অন্তহীন আকাশের নীচে/৫
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ৫
দেবপ্রিয়া সরকার
------------------------------
-মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কোচ মহারাজ বিশ্ব সিংহের পত্নী রানি পদ্মাবতীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল এক বীর সন্তানের। পূর্ণিমায় জন্ম হয়েছিল বলে নাম রাখা হয় শুক্লধ্বজ। শোনা যায় বড় ভাই নর নারায়ণের সঙ্গে শুক্লধ্বজ বারানসী গিয়ে ব্যাকরণ, সাহিত্য, জ্যোতিষ, শ্রুতি, স্মৃতি, ন্যায়, মীমাংসা এবং পুরাণের পাঠ নিয়েছিলেন। সেখানে ব্রহ্মানন্দ বিশারদ নামে এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে বাস করতেন তাঁরা। উত্তরপূর্বাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধেরকৌশল প্রথম শুরু করেছিলেন তিনি। চিলের মতো ক্ষিপ্র গতি ছিল তাঁর। তাই তাঁকে বলা হত চিলা রায়। এক দিকে অনুজ এবং অন্যদিকে সেনাপতি বীর চিলা রায়ের জন্যই মহারাজা নর নারায়ণের রাজ্যের সীমা বিস্তৃত হয়েছিল অনেক দূর। অহোমরাজ্য, মানে এখন যাকে আমরা আসাম বলে জানি সেই রাজ্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করে জয়ী হয়েছিল চিলা রায়ের নেতৃত্বে রাজা নর নারায়ণের সেনাবাহিনী। একে একে কাছাড়, মণিপুর, জয়ন্তিয়া, শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে চিলা রায় ওই সকল রাজ্যের রাজাদের কর দানে বাধ্য করেছিলেন। রাজা খুশি হয়ে চিলা রায়কে ‘সংগ্রাম সিংহ’ উপাধি দিয়েছিলেন। কিন্তু মহারাজা নর নারায়ণ এবং বীর চিলা রায়ের বিজয় রথের গতি থমকে যায় গৌড় আক্রমণের পর। এই যুদ্ধে তাঁরা হেরে যান এবং বন্দি করা হয় চিলা রায়কে।*
-তারপর? চিলা রায় কি গৌড় রাজ্যে বন্দি হয়েই থেকে গেলেন সারাজীবন?
পাখির প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসল ইন্দ্রায়ুধ। বলল, নাহ্। ডঃ ওয়েডের মতে প্রায় বছর খানেক আটক ছিলেন চিলা রায়। রাজবংশাবলী থেকে পাওয়া তথ্য আনুসারে চিলা রায় গৌড়ে থাকার সময় গৌড় রাজার মাকে সাপে কামড়ায়। চিলা রায়ের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং রাজমাতা তাঁকে ‘পুত্র’ বলে সম্বোধন করেন। এই উপকারের প্রতিদান হিসেবে গৌড়েশ্বর চিলা রায়কে মুক্তি দিয়ে পাঁচজন সৎ বংশের মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন বাহারবন্দ, ভিতরবন্দ, গয়বাড়ি, সেরপুর এবং দশকাহনিয়া পরগণা।*
-বাপ রে! এতো যে কোনও অ্যাডভেঞ্চার স্টোরিকে হার মানাবে।
বিস্মিত হয়ে বলে উঠল পাখির সহপাঠী অর্পিতা। একটা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ইন্দ্রায়ুধ বলল, সে তো বটেই ইতিহাস মানেই তো অ্যাডভেঞ্চার, সাসপেন্স, থ্রিল! ইতিহাসের ভেতর যত মনের খোরাক পাবে তা আর অন্য কিছুতে নেই। কিন্তু সমস্যা হল আজকের ছেলেমেয়েরা ইতিহাস বলতে ভাবে শুধু নীরস সাল-তারিখ মনে রাখা। কিন্তু ইতিহাসকে ভালবেসে পাঠ করলে দেখবে এর থেকে বেশি ইন্টারেস্টিং খুব কম সাবজেক্টই আছে। আজ তবে এ’পর্যন্ত থাক। আবার নেক্সট ক্লাসে দেখা হবে, কেমন?
আপনপাঠ কোচিং সেন্টারে ছেলেমেয়েদের সিলেবাসের পড়া পড়াতে পড়াতে ইন্দ্রায়ুধ মাঝে মাঝেই ডিঙিয়ে যায় সীমান্তের বেড়া। উঠে আসে স্থানীয় সংস্কৃতি, ভুলে যাওয়া রীতি রেওয়াজ আর হারিয়ে যাওয়া রাজত্বের প্রসঙ্গ। আজও টুয়েলভের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিতে নিতে দেশ কালের গণ্ডি অতিক্রম করে সে পাড়ি জমিয়ে ছিল কয়েকশো বছর আগের পটভূমিতে। কোচ রাজবংশের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে করতে সে হদিশ পেয়েছে অসাধারণ এক বীর গাথার। সেটাই কিছুটা ভাগ করে নিল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। ঘর থেকে বেরুবার আগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছিল ইন্দ্রায়ুধ। পাখি সামনে এসে একটা খাতা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, গত পরশু যে নোটগুলো দিয়েছিলে সব কপি করে নিয়েছি।
ইদ্রায়ুধ মাথা তুলে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল পাখির দিকে। বলল, ভেরি গুড পাখি। ইউ আর ডুয়িং ওয়েল। এভাবে এগিয়ে চল, দেখবে তোমার ভাল রেজাল্ট করা কেউ আটকাতে পারবে না। পরের দিন আরও কিছু স্টাডি মেটেরিয়াল নিয়ে আসব তোমার জন্যে।
বইপত্র গুটিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইন্দ্রায়ুধ। পাখি মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকল তার চলে যাওয়া। একটা অদ্ভুত সুগন্ধ ঘিরে আছে পাখিকে। কোনও এক নামী ব্র্যান্ডের পারফিউম গায়ে মাখে ইন্দ্রায়ুধ। যখনই সে পাখির সামনে আসে সেই মাদকগন্ধ আবিষ্ট করে পাখিকে।
ইন্দায়ুধ, সৌরিশ, ইকবাল আর তপন চার বন্ধু মিলে খুলেছে আপনপাঠ কোচিং সেন্টার। ইন্দ্রায়ুধ ইতিহাসের ছাত্র, সৌরিশ ইংরেজি সাহিত্যের। ইকবাল পড়েছে ইকনমিকস নিয়ে, তপনের বিষয় ভূগোল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে চেষ্টা করছে কেরিয়ার গড়ার। শহরের মাঝামাঝি জায়গায় দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে এই কোচিং সেন্টার তারা খুলেছিল নামমাত্র বেতনে শহরের মেধাবী অথচ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াবে বলে। কিন্তু গত তিন বছরে যথেষ্ট প্রতিপত্তি বেড়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানের। বেশ কিছু ছেলেমেয়ে তাদের কাছ থেকে কোচিং নিয়ে ভাল ফল করেছে বোর্ডের পরীক্ষায়। তাই আজকাল নিম্নবিত্তের পাশাপাশি অনেক মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাদের সেন্টারে নাম লেখাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের বসার জায়গার অভাব তারা লক্ষ্য করছে ইদানিং। সেসব নিয়েই আলোচনা করছিল সৌরিশরা। ইন্দ্রায়ুধকে ঘরে ঢুকতে দেখে তপন বলল, এই তো ইন্দ্রও চলে এসেছে। শোন আমরা ভাবছি সামনের সেশন থেকে ক্লাস নাইন-টেনেরও একটা করে ব্যাচ শুরু করব। অনেক গার্জিয়ান এসে অনুরোধ করে যাচ্ছেন। আমরা চারজন তো আছিই দরকার হলে আরও দু’একজন ছেলে বা মেয়েকে পড়ানোর জন্য রেখে নেব। কিন্তু এই বাড়িটা ছাড়তে হবে। এখানে আর জায়গা কুলোচ্ছে না। এ ব্যাপারে তোর কী মত?
ইন্দ্রায়ুধ হাতের বইগুলো টেবিলে রেখে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বলল, উত্তম প্রস্তাব! চাকরির যে আকাল শুরু হয়েছে তাতে এম এ, পি এইচ ডির মতো বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও কোনও হিল্লে হবে বলে মনে হয় না। তার থেকে আপনপাঠকে ঠিকঠাক চালাতে পারলে আমরা নিজেদের পাশাপাশি আরও কিছু শিক্ষিত বেকার যুবকযুবতির উপার্জনের ব্যবস্থা করতে পারব।
-একদম হক কথা বলেছিস। আমাদের কারুরই বাপ-ঠাকুরদা লাখ লাখ টাকা রেখে যায়নি ঘুষ দিয়ে চাকরি জোটানোর জন্য।
উত্তেজিত গলায় বলে উঠল সৌরিশ। ওর কথার খেই ধরে ইকবাল বলল, বিতৃষ্ণা এসে গেল শালা পুরো সিস্টেমের ওপর! এতো বছরের পড়াশোনা, খাটুনির কোনও মূল্যই আজকাল আর কেউ দেয় না। সব জায়গায় এক থিওরি, ফেলো কড়ি মাখো তেল!
উত্তেজনার পারদকে ঊর্ধ্বগামী হতে দেখে হাল ধরল ইন্দ্রায়ুধ, হতাশা তো নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এভাবে বেশিদিন চলবে না। এই অবস্থা থেকে শিগগিরিই আমরা নিস্তার পাবো। সকলেই বুঝতে পারছে পরিস্থিতি কোন দিকে গিয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, দোষীরা নিশ্চয়ই ধরা পড়বে একদিন। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। কিন্তু ততদিন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে আমরা আমাদের কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আরও বড় জায়গা, চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চের ব্যবস্থা করি। তোদের কারও সন্ধানে কোনও বড় বাড়ি আছে নাকি? থাকলে বল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেন্টারটা শিফট করি নতুন জায়গায়।
-আছে আছে, আমার সন্ধানে আছে একখানা। রাধাকান্ত জেঠুদের বাড়িটা যারা কিনেছিল সেই রায়বর্মণরা বাড়ি সমেত জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে প্রমোটারের কাছে। সেখানে তৈরি হয়েছে পাঁচতলা আবাসন। সেখানকার গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা বারোশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট পেয়েছে ওরা। কিন্তু থাকার কেউ নেই। সকলেই শিলিগুড়িতে শিফট করছে। ফ্ল্যাটটা ওরা কোনও বিশ্বস্ত লোককে ভাড়া দিতে চায়। গতকাল আমাকে বলছিল। আমি তাদের সামান্য আভাস দিয়ে রেখেছি কিন্তু কনফার্ম কিছু বলিনি। তোদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর বলব।
গড়গড় করে বলে গেল সৌরিশ। ইন্দ্রায়ুধ ভুরু কুঁচকে বলল, কোন বাড়িটা রে? তোদের পাড়ায় নাকি?
-আরে হ্যাঁ, রাধাকান্ত জেঠুকে চিনিস না? জেনকিন্স স্কুলের কৃতি ছাত্র, কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা ছিলেন একসময়, এখন রিটায়রড। লখনউতে থাকেন।
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি সেই যে বড় মাঠওয়ালা বাড়িটা। ওটাও গুঁড়িয়ে গেল? শহরের পুরনো বাড়িগুলোর আর একটারও অস্তিত্ব থাকবে না মনে হয়। যাক গে, কাল আমরা গিয়ে ফ্ল্যাটটা একবার দেখে আসি, তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেব। কী বলিস?
সকলে সম্মতি জানালে সেদিনের মতো আপনপাঠের দরজা বন্ধ করে ফিরে গেল তারা একে একে। বাইক চালাতে চালাতে ইন্দ্রায়ুধ ভাবছিল সেই প্রথম দিকে আপনপাঠ শুরুর কথা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের যাবতীয় ভার এসে পড়েছিল ইন্দ্রায়ুধ আর তার দিদি যশোধরার ওপর। দিদি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইন্দ্রায়ুধ সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হয়েছে কলেজে। বাবার পি এফ, গ্র্যাচুইটি সহ যাবতীয় জমানো টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল তাঁর চিকিৎসায়। তবুও নিষ্কৃতি পাননি ক্যান্সার থেকে। মায়ের প্রাপ্য সামান্য ফ্যামিলি পেনশন দিয়েই চলত যাবতীয় খরচাপাতি। প্রচণ্ড আর্থিক সংকটের সময় পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা টিউশন জুটিয়ে নিজের হাত খরচটুকু তোলার চেষ্টা করত ইন্দ্রায়ুধ। তারপর একদিন তপন আচমকাই প্রস্তাব দিয়েছিল কোচিং সেন্টার খোলার। একজন বা দু’জন ছাত্রছাত্রীকে টিউশন পড়াতে যতটা সময় সে ব্যয় করে ততটা সময়ে সে যদি একসঙ্গে দশজনকে অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকেও পড়ায় তাহলেও অনেকবেশি লাভবান হবে। এই ভাবনা থেকেই একসময় যোগ দিয়েছিল আপনপাঠে। কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরতে বেশি সময় নেয়নি। দিদি এম এ পাশ করেই চাকরি পেয়েগিয়েছিল সরকারি স্কুলে। ইন্দ্রায়ুধও কলেজ, ইউনিভার্সিটির হার্ডেল পেরিয়ে নেট পাশ করে এখন পি এইচ ডির পথে। ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবুও আপনপাঠ রয়ে গিয়েছে তার সবটা জুড়ে। একদিন এই কোচিং সেন্টার ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। কচিকাঁচা ছেলেমেয়েদের সারল্য মাখানো মুখগুলো মনে পড়ে ভীষণ রকম।
বাইক রেখে ঘরে ঢুকল ইন্দায়ুধ। ব্যাগ থেকে বইপত্র বের করতে গিয়ে দেখতে পেল পাখির ফিরিয়ে দেওয়া নোটসের খাতাটা। ছাত্রজীবনে নিজের হাতে নোট বানিয়ে লিখে রাখত এই খাতায়। এখনও কোনও ভাল ছাত্র বা ছাত্রী চাইলে তাদের কপি করতে দেয় এই খাতা থেকে। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে এলোমেলোভাবে খাতার পাতা ওলটাচ্ছিল, হঠাৎ এক জায়গায় নজর আটকে গেল তার!
*তথ্যসুত্রঃ কামতাপুর বীরশ্রেষ্ঠ চিলা রায়ঃ শাশ্বতী দেব ( ‘কোচবিহারের ইতিবৃত্ত’ সম্পাদনা রণজিৎ দেব)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴