ঘাটিয়া টি এস্টেট/গৌতম চক্রবর্তী
ঘাটিয়া টি এস্টেট
গৌতম চক্রবর্তী
-----------------------
ভারতের সুসংহত চা কোম্পানিগুলির মধ্যে অন্যতম চা কোম্পানি জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের ঘাটিয়া টি গার্ডেনটির পরিচালক গোষ্ঠী রাঙামাটি টি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ভারত এবং বিশ্বব্যাপী সুস্বাদু চা উত্পাদন, প্যাকেজিং এবং বাজারজাত করে। ভুটানের পাদদেশের ঠিক নীচে ডুয়ার্স বেল্টের উত্তরবঙ্গে অবস্থিত ঘাটিয়া টি এস্টেট। ভুটানের পাদদেশে থাকার ফলে শীতল জলবায়ু এই বাগিচার চাতে এক অতিরিক্ত স্বাদ এনে দিয়েছে যা সাধারণত ডুয়ার্স চায়ে অনুপস্থিত থাকে। উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি মৃদু ঢাল সহ এখানকার লাল ভারী মাটি এবং এর টপোগ্রাফি বর্তমানে ডুয়ার্স অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত চা উৎপাদনকারী সংস্থা হিসাবে ঘাটিয়া চা বাগিচাকে দেশে বিদেশে পরিচিতি দিয়েছে। মার্চের শুরুতে এবং সারা বছর ইনঅরগ্যানিক সিটিসির পাশাপাশি স্বাদযুক্ত অর্থোডক্স চা উত্পাদন করার ক্ষমতা রয়েছে ঘাটিয়াতে। ছয় দশক ধরে ঘাটিয়া তথা রাঙামাটির পরিচালকবৃন্দ গ্রাহকদের জন্য উৎকৃষ্ট চা উৎপাদন এবং বিপননের দিকে মনোনিবেশ করে চলেছে। ভারতে সেরা চা চাষ, বাজারজাত করা; সরাসরি প্যান-ইন্ডিয়ান ভিত্তিতে বিতরণ করার লক্ষ্যে পেশাদারি ভিত্তিতে ঘাটিয়া কাজ করে চলেছে। কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সামগ্রীক পরিচালক হর্ষ কেজরিওয়াল একজন পরিপূর্ণ চা পেশাদার হিসাবে দক্ষতার সাথে ৪৫ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা নিয়ে সর্বোত্তম চা উৎপাদন, বিক্রয়, ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে সুগভীর প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কোম্পানির পরিচালনাতে কাজে লাগাচ্ছেন। উন্নত মানের উৎপাদনের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে একজন টিম মেকার হিসাবে তিনি সততার সঙ্গে রাঙামাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর সুযোগ্য পরিচালনাতে দার্জিলিং-এর জংপানা, আসামের গিলিদারি এবং ডুয়ার্সের ঘাটিয়া এই অঞ্চলের প্রধান বাগানে পরিণত হয়েছে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গণিতে অনার্স এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করে কেজরিওয়াল চা বাগিচা শিল্পে মনোনিবেশ করেছেন।
বাগিচা ম্যানেজমেন্ট ডিবিআইটিএর সদস্য গাঠিয়া বাগানটির হেড অফিস কলকাতায়। বাগানে ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন, স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন এনইউপিডব্লিউ, এবং পিটিডব্লিউইউ। বাগিচার আয়তন বা গ্রস এরিয়া এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র বা গ্রান্ট এরিয়া ৭৫৬ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ৬৪.৪৭ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত মোট চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র অঞ্চল ৫৮২.৩৯ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৯১৩ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। চা বাগানে নিজস্ব কাঁচা চা পাতা উৎপাদনের গড় ৪৫ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত চা গড়ে ১০ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহিত কাঁচা পাতা ফ্যাক্টরিতে প্রসেস করে গড়ে ৫০০০০ কেজি চা উৎপাদিত হয় মাঝেমাঝে। প্যাকেজড টি তৈরি করা হয় ফ্যাক্টরিতে প্রায় ২৫০০০ কেজি। ফলে মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি, গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, ওলং টি সহ মোট চা উৎপাদিত হয় গড়ে প্রায় ১১ লাখ কেজি। চরিত্রগত দিক দিয়ে উন্নতমানের বাগান ঘাটিয়া। চা বাগিচার স্টাফ সংখ্যা ৯৪ জন। করণিক ১৬ জন। ক্ল্যারিক্যাল ও টেকনিক্যাল স্টাফ ১৩ জন। বাগানের শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১০৩২ জন। মোট জনসংখ্যা ৬৫০০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১৩৭০ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। সাম্প্রতিককালে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল গড়ে ৫০০ জন। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জন। কমপিউটর অপারেটর ছিল ২ জন। ফ্যাক্টরিতে ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং স্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩২ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৬৯১ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ৪৮০৯ জন। বাগিচায় শতকরা ৫০ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। ঘাটিয়া চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৩৩১ টি। সেমি পাকা বাড়ি ২৮৪, অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ২৩৪। মোট শ্রমিক আবাস ৮৪৯। শ্রমিক সংখ্যা ১৬৯১।
ইউকো ব্যাংকের কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগানটির লিজ হোল্ডার রাঙামাটি টি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ছিল ২০১২, লিজ রিনিউয়াল হয়েছে। চা বাগিচায় হাসপাতাল ১টি। ডিসপেনসারিও ১ টি। বাগিচার আবাসিক ডাক্তার অল্টারনেটিভ মেডিসিনে এমবিবিএস পাশ। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ১ জন। নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ২ জন। কম্পাউন্ডার ১ জন, স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ১ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ১ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করা হয়। এর আগে বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন। সাম্প্রতিককালে তিনি আছেন কিনা সেটা অবশ্য জানা নেই। বাগিচায় ওষুধ সরবরাহ পর্যাপ্ত। উন্নত মানের পথ্য সরবরাহ এবং নিয়মিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হয়। বাগিচাতে স্থায়ী ক্রেশের সংখ্যা ১ টি এবং মোবাইল ক্রেশের সংখ্যা ২ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। দুধ, বিস্কুট বা পুষ্টিকর খাবার ক্রেশের শিশুদের দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত পানীয় জল ক্ৰেশে এবং চা বাগানে সরবরাহ করা হয়। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। উচ্চ বিদ্যালয় বাগিচা থেকে একটু দূরবর্তী স্থান লুকশানে অথবা নাগরাকাটাতে আছে। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব, খেলার মাঠ আছে। ঘাটিয়া টি গার্ডেনে নিয়মিত গড়ে ৭৫ লাখ টাকা শ্রমিকদের পি এফ অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। পি এফ বা গ্র্যাচুইটি বকেয়া থাকে না । শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়। গড়ে ৫০-৬০ জন শ্রমিক প্রতি বছর অবসর গ্রহণ করলে গড়ে ৫-৬ লাখ টাকা শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি বাবদ দেওয়া হয়। বাৎসরিক বোনাসের পরিমান ২০ শতাংশ। বোনাস বাবদ প্রায় গড়ে ১৯০০ শ্রমিকের জন্য ৮০-৯০ লাখ টাকা খরচ হয়।
বাগিচাতে শ্রমিক বাসগৃহগুলিকে এক একটি লাইন বলে। আদিবাসী শ্রমিকেরা এই লাইনগুলিতে কোনমতে মাথা গুঁজে থাকেন। যেহেতু বাগিচার জমির লিজ রাজ্য সরকারের তাই বাগিচার জমির মালিক রাজ্য সরকার, অন্যদিকে লিজ গ্রহণকারী মালিক লিজ নেওয়ার পর বাগিচার পূর্ণ দেখভালের অধিকারী। তাই ডুয়ার্সের চা বাগিচাগুলিতে শতাব্দীকাল ধরে শ্রমিকদের ছিল না জমির মালিকানা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরবঙ্গ সফরে এসে বন্ধ, রুগ্ন চা বাগানে শ্রমিকদের নতুন আবাসন তৈরির লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চা সুন্দরী প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে কাজ দ্রুত শুরু করার নির্দেশ দেন। এই প্রকল্পে উত্তরবঙ্গের প্রায় ৩৭০ টি চা বাগানের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চা বাগানের স্থায়ী অথচ গৃহহীন শ্রমিকদের আবাসন তৈরি করে দেওয়ার লক্ষ্যে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার এই দুই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আবাসন, বিদ্যুত, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, জমি অধিগ্রহণ দপ্তরের আধিকারিকরা। সরকারি সূত্রে জানা যায় চা সুন্দরী প্রকল্পে চারশো বর্গফুটের শ্রমিক আবাসে দুটি শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর এবং বসার ঘর সহ শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিকভাবে খরচের হিসেব করা হলেও সব সমীক্ষা শেষ না করা পর্যন্ত চূড়ান্ত খরচ হিসেব করা যায় নি। আবাসন দপ্তরের আধিকারিকরা সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে চা বাগানগুলি পরিদর্শন করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। কোন জমিতে আবাসন তৈরি করা হবে, পানীয় জলের লাইন কিভাবে আসবে, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য নতুন ট্রান্সফর্মার বসাতে হবে কিনা এই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখেন আধিকারিকরা। সমীক্ষার পর সরকারিভাবে টেন্ডার ডাকে আবাসন দপ্তর। রামঝোরা, মুজনাই সহ কিছু কিছু বাগানে চা সুন্দরী প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এবারে ঘাটিয়া চা বাগিচাতে কাজ করার সময় স্থির করলাম চা সুন্দরী প্রকল্প নিয়ে সরকারী চিন্তাভাবনা পাঠকের সামনে পেশ করা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতে কোন চা বাগিচাতে আজ পর্যন্ত বাড়ি হয় নি। যদি এই স্কিম থেকে থাকেও তাহলে তা কাগজে কলমেই, তাতে শ্রমিকদের কোন লাভ হয় নি এতদিন পর্যন্ত। তাই রাজ্য সরকার চা সুন্দরী প্রকল্প গ্রহণ করতেই শুরু হয়ে গেল বাগানে চা সুন্দরী প্রকল্প নিয়ে বিরোধীদের প্যাঁচ। অভিযোগ এল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নাম বদলে চা সুন্দরী প্রকল্প করা হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টিকলো না। দেখা গেল বাগানের প্রত্যন্ত এক কোণে এই ঘরগুলি তৈরি হবে বলে শ্রমিকদের অনেকেই এই ঘরগুলিতে যেতে চাইছেন না। শুনলাম এখানেও রয়েছে বিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থবাহী উস্কানি। কথা বললাম একাধিক চা বাগিচার শ্রমিকদের সঙ্গে। সমস্যা হিসাবে যেটা উঠে এল সেটা হল যুগ যুগ ও বংশপরম্পরায় বর্তমান ঘরগুলিতে থাকার দরুন ওইসব ঘরের ওপর শ্রমিকদের ভালোবাসা ও টান তৈরি হয়েছে। কেউ নিজেদের মতো করে ঘর গেরস্থালি সাজিয়েছে। কেউ ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই ফলফলাদি, সুপারি গাছ লাগিয়েছে। কেউ বা আলাদা ঘর তৈরি করে গো পালন, হাঁস-মুরগি, ছাগল, শুয়োর পালন করছে। কিছু শ্রমিক দোকানঘর তৈরি করে অতিরিক্ত উপার্জন করছে। তাই বাগানে বাগানে সমস্যা দেখা দিল যেটা সেটা হল চা বাগানে শ্রমিকদের বসবাসের জন্য নতুন ঘর তৈরি হল ঠিকই। কিন্তু তৈরি হওয়া নতুন ঘর বরাদ্দ হলে শ্রমিকরা অনেকেই যে থাকবে না তা নিয়ে কোনও সন্দেহ রইল না। কারণ কোনও শ্রমিকই পুরানো আবাস ছেড়ে নতুন আবাসে যাবে না। অন্য চা বাগানেও একই অবস্থা তৈরি হবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যেসব শ্রমিকের ঘর নেই, যারা অন্যের ঘরে বা পরিত্যক্ত ঘরে বা হাসপাতালে বসবাস করছেন তাদের জন্য নতুন ঘরের ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। দেখা গেল নতুন ঘর তৈরি হবার পর এগুলি পরিত্যক্ত অবস্থাতে পড়ে থাকবে। এগুলি হবে সমাজবিরোধীদের আশ্রয়স্থল, মদ ও জুয়ার আসর এবং দেহব্যবসার কেন্দ্র।
হাতে কলমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষান করার জন্য গেলাম মুজনাইতে। শুনলাম প্রায় দু’বছর বন্ধ থাকার পর আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের মুজনাই চা বাগান সম্প্রতি খুলেছে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে। বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ চা সঞ্চালক বিকাশ মুখার্জির তত্বাবধানে উত্তরবঙ্গে চারুচন্দ্র সান্যালের স্মৃতিবিজড়িত মুজনাই চা বাগানে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বাগান খোলার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প জলস্বপ্নের মাধ্যমে ঘরে ঘরে জল সংযোগ ও চা সুন্দরী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তমান চা বাগান কর্তৃপক্ষের উপর এসে পড়েছে। রুগ্ন চা বাগানের দূর্বল পরিকাঠামোর মধ্যেও স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন চা বাগান কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই তারা এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বহিরাগত প্রচুর শ্রমিকের থাকা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। পাশাপাশি চা সুন্দরী প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট জমি প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েছে। চমকে উঠলাম। ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে ছুটলাম মুজনাই। চিন্তা করলাম এই প্রকল্প সফল হলে এটাই তো রোল মডেল হতে পারে উত্তরবঙ্গের বন্ধ এবং রুগ্ন বাগিচাক্ষেত্রে। শুনলাম মুজনাই চা বাগানে শ্রমিকদের বসবাসের জন্য ৮৭৬ টি নতুন ঘর তৈরি হবে। কিন্তু তৈরি হওয়া নতুন ঘরে শ্রমিকরা যে থাকবেন না তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেখানে গিয়ে দেখলাম উন্নয়নের পরিকল্পিত উদ্যোগ শুরু হয়েছে। যদিও উন্নয়নের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল শ্রমিকদের একাংশের। কিছু শ্রমিক নিয়ে গেলেন চা সুন্দরী প্রকল্পের জমিতে। দেখা গেল বাগানের প্রত্যন্ত এক কোণে এই ঘরগুলি তৈরি হবে। পিছনেই নদী ও ঘন অরণ্য। এই বাগানে প্রত্যেকদিন হাতির হানা ঘটছে। সবচেয়ে ভালো হত যদি পুরোন ঘরগুলি সুন্দরভাবে মেরামত ও রং করে শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়া হত। চা সুন্দরী প্রকল্প সম্পূর্ণ হওয়ার পরে শ্রমিকদের যদি জোর করে নতুন ঘরে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে বাগানে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠবে। এর ফলে হয়তো বাগানও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
তাই দাবি উঠেছে চা সুন্দরী প্রকল্প সম্বন্ধে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করা, নতুনভাবে পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। অনেক চা বাগান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় বহু শ্রমিক বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সেই বিষয়টিও পরিদর্শনের সময় বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের পরে রাজ্য আবাসন দপ্তরের উত্তরবঙ্গের এক আধিকারিক সূত্রে জেনেছিলাম ‘চা সুন্দরী প্রকল্পে’ প্রস্তাবিত আবাসনের নকশার কাজ শেষ। দ্রুত ফিল্ড সার্ভের কাজ শুরু হবে। সেই সময়ে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলার বন্ধ চা বাগানের জমি পরিদর্শনের কাজ শুরু করেছিল রাজ্য আবাসন দপ্তর। শুনেছিলাম জলপাইগুড়ির রেডব্যাংক, মানাবাড়ি, ধরণীপুর এবং আলিপুরদুয়ার জেলার তোর্ষা, লঙ্কাপাড়া, মুজনাই, ঢেকলাপাড়া চা বাগানে এই আবাসন তৈরি হবে। আলিপুরদুয়ার জেলায় প্রথম ধাপে চা সুন্দরী প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সরকার আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার বন্ধ এবং রুগ্ন চা বাগানের জন্য ৩,৬৯৪ টি আবাসন তৈরির কাজ শুরু করে। আলিপুরদুয়ারের লঙ্কাপাড়া চা বাগানে ১১৮৪ টি, তোর্ষা বাগানে ৩৫৪ টি, মুজনাই বাগানে এবং ঢেকলাপাড়া বাগানে ৮৭৬ টি করে ঘর তৈরি হবে বলে জানলাম। অন্যদিকে, জলপাইগুড়ি জেলার রেডব্যাংক চা বাগানে ৫৬২টি, মানাবাড়িতে ২০৬ টি এবং ধরণীপুর বাগানে ২৮৫ টি ঘর তৈরি করা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানলাম। কিন্তু সেই কাজ মাঝে থমকে যায়। আলিপুরদুয়ারে সম্প্রতি ফের কাজ শুরু করা হয়েছে। অনেক চা বাগিচাতেই স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ১০০০ এরও বেশি আবাসন রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি আবাসন ভেঙেচুরে একাকার হয়েছে। টিনের চাল ফুটো হওয়ায় ভিতরে বৃষ্টির জল পড়ে। জানলা-দরজা ভেঙে গিয়েছে চা বাগানের শ্রমিক বস্তির প্রায় প্রতিটা পরিবারের। তাই নতুন ঘর করে দেবার পাশাপাশি পুরনো ঘরগুলি সংস্কারের ব্যাবস্থা কি করা যায় না? উঠেছে প্রশ্ন।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴