একান্নবর্তী-৫/গৌতম কুমার ভাদুড়ি
একান্নবর্তী/৫
গৌতম কুমার ভাদুড়ি
ত্রিগুণাতীত যাকে বলি
পেশায় ডাক্তার, তবে আমার প্রসঙ্গে ডাক্তারির সুযোগ বা আমার পক্ষে দুর্যোগ এখনও ঘটেনি। তাই আশুতোষ আমার সাহিত্য-বান্ধব, ফাজলামি পরিপূরক, আমার যাবতীয় গোপন অভিসন্ধিগুলোর নির্ভরযোগ্য রক্ষক এবং নাটকাদির ক্ষেত্রে আমার সহদর্শক। তবে আশুতোষের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত লেখালিখির সূত্রে। তখন আমি সবে কলকাতা থেকে স্বভূমিতে ফিরে এসেছি।আনন্দবাজার পত্রিকার দপ্তর থেকে আমাকে একজন ফোন করে জানতে চাইল কোচবিহারে আশুতোষ চক্রবর্তী নামে কাউকে আমি চিনি কিনা, তাঁর নামে একটি চেক পড়ে আছে, সেটি পাঠাতে চায় ওরা।ঘণ্টাখানেকের চেষ্টাতেই পেয়ে গেলাম। তখন আশুতোষ কড়চা বিভাগে লেখা পাঠাত সরাসরি কলকাতার ঠিকানাতেই, তারই কিছু অর্থপ্রাপ্তি সম্ভব হল আমার মধ্যস্থতায়, আর অর্থই যেহেতু অনর্থের মূল, আমিও প্রথম দিনই আশুতোষকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে গেলাম। খুব পরিচিত একজন চিকিৎসক,সবার বন্ধু, সদাহাস্য এক দুর্লভ ব্যক্তিত্ব ডক্টর আশুতোষ চক্রবর্তী। আমাদের উভয়েরই প্রাত্যহিক ব্যস্ততা একটু প্রবল ধরণের হওয়া সত্বেও আমাদের একত্রাবস্থানে কেউ মনেও করবেন না যে আমরা কোনদিন সামান্যতম দায়িত্বটুকুও পালন করতে পারি। সে অন্য প্রসঙ্গ, সেটা ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হবে।
আশুতোষ খুব ভালো ছড়াজাতীয় কবিতা লেখে। তাৎক্ষণিক। সাম্প্রতিক সমস্যা মাথায় ধাক্কা মারলে ও দ্রুত সেটা কবিতায় প্রকাশ করতে পারে। গদ্যেও পারে কিন্তু আমার যেন মনে হয় কবিতাতেই ও স্বচ্ছন্দ। তার একটা কারণ আছে। নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করে করে ওর একটা কাব্যিক দক্ষতা তৈরি হয়ে গেছে। ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে তার চর্চায় আনন্দ পায়।অনেকে মনে করেন এসবের চর্চার ফাঁকে ফাকেই নাকি ওর ডাক্তারিচর্চা। সুতরাং ছড়া- কবিতাতেই সাফল্য দৃশ্যমান।তবে ওর বিশেষত্ব নিঃসন্দেহে আড্ডাবাজিতে। মজার আলোচনায় আশুতোষ অদ্বিতীয়। তবে একটাই শর্ত - সমমনোভাবাপন্ন এবং স্বল্পসংখ্যক শ্রোতা থাকতে হবে অনেকের মধ্যে নিজেকে প্রকাশে ওর খুবই সংকোচ। (অনেকটা লেখকের মতো)। অসম্বব উইট আর শব্দপ্রয়োগের কৌশলে সামান্য বিষয়কেও আলোড়নসৃষ্টির বিষয় করে তুলতে পারে যে মানুষটি মজার আলোচনায় তিনি যে অদ্বিতীয় হবেন সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হতে পারে যে ডাক্তাররা সর্বসমক্ষে তাঁদের ফাজিল রূপটি প্রকাশ করতে চান না, রোগী কমে যেতে পারে। কিন্তু নিভৃত আলাপচারিতায় আশুতোষ বিচ্ছু দি গ্রেট । তবে না, অশ্লীল অবান্তর আলোচনা আমরা করি না, মানুষের সম্পর্ক প্রেম অপ্রেম কুটকচালি এসব আমাদের বিষয় নয়, আমরা একটু ধর্মকথা আর সবই দৈনন্দিন যাপনচিত্র নিয়ে কারবার করি। আমরা ভালো মানুষ।
আশুতোষ পেছনে লাগার মাস্টার। আমাকে জুড়ি পেলে আর অন্য কাজ খোঁজে না। একেকটা অনুষ্ঠানে এক একজনকে টার্গেট করে। মহিলা নয়। একজন গায়ক তো আমাদের কাছেই বসতেন না। সাধনদা তখন ছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিক অভিভাবক, সাধন গুহ । আমরা দুজন যেখানে বসতাম, সাধনদা এসে এসে আমাদের কুশল জেনে যেতেন। ভয়ে। উজ্জ্বলদা,হ্যাঁ হ্যাঁ ডক্টর উজ্জ্বল দাশশর্মা পাশে থাকলে তো সাধনদা প্রমাদ গুনছেন,ত্র্যহস্পর্শে কি যে ঘটে যায়! আমরা কাউকে কোনদিনই বিরক্ত করতাম না,কিন্তু আশুতোষের কায়দাটাই ছিল কোন একটা লোককে টার্গেট করে তাকে রীতিমতো টেন্সড করে তোলা। তিনি যদি মুখস্থ কবিতাও আবৃত্তি করতে এসেছেন ভেবে থাকেন তবু তাঁকে বই খুলেই পড়তে হবে। সে এক অসম্ভব কৌশল সেসব দিনে আমরা জানতাম, আশুতোষ ছিল আমাদের গুরু।তবে আমরা খুব ভালো মানুষ, আমরা একদম পেছনের দিকে বসে প্রায় চুপ করেই ফাংশান শুনি, কারও ক্ষতি হোক চাই না।
অনেকে মনে করতে পারেন, এসব তো কিছুই গুণের লক্ষণ নয়। সত্যি কথা, এগুলো তো নেহাতই ফাজলামি আর ষড়যন্ত্রের গল্প, প্রকৃত গুণের উদাহরণ কোথায়? আছে।এগুলোকে নির্গুণতা ধরলেও আশুতোষ একবারে নির্গুণ নয়। ফাজলামির ফাঁকে ফাঁকে ও কাজও করে। একটা অনুষ্ঠান চলাকালীন কে কখন চলে যাবে, কে যাবার সময় কী বলে অনুমতি চাইবে, আসলে কোথায় যাবে, চাঁদার টাকা ব্যাপারে কী বলবে সব ও আগে থেকে লিখে রাখতে পারে। সুতরাং গণৎকারের মাহাত্ম্য আছে। কিন্তু এহো বাহ্য।
আশুতোষ ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। খুব নিম্নমানের কবিতাকেও একটা জাতে দাঁড় করাতে পারে। ভাষ্যপাঠে খুব স্বচ্ছন্দ। দেশাত্মবোধক কিছু হলে বেশি উদ্বুদ্ধ হয়।ক্ষুদিরামের পুনর্জন্ম হয়েছে এমনও ভাবেন অনেকে। এরকম অনুষ্ঠান আমরা এখন কম করলেও একসময় অনেক করেছি। তখন অনেক রাত পর্যন্ত সাধনদার পরিচালনায় রিহার্সাল চলত। সেসব আসরে আশুতোষ খুবই সিরিয়াস। আমার মতো। নাটক বলে আলাদাভাবে কিছু করেনা তবে নাটকের নিমন্ত্রণ পেলে সোজা রবীন্দ্রভবনে। গিয়েই ফোন। আমি গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। কার্ড না পেলেও চলে আসুন, আমি ঢুকিয়ে নেব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছনো চাই। একবার তো কানপুর থেকে ফোন পেয়েছি। বলে পনেরো মিনিটে আসতে পারবেন না? শুনেছিল মধুপুর। আমার সাথে বসেই কেন নাটক দেখতে হবে? এরকম এক প্রশ্নের জবাবে আশুতোষ সেই প্রশ্নকর্তাকে বলেছিল কঠিন জায়গাগুলো নাটক চলাকালীন দুজন মিলে আলোচনা করে সহজ করে নেব। ভদ্রলোক শুনেই দৌড়, আর পাশে বসেননি। অবশ্য নাটক চলাকলীন আমরা যে সবটাই নাটকে নিমজ্জিত থাকি তা নয়। ফলত পরে আমাদের সে নাটক বিষয়ে বাইরে জেনে নিতে হয়।
আমার মেজোমামা, শ্রী শচীন্দ্রনাথ রায় যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর সাহিত্য আলোচনায় আশুতোষ ছিল খুব উৎকৃষ্ট অংশগ্রহণকারী। মেজোমামা সেজন্যেই ওকে বেশি পছন্দ করতেন। বছর চারেক ওদের যোগাযোগ বন্ধ। আশুতোষ সেজন্য দুঃখই করে। ডাক্তারদেরও দুঃখ হয় নাকি? জিজ্ঞেস করতে হবে।
আমাদের দুজনের এই বোঝাপড়াটা খুব মজবুত। যে কোনও প্রসঙ্গ নিয়েই আলোচনায় আমরা দুজন প্রায়শ একই রকম ভেবে থাকি, তাই আমাদের মধ্যে কোনও তর্ক সাধারণত ওঠে না। কিংবা এরকম হতেই পারে যে আশুতোষ সব জিনিষের মধ্যে থেকে ভালোটুকুকেই খুঁজে নিতে ভালোবাসে বলে অনাবশ্যক বিতর্ক এড়াতে পারে। আজগুবি কিছুর পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করবার প্রবণতা ওর মধ্যে দেখিনি।আর তাইতো ওর বিষয়ে লিখতে বসে কেবলই মনে হচ্ছে নিজের জীবনীই লিখে রাখছি না তো?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴