দাঁড়াবার জায়গা
পর্ব : পাঁচ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^
এখনকার
বাচ্চারা দেখি ইঞ্জেকশন নিতে বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের তেমন বীরত্ব
ছিল না। একদিন স্কুলে কোত্থেকে এলেন সম্পূর্ণ অচেনা অজানা ধোপদুরস্ত লোক।
তাঁরা টিচার্স কমন রুমে ঢুকে কিছু কথাবার্তা বললেন। আমরা তাঁদের আগমন খেয়াল
করলেও কথাবার্তা কিছুই শুনিনি। তাতে আমাদের আগ্রহও ছিল না। আমরা আমাদের
মতো ক্লাসে হইচই করছিলাম। তারই মধ্যে ক্লাসে এলেন যদুবাবু। তিনি বললেন, খুব
কলেরা হচ্ছে। জানিস তো। একবার হলে আর রক্ষা নাই। একেবারে বোলো হরি, হরি
বোল। সরকার থেকে লোক এসেছে তোদের টিকা দেবে। সবাইকে নিতে হবে।
ততক্ষণে
স্কুলের বারান্দায় ছোটমতো একটা জটলা জমে উঠেছে। একটা টুলের ওপরে জ্বলছে
একটা কুপি (বুনসেন বার্নারের নাম শুনেছি অনেক পরে)। কুপির আলোটা নীলচে।
আগন্তুকদের একজন হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে তার সূঁচটা সেই আগুনে সেঁকছে আর
একেকজনের বাহুতে ঠুসে দিচ্ছে। সূঁচ গরম করে ছ্যাঁকা দিচ্ছে! সে এক জান্তব
ব্যাপার! স্কুল জুড়ে পড়ুয়াদের পরিত্রাহী চিৎকার, মরাকান্না। তুমুল
সোরগোল। দুলালের মতো যারা একটু ডাকাবুকো তারা ক্লাসের দরমার ভাঙা বেড়া গলে
একে একে পগার পার হচ্ছে। ক্লাসঘরের পেছনে তাদের একেকজনের লাফিয়ে পড়ার
দুমদাম আওয়াজ। আমার মতো কয়েকজন হতভাগার সাহস নেই। অতএব পরিত্রাহী চিৎকার
করতে করতে আমরা একে একে সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হই। মনে
হচ্ছিল এই শেষ, মাকে আর দেখা হবে না এ জন্মে। একটি মেয়ে, তার নাম যতদূর মনে
পড়ে, মমতা, রোজ ক্লাস শুরুর আগে আমাদের যে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গাইতে
পিঠোপিঠি সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াতে হতো, এই মমতাই কেন যেন আমার সামনে চুলের
দুটো বেণী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি মাঝে মধ্যে তার বিনুনি ধরে আলতো টেনে
দিলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতো। একদিনও রাগ করেনি সে! তার কাজল টানা আয়ত দুটি
চোখে ছড়িয়ে থাকতো অলৌকিক হাসি। সেই মমতা এখন তার আয়ত দুই চোখ বন্ধ করে
বুকের কাছে দুহাত জোড় করে প্রার্থনা করে চলেছিলো অবিরাম। কেউ একজন তাকে
পেছন থেকে জোর ধাক্কা দিলে সে ইঞ্জেকশন-ওয়ালাদের একেবারে সামনে হুমড়ি খেয়ে
পড়লো। একজন তাকে পাকড়ে একটা হাত কাছে টেনে নিলে মমতা হাউমাউ করে কান্না
জুড়ে দিলো। লোকগুলো এমন নৃশংস, এমন দয়ামায়াহীন, নিষ্ঠুর যে তাঁরা হাসছিলো!
প্রবল আতঙ্কে আমার বুকে টিপ টিপ করছিলো, কিন্তু মমতার এই গগনবিদারী
কান্নায় লোকগুলোর ওপরে ভয়ানক ক্রোধে বুক টান টান করে এগিয়ে গেলাম। আমার মনে
পড়েছিলো, পাড়ায় মনসা পুজোয় পাঁঠা বলির একটা দৃশ্য। কী নৃশংসতায় একটা
প্রাণীকে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়। কয়েকজন মিলে তার গলাটা হাঁড়িকাঠে ফেলে
মাথাটা টেনে ধরে। তারপর একটা নৃশংস জহ্লাদ এক বিশাল দা নিয়ে দৌড়ে এসে সেই
নিরীহ প্রাণীর গলাটা এক কোপে কেটে ফেলে। ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে
রক্তের ধারা। পৃথিবীর নৃশংসতম দৃশ্যের একটি এই দৃশ্য আমার মাথায় গেঁথে
গেছে। এখন ইঞ্জেকশন-ওয়ালা এবং সেইসঙ্গে যদুবাবুকেও সেরকম জহ্লাদই মনে
হচ্ছে। আমাদের সবাইকে একে একে বলি দেওয়া হচ্ছে। এসব মনে আসায় আমার আতঙ্ক
ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে গেলে একটুও ভয় করছিলো না আর। ফলে, বলি হয়ে গেলো আমারও।
একটা তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিলো বাহুতে ইঞ্জেকশনের ক্ষতস্থলে নয়, বরং অনেক
বেশি বুকের ভেতরে। নিদারুণ এক অন্যায়, এক নৃশংসতার কাছে পরাজয়ের গ্লানি
কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। আমার বলি হয়ে গেলে আমাকে মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দেয় কেউ
একজন। লাইনে এরপরেই ছিল বাদল কাঞ্জিলাল। কী বিস্ময়, তার নামটি এবং সেই
সময়ের চেহারাটা আজও স্পষ্ট মনে আছে। তার দুচোখ বন্ধ। দুটো হাত প্যান্টের
পকেটে। একজন কুপির নীলচে আগুনে সূঁচ গরম করছে! একবার চোখ খুলল বাদল। তার
দুচোখ দিয়ে গলগল করে নেমে আসছে জলের ধারা। সে কাঁদছে। ইঞ্জেকশন পুশ করতে
করতেই সেই নৃশংস লোকটা হাসতে হাসতে বলে, এ মা, এ তো হিসি করে ফেলেছে! তার
একথায় তুমুল হাসির রোল উঠলে বাদল হঠাৎই দৌড় লাগাল। সে কোথায় যেন চলে গেল।
প্রাইমারি স্কুল
জীবনের একেবারে শেষবেলায় একদিন স্কুল জুড়ে সাজোসাজো রব। একজন জাদুকর
এসেছে। আমাদের আজ জাদু দেখানো হবে। জাদু ব্যাপারটা ঠিক কী তখনও কোনও ধারণা
ছিল না। স্কুলের ক্লাস ঘরগুলো ভাগ ভাগ করা ছিলো অস্থায়ী পার্টিশন দিয়ে। আজ
জাদু প্রদর্শন উপলক্ষে আমাদের সকলের বসার জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে
পার্টিশনগুলো। আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছি। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর জাদুকর
এলেন। তারপর মজার মজার সব খেলা শুরু হল। আমাদের যে কাউকে তাঁর কাছে আসতে
ডাক দিলেন জাদুকর। এগিয়ে গেল চিত্ত। সে আমাদের থেকে অনেকটা বড়, বয়সে এবং
শরীরেও। তাকে দেখেছি আগে, কিন্তু সে আমাদের স্কুলেরই ছাত্র নয়।
হেডমাস্টারের ছেলে হিসেবে তার নিয়মিত আগমন ঘটত স্কুলে। সেদিনও সে এসেছে।
জাদুকর একজনকে ডাকতেই সে সোজা চলে গেল তাঁর কাছে। এরপর জাদুকর একটা ডিম
আমাদের দেখিয়ে চিত্তর মাথায় চেপে ধরলেন। তারপর হাত নামিয়ে তিনি দুহাত
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখালেন যে, তাঁর হাতে কিছু নেই। এরপর তিনি চিত্তর
পাছায় হাত রেখে মাথায় একটা থাবড়া দিলেন। কী আশ্চর্য, তাঁর হাতে সেই ডিমটা!
আমরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। সেদিন পরপর অনেকগুলো জাদু দেখিয়েছিলেন
জাদুকর। শেষটা ছিল মারাত্মক। একটা চেয়ারে বসতে বললেন চিত্তকে। তারপর একথা
সেকথা বলে চললেন তিনি। বেশ খানকটা পরে চিত্তকে তিনি বললেন, তুমি এখানে বসে
আছো কেন? যাও, সবার সঙ্গে গিয়ে বসো। বলেই তিনি হাতের ইঙ্গিতে তাকে চেয়ার
ছেড়ে উঠতে বললেন। চিত্ত উঠতে গিয়েই বুঝল সে আটকে গেচে চেয়ারে। সে বারবার
ওঠার চেষ্টা করতে থাকলো, কিন্তু বারবারই ফের বসে পড়ল। আমরা আবারও তুমুল
হাসিতে ফেটে পড়লাম। জাদুকর হাতের ছোট্ট দণ্ডটা নিয়ে চিত্তর শরীরের এখানে
ওখানে স্পর্শ করলেন, হাতের নানা মুদ্রায় কী কী সব করলেন। তারপর বললেন,
এবারে ওঠে। এবারে চিত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার মুখে বেকুবের হাসি।
এমনিতে তার খুব মস্তানির ভঙ্গি। আমরা তাকে কখনও সামনে দেখলে এড়িয়ে চলি।
আজ, সেই বীর ভাবটা তার একেবারে চুপসে গেছে। জাদুকর তাকে একেবারে বেকায়দায়
ফেলে দিয়েছেন। এতে আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছিল। প্রদর্শনী শে, হলো। কিন্তু
আমরা কেউ কেউ চলে যাচ্ছিলাম না। সুযোগ বুঝে জাদুকরের খুব কাছে গিয়ে তাঁর সব
সাজসরঞ্জাম দেখছিলাম। একটা বড় ব্যাগে তিনি একে একে ভরে নিচ্ছিলেন সব।
ব্যাগে ভরানোর সময় সেই ডিমটাও নজরে পড়লে বুঝতে পারি সেটা মোটেই ডিম নয়।
আসলে সেটা ছিল একটা রবারের বল।
তারপর,
একদিন বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমাদের প্রাথমিক স্কুলের পাট চুকল। প্রচুর
ক্ষোভ জমেছিল স্কুল নিয়ে, বা বলা ভালো, একাংশ শিক্ষককে নিয়ে। অথচ, স্কুল
ছাড়ার সম্ভাবনা মনটাকে বিষণ্ণ করে তুলল। নতুন স্কুলে যাবো, উঁচু ক্লাসে
পড়ব তা নিয়ে প্রবল উদ্দীপনা সত্ত্বেও যদুবাবুর স্কুলে আর আসবো না ভাবতেই
বুকের ভেতরে কী একটা যেন নড়েচড়ে বেড়ায়। তারই মধ্যে শেষ যেদিন স্কুলে
গেছি আমার জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। আমাদের ইংরেজি পরীক্ষা হয়েছিলো
পঞ্চাশ নম্বরের। তাতে আমি পঞ্চাশ নম্বরই পেয়েছি। আমাদের যিনি ইংরেজি
পড়াতেন সেই বকুল দিদিমণি আমাদের বলেছিলেন, যে পঞ্চাশ নম্বর পাবে তাকে
উপহার দেবেন। আমার মার্কশিট আমার হাত থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়েই দুলাল সোজা
বকুল দিদিমণির দরবারে হাজির। সে বললো, দিদিমণি, অকে উপহার দ্যান। বলেই আমার
মার্কশিটটা সে বাড়িয়ে ধরে। দিদিমণি খুব হাসছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের
হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা কলম বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, খুব খুশি হয়েছি।
ভালো করে পড়াশুনো করবি। অনেক বড় হতে হবে।
খুব
আনন্দ হচ্ছিলো। দুলাল আমার চেয়েও বেশি খুশি। সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছিলো
সে আমার উপহারটা। ক্লাসের সকলে আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছিল। কিন্তু
খানিক পরেই ঘরের পথে রওনা হতে হয়েছিল। অথচ আমার খুব ইচ্ছে করছিল আরও অনেকটা
সময় স্কুলে থাকতে।
বাড়িতে
এসে কলমটা দাদা-দিদিদের সবাইকে দেখাচ্ছিলাম। পরীক্ষার আগে এবং পরে, রোজই,
এমনকী ছুটির দিনগুলোতে বা বার্ষিক পরীক্ষার পরেও পড়তে বস, বলে কঠোর
নির্দেশ থাকত। কিন্তু সেদিন কেউ আমাকে পড়তে বসার নির্দেশ দেয়নি। ফলে, বেশ
ফুরফুরে লাগছিল। সন্ধ্যার দিকে বাবা ঘরে ফিরলে সব শুনে বললেন, একটু
পড়াশুনো তো করতেই হবে। এবার বড় স্কুলে যেতে হবে। মুখে একথা বললেও তিনিও
কিন্তু সেদিন পড়ার জন্য চাপ দিলেন না। আমিও মনে মনে লায়েক হবার ভঙ্গিতে এক
দিদির ক্লাসের বাংলা বই থেকে জয়দেবের একটা কবিতা উচ্চস্বরে পড়তে থাকলাম।
গীতগোবিন্দ বইয়ে বিষ্ণুর অবতারত্ব নিয়ে একটা অংশ ছিল সেই বইয়ে। মনে আছে,
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং।
বিহিতরহিত্রচরিত্রমখেদম্।।
কেশব ধৃতমীনশরীর জয় জগদীশ হরে।।
ক্ষিতিরতিবিপুলতরে তিষ্ঠতি তব পৃষ্ঠে।
ধরনিধরণকিণচক্রগরিষ্ঠে।।
কেশব ধৃতকূর্ম্মশরীর জয় জগদীশ হরে।।
বসতি দশনশিকরে ধরণী তব লগ্না।
শশিনি কলঙ্কলেব নিমগ্না।।
কেশব ধৃতশূকররূপ জয় জগদীশ হরে।।...
...ইত্যাদি।
অর্থ বোঝার প্রশ্নই ছিল না। পরিণত বয়সে জেনেছি ওটা গীতগোবিন্দ-এর দশাবতার
স্ত্রোত্র। সংগীতের মূর্চ্ছনা আছে এই শ্লোকে। অদ্ভুত ধ্বনিতরঙ্গ শ্রবণে
আশ্চর্য এক ভালোলাগার সৃষ্টি করে। যে বয়সে অর্থ বুঝতে শুরু করেছি তখন এই
শ্লোক আরও বেশি ভালো লেগেছে।