গঞ্জহাটের আখ্যান/৫
গঞ্জহাটের আখ্যান/৫
সুবীর সরকার
--------------------------
১৯.
ইয়াকুব ব্যাপারীর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হয়ে যায় ঘুঘুডাঙার হাটে। তখন মধ্য দুপুর। ভরা হাটের
গুমগুম শব্দ। ইয়াকুব গরুহাটির পাশে ঝাঁকড়া শিমুল গাছের নিচে ভবেন বৈরাগীর গান শুনছিল। ভবেনের গায়কখ্যাতি তিরিশ চল্লিশ গঞ্জ হাটে কিংবদন্তির মতো। গৌরীপুরের লালজি রাজা তার গান ভালোবাসে। প্রতিমা বাইদর দলেও একসময় দোতরা
বাজাত সে।
হাটে হাটে গান গেয়ে গেয়েই জীবন কাটিয়ে দিল ভবেন বৈরাগী।
ইয়াকুব আজ বায়না করেছিল দেহতত্ত্ব মনশিক্ষার
গানের।
আমরা যখন ইয়াকুবকে ভরা হাটের পাশে ঝাঁকড়া শিমুল বৃক্ষের নিচে আবিষ্কার করি, তখন সে ভবেনের
গানে উদ্বেল_
"ওরে টাকা পয়সা ভিটা বাড়ি
জীবন গেইলে সব রইবে পড়ি
সঙ্গের সাথী তোর কেউ তো হবে না"
গান শুনতে শুনতে ইয়াকুবের চোখ ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।
সে কি দূরাগত হাওয়ায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল!
জন্ম কিংবা মরণ নিয়ে কোন দার্শনিকতা তাকে আক্রান্ত করেছিল!
সমাধানহীন এই প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে গান কিন্তু বেজেই চলছিল_
"আরে হাতি মার্কা কেরাসিন তেল
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপরে বাপ
মাওরে মাও
আজি মোর গাও ঝনঝন করে রে"
২০.
গঙ্গাধরের উজানে মাইল মাইল হাঁটতে হাঁটতে একসময় দাড়িয়েই পড়তে হয় বিমল মালিকে।
সে মুখ ফিরিয়ে পেছনে শীতের নদীকে দেখে।বিমলের কাধে ঢোল।গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
এই ঢোলের জাদুতে অন্তহীন গানবাড়ির মানুষেরা উদ্বেল হয়ে ওঠে। বিমল মালির ঢোল কথা বলে।মানুষের দৈনন্দিন যাপন গানে আর ঢোলে ছড়িয়ে পড়ে দিক ও দিগরের দিকে।
"রাজার বেটির" দলে কত কত বছর জুড়ে বেজে চলেছে বিমল মালির জাদু ঢোল।
গত রাতে বিমল গিয়েছিল সিতানন্দ বুড়ার বাড়ি।
সীতানন্দর সারিন্দা আর বিমলের ঢোল_প্রায় সারারাত চলেছিল তাদের আসর। এমন আসর প্রায়ই বসে তাদের। সঙ্গে "চাওলা" আর "নাসিরউদ্দিন বিড়ি"।
গান চলে। গান থামে।
দুঃখ সুখের কথা হয়। দেশ গ্রামের কথা হয়।
এভাবে মত্ততা জাগে। স্মৃতিকন্দর থেকে ভুস করে জেগে ওঠে গানের কলি_
"বুড়া মাছ মারে রে
গঙ্গাধরের পারে
মাছ মারিতে মাছ মারিতে
বুড়াক নিল চিলে"
অন্যমনস্কতার ঘোর থেকে একসময় বেরিয়ে আসে
বিমল মালি।তারপর সে আবার হাটতে থাকে
গঙ্গাধরের উজানে।
এভাবে কত গল্প জমে ওঠে আমাদের এই চারপাশের পৃথিবীতে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴