পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৮
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নারদের ভার
মতিবালা
ছেলেদুটোর হাত থেকে নারদের ভারটা হাতে তুলে নিতেই বাঁশের থুড়িগুলো খোলটোং
খোলটোং করে বেজে উঠল। আলতা দিয়ে রঙ করা সুন্দর একটা বাঁকে করে ছেলেগুলো
নারদের ভার নিয়ে এসেছে। মতিবালা ওটা নামিয়ে নিতেই মালতীর ছোট মামি
ছেলেদুটোকে বসতে দেয়। বাঁকের একদিকে একছড়া পাকা কলা, আর কিছু নেই। অন্যদিকে
একছড়া কলা, বাঁশের তৈরি গোমার মতো ফাঁকা ফাঁকা করে বোনা ছোট্ট ঝুড়িতে
সিঁদুর লাগানো পাঁচটা পুঁটি মাছ আর সাথে নতুন মাকলা বাঁশের পাঁচটা থুড়ির
মধ্যে একটায় দই, একটায় দুধ, একটায় পান, একটায় চুন আর একটায় শুধু জল।
থুড়িগুলোর মধ্যে দড়ি লাগিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে, সেজন্য খুব সুন্দর আওয়াজ করে
বাজছে।
পঞ্চদেবতার পূজাসহ হর-গৌরি পুজো,
তারপর মালতীর অধিবাস হয়ে গেলে মালতীর বাবা বসেছিল নান্দিমুখ শ্রাদ্ধ করতে।
উপোস আছে, কন্যাদান বলে কথা! সবে সব শেষ করে বসেছে। পুরোহিত মশাই তাড়াতাড়ি
বেরিয়ে গেছেন, তাঁর আরো কোথায় একটা পুজো আছে। মালতীর বাবার দিকে তাকিয়ে
মতিবালা জিজ্ঞেস করে,
"নারদের ভার আরো কেনে আনির নাগে তো! ভাগিনাগিলা কেমন শরম খায়! অইন্য মানষিও আরো আনা না যায়। কেনে তো বাবা?"
পাশ থেকে বুধেশ্বরের মা বলে,
"ঘটকটাক পুছেকখেনে। উমা অ্যাত কাথা কোবার পায় আজি? উপাসের দেহা। নানান জাতির কাথা কোইলে এলায় মাতাটা ঘুরিবে।"
মালতীর বাবা কথাগুলো জানে কিনা বোঝা গেল না তবে ঘটকমশাই বলার জন্য যেন তৈরি হয়েই ছিল। বুড়ির কথা শেষ না হতেই বলল,
"হ, তে শুনিবেন? হিটা তো মেলা কাথা বারে। তে মুই তোমাক কনেক ছোট করিয়ায় কং।"
বলে একটু থামল। তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল,
"কনেক জল দেও বারে, ওউদোত সাইকোল চালেয়া টুটিটা শুকি গেইসে।"
ঘটকের
কথা শুনে মালতীর ছোটমামি হেসে দিল। ওর একহাতে একটি থালায় প্লেটে করে
তিনজনের জন্য মিষ্টি, অন্য থালার উপর তিনটে দস্তার গ্লাস ভর্তি ঠান্ডা জল।
রূপোর নূপুরে ঝুমঝুম আওয়াজ তুলতে তুলতে আসতে আসতে হাসিমুখে উত্তর দিল,
"নন বারে, বাচ্চাও কনেক। তোমারে ত্যানে মিষ্টি আর জল নিগাছোং।"
ফাকাই
ঘটক যে শুধু ঘটকগিরিই করে তা নয়, মাঝে মাঝে ধর্মকর্মও করে। সেটাতেও ওর
আয়ের ব্যবস্থা ভালোই। ছাতুয়াগিরিও করে সময় বিশেষে। তাই গভীর শাস্ত্রজ্ঞান
নাই বা থাকল, ধর্মের দুই একটা কথা বুঝে শুনে মনে রাখতে হয়। সময় বিশেষে সেসব
আবার একটু জনসমক্ষে বলতে টলতেও হয় আর কী। যেমন এখন। মতিবালার কথায় ফাকাই
ঠিকঠাক জবাব দিতে তৈরি হয়। এতে তার একটু মহিমা বাড়বে। পান খাওয়া লালচে
মুখেই মিষ্টিদুটো পরপর ঢুকিয়ে ঢকঢক করে জল খায়। ঘাড়ে ফেলে রাখা গামছাটা
দিয়ে মুখটা মুছে নেয়, তারপর শুরু করে,
"নারদ মুণি যেই সেই মানষি নোহায় বারে! উয়ায় মানষিতে মানষিতে যেমতোন মিলন
ঘটে দ্যায় ত্যামোতোন মিল ভাঙেয়াও দিবার পায়। ওই ত্যানে উয়ার নামে নারদের
ভার আনির নাগে। তে এলা কবেন ভাগিনায় কেনে? নারদ মুণি যে শিবের ভাগিনা বারে!
তে ভাগিনাকে না হিটা করির নাগেছে এলা!"
সবাই মন দিয়ে ফাকাই ঘটকের কথা শুনছিল। ঘাড়ের গামছাটা দিয়ে আর একবার মুখটা মোছে ফাকাই। তারপর ডাক দেয়,
"কায় আছেন, আর এখেনা জল দ্যাও বারে।"
বলে
একটু থামে। মালতীর মামি হাতে দস্তার জগটা নিয়ে এসে আগের গ্লাসটাতেই আরো জল
ঢেলে ভর্তি করে দেয়। জলটা কয়েক ঢোঁক খেয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়েই আবার বলতে
শুরু করে,
"আগিলা মানষি তো মেলা নিয়ম মানিসে
বারে। হরগোরি পূজা তো আগোত নারদের ভারের জিনিস দিয়ায় কোইচ্চে। এলা সিনি
পূজা হয়া নারদের ভার আইসে! ওটে পঞ্চ দ্যাবতার পূজা, ওটে অধিবাস করির আগোতে
নারদের ভার আসির নাগে। আর এলা তো আগোতে সব হয়া গেল।"
মতিবালা কলকল করে ওঠে,
"তোমরায় না তে দেরি করি আসিলেন বারে! আগোত কোইলে না কনেক বাচ্চালি হয়!"
ফাকাই মতিবালার কথায় হাসে।
"এ, এলা না সোগায় এমতোনে করে বারে! আর ছাওয়া দুইটা বিরাইতে দেরি করিল! হবে।"
তারপর আর একটু থেমে বলে,
"আগিলা নিয়াম কী আর সবলায় মানি চোলা যায়! অ্যায় যেমতোন, আগোত ছেলে
বরণের দিনোত পাঁচকাপড়া দিবার চল ছিল না। বরণের দিন জামার কাপড় টাপড় দিসে!
আর পাঁচকাপড়া দিসে হেটে কোইনার বাড়ি আসিয়া। একটা কলার গছ গাড়ির নাইগবে, ওটে
পাত্রক পাঁচকাপড়া দিসে কোইনার বাপ। স্যাও কাপড়া পিন্দিয়া পাত্র বিয়াত
বোইসে। এলা কী তে এইলা হামরা মানি বারে! এলা পাত্র বাড়িতে সাজি পারি আইসে!"
কথাটা ঠিক। ফাকাই বেশ গর্বের সাথে বলে,
"হামরা যেলা ছোট ছিলি, আগিলা দিনকার বুড়াগিলা বাহে বসি থাকি নিয়াম
করে নিসে। এখেনা হিদি হুদি হোবার পায় নাই। আর আগ ছিল সোগারে খিব। কাহো
কাহো তো বামনেরে ভুল ধোইচ্চে বাহে! ন্যাও তো কেমতোন শাস্তর জানা মানষি
ছিলেক তাহালে!"
গল্পের মাঝখানে কখন বুধেশ্বরের বাপ
এসে বসেছে অনেকেই খেয়াল করেনি। এবার গলা খাঁকারি দিয়ে নিম্ন স্বরে, কিছুটা
স্বগতোক্তির মতো করেই বলে,
"অ্যা, বিয়াও টিয়াও এখেরে সবলায় শাস্তরের নিয়াম নাহয়। কিছুটা দ্যাশের হাওয়াও থাকে।"
ফাকাই
একটু নড়েচড়ে বসে এবার। বুধেশ্বরের বাপকে চেনে। এরকম জানবুঝ ভালো লোকের
সাথে কথা বলে মজা, আবার নিজের জ্ঞানও একটু জাহির করা যায়! সেজন্য মনে মনে
খুব উৎসাহী হয়ে ওঠে, সেটা ওর চোখমুখ দেখে বোঝাও যায়। মহা উৎসাহে শুরু করে,
"কাথাটা তোমরা ঠিকে কোইলেন বাহে। তোমরা হোইলেন আগিলা দিনের মানষি।
অ্যায় যে হামার দেশি মানষিলার বিয়াও দেয় কায়? আসামিয়া বামনঠাকুর। তে উমার
নিয়ামের সতে হামার মিল থাকির কাথা। সবলায় কিন্তুক মিলে না বারে। গোদেক একে
একে আছে, গোদেক আলাদা।"
একটু থামে। গামছাটা দিয়ে আর একবার ঘাড় গলা মোছে। মালতীর বড়মামা একটা হাঁক দেয়,
"হাকোই দুই একখান থাকিলে আনো বারে, ঘটকটাক গরম নাগাইসে। সামানে ঝসেছে।"
ফাকাই তড়িঘড়ি হাত তুলে বলে,
"নানাগে বারে, নানাগে। এংকেরি ভাল।"
তারপর বুধেশ্বরের বাপের দিকে তাকিয়ে আবার শুরু করে,
"কেনে আলাদা? একোমোতোন জাগার আচার-বিচার আলাদা। তে নিয়ামো মনে করেন আলাদা হচে।"
বুধেশ্বরের বাপ এবার হালকা হেসে ফাকাইকে সমর্থন করে বলে,
"ওইলাকে না দেশাচার, কূলাচার কয় বাহে। হিলা বাদ দিয়া তো হামরা
কুনো কাম করির পামো না। অ্যায় দেকোখেনে, বিয়াওখানোতে কোইনার বাড়ি আর
পাত্রের বাড়ির বৈরাতীর কতো ঝগড়া নাগে। নিয়ামেরে জোইন্যে। জাগা আলাদা,
নিয়ামও খানেক আলাদা।"
একটু হাওয়া বুঝে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুধেশ্বরের বাপ আলোচনা নিজের কাছে টেনে নিল। আসলে সর্বসমক্ষে এসব কথা বলেও সুখ।
"হামরা বিয়াও আদি হোইতে যা যাবতী কাজ কাল দ্বারায় কোরাই?
আসামিয়া বামনঠাকুর দিয়া তো? উমাক পুছেন তো উমরা কুন শাস্তরের কাথা ধরি
চলে?"
এটুকু বলে বৃদ্ধ মানুষটি সবার মুখের দিকে তাকায়। কেউ কোনো কথা বলে না।
"হামার যে চর্তুবেদ আছে, তাহার মোইদ্যে যর্জুবেদের নিয়ামগিলা
ধোরিয়াই বিয়াও আদি এইলা কাজ-কর্ম কোরা হয়। বুঝলেন হে বাবার ঘর। হিলা কাথা
অত সোজা নাহয়।"
ইতিমধ্যে মালতীর ছোটমামি চা নিয়ে এলে আলোচনায় ছেদ পড়ে। মালতীর মামি হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বুধেশ্বরের বাপকে বলে,
"মোক চিনিসেন বা? মুই মালতীর ছোটমামি হং।"
বুড়া খুশি হয়ে হাসে।
"ভাল করি এলা চোকুদি না দেখোং বারে। কী চিনা পাইম।চা খেতে খেতে
সবাই নানারকম কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে প্রসঙ্গ ঘুরে যায় নানা দিক, তারপর
উঠোনেই নিজেদের মতো গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে সবাই। আগে এত গরম পড়ত না, এখন গরম
অনেক বেশি। শীতকালের বিয়েতে কাজ করে খেয়ে-দেয়ে শান্তি। এসবই ঘুরে ফিরে
আলোচনা হতে হতে কৃষিকাজ, চাষ-বাস থেকে আলোচনা বাংলাদেশ-পাকিস্থান যুদ্ধ হয়ে
ভারত-চীন যুদ্ধে ঢুকে পড়ল।
ছেলেদুটো
কাঁহাতক আর মুখ আমসি করে বসে থাকে! বড়দের এত ভারী ভারী কথা শুনতে শুনতে
ওদের হাই ওঠে। তারপর ওরাও একটু পরে কখন যেন এ বাড়ির ছেলেদের দলে ভিড়ে যায়!
...............................................................
ছাতুয়াগিরি - গ্রামের বয়স্ক মানুষজন জড়ো করে গাড়ি ভারা করে তীর্থস্থান ঘুরিয়ে আনা।
বাচ্চাও কনেক - একটু অপেক্ষা করুন।
হাকোই - হাতপাখা