আমি এক যাযাবর-৫/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
৫ম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
গাড়ি থেকে জিনিসপত্র বের করে রওনা হবো প্ল্যাটফর্মের দিকে, মধুপর্ণার তখন খেয়াল হ'ল যে নিজের পোশাক এবং অন্য সব সরঞ্জাম যে ট্রলিতে, সেটি গাড়িতে তুলতেই ভুলে গেছে! এদিকে তখন ঘোষণা হয়ে গেছে, পদাতিক ঢুকছে স্টেশনে! মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওকে, অর্পিতাকে ট্রেনে চাপতে বললাম। গাড়ি ঘুরলো বাড়ির পথে, ট্রলি নিয়ে এনজেপিতে গিয়ে কামরায় উঠে যাবো।
যাচ্ছি শান্তিনিকেতন। আমরা তিনজন। অর্পিতা, মধুপর্ণা আর আমি। রোড স্টেশনে এই ট্রলিবিপত্তি। বাড়ির পথে গাড়ি চলছে, আর আমার হ্যান্ডসেট বেজেই চলেছে। একবার তিনি পরেরবারই অর্পিতা। বক্তব্য একটিই, বারবার, এনজেপিতে আমি যদি সময়মতো না পৌঁছাতে পারি, ওরা কি করবে! ততক্ষণে বাড়ি থেকে ট্রলি নামিয়ে রওনা হয়েছি। জানিয়ে দিলাম চলে যাও, যদি পদাতিক ধরতে না-ও পারি, আমি অন্য যে কোনো ব্যবস্থা করে পৌঁছে যাব ঠিক। আর সেটাই হ'ল। ফাটাপুকুর ছাড়াতেই জ্যামজমাট পথ, এনজেপি ওভারব্রীজে যখন হাঁফাতে হাঁফাতে উঠতে পারলাম, পায়ের তলা দিয়ে দু নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে পদাতিক বেরিয়ে গেল। আর তক্ষুনি ফোন বাজলো, "দাদা, ট্রেন ছেড়ে দিল তো!" অর্পিতাকে আবার জানালাম, নো টেনশন, তোরা পৌঁছে যা, আমিও আসছি।
আসছি তো বললাম, কিন্তু কিভাবে। প্রিমিয়াম তৎকালেও টিকিট নেই এদিন বা পরদিন সকালের কোনো ট্রেনে। এদিকে আমাদের তো মাত্র আড়াই দিনের প্রোগ্রাম! মুহুর্তে মুহুর্তে ফোন। সেরকমই একবার অর্পিতা বললো, গাড়ি নিয়ে আসা যায় না? কিন্তু আমি তো ড্রাইভার দীনেশকে ছেড়ে দিয়েছি! সুতরাং চেষ্টা, ফোনে যদি ধরতে পারি। এবার অন্য বিভ্রাট, "দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড, ইজ কারেন্টলি নট রেসপন্ডিং!"
এবারের সিদ্ধান্ত এনজেপিতে কোনো হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে যে ট্রেন পাবো, উঠে যাবো। সেইমতো স্টেশনের পাশেই হোটেলসন্ধানে। একটা ঘর পছন্দও হ'ল, এমন সময় ফোন বাজলো। দীনেশচন্দ্র!
"কোথায় তুই?"
"কাকু এখনো স্টেশনেই আছি, একটু চা খাচ্ছিলাম, ফোনটাও চার্জে দিয়েছিলাম।"
চা শেষ করে এলেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম, "পারবি নাকি বোলপুর পর্যন্ত টানতে?" জানতামই, এবং সে জানা মতেই দীনেশ সঙ্গে সঙ্গে রাজি। অতএব চলো সড়ক পথেই! রাত তখন ন'টা। ঘোষপুকুর দিয়ে বের হবো, নগর শিলিগুড়ির ভীড় এড়াতে, অথচ সে পথে অল্প পাড়ি দিতেই আবার জ্যাম! ডানদিকে যে ঘুরবে গাড়ি, কোনো উপায় নেই। গাড়ি তো দূরের কথা, একটা পিঁপড়েরও বুঝি ক্ষমতা নেই ওদিকে ঘোরার!
সেসব ঝামেলা পেরিয়ে ইসলামপুরের কাছাকাছি যখন আমরা, পেটের ভেতর ছুঁচোর কেত্তন! অতএব পথিপার্শ্বে সরাই। পেট পুরে খেয়ে ফের পানসি বাওয়া। দীনেশচন্দ্রকে যতবার জিজ্ঞেস করি, সে ব্যাটা কেবলই বলে, "কোনো প্রব্লেম নাই, কাকু, পারব, পারব।" রায়গঞ্জ শিলিগুড়ি মোড়ে রাত দেড়টায় চায়ে চুমুক। কিন্তু মালদা পৌঁছতে পৌঁছতে আমার কেমন সন্দেহ হল, দীনেশবাবুর চোখ বুঝি একটু লেগে লেগে আসছে! মাঝেমাঝেই চোখদুটো বড়ো বড়ো করছে। জিজ্ঞেস করলাম, যথারীতি উত্তর, "না কাকু, হবে, হবে!" ফারাক্কা অব্দি এরকমই চলে ভয়টা বাড়লো, অতএব প্রশ্নটশ্ন না আর, সোজা নির্দেশ, গাড়ি থামা। ট্রাক-বে তে গাড়ি রেখে বললাম, "চল, চা খেয়ে আসি।" দীনেশচন্দ্র খাবেন না চা। অতএব একলা চলো রে। অত রাতে একমাত্র হাইওয়ের পাশেই চা-দোকান জেগে থাকে। সুতরাং পেয়ে গেলাম। চা-পিয়ে ফিরে দেখি সীট হেলিয়ে ঘুমিয়ে গ্যাছেন "হবে হবে" বাবু, দিব্যি ডাকছে নাক। ডাকলাম না বেচারিকে। আস্তে গাড়িতে উঠে নিজেও একটু হেলান দিয়ে বসলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। অতএব কখনো হ্যান্ডসেটে উঁকি, কখনো বা রাস্তায় নেমে পায়চারি করতে করতে ভোররাত। দীনেশচন্দ্র এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঝরঝরে হয়ে উঠেছে, আবার রওয়ানা হলাম। এবারের প্রশ্ন, যাবোটা কোন রাস্তায়। দুজনেরই দৌড় মালদা অব্দি, সড়কপথে। ফারাক্কাও না হয় সোজা চলে আসা গ্যাছে, এবার? দূরযায়ী ট্রাক ড্রাইভাররা বিপদতারণ এবার। জানিয়ে দিলেন আর কয়েক কিলোমিটার গড়িয়ে মোরগ্রাম, সেখানেই ডানদিকে মোড় ফিরতে হবে বোলপুরের রাস্তা ধরতে।
এ পর্যন্ত জেনে অনেকে মন্তব্য করেছেন, ট্রলি আনতে ট্রেন না ফুরিয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে জামাকাপড় কিনে নিলেই তো হ'ত। ঠিক। এক্কেবারেই ঠিক। আমার ট্রলি হলে তা-ই হয়তো করতাম, এমনকি কিচ্ছুটি কেনাকাটা না করেও এক পোশাকে আড়াই দিন কাটানো এমন বিরাট বিশ্বরেকর্ড নয়। কিন্তু ট্রলিটি আমার নয়। যাঁর, তাঁর সম্পর্কে একটা তথ্য জানাইঃ
তিনি হাতে একটি দশ টাকার নোট নিয়ে আছেন। আমার দশ টাকাই প্রয়োজন। চাইলাম। তিনি দিলেনও। কিন্তু হস্তধৃত নোটটি নয়! অন্য ঘরে গিয়ে নিজের গোপন ভাঁড়ার থেকে অন্য একটি দশের নোট নিয়ে এলেন। কেন? কারণ, হাতে ধরা ঐ নির্দিষ্ট নোটটি তিনি নাকি অন্য কোনো পারপাসে খরচ করবেন বলে মনস্থ করে রেখেছেন। হ্যাঁ, পাঠিকা/পাঠক, একবিন্দু জল নেই এ কহানিতে। তাঁকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারেন। সমমূল্যের নোটেদের প্রত্যেকের জন্য যাঁর এহেন বাৎসল্য, জামাকাপড়, ব্রাশ, রুমাল, ওষুধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটাব, এমন মাথা আমার ঘাড়ে ক'টি? ট্রলিকাহিনীর নেপথ্য গল্পে আরেকটি যোগ করি, এযাত্রায় ভাগ্যিস অর্পিতা সাক্ষী, ঐ ট্রলিতে তাঁর এক জোড়া ভালো চটিও ছিল, যারা আড়াইদিনের মধ্যে সূর্যের মুখ দেখেনি, কিন্তু সফরসঙ্গী হয়েই ছিল, থাকে। বরাবর। এরপরও আমার বাড়াবাড়ি খুঁজছেন? পরামর্শ দিচ্ছেন, "যাহা স্বাভাবিক, তাহাই করিবার"?
জোকস এ্যাপার্ট, সে মুহুর্তে মাথায় এ ভাবনাটাই এসেছিলো, তাই অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কি কি অপশন আছে, তার ভেতর থেকে কোনটাকে বাছাই করি, এসব ভাবার অবকাশ ছিল না। মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, তাতে চোর পালায়নি, ঘটনার এতদিন পরেও দেখছি, আমার বুদ্ধি নতুন করে বাড়েওনি আর!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴