানা থেকে নেমে দরজায় দাঁড়ায়। দেখে বুধেশ্বরের মা। কোনো ভূমিকা না করেই তাড়াতাড়ি বলল, "বাউ বড় নাইটটা দে তো কোনেক। বানেরটে যাও, ওদি গুন্ডা আবো কো খবর দিম এলায়। ফেনো আবোক কলুং, গেইসে বোদায়। মাই তোর শোলোই খাটি আছে তে দে তো কয়টা, আঞ্চলত পল্টে নিগাং। একেটা খাটি ছিল, যেজ্ঞোনে আরো জ্বলিল। এত হাট করে তাও উমরা একটা শোলোই না আনে, দ্যাখ তো আজি এলা কেমন ফোইজ্জতখান। ছাওয়াটাক দেখিলে কওয়া যায় আজি কালিয়ে বা কি কয়, জিনিসগিলা না কোনেক যোগাড় করি থুবার নাগে, হে না বাউ!" বসমতী একটা গোটা দেশলাইই এনে দিয়ে বলল, "এইটা গোটায় নিগা দি, বাড়িত মাটিয়া ত্যাল আচে কোনেক বেশি বাসায়? গোটায় আতিটা যুদি এলায় জ্বালের নাগে!" "আচে, মুই কোনেক করি নুকি থুসুং। ওকিনায় হবে এলায়। যাং মাই, দ্যাক তো এইলা নাঞ্চানা খান। গিব গিব করি জল পড়েছে, সোগায় এখেরে কোয়ারি-কাট্টা নাগে দিয়া নিন পাড়েছে।"
বুধেশ্বরের মা ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়। বসমতীর আর ঘুম আসে না, কান্তেশ্বরের মুখেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। আসলে কাছাকাছি হাসপাতাল বলতে বীরপাড়া অথবা ধূপগুড়ি। ধূপগুড়ি যাওয়ার উপায় নেই, পথে নদী পেরোতে হবে, রাতে নৌকো থাকে না। বীরপাড়া হাসপাতাল প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। তবু অবস্থা বেগতিক হলে ভ্যান অথবা গরুর গাড়ি চাপিয়ে রুগী বা প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বৌটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রসবের রুগীর ক্ষেত্রে বাড়ির লোকের সাথে গ্রাম্য দাই হিসেবে যারা কাজ করে তারা একজন বা দুজন সঙ্গে যায়। প্রসব করাতে এসে আসন্ন প্রসবাকে একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেই এরা বুঝতে পারে অবস্থা জটিল কিনা। খুব জটিল হলে বাড়ির লোককে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করতে বলে দেয়। আর আয়ত্বের মধ্যে থাকলে নিজেরা যুদ্ধ করতে থাকে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে নয়। অনেকের তো কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্বিঘ্নে প্রসব হয়ে যায়। গোটা পাড়াটার যত পোয়াতি আছে সবার বাচ্চাই এই তিনজনের কাছেই প্রসব হয়েছে। অথচ বিনিময়ে কিছুই নেয় না। অবস্থাপন্ন যারা তারা তিনজনকে তিনটে কাপড় দেয়, ভালো-মন্দ খাওয়ায়। হতদরিদ্র পরিবারগুলি কিছুই দিতে পারে না, তবু কখনও কাজে নিষ্ঠার অভাব নেই।
একটু আলো ফুটতেই বসমতী ছুটল বুধেশ্বরের বাড়ি। দেখল হাসি-খুশি পরিবেশ। আরো অনেকেই আছে। আকাশও এখন পরিস্কার। কেউ একজন মজা করে বলল, "এইটা চেংরি এখেরে দুন খান ধরি আইচ্চে, দেখিস তো ইয়ার বিয়া তো কেমন দুন বাইষ্যা নাগে।" সবাই হেসে ওঠে। একটা বড় পুরোনো চেলায় কাপড় পেতে বাচ্চাটাকে শুইয়ে রাখা। মা-মেয়ে, উভয়কেই স্নান করানো হয়ে গেছে। গুন্ডা আবো বাঁশের ছেঁচকুনি দিয়ে নাড়িটা কাটতেই চিল চিৎকার দিয়ে উঠল। গুন্ডা আবোও বুধেশ্বরের মা কে ডেকে বলল, "দেখিস, তোর নাতিনির কি গোলাত জোর মাই, তোর সাতে কেমন ঝগড়া করিবে, তোমার বুড়াটাক ধরি।"
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ঘর ছোঁয়ানি - গ্রাম্য দাই
উকা - এক গোছা পাট কাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিলে সেটাকে উকা বলে।
যেজ্ঞোনে - যেই গুণে অর্থাৎ ভাগ্যিস জ্বলল।
মাটিয়া ত্যাল - কেরোসিন
গিব গিব করি - প্রবল বৃষ্টিকে বোঝানোর শব্দ।
কোয়ারি কাট্টা - ঘরের দরজাকে কোয়ারি বলে, কোয়ারি কাট্টা শক্তপোক্ত করে দরজা এঁটে বিষয়টি জোর দিয়ে বোঝানোর জন্য বলা।
দুন - ঝড় বৃষ্টি
ছেঁচকুনি - পাতলা করে তোলা বাঁশের আঁশ। ব্লেডের মতোই ধার হয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ছবিঋণ : তুলেশ্বর রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴