তিস্তাবাথান
পর্ব: পাঁচ
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
"""""""''''''''''''''''''''''''""""
তিস্তাবাথান ঘিরে অনেক মিথ রয়েছে। রয়েছে অনেক লোকবিশ্বাস। মিথ, বিশ্বাস ও বাস্তব মেশানো বহু ককটেল রিফিলে ভরে চলেছি বহুদিন থেকেই। এখানে উঠোন যেহেতু সহজ তাই সেইসব ককটেলের দু-একটি আঁচর কাটা যেতেই পারে।
তিস্তাপুত্র সানিয়া মূর্মু। সন্ধ্যাবেলা মহিষের পায়ে বেড়ি (ডোর) বেঁধে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিলেন বাথান থেকে একটু দূরেই। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সে রাতে বাথানের ঘরে তিনি পৌঁছাতে পারেননি। সে রাতে বাথানে একাই ছিলেন সানিয়াদা। তাই তার ডাক পৌঁছায়নি অন্য কোনো মৈষালবন্ধুর কাছে। পেটে ছিল প্রচণ্ড ক্ষিধে। সেই ক্ষুধাপেটেই ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটে বেরিয়েছেন এদিক থেকে সেদিক; কিন্তু সেটা কোনদিক তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। ওপরে তাকিয়ে আকাশের চেনা তারাগুলিকে খুঁজে চলেন তিনি। কিন্তু মেঘ ও কুয়াশার আড়ালে যে সবাই মুখ লুকিয়ে রেখেছে। পথ খুঁজে পাবার আশা ছেড়েই দেন সানিয়াদা। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে খোলা আকাশের নীচে বালি আর ঝোপঝাড়ের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েন। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ তার সম্বিৎ ফেরে। কানে আসে মহিষের গলার ঘন্টির আওয়াজ। ঘন্টির শব্দকে লক্ষ্য করে কয়েক পা এগোতেই মেলে তাঁর বাথান ঘর। এটা কোন গল্প নয়। বাস্তবিকই সানিয়াদা’র বয়ান। ভেবে অবাক হয়ে যাই এমন একজন অভিজ্ঞ মানুষ যিনি পথ হারিয়ে খিদে পেটে সারারাত পড়ে রইলেন খোলা আকাশের নীচে। এর কি ব্যাখ্যা হতে পারে সে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করিনি। তবে এই আশ্চর্য ঘটনাকে মিথ্যে বা মনগড়া বলার অভিপ্রায়ও আমার নেই।
‘ভইসডোবা’ নামে একটি জায়গা রয়েছে তিস্তাবক্ষে। বহুবছর আগে প্রায় তিনশ’ মহিষ ও দু’জন মৈষাল ডুবে গিয়েছিল এই স্থানে। বহু খোঁজা খুঁজির পরও তাদের কোনো হদিস মেলেনি। খুঁজে পাওয়া যায়নি বা ভেসে উঠেনি একটি মৃতদেহও। তুলনামূলকভাবে তিস্তার অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে জলের গভীরতা অনেকটাই বেশী। পাশেই রয়েছে ঘন জঙ্গল। গা ছমছম করা একটা পরিবেশ চারপাশে। স্থানীয় মানুষেরা দিনের বেলায় একা একা এই স্থানে যেতে ভয় পান। তারা জানিয়েছেন যে গভীর রাতে এখনও এই স্থান থেকে মহিষের গলার ঘন্টির আওয়াজ ভেসে আসে। অথচ কোনো মহিষের দেখা পাওয়া যায় না। এ ঘটনা যে বাস্তবেই সত্য তা জোর দিয়েই বলেছেন তাঁরা। বয়স্করা তো আর একধাপ এগিয়ে বিশ্বাস করেন যে, চোরাবালির নীচে এখনও জীবিত রয়েছেন মহিষ ও রাখালেরা। সেই ডুবে যাওয়া মহিষেরা তিস্তার নীচে আজও ঘুরে বেড়ায়, ঘাস খায় আর তাদের চড়িয়ে বেড়ান হারিয়ে যাওয়া সেই দু’জন মৈষাল বন্ধু। মহিষ চড়ানোর সেই হুর-হুর কোরাস নাকি আজও অলস দুপুরে কান পাতলে শোনা যায় তিস্তার আকাশে-বাতাসে। বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার তবে তিস্তায় ঘুরতে ঘুরতে যা শুনেছি তা বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন না করে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। তাদের সাক্ষাৎকারের অডিও ভিডিওগুলি রয়েছে আমার কাছেই।
আর একটি অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। পায়ে হেঁটে ভরা নদী পেরিয়ে যাবার ঘটনা আপনারা এর আগে শুনেছেন কী? 'চৌরঙ্গী' থেকে 'চ্যাংমারী' অথবা তিস্তাপারের 'নেওলা বস্তি' থেকে 'কাইয়া বস্তির' বয়স্ক মানুষেরা একডাকে চেনেন দুর্গা বাবুকে। লাখোর বাবা দুর্গা-পাগলা বললে তো ছোট বড় সবাই এক ডাকে চিনিয়ে দেবে। দুর্গাবাবু আজ বেঁচে নেই। তবে তাঁর ছেলে-মেয়েরা রয়েছেন। তাঁর এই বিখ্যাত হবার পেছনে একটা উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। তিনি নাকি ভরা তিস্তা পায়ে হেঁটে পেরিয়ে যেতে পারতেন। শুধু নিজে একা নয়; পার করাতেন সানিয়া-বাচ্চু- কান্দারুদেরও।আগে (১৯৪০-১৯৯৫) উজানের বেশির ভাগ বাথানই ছিল কাঠামবাড়ি, গোলাবাড়ি, চ্যাংমারী এলাকায়। তিস্তা তখন বইত পশ্চিমে। এখন যেমন মূল তিস্তা বইছে পূর্বে । এইসমস্ত এলাকার চরে চরেই তখন বাথান সামলাতেন সানিয়াদারা। দুর্গা পাগলার নাকি ঝাড়ফুক-তুকতাক করবার গুণ ছিল। তার জোরেই তিনি তিস্তার জল দু’ভাগ করে রাস্তা তৈরি করে নিতে পারতেন। অবাস্তব এই ঘটনা মোটেও বিশ্বাস হয়নি আমার। সত্যতা যাচাই করতে অবশেষে মৈষাল সানিয়াদা’রই দ্বারস্থ হই। কারণ সানিয়াদা নিজেও দুর্গা পাগলার সাহায্য নিয়ে তিস্তা পায়ে হেঁটে পেরিয়েছিলেন কয়েকবার। কেমন ছিল সেই ঘটনা ?
স্বয়ং সানিয়াদা’র মুখ থেকে যা শুনেছি তা বলবার চেষ্টা করছি। একটি শব্দও লেখকের কল্পনাপ্রসূত নয়। যাত্রা শুরুর পূর্বে দুর্গা পাগলা প্রথমে তিস্তা থেকে কিছু জল হাতে তুলে নিতেন। তারপর মন্ত্র সহযোগে তা ছিটিয়ে দিতেন সকলের মাথায়। উনি নিজে থাকতেন সকলের সামনে। বাকিদের একটি লাইনে থাকতে বলতেন পেছনে। যারা পেছনে থাকতো তাদের প্রতি কড়া নির্দেশ ছিল দুর্গা পাগলার। ডানদিক, বাঁদিক অথবা উপরে তাকানো একেবারেই বারণ ছিল। সকলকেই মাথা নীচু করে চলতে হতো তার পেছন পেছন। নদী পেরিয়ে একমাত্র ডাঙ্গায় উঠবার পরই তাঁর নির্দেশ পেয়ে সকলে সামনে তাকাতেন। পেছনে তাকালে দেখা মিলত ভরা তিস্তার।
সানিয়াদা বড্ড সরল মানুষ। কথার মারপ্যাঁচ কিছুই বোঝেন না। বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি রয়েছেন এক্কেবারে মধ্য তিস্তায়। কত ঘটনার সাক্ষী তিনি। স্মৃতিশক্তি এখনো অটুট রয়েছে। তিনি আমার সামনে মিথ্যে বা মনগড়া কোনো গল্প শোনাবেন এ কথা বিশ্বাস করি কেমন করে? আবার এটাই বা বিশ্বাস করি কেমন করে যে, তিস্তার জলরাশিকে দু’ভাগ করে রাস্তা বানিয়ে, তাঁরা কাঠামবাড়ি থেকে পৌঁছতেন জলপাইগুড়িতে।