সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
26-November,2022 - Saturday ✍️ By- অমিত কুমার দে 486

কাফেরগাঁও/অমিত কুমার দে

কাফেরগাঁও   
অমিত কুমার দে
^^^^^^^^^^^^^^^

লাভা গিয়ে জানলাম – লোলেগাঁও-এর রাস্তা দিয়ে যাওয়া কঠিন, রাস্তা কেটে কাজ চলেছে। একজন তো বলে দিলেন – “কী গাড়ি দেখি!” আমাদের গরীবী গাড়ি দেখে তিনি মুখ বেঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে নিদান দিলেন – “অসম্ভব, এ গাড়ি নিয়ে কাফেরগাঁও-এ পোঁছতে পারবেন না কিছুতেই!” 
আঁচ করলাম – বক্তাটির নিজের গাড়ি আছে। এবং সে কারণেই আমাদের নিরুৎসাহিত করছেন! আমরা যাতে বলে ফেলি – “আমাদের এ গাড়ি এখানে রেখে তবে আপনার গাড়ি ভাড়া নেওয়া যায় ভাই?” 

কিন্তু সে পথে শুভ কিছুতেই যাবে না। সে রীতিমতো কনফিডেন্ট তাঁর গাড়ি নিয়ে। ড্রাইভিং নিয়েও। অন্য পথের খোঁজ চলল! এবং মিলেও গেল। কালিম্পং-এর আগে ‘বারো মাইল’ থেকে বাঁ দিকে নেমে যেতে হবে। রেলি বাজারের পথ দিয়ে এগোতে হবে। সেটা দিব্যি ভালো রাস্তা।
পাহাড়ি গান বাজতে লাগল গাড়ির স্পীকারে। ঠিক রাস্তায় পৌঁছেও গেলাম। বহ্নি বলল – “দ্যাখো, ঘরের কাছেই স্বর্গ!” আঁকাবাঁকা পথের দু’ধারে যে সব রঙিন বাড়ি দেখা যাচ্ছিল, সব যেন রঙ-তুলিতে আঁকা। পপি বলল – “এই দুর্গমে কত কষ্ট করে লোক বাস করে!” বহ্নি বলল – “তুমি ভাবতেই পারবে না এখানের কত মানুষ কত বড়সড় কাজের সঙ্গে যুক্ত। দারুণ উপার্জন করে। কিন্তু নিজের শেকড়কে ভোলে না। পাহাড়ে দিব্যি প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছে!” অন্তরা জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে আর ভাবছে – “সুইজারল্যান্ডে চলে এলাম না তো!” 

কাফেরগাঁও পৌঁছতে একটু বেলাই হয়ে এল। পেটে চোঁ চোঁ! ব্যাগ ঘরে ঢুকিয়েই সোজা ডাইনিং হল। ঢুকেই মনটা অন্যরকম খুশিতে ছেয়ে গেল। এত ছিমছাম সাজানো – চোখ শান্তি পায়। জানালা দিয়ে পাহাড় আর মেঘেদের খুনসুটি! আমার চোখ আটকে গেল খাবার ঘরের দেওয়ালে! এখানেও তিনি!! রবি ঠাকুরের একখানা ছবি, আর তাঁকে নিয়ে কয়েক ছত্র! একটা ছোট্ট মেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। বড্ড মিষ্টি। ওর মা আমাদের খাবার পরিবেশনের কাজ করে চলেছেন। আমি খাতির জমালাম মেয়েটির সঙ্গে। কি নাম? গালে টোল ফেলে বলল – “দাওয়ালামু তামাং।” কোলে টেনে রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে বললাম – বলো তো ইনি কে? পাহাড়ের সমস্ত সারল্য মুখে চোখে এনে কী সুন্দর করে বলল – “ও তো ভগওয়ান হ্যায়!”
আর আমার মনে হতে লাগল কাফেরগাঁও-এ সত্যিই ঈশ্বরের বাস। সহজ সরল মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে তিনটে দিন ঈশ্বরেরই দর্শন করলাম! সব ব্যস্ততাকে সমতলে রেখে পাহাড়ে উঠেছি। ভেবেই এসেছি এখানে কোনো ছোটাছুটি নয়। 

হোম স্টে-র মালিক সুনীল তামাং-এর কাছে জানতে চাইলাম – এত সুন্দর গ্রামটির নাম ‘কাফেরগাঁও’ কেন! স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে জানালেন, মেঠো আলুর মতো এক ধরণের ফল হয় এখানে, মাটির নিচে। তাকে ‘কাফের’ বলা হয়। সে থেকেই ‘কাফেরগাঁও’। পাহাড়ের গায়ে বিরাট এলাকা নিয়ে সুনীলের হোম স্টে। জৈব সারে কত শাক সবজি ফলছে এখানে। আমরা বায়না ধরলাম স্কোয়াশের লকলকে ডগা পাতা দিয়ে তরকারি রেঁধে খাওয়াতে হবে। হাসিমুখেই সুনীল সেই দাবি মঞ্জুর করলেন।  

ফুলমায়া তামাং (৬৯), সুনীলের মা, যেন শরীরে পাহাড়ের প্রবীণ সৌন্দর্য ধরে রেখেছেন সযত্নে। মুখ জুড়ে বলীরেখা, নাকে ট্রাডিশনাল বিশাল নোলক, মুখ ভরা হাসি। এক মনে কাজ করে চলেছেন। পাতা পচানো সার দিয়ে চলেছেন গাছের গোড়ায় গোড়ায়। পাশে গিয়ে বসতেই আত্মীয়তার হাসি। কখনো কখনো কথা না বলেও অনেক কথা বলে ফেলা যায়! তাঁর স্বামী ধনবাহাদুর তামাং-ও এসে বসলেন। তিয়াত্তর বছর বয়সেও একটা মানুষ সারাদিন কত কত কাজ করে চলেন – তিনটে দিন কাছ থেকে দেখেছি আর বিস্মিত হয়েছি। 

পোষ্যরাও আমার বন্ধু হয়ে উঠল নিমেষে। এক ঝাঁক পাহাড়ি সারমেয় আমার সঙ্গে তিনদিন হাঁটতে গেল। পাশে বসে থাকল! রাতে ঘরের দরজায় চৌকাঠে শুয়ে থাকল। আমার স্বভাব তাদের সঙ্গে গল্প করা। হয়তো ওরা বাংলা বোঝে না, কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে খুব বোঝার চেষ্টা করেই গেল। আর বেড়ালটাকে একটু দেমাকি মনে হল, এই যা! একখানা বিশাল মোরগ আমাকে পাত্তাই দিল না! আশেপাশে ছানাপোনা সহ বান্ধবীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে যে! তবে ভোর হওয়াটা ঠিকঠাক জানাতে ভোলেনি! আর পাত্তা দেয়নি মালকিনের পোষা ধোপদুরস্ত বিদেশি কুকুরটা। ছাগলদের এমন বাসা আগে দেখিনি! ফোঁকর দিয়ে মুখ বের করে সবুজ পাতা চিবিয়েই চলেছে। তিনদিনই তাদের সঙ্গে আড্ডা মেরে এসেছি। পাহাড়ি ছাগল, ছাগলত্বই (ব্যক্তিত্ব বলা ব্যাকরণসই হবে না হয়তো!) আলাদা!!!

ধনবাহাদুরের সঙ্গে অনেকগুলো সময় পাহাড়ের গল্প শুনে কাটল। কাফেরগাঁওয়ের পত্তন হয়েছিল ১৯২৮ সালে; তার আগের বছর লোলেগাঁও। ধনবাহাদুরের স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল – ঘোড়ায় চড়ে টকটকে ফর্সা সাহেবরা আসতেন এ গ্রামে। পাইন বনের গভীরে যেতেন শিকার করতে। এই পাহাড়ের জঙ্গলে প্রচুর গাছ – পাইন, রানি চাপ, ধুপি, বর, পিপল, চিলাউনি ...। কত জানা অজানা লতাপাতা কীটপতঙ্গ, রকমারি পাখি। জঙ্গলে অনেক হরিণ আছে। ভালুক চিতাবাঘ আছে গভীর অরণ্যে। ৫২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই গ্রামে সবসময় মেঘ আর কুয়াশার খেলা। ধনবাহাদুর জানালেন – এখান থেকে দু কিলোমিটার গেলে সাইলুং বাজার, সেখানে হাট বসে প্রতি শুক্রবার।
হোম স্টে-র সামনে দিয়েই একটা পথ চলে গেছে জঙ্গলের দিকে। বড্ড মোহময় সে পথ, নেশা ধরায়। নূপুরের মতো ঝিঁঝিঁর আওয়াজ, আর পাখির ডাক। পাতায় পাতায় ডালে ডালে ঘষা লেগে কত শব্দ। কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর চলে গেছি একা একা। এই নৈ:শব্দ যে কত মহার্ঘ্য – তা ভাষায় অবর্ণনীয়। প্রাচীন বৃক্ষের গায়ে ফুটে আছে পরগাছা ফুল। তবে সুন্দরের জন্য খেসারতও দিতে হল! হোম স্টেতে ফিরে আবিষ্কার করলাম পায়ের পাতা রক্তে ভিজে গেছে! আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে জোঁক!!

সুনীলের পরিবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ডাইনিং হলের ওপরতলায় কী যত্ন করে একটা ছোটোখাটো গুম্ফা বানিয়ে ফেলেছেন। বুদ্ধ পূর্ণিমার সকালে সেই পারিবারিক গুম্ফায় গিয়ে বসলাম। জানি না, এ সুযোগ আর এ জীবনে হবে কিনা! বুদ্ধের জন্মদিনে, তাঁর বোধিলাভ ও মহানির্বাণ লাভের পুণ্যদিনে পুরো বৌদ্ধ আরাধনা দেখলাম সেখানে বসে। লামা এসে উদার কন্ঠে নানান সুর করে ত্রিপিটক থেকে মন্ত্র পড়ছেন। ছড়িয়ে পড়ছে সেই মন্ত্র পাহাড়ে পাহাড়ে। পুজো শেষে পেলাম বুদ্ধ-পুজোর প্রসাদ। এ দিনই কাফেরগাঁওয়ের বড় গুম্ফায় গিয়ে আমরাও প্রদীপ জ্বাললাম। প্রাণ জুড়ে শান্তি, শান্তি, শান্তি...। 

ফেরার পথে পাহাড়ের ঢালে সুনসান রাস্তায় একটা ফুল-ছাওয়া বাসার সামনে ‘কাফের বেকারি’ সাইনবোর্ড দেখে বহ্নির আবদার – “গাড়ি থামাও, কেক কিনব!” সুন্দরী ঝর্না ছেত্রী বেরিয়ে এলেন তাঁর সুন্দর ঘর থেকে। কেক পাওয়া গেল না, তবে তাঁর হাতের তৈরি আইসক্রিম যেন অমৃত! ঝর্নার উঠোনে অনেকটা সময় আনন্দে কাটল আমাদের। মানুষ ঝর্নার সঙ্গে আমাদের সঙ্গে লুকোনো পাহাড়ি ঝর্নাও ছিল সারাটা সময়! 

দ্বিতীয় দিন আমরা গিয়েছিলাম ডাবলিং ভিউ পয়েন্টে। খুব ধীরেসুস্থ্যে। কারণ আমরা ভেবেই এসেছি খুব ছোটাছুটি নয়। চোখ পেতে দিতেই প্রশান্তি। নাগালে মেঘ, নিচে সবুজের প্লাবন; বৃষ্টির জলে ভেজা। বহ্নির অনেক পুরনো পুরনো গান মনে পড়ছিল! নিসর্গ ও গান মিলেমিশে একাকার হল। বুদ্ধ পূর্ণিমার দুপুরবেলায় ডাবলিং ভিউ পয়েন্টে একটা গুহার মতো পাহাড়ি ঢালে আমরা আবিষ্কার করলাম কে যেন পাথরের গায়ে এঁকে রেখেছে বুদ্ধের অসামান্য ধ্যানমগ্ন ছবি। প্রণত হলাম। এক অদ্ভুত বিশুদ্ধতা ছড়িয়ে গেল শরীরে মনে!

ফেরার পথে ছোট্ট একটা দোকানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বহ্নি কিনে আনল হাতে তৈরি ‘তেঁতুলের চকলেট’। অপূর্ব। জিভে নিয়ে সবাই ‘আহা আহা’ করতে করতে লোলেগাঁও চলে এলাম!
লোলেগাঁওয়ের বিখ্যাত ক্যানোপি ওয়াকের জায়গায় পৌঁছে দেখি ঝুলন্ত সেতু বেঁকে রয়েছে, ওঠা বারণ। তিন তরুণ ফোটো তোলায় ব্যস্ত। তাদের একজন জানিয়ে দিলেন তাকে সতেরখানা জোঁক ধরেছে। সেই শুনে অন্তরার চিৎকার – “এমন জোঁকের জায়গায় বেড়াতে আসার কোনো মানেই দেখি না!” সবাই লাফাতে লাফাতে ফিরতে লাগলাম। বাকি ফেরার পথটাও বারবার মনে হতে লাগল পা বেয়ে বুঝি তেনারা কিলবিল করছেন!! 

রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। কাফেরগাঁওয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মনে হল পৃথিবীর বাইরে কোথাও এসে দাঁড়িয়েছি। এক অলৌকিক রাত! পাইনবন কী গাঢ় রহস্যঘন হয়ে বাতাসে দুলছে। যেন কেউ ডাকছে! আমরা হাঁটতে লাগলাম পাইন বনের পাশ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার চলে এসেছি, যেন নিশির ডাক পেয়েছে! হঠাৎ দুষ্টুমি মাথায় চাপল; অন্তরাকে বললাম – “ভাবো অন্তরা, যদি এমন হত – ঐ বাঁকটায় এমন একজনের দেখা মিলল – ধবধবে সাদা শাড়ি প'রে দাঁড়িয়ে আছেন, পা মাটি থেকে দু’হাত ওপরে। আমাদের আওয়াজ পেয়েই তিনি সাঁই করে উঠে পড়লেন পাইন গাছের মগডালে। হি-হি-হি করতে করতে কাঁপিয়ে তুললেন এই রাতের নিস্তব্ধ পাহাড়! কেমন হত?” আমার বলাও শেষ, আর অন্তরার ভীষণ ভয় পাওয়া শুরু! ফেরার পথে হঠাৎ সে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। ওর মনে হল কেউ ওকে পেছন থেকে খুব জোরে ধাক্কা দিল! পুরো রাতটা কেমন ভৌতিক হয়ে উঠল!! আর তখনি খুব জোরে হাওয়া উঠল, মনে হয় ঝড় আসবে, চাঁদ ঢেকে গেল বৃষ্টির মেঘে!

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri