নানারঙের গানগুলি/৫
শৌভিক কুন্ডা
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
পুজো
এলো। পুজো গেলো। আনন্দ আয়োজনে কিছু শোক, কিছু বিতর্ক জায়গা করে নিলো। এ
বয়সে তেমন আর বের হতে মন চায় না। তার ওপর নবমী তো ভেসেই গেছে বৃষ্টিতে।
বিভিন্ন পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের হতাশা বেড়েছে। আমি পাড়ার পুজোর পঁচাত্তর
বছরের মণ্ডপে কিছুক্ষণ, পায়ে হেঁটে কদমতলা সার্বজনীন মন্ডপে এক সন্ধ্যেয়,
আর বাড়ির সবার সাথে এক রাতে লাটাগুড়ি-মালবাজার হয়ে 'ঠাকুর দেখা' সারলাম।
তো, আমার ব্যক্তিগত দর্শন-ভ্রমণ বিষয়ে কারই বা কি এসে যায়! তবু মুখবন্ধটা
করে রাখলাম।
রাখলাম এ
কারণে, যে, যতটা পথের বর্ণনা দিলাম, তার অনেকটা জুড়েই নানা পুজো মন্ডপ, আর
সেসব মন্ডপ থেকে বরাবরের মতোই গান ভেসে এসেছিলো, কি দিনে, কি রাতে। আর অবাক
হয়ে শুনলাম, সে সব গান কিন্তু আমার কৈশোর যৌবনকেই ভরিয়ে রেখেছিলো। তুলনায়
পরের প্রজন্মের, সদ্য রিলিজ হওয়া (কি বেসিক, কি সিনেমার) গান কানে এসেছে
কম। "নবমীর নিশি গো তুমি আর যেন পোহায়ো না" এই পুরাতনী গানটি অবশ্য বহুদিন
পর শুনলাম ফেসবুক মাধ্যমে, মল্লিকা ব্যানার্জি পারিয়ালের গলায়। এক লৌকিক
মায়ের আকুতি বড়ো সাবলীল ফুটিয়ে তুলেছিলো মল্লিকা। সপ্তমীতে ভীড় সন্ধ্যে
নাগাদ হয়ই নি বলা যায় জলশহরে, তবু রাস্তায় রাস্তায় ট্র্যাফিক পুলিশের
ব্যারিকেড ছিলো যানচলাচল নিয়ন্ত্রণে। অতএব রাস্তা আরও ফাঁকা। দু'পাশের
দোকান গুলোও কেমন নিষ্প্রভ। সেই একা ফাঁকা গুমরে থাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে
হাঁটতে কদমতলা মোড়ের দিক থেকে ভেসে আসছিলো,
"কুহু কুজনে
এই রাত শুধু যে গানের!"
ডেঁপোমির
বয়সে এই গানের সাথে জড়িয়ে থাকতো অমোঘ চিত্রকল্প। পুরো গান তো এ মুহুর্তে
মনে পড়ছে না, গুগলে খুঁজে নেওয়া মাত্র এক আঙুল দূরে হলেও মন সেটাও চাইছে
না, কিন্তু আমার কাছে রাতটা শীতজ্যোৎস্নার! বাতাসের বরফিলা আদর গায়ে মেখে
কেউ হেঁটে চলেছেন
"অনুভবে তোমাকে যে পাই" গাইতে গাইতে। ঐ অনুভূতির উষ্ণতাটা ছুঁয়ে যাচ্ছে শ্রোতাকে। কখন যেন সে নিজেই গুনগুনিয়ে উঠছে,
"এই রাত তোমার আমার"!
অল্পবয়সে
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে সুরে, যে কন্ঠমাদকতায় মাত করে রেখেছিলেন, বহু দশক
পার করে সেই আসব পান করার সৌভাগ্য আবার হয়েছিলো বাংলা গানের রিয়ালিটি শো'র
মঞ্চে দুর্নিবারের গলায় এ গান শুনে! হ্যাঁ, এই দুজন ছাড়া একমাত্র আমিই
পেরেছি গানটিকে সঠিক সম্মান দিয়ে গাইতে, অবশ্য মনে মনে, বহুবার!
গতপর্বে
যে ইতিহাসের ভেতর ছিলাম, তাতে একটা কথা জানানো হয় নি। '৫৩ সালে HMV তার
শারদীয়া বইটির নাম পাল্টে রাখে শারদ অর্ঘ্য। এসময় দিয়েই প্রবোধ চন্দ্র দে'র
আত্মপ্রকাশ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা "হায় হায় রে, প্রাণ যায় রে" গানটির
সাথে সাথে। এই প্রবোধ, পরবর্তী ছ' দশকেরও বেশি সময় বাংলা গানে তো বটেই,
সারা দেশকেই এমনকি মাতিয়ে রাখবেন ভজন, হিন্দি সিনেমা গীত গেয়ে মান্না দে
নামে। মান্না দের গান আর আমার স্কুল-কলেজের দিনগুলো একে অন্যের সাথে এমনই
ভাবে মিশে আছে, যে আলাদা করে তাদের দেখা খুবই কষ্টের কাজ! সেই "আমি দুঃখ
পেলেও খুশি হলাম জেনে", অথবা, "যখন কেউ আমাকে পাগল বলে!" দ্বিতীয় গানটির ঐ
জায়গাটা, সেই যে,
"যখন নেশায় আমার রাস্তা টলে
কেউ
আমাকে মাতাল বলে", মাতাল উচ্চারণটিতেই যেন টলে যায় জ্ঞানপাপী বিরহীর পথ!
মান্না দে'র গান নিয়ে আমি বোধহয় আলাদা বই-ই লিখে ফেলতে পারবো একটা। আপাতত
সে শ্রমে নজর না দিয়ে বরং ওঁর গলায় আমার অন্যতম প্রিয় দুটোমাত্র গানের কথা
দিয়েই এ পর্বে ছাড়ি এ দেশের জনপ্রিয়তম গায়কটিকে। একটি তো সেই,
" ও চাঁদ, সামলে রাখো জ্যোছনাকে"
যে কথাগুলোর একটা গোপন ব্যাখ্যা সে সময় ছেলেদের খুব প্রিয় ছিলো। আর একটি হিন্দি,
"ছন
ছন বাজে রে পায়েলিয়া"। আমি যেন দেখতেই পাই ফর্সা শরীরে হেঁটে যায় রাধা,
মোতির মতো বৃষ্টিদানা ঝরে পড়ছে, গাগরি, শাড়ি ভিজে যাচ্ছে শ্যামপ্রিয়ার, আরও
সুন্দর হয়ে উঠছে সে!
১৯৫৪ মেতে উঠলো সলিল চৌধুরীর
সুরে "ধিতাং ধিতাং বোলে", আর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি শ্যামল
মিত্রের গলায় "ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা" এই গানদুটোতে। ঘোমটায় মুখ
ঢাকে গ্রামের বউ, পানকৌড়ি ডুব দেয়, গানের শেষ দিকে এসে আমিও তিনজন মাল্লার
সাথে দাঁড় বাইতে থাকি, শরীর ভেঙে আসে, তাও। ওদিকে চাঁদের সীমানায় মেঘলা
গুমরানি, লগ্ন বয়ে যাওয়ার অপূর্ব ছন্দ আমার আকাশটাকেও ভরিয়ে দেয়!