পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৯
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ওই আইসেছে বিয়ার গাড়ি
"ঢাক্কুয়ারে বাজিন্দারে ঢাক্কে বাজায় ঢোল/খাবার বেলা খায় হাড়ি মাগুর মাছের ঝোল।"
ভিড়ের
মধ্য থেকে আর একজন রোগামতো মাঝবয়সী বউ আটপৌরে করে পরা শাড়ির আঁচলটা ঝটকা
মেরে দুলিয়ে আর ফঙফঙে রোগা হাত দুটো নাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোর গলায় বলে
"শিঙ্গি মাছের ঝোল।"
সমস্বরে গান আর নাচের ঝোঁকের সাথে তাল মিলিয়ে বাজিন্দাররাও জোরে জোরে বাজাতে থাকে। এবার মালতীর বড় মামা হাঁক দেয়,
"হোইসে হোইসে। এলা কনেক মানষিগিলাক বোসির দ্যাও বারে, জিরাউক।"
গোয়ালঘরের
একদিকের বেড়া সাময়িকভাবে খুলে মেঝেটা পরিষ্কার শুকনো করে লেপে বাজনদারদের
বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিচে খড় বিচালি ফেলে তার উপর চট, তার উপর একটা
সস্তার সুতির বিছানার চাদর পেতে রাজকীয় বসার ব্যবস্থা! সাবধানে এবং যত্ন
করে কাঁধ থেকে বাদ্যযন্ত্রগুলো একপাশে নামিয়ে রেখে লোকগুলো আয়েশ করে বসে।
ঘাড় থেকে গামছাটা হাতে নিয়ে মুখ মোছে। একজন অল্পবয়সী ছেলে কলাপাতায় করে
পান, চুন, সুপারী আর কয়েকটা বিড়ি নিয়ে এসে মাঝখানে রাখে। বাবরি চুলো
কালোমতো এক রসিক বাজন্দার ছোট্ট একটা অতি কৌতুহলী বাচ্চার দিকে তাকিয়ে একটা
বিড়ি এগিয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বলে,
"ন্যাও বারে, টানো।"
বাচ্চাটা থতমত খেয়ে লজ্জা পেয়ে সরে আসে। উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
পাড়া-গেঁয়ে গ্রাম্য রাত, নটা বাজতে না বাজতেই নিশুত হয়ে ওঠে।
অন্ধকারে সামনের দিকে লন্ঠন ঝুলিয়ে দুটো গরুর গাড়িতে বরযাত্রীর দল ঢোকে।
পাড়ায় ঢোকার মুখে জোরে বেজে ওঠে বিয়ের বাদ্য আর মাইকে ভেসে আসে গান,
"ওই আইসেছে বিয়ার গাড়ি/ঝুমুর ঝুমুর ঝুমুর করি/কোইনা কান্দো না কান্দো না কান্দো না ঘরে"।
আওয়াজ শুনে ঘুমজড়ানো চোখে কোন এক প্রতিবেশি পাশ ফিরতে ফিরতে বলে উঠল,
"উমার বরযাত্রীখান আসিল। পাড়াটাক কান্দে এলায় ছাওয়াটাক নিগাবে বারে।"
বাড়ির
মহিলারা মালতীকে মাঝখানে রেখে জড়াজড়ি করে উচ্চকন্ঠে কেঁদে ওঠে। বরযাত্রী
এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেও মালতীর মাকে বের করা যায় না। উচ্চকন্ঠ থেমে
ইনিয়ে-বিনিয়ে নানান কথা বলে কেঁদেই যাচ্ছে, এদিকে বরণের সময় পেরিয়ে যায়।
মালতীর বড়মামা মতিবালাকে ডেকে বলে,
"বৌমা, তোমরা আনির পাছেন না মালতীর মাক!"
মোতিবালা নিজেও কাঁদছিল। তারমধ্যে উত্তর দেয়,
"কয়বার যায়া ডেকাছোং, ওটে আনোছোং তে মাও আরো দেহাটা ছাড়ি দ্যাছে। মুই পাং বারে!"
কথাটা ঠিক। এবার মালতীর মামা নিজেই বোনকে ডাকে,
"কী মাই? হোইসে কান্দন। মানষিলা দুয়োরোত খাড়া হয়া আছে। জাঙোই বরণ না কোইল্লে উমরা চেংরা ধরি ঘুরি যাছে ভোল।"
দাদার ধমক খেয়ে মালতীর মা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। বরণডালা নিয়ে সুকারুর বৌ তৈরি হয়েই ছিল। কেউ একজন বয়স্ক পাশ থেকে মালতীর মাকে বলল,
"মাই, কনেক থির হ। কান্দা না যায়। ভালে ভালে থাউক, ভালে ভালে খাউক।
বেটি আছে তে বিদায় দিবারে নাগে।" মালতীর মার সাথে জলছিটা বসমতীও সঙ্গে
গেল। গেটের কাছে হ্যাজাক আর লন্ঠনের আলোয় বরযাত্রী দাঁড়ানো। বরপক্ষের একজন
মামা-কাকা স্থানীয় হবে, হাঁক দেয়,
"কোটে বারে কোইনার মাও। আইসো বারে। পাত্রর কমর বিষাছে।"
সঙ্গে সঙ্গে এ পক্ষের ছেলে-মেয়েরা সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
"বিষাউক। কেমন আরো পাত্র তে তোমার!"
হই
হট্টগোলে ভরপুর হয়ে জায়গাটা পুরো সরগরম হয়ে ওঠে। মতিবালা একহাতে বরণৃর
চালুন, অন্যহাতেসঘটিতে জল নেয়। আর একজন তালপাতার পাখা, শঙ্খ অন্যান্য জিনিস
নিয়ে এগোতে থাকে। বসমতী মালতীর মার হাতটা ধরে বলে,
"নে, চল আগদোরোত ওত্তি।"
বাজনদাররা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসি-মস্করা দেখছিল, এবার জোরসে বাজাতে শুরু করে। একজন মাতব্বর গোছের লোক হাত তুলে বলে,
"থামো, থামো, থামো। হেটে এদি কোনোই শুনা যাছে না। এলা তোমরা বোইসো যায়া। কোটে বসিবার জাগা করি দিসে।"
বরণ
শেষে মন্ডপের ওখানেই বাঁশের বসার খাট, বেঞ্চ আর খড় বিচালির উপর চট আর
সুতির চাদর পেতে বসার ব্যবস্থা করা। কনে পক্ষের যারা দেখাশুনা করছে তারা
বরপক্ষকে বলে,
"পাত্রক ওদি আসোরোতে বসাও বারে। আর ছোট-বড়গিলা ঘরোত যায়া বোসুক।"
বাজনদাররা
গোয়ালঘরে পেতে রাখা তাদের র্নিদ্দিষ্ট জায়গায় বসে একটু আরাম করে। চা খেয়েই
আবার বাজাতে যেতে হবে। সমস্যা হল গাড়োয়ানের। অচেনা জায়গায় গরুগুলো কোথায়
বাঁধবে। অবশেষে গাড়ি থেকে খুলে পাশের বাড়ির পুঞ্জিতে দুটো গাড়ির চারটে
গরুকে বেঁধে রাখা হল। বরযাত্রীদের চা-বিস্কুট খাইয়ে একটু পরেই দুটো করে
মিষ্টি আর খাস্তা নিমকি পরিবেশন করা হল। খাওয়া-দাওয়ার প্রাথমিক পাট চুকলে
বাড়ির মেয়ে-বউরা তৈরি হল গ্রাম পুজোয় বের হতে। প্রদীপে সাজানো চালুন,
সর্ষের তেলের শিশি, ধূপচী -সব নিয়ে মতিবালাসহ সব তৈরি হয়ে বাজনদারদের নিয়ে
গ্রামপূজায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। একজন শোখিন হাউশালি বৌ এসে বাজনদারদের
ডাক দিল,
"ন্যাও, চল বারে। আজি দেখিমো তোমা কেমন বিজান।"
বাবরিচুল হাসতে হাসতে উঠতে উঠতে বলে
"চলখেনে। কায় জিতে কায় হ্যারে দেকা যাবে।"
সঙ্গে সঙ্গে সবাই সমস্বরে গলায় তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে,
"বায়, ইমার আরো ভালে তো কাথা! দেকা যাবে।"
তখন
যে বৌটা আঁচল দুলিয়ে হাত নেড়ে গান করছিল, সে এবার রসিকতা করে গান করতে
করতে সামনে এসে হাত নেড়ে কোমরটা একটু দুলিয়ে নেয়। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে
বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
"চলো তো। ক্যামোতোন
বাজায়। ইমাক হাপসে ছাড়ি দিমো আজি। হামার টারির সোগায় নাচুনি। নাইচতে
নাইচতে আজি তোমার হাত বিষি ছাড়ি দিমো। ক্যামোন না হাইপসেন!"
সবাই
খুব উৎসাহী হয়ে বের হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুখে উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি
দিয়ে সবাই বের হয়। নিমেষে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যায়, এমনকি মালতীর কাছে বসারও
কেউ থাকল না। মালতীর বড় মামি এসে মালতীর পাশে বসে।
লন্ঠন নিয়ে আগে আগে ব্যাদেঙ হাঁটছে, পেছনে আর একটা লন্ঠন
সোমারুর হাতে। এরা দূজন আর বাজনদাররা ছাড়া দলে পুরুষ প্রায় নেই বললেই চলে।
বৈরাতী চালুন দুলিয়ে মাঝে মাঝে নাচলেও জোরে পা চালাচ্ছে। পেছনে মহিলাদের
দলটা বাজনদারদের সাদে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে নাচতে নাচতে চলছে। প্রথমে
পাড়ার বটগাছটার পুজো করল। পুজো চলতে চলতেই একচোট নাচ শুরুহল। বাজনদাররাও
ভালোই রসিক। তারাও ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে তালে তালে বাজাতে লাগল। ওখান থেকে
চলল বারোয়ারি রাসমন্দিরে। রাসমন্দিরের মাঠে কিছুটা সময় বেশি কাটাল। কারণ
খোলামেলা, নাচের জন্য ভালো জায়গা। তারপর গোটা পাড়া ঘুরে ঘুরে যেখানে যত
ঠাকুরে থান আছে পুজো দেওয়া হল। ক্রমে রাত গভীর হতে চললেও কেউ আর বাড়ি ফিরতে
চায় না, নাচের নেশায় সব মশগুল। বেগতিক দেখে মতিবালা তাড়া লাগায়,
"চল বারে, দেরি হছে। লগ্গনের টাইম হয়া গেইসে। বাবা এলায় তাও হবে। মুইয়ে এলায় ধাওয়া খাইম।"
বলেই চালুনটা নিয়ে নিজে হনহন করে হাঁটতে থাকে।
..............................................................
হেটে এদি - এখানে এদিকে
তাও - রাগ হওয়া