চা-ডুবুরি : পর্ব-৫
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^
সত্যপ্রিয়র বিদ্যারম্ভ
কাজলিডাঙা
চা-বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো মনে
পড়ে সত্যপ্রিয়র। প্রথমদিন স্কুলে গিয়ে বাঁশের গায়ে ঝুলে থাকা রঙচটা
টিনের বোর্ডে অস্পষ্ট অক্ষরে স্কুলের নামটা পড়ে মন খারাপ হয়েছিল গেছিল
সত্য-র। সাইনবোর্ডটায় কি রঙ ফেরানো যায় না! কথাটা মনে এলেও বাবাকে তা
কখনোই বলা যাবে না। রাশভারী মানুষ কুমুদ। কম কথা বলেন। ছোট মুখে বড় কথা
সইতে পারেন না। বলতে হলে মাকে বলতে হবে। ছোট থেকে এই এক সমস্যা
সত্যপ্রিয়র। নিজের চারপাশে কোন অসংগতি, আগোছালো বিষয় নজরে পড়লেই মনটা
খুঁতখুঁত করে। যতক্ষণ না সেটার কোনও নিষ্পত্তি ঘটছে ততক্ষণ যেন স্বস্তি
মেলে না।
'কী দেখছিস হাঁ করে? ভেতরে গিয়ে বইখাতা রেখে আয়। প্রার্থনা সংগীত শুরু হবে এক্ষুণি।'
বাপের
তাড়া খেয়ে হুঁশ ফেরে সত্যপ্রিয়-র। ছোট্ট স্কুল। একটি মাত্র হলঘর।
সেখানে ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর, চারটে ক্লাস। গোটা দশেক জোড়-বেঞ্চি ভাগাভাগি
করে শ্রেণি ভাগ করা হয়েছে। দেয়াল সংলগ্ন মাস্টার মশায়ের টেবিল চেয়ার।
ডানপাশে কাঠের আলমারি। তার ওপর গ্লোব। পাশে মানচিত্রের রেক। তাতে দুখানি
মানচিত্র। একটি ভারতের, অপরটি অভিভক্ত বাংলার জলপাইগুড়ি জেলার। বাঁ পাশে
বিগত তিন বছরের অবিসর্জিত সরস্বতী মূর্তি। দুটো একেবারে ভেঙে পড়েছে। তবু
বিসর্জন দেয়া হয়নি। সরস্বতী মূর্তি নাকি বিসর্জন দিতে নেই। দিলে কী হয়?
বিদ্যা কমে যায়? মাকে প্রশ্নটা করে সদুত্তর পায়নি সত্যপ্রিয়।বাবাও কী
এসব মানেন? সুনয়নীকে স্বামীর প্রতি মাঝে মধ্যে অভিযোগ করতে শুনেছে
সত্যপ্রিয়,"বড় নাস্তিক তুমি।কখনও কি পুজোর ঘরে এসে একটি বারের জন্য মাথা
ঠেকাতে নেই! ' কুমুদ নির্বিকার। মৃদু হেসে বলতেন, 'কর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
অধ্যয়নই আমার পূজা।' কথায় ও কর্মে কখনও প্রভেদ রাখতে দেখেনি সত্যপ্রিয়
কুমুদকে। মানুষটি নিজের কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসতেন। ভালোবাসতেন ফুটবল খেলা
দেখতে আর পড়াশোনা। নানা বিষয়ে জ্ঞান ছিল তাঁর। সেই জ্ঞান জাহির করতেন না
কখনও। তবু এতগুলো সরস্বতী প্রতিমা রেখে দেয়ার কারণ কী! ছোট্ট মনে প্রশ্ন
উঁকি দেয় সত্যপ্রিয়-র। নতুন মূর্তিটির গায়ে ধুলোর আস্তরণ। গলায় বিবর্ণ
মালা। অথচ খোলা জানালার বাইরে ঝুঁকে পড়া মাধবীলতায় কত অজস্র ফুল ফুটে
আছে। বইখাতা রাখতে গিয়ে সেদিকে চোখ পড়তেই সত্যপ্রিয়-র মনে হয়, মা
সরস্বতীর গায়ের ধুলো ঝেড়ে, জীর্ণ মালাটা ফেলে যদি মাধবীলতা ফুলের একটা
মালা পড়ানো যেত বেশ হত তবে।
কুসুমরঙা
সরস্বতী মূর্তির ওপর আটকে থাকা দৃষ্টিটা সাড় পায় চারপাশে ভিড় করা
বাচ্চাগুলোর ফিসফিস শব্দের গুঞ্জনে। তাদের প্রিয় মাস্টারজীর সাথে নতুন
একটি ছেলেকে দেখে তারা অপার কৌতূহলী। হাঁ করে চেয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর চোখে
চোখ পড়তেই ওরা একে অপরকে ঠেলাঠেলি করতে করতে চাপাগলায় ছড়া কাটে,
'মাস্টরজী কর ছোউয়া, কাটে কালা কাউয়া,এগো হাতমে ফাটল কিতাব, দুসরা হাতমে
ডেউয়া....' বলেই হেসে এ ওর ঘাড়ে গড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে
প্রশস্ত ঘাসজমিটার দিকে। যেখানে অপেক্ষা করে আছেন কুমুদরঞ্জন। ছড়া শুনে
মজা পেয়ে সত্যপ্রিয় নিজেও হেসে ফেলে। তারপর বই রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়
প্রার্থনা সংগীতের জন্য সমবেত লাইনের দিকে। মনে পড়ে কুমুদরঞ্জন সেদিন
তাকে আদেশ করেছিলেন, 'তুমি সামনে এসো। আমার পাশে এসে দাঁড়াও। "ধন্যধান্যে
পুষ্পেভরা" গান টা গাও। আজ থেকে 'বন্দেমাতরম' গাইবার আগে দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়ের লেখা এই গানটি তুমি প্রথমে গাইবে। তোমাকে দেখে ওরাও গাইবে। নাও শুরু
করো। ' গানটি মায়ের মুখে শুনে শুনে একসময় গলায় তুলে নিয়েছিল
সত্যপ্রিয়। গান শুনে আড়ালে নাকি প্রশংসাও করেছিলেন কুমুদ সুনয়নীর কাছে।
তখন ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায় নি এত বড় দায়িত্ব কাঁধে চাপবে একদিন। দুরুদুরু
বুকে গান শুরু করতেই সামনে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা গুলোও সুর ধরে
নেয়। প্রথমদিন যদিও ওরা কথাগুলো ধরতে পারছিল না তবুও সুর অনুসরণ করে
যাচ্ছিল প্রাণপণে।
এভাবে আস্তে আস্তে ছেলেগুলোর সাথে
ভাব জমে উঠতে থাকে সত্যপ্রিয়র। ওরা তাকে সমীহ করে দূরত্ব রাখার চেষ্টা
করলেও সত্যপ্রিয় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওদের কাছে আসার চেষ্টা করে চলে। যে
কারনে ওরাও আর দূরে থাকতে পারে না। সত্যপ্রিয় লক্ষ্য করে ওর কোনো অনুরোধ
ওরা ফেলছে না। বরং কে কার আগে কাজটি করে দিতে পারে তার যেন প্রতিযোগিতা চলত
ওদের ভেতর।
একদিন কুমুদের অনুমতি নিয়ে সকলে মিলে
মা সরস্বতীর ভাঙা মূর্তি দু'টো মাথায় চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে রেখে এসেছিল
কাজলিঝোরার ধারে। সারা রাস্তা সহপাঠীরা 'সরস্বতী-মাঈ-কী-জয়' ধ্বনি দিয়ে
হৈ-হৈ করতে করতে চলেছিল চা-বাগানের ভেতর দিয়ে কাজলির দিকে। ফিরে এসে নতুন
মূর্তিটা পরিষ্কার করে তাতে সত্যপ্রিয় সাজিয়ে দিয়েছিল মাধবীলতা ফুল
দিয়ে। যা দেখে সহপাঠীরা সকলেই বেজায় খুশি। কেবল কুমুদ খুশি হয়েছিলেন কিনা
মনে পড়ে না সত্যপ্রিয়-র। তবে সেদিন ওঁর আসার আগেই কাজগুলো সেরে ফেলা
গেছিল। ক্লাসে ঢুকে সব দেখে শুধু বলেছিলেন,'আগের মূর্তিগুলো কোথায় ফেলে
এলে?'
সত্যপ্রিয় কিছু বলার আগেই ছবিলাল ওঁরাও চটপট
উত্তর দেয়, 'উ নদী বটে রাইখকে আলো মাস্টরজি। সরসত্তি ডুবায়ক নি লাগেল।
পাপ লাগি।' ছবিলাল ভর্তি হয়েছিল ক্লাস ওয়ানে। বুকের বোতাম খোলা। হাফ
প্যান্টও তথৈবচ। পা-দুটো একটু বেঁকে গেছিল পোলিও রোগে। খুঁড়িয়ে হাঁটত।
চোখ দুটো বড়বড়। চুল ছোট করে কাটা। অনর্গল বকে চলেছে। কদিনেই ছবিলাল বেশ
নেওটা হয়ে উঠেছিল সত্যপ্রিয়র। 'মাস্টরজী-কর-বেটা' যা বলবে তাই যেন
শিরোধার্য।মাস্টারজির মুখের ওপর ওর ছটফটে কথার তোড় শুনে সকলেই হেসে ফেলে।
কুমুদ গাম্ভীর্য বজায় রেখে প্রশ্ন করে,'তুমকো কোন বোলা, ই বাত? '
ছবিলাল
নির্দ্বিধায় আঙুল তুলে সত্যপ্রিয়র দিকে দেখিয়ে বলে,' উ, অ-দে, তর বেটা
জুন।'( ঐ যে তোমার ছেলে)। কথাটা ঠোঁট ফসকাতেই পাশের ছেলেরা ওকে টেনে বসায়।
চাপা হাসির গুঞ্জন ওঠে ক্লাসে। অতিকষ্টে হাসি চাপেন কুমুদ।
স্কুলে
সাকুল্যে জনা কুড়ি ছাত্র। তাও একশো শতাংশ হাজিরা কোনও দিনই হয় না।
বাবুদের ঘরের দু'তিন জন বাঙালি ছাত্র ছাড়া বাকি সকলেই আদিবাসী ঘরের
ছেলেপুলে। শিক্ষক বলতেও কুমুদরঞ্জন একা। উনিশশো আটাশ সালে এই স্কুলের
চাকরিটি জোগাড় করে দেন কুমুদের ভগ্নিপতি। যিনি ছিলেন কাজলিডাঙার বড়বাবু।
ম্যাট্রিক পাশ করার পর চাকরি প্রার্থী কুমুদকে তিনি ডেকে নেন চা বাগানে।
তখন জঙ্গলঘেরা, ম্যালেরিয়া-কালাজ্বরের ডিপো, শ্বাপদসংকুল চা-বাগান অঞ্চলে
একাকীত্ব কাটাতে চা-বাগানের নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব বাবুরা চাকরির আশ্বাস
দিয়ে প্রিয়জনকে ডেকে নিতেন কাছে। চাকরি জুটিয়েও দিতেন ব্রিটিশ সাহেবদের
ধরেকয়ে। ভগ্নিপতির ডাক এড়াতে না পেরে সেই চলে আসা। তারপর একটু একটু করে
বিয়ে থা করে থিতু হওয়া কাজলিডাঙায়।
স্কুলটি ছিল
বাগান কর্তৃপক্ষের অধীন। যে কারণে মাসিক বেতন হিসেবে বাগান কর্তৃপক্ষ
সামান্য কিছু দেয় কুমুদকে। এছাড়া বাসস্থান, জ্বালানী, একজন কাজের লোক
ছাড়াও আনুষঙ্গিক যা কিছু বাগানের বাবুরা পান কুমুদও সেটা পেতেন। তা বাদে,
সবজি খেতের শাক-সবজি,কলা-মুলো, গরুর দুধ, এসব নিয়ে টেনেটুনে একভাবে কেটে
যেত দুই ছেলে, আর সুনয়নীকে নিয়ে কুমুদের ছোট্ট সংসার।
তবে
সামান্য বেতনের বিনিময়ে স্কুলে পড়ানো ছাড়াও কুমুদকে বাগানের অফিসেও
কিছু কাজ করে দিতে হতো। যেমন, বাৎসরিক 'ঘরসুমারি' বা ডোমেস্টিক সেন্সাসের
পুরো দায়িত্ব থাকত কুমুদের ওপর। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় মাস খানেক ধরে
বাগানের শ্রমিক বস্তির ঘরে ঘরে ঘুরে তাদের ঘর-গেরস্থালীর অবস্থা, মানুষের
সংখ্যা, গরু-ছাগল কত, স্থাবর অস্থাবর কী আছে তা নথীভুক্ত করতে হত কুমুদকে।
তার ওপর অফিসিয়াল নানান খাতাপত্রের কাজে সাহায্যর জন্যও ডাক পড়ত। কেননা
কুমুদের মুক্তো ঝরানো ইংরেজি হাতের লেখা সাহেবদের খুব পছন্দ ছিল।
ঘড়ির
কাঁটা মিলিয়ে রোজ সকাল দশটায় প্রার্থনা সঙ্গীত হয়। তারপর দুপুর একটা
পর্যন্ত ক্লাস। মাঝে ঘন্টা খানেকের বিশ্রামের পর আবার বিকেলে দুটো থেকে
চারটে । তারপর ছুটি। এমনটাই চলত প্রতিদিন। বিশ্রামের অবকাশে স্কুলে তালা
দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন কুমুদ। বাড়ি ফিরলে রান্না ঘরে পিঁড়ি পেতে
দিয়ে স্বামী-পুত্রকে খেতে দিতেন সুনয়নী। খাওয়া শেষে আধঘন্টা খানেক
বিছানায় গড়িয়ে নেয়া অভ্যেস ছিল কুমুদের। সেই ফাঁকে সত্যপ্রিয় হারিয়ে
যেত নিজের ভালবাসার পৃথিবীতে। যেখানে অপেক্ষায় থাকত সবজি খেতের সবুজ আদর,
বাঁশঝাড়ে রহস্যময় মড়মড় শব্দের কুহক, দলগাঁও ফরেস্ট রেঞ্জ থেকে উড়ে আসা
টিয়ার ঝাঁক। এছাড়াও গাছে গাছে বিচিত্র রঙবেরঙের পাখি, তাদের সুরেলা
শিস, মিষ্টি ডাক, প্রজাপতি, জলফড়িং, কাঠবিড়ালি, সাপ, ব্যাঙ, মৌমাছিদের
নিয়ে রান্না ঘরের পেছনে এক আশ্চর্য মোহময় জগত। যে জগত ছেড়ে ঘরে ফিরতে মন
চাইত না। তবু স্কুলের সময় হতেই বাবার ডাকে ফিরতেই হতো।
সন্ধে
নাগাদ আমগাছের পাতায় চাঁদ উঁকি দিতেই বাঁশঝাড়ে, বাসক-নিশিন্দার ঝোপে যখন
জোনাকি জেগে উঠতো, রান্নাঘরের বারান্দায় সাফসুতরো লন্ঠনের ফিতেয় শলাই
জ্বালতেন সুনয়নী। বাইরের ঘরে সতরঞ্চি পেতে লন্ঠনটা বসিয়ে দিয়ে যেতেন
তিনি। যে সতরঞ্চির ওপর এক কোণে সুতোর অ্যাপ্লিক করে সুনয়নী লিখে
রেখেছিলেন,'স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।' সেটিতে বসে
একসময় পড়াশোনা করতেন বড় দাদা বিশু,অর্থাৎ বিশ্বপ্রিয়। উঁচু ক্লাসে উঠে
সে দেশের বাড়ির স্কুলে ভর্তি হয়ে চলে যাওয়ার পর কদিন আসনটি পড়েছিল
আলমারির ভেতর। ছোট ছেলে সত্যর লেখাপড়া শুরু হতেই সেটি আবার বের করে
সুনয়নী। ওতে বসে সত্যপ্রিয় বাবার কাছে বাংলা,ইংরেজি,অংক,বিজ্ঞান,ইতিহাস,ভুগোলের
পাঠ নিত নিয়ম করে। কুমুদ প্রতিটি বিষয় বড় যত্ন করে পড়াতেন। নিজেকে যেন
উজাড় করে দিতেন প্রতিদিন।আসলে ছোট ছেলের ভেতর সহজাত মেধার সন্ধান
পেয়েছিলেন তিনি। মেধাকে ছাপিয়ে সত্যপ্রিয়র ছিল অসম্ভব পাঠতৃষ্ণা। সুযোগ
পেলেই বই এনে দিতেন কুমুদ ছেলেকে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন লেখকের লেখা। বাবার
কাছে পড়তে বসে সত্যপ্রিয়র মনে হত তিনি যেন তার সব টুকু জ্ঞান দিতে দিতে
নিঃস্ব করে ফেলছেন নিজের জ্ঞানভাণ্ডার। মনে হত যেন বড্ড তাড়া তার।
বারান্দার
চেয়ারে বসে স্মৃতি ঘেঁটে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল সত্যপ্রিয়। একটু
বাদেই সুবর্ণর ফোন আসবে। আজ সে জানতে চায় সত্যপ্রিয়র লেখাপড়ার শুরুর
কথা। কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারে না সত্যপ্রিয়। কাজলিডাঙার
স্কুলে তো মাত্র দুটো বছর। তারপরেই তো শুরু হল পড়াশোনার জন্য লড়াই।
কাজলিডাঙা থেকে জটেশ্বর, সেখান থেকে ফরিদপুর, তারপর ফিরে এসে কুচবিহার।
বারবার ঠাঁইনাড়া।
ক্লাস
টু পেরোতেই বাবা আর স্কুলে নিয়ে যেতেন না।বাড়িতে পড়েই মেধাবী সত্যপ্রিয়
অনেকটা এগিয়ে যায়। একদিন ক্লাস ফোর এর বইপত্তর এনে বাবা বললেন বৃত্তি
পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে। বছর খানেক প্রস্তুতির পর একসময় বৃত্তি
পরীক্ষা এগিয়ে এল। পরীক্ষা দিতে হবে ফালাকাটায় গিয়ে। কাজলীডাঙা থেকে
ফালাকাটা ১৭ কিমি পথ। যেতে হবে গরুর গাড়িতে। সেখানে ড্রামাটিক ক্লাবে শুধু
থাকার ব্যবস্থা। রান্নাবান্না কুমুদ নিজেই করে নেবেন। যাওয়ার দিন ভোর
নাগাদ গণশু ওর গরুর গাড়িটা নিয়ে এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। সকাল ন'টা
নাগাদ বাক্স-প্যাঁটরা, চাল-ডাল, সুনয়নীর হাতে তৈরি ঘি, সর্ষের তেল ,বইপত্র
চাপিয়ে বাপ ছেলে মিলে উঠে বসা হল গাড়িতে। গাড়ি গড়িয়ে চললো রাস্তা
ধরে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় গাড়ি যত ঝাঁকুনি দেয় গরুর গলার ঘন্টা তত জোরে
বাজতে থাকে। ঝাঁকুনি মাঝে মাঝে এত দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল যে কুমুদরঞ্জন নেমে
পড়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন । অনেকটা ভাঙা পথ পেরনোর পর আবার উঠে পড়ছিলেন
গাড়িতে। রাস্তায় আদিতোর্সার ওপর ভাঙা পুলটা পেরোতেই কিছুটা দূরে সেগুন
গাছের ছায়া ঘেরা শুনসান জায়গাটার নাম 'বাগানবাড়ি'। দিনের বেলাতেও
জায়গাটায় ছায়াঘন অন্ধকার। ছমছমে পরিবেশ । বাগানবাড়ির কাছাকাছি আসতেই
হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো গরুগুলো। অস্থির হয়ে উঠল গণশুও। গলুইয়ের বাইরে
দুপাশে বাঁশের বেড়ায় বারবার আঘাত করে করে মুখ দিয়ে' হো ওওও, হাঃ হ্যাট,
হ্যাট, হুররররর হাঃ' শব্দ তুলছিল থেকে থেকে। ছোট্ট সতু ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে
গিয়ে কুমুদকে জিজ্ঞেস করে, 'ও অমন চেঁচাচ্ছে কেন বাবা?'
-'
কিছু নয়। এমনি।' বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কুমুদ। কিন্তু বারবার
অমন চিৎকার কৌতূহল বাড়ায়। ফের প্রশ্ন করতেই এবার গণশু মুখ খোলে, ' ই
জঙ্গল মে বাঘ হ্যায় ছোটাবাবু। বাঘ কা গমক্ মিলনে সে ব্যয়ল সব ডরতা
হ্যায়। ইসলিয়ে... '
সতুকে বুঝিয়ে দেন কুমুদ। কথাটা
সত্যি। বাঘের আনাগোনা আছে এ জঙ্গলে। গন্ধ পেলে বলদগুলো বেচাল করে। তাই
ওদের ভরসা দিতে এই হৈ-হট্টগোল। শুনে হাত পা ঠান্ডা হবার যোগাড় হয়
সত্যপ্রিয়র। ঐটুকু জায়গা পার না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি থেকে কুমুদকে নামতে
দেয়নি সত্যপ্রিয়।
এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে গরুর
গাড়ি যখন গিয়ে ফালাকাটা ড্রামাটিক ক্লাবের সামনে দাঁড়ালো তখন সন্ধে
গড়িয়ে গেছে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে সেই রোমহর্ষক পথ অতিক্রম আজও ভুলতে পারেন
না সত্যপ্রিয়।
ঘড়ির
কাঁটা কখন যে রাতের খাবার সময়কে ছুঁয়ে ফেলেছে টের পায়না সত্যপ্রিয়।
'খেতে আসুন ' দরজার ভেতর থেকে নির্দেশ আসতেই অতীত থেকে নিজেকে গুটিয়ে
বর্তমানে ফিরে আসতে হয়। সময় পেরিয়ে গেছে। রাত সাড়ে আটটার পর সচরাচর ফোন
করে বিরক্ত করে না সুবর্ণ। হয়ত কাজে জড়িয়ে গেছে। চা -বাগানের ফ্যাক্টরি
সুপারভাইজারের কাজ। কত যে দায়িত্ব, কত যে দুশ্চিন্তা মাথায় ঘোরে তা
নিজেকে দিয়ে অনুভব করে সত্যপ্রিয়। প্রথম জীবনে বছর খানেকের শিক্ষকতা।
তারপর দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী তো চা তৈরির কাজেই নিজেকে সঁপে দেয়া। এতগুলো বছর
ধরে চা উৎপাদনের সব কটা পদ্ধতি তার চোখে দেখা। কারখানার মেশিন পত্তর, তাদের
আচার আচরণ সব নখদর্পণে। কোন মেশিনের কেমন শব্দ চোখ বুজে বলে দিতে পারেন।
চোখে ভাল দেখতে না পেলেও শুধু স্বাদগন্ধ বিচার করেই বলে দিতে পারেন এখনও,
কোনটা কোন গ্রেডের চা। কিংবা কোন চা কত দামে বিক্রি হতে পারে।
সুবর্ণও
প্রয়োজনে সত্যপ্রিয়র কাছ থেকে নানান পরামর্শ নিয়ে থাকে। বেচারা ছেলেটা
চাকরি, সংসার সব নিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়ে আছে। পরিবার থাকে একজায়গায়। নিজে
আরেক জায়গায়। অন্যের হাতে যা হোক একটা রান্না খেয়ে দিনকাটাতে হচ্ছে
তাকে। আসলে সন্তান মানুষ করার জন্য এই যে কৃচ্ছ্রসাধন এই রেওয়াজটা কিন্তু
আগে ছিল না চা বাগানে। স্বাধীনতার আগে ডুয়ার্স অঞ্চলে পড়াশোনার সুযোগ
সুবিধে না থাকায় অনেকেই সন্তানদের পাঠিয়ে দিতেন দেশের বাড়ি বর্তমান
পূর্ববঙ্গের নানা জেলায়। এখন মানুষের চাহিদা বেড়েছে। বেড়েছে
উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সন্তান কে সকলেই দেখতে চায় সমাজের শীর্ষ স্তরে । কিন্তু
সকলের কী সেই আশা পূরণ হচ্ছে? সত্যপ্রিয়র মনে হয় তা একেবারেই নয়। বরং
খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ইচ্ছাপূরণ ঘটলেও অন্যদের ব্যর্থকাম তাদের হিংস্র
করে তুলছে। যেনতেন প্রকারে মোক্ষলাভের উদগ্র বাসনা মনকে বিষিয়ে তুলছে। ঘরে
ঘরে ঘটে যাচ্ছে নানান দুর্ঘটনা ।
বাবার
অসুস্থতা নিয়েও বিব্রত রয়েছে সুবর্ণ। ভদ্রলোক ভাল নেই। স্ত্রী মারা
যাওয়ার পর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছেন সুধাময়বাবু। বয়সে কিছু বছরের বড়
এই মানুষটি ডুয়ার্সের চা-বলয়ের পরিচিত জীবিত মানুষদের মধ্যে একজন।
কর্মজীবনে কুমুদরঞ্জনের মত তিনিও ছিলেন চা-বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রধানশিক্ষক। অসম্ভব ভাল ফুটবল খেলতেন। বিভিন্ন খেলার জন্য নানা জায়গায়
ডাক পড়তো তার। খেলা পাগল কুমুদের মুখেও সুধাময়ের নাম শুনেছে সত্যপ্রিয়।
শিক্ষক হয়েও সুধাময় মিত্র ছিলেন চা কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত।
ইউনিয়নে সক্রিয় ভুমিকা পালন করতেন সুধাময়। স্বল্পবাক হলেও নীলপাহাড়ীর
ম্যানেজমেন্টের অনৈতিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনেকবার প্রতিবাদে সোচ্চার
হয়েছেন। দু'জন কর্মচারী চাকরি সংকটের মুখে পড়লে সেই সংকট নিরসনে সদর্থক
ভুমিকা নিয়েছিলেন সুধাময়বাবু।
রিটায়ার করার পর
শিলিগুড়ির বাড়িতে চলে গেছিলেন । তার আগেই অবশ্য ইন্টারভিউ দিয়ে সুবর্ণ
চাকরি পায় নীলপাহাড়িতে। ইন্টারভিউয়ে প্রথম স্থান পেলেও তাকে চাকরিতে
ঢুকতে দিতে চায়নি স্থানীয় কিছু ভূমিপুত্র। নানাভাবে অপদস্থ করা শুরু
করেছিল তারা সুবর্ণকে। ব্যাপারটা ইউনিয়ন সভাপতি বরুণবাবু্ সেবার দারুণ
ভাবে সামলেছিলেন।
ভাবতে
বসলে অনেকে পুরনো কথা ভীড় করে আসে বুকের ভেতর। সেসব আলোচনা করার মতো লোকজন
কমতে কমতে চারধারে শুধুই মরুভূমি এখন। না বলতে পারলে বুকের ভেতরটা
উথালপাথাল করে। সুবর্ণ যখন জানতে চায় তখন বন্যার ঢেউয়ের মতো সব তালগোল
পাকিয়ে ছুটে আসে দুর্বার গতিতে।
'বাবা
ভেতরে আসুন, খাবার যে ঠান্ডা হয়ে গেল। বাইরে এত রাত অবধি বসে থাকলে যে
বড়সড় অসুখ বাঁধাবেন। তখন তো আমাদেরই সামলাতে হবে। কদিন আগেই তো অসুখ থেকে
উঠলেন, সে খেয়াল আছে?'
শিশুর
মত শাসন করে ইদানীং বৌমা। চিরকাল খামখেয়ালি মানুষ টাকে আগলানোর এ বাড়িতে
তো কেউই রইলো না আর। বৌমার শাসনকে তাই মায়ের শাসন বলেই মেনে নেন
সত্যপ্রিয়।