পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৭
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঝাকুয়া আন্দন
চোখের
জল বড় ছোঁয়াচে। মনখারাপ লাগলেও বসমতী তাড়াতাড়ি মালতীকে ওখান থেকে সরিয়ে
ঘরে নিয়ে যায়। সুকারুর বৌ বাকি কাজকর্ম গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মালতীর মা ও নিজেকে সামলে নিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে রান্না-বাড়ির অবস্থা
দেখতে রান্না ঘরের দিকে যায়। যদিও মালতীর মামিই সব দেখাশুনা করছে। তবু সে
হল 'দুরান্তরকার মানসি' এদিককার মানুষজন সবাইকে চেনে না। রাতের রান্না
মালতীর ছোট মামা আর পাড়ার তিনজন লোক মিলে করবে। জোগাড় যন্ত্র করে দিতে হবে
সব। উঠোনের বাইরে এক কোণায় চৌকো উনুন খুঁড়ে লেপে পুঁছে রাখা আছে। এখনকার
খাওয়ার জন্য যেটুকু রান্না মহিলারাই বসিয়েছে। রান্না ঘরে যেতে যেতে শুনলো
নগেন কাকার বৌ কাকি বুধেশ্বরের বৌকে বলছে,
"ন্যাও তো বৌমা। ক্যামোতোন আন্দেন, আজি তোমরায় ভাত চোড়াও। দ্যাখোং তো হাতাস খান না কি!"
বুধেশ্বরের বৌকে কথায় হারানো কঠিন। পট পট করে উত্তর দিল,
"কেনে আরো হাতাস খাইম বারে মাও। তোমরা শাশুড়িলা আছেন, দ্যাখে দ্যাখে শিকি শিকি দ্যাও আন্দোছোং।"
নগেনের বৌ যশোবালা কৃত্রিম মুখ মুচড়িয়ে বলে,
"হামরা আরো কেনে শিকামো! তোমার মাও কী কোনোয় শিকি পেটায় নাই!"
বুধেশ্বরের বৌ কখনোই কম যায় না, একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে বলে,
"মোর মাও না শিকালে কী আর পরার বাড়িত খাবার পাং বারে! তে এলা
তোমার মানসি, তোমার মতোন করি শিকাও আরো! যেমনে শিকাবেন, তেমনে আন্দিম,
তেমনে খাবেন। ভাল হোইলেও মুই এলা তোমাল মানসি, খারাপ কোইল্লেও তোমার
মানসি।"
ওর মুখের সাথে না পেরে যশোবালা হেসে ফেলে,
"নাউয়ার না ক্ষুরখানের নাখান তোমার মুখ চলে বায়। হিটা কোটেকার ছাওয়া তে কায় জানে।"
আর একজন ভিড়ের মধ্য থেকে বুধেশ্বরের বৌয়ের হয়েই উত্তর দেয়,
"তোমা সিনি জানেন কোটেকার ছাওয়া ধরি আইচ্চেন!"
এবার বুধেশ্বরের বৌ একটু হেসে বলে,
"আন্দির না সোগায় পায় বারে! তে ঝাকুয়া আন্দন তো আন্দোং নাই
কুনোদিন! তোমরালা আছেন, হবে এলায়। না পাইম তে কী পাইম। তে ফির ভাল না হলে
কুনো কন না!"
হাসি গল্পের মধ্যেই বুধেশ্বরের বৌ,
মালতীর ছোট মামি মিলে রান্না চড়িয়ে দিল। যশোবালা আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে
সবজি কাটতে বসে জিজ্ঞেস করল,
"কও বারে আন্দুনির ঘর। কী আন্দিবেন।"
"কী আরো আন্দিমু! হামরা বাড়ির মানসিলা না এইলা দিয়ায় খামু বারে।
ডাইল, একখান তরকারি। কয়খান আরো শাক করে! তোমা আতিকার বাদে শাক ব্যাচো বেশি
করি।"
গল্প আর মাঝে মাঝে চা, সঙ্গে পান, চুন, সুপারি
- মহিলা মজলিশ নিজের মতো জমজমাট! এরমধ্যে মাছ এসে পৌঁছালে একজন যায় মাছ
ধুয়ে পরিস্কার করে রাখতে। হাতও চলতে থাকে, মুখও চলতে থাকে।
মালতীর বাবা মালতীর বড় মামার সঙ্গে একসাথে কাজকর্মের তদারকি করছে।
কিন্তু সমস্যা হল কেউ কিছু জানতে চাইলেই মালতীর বাবার কিছুই মাথায় আসছে না।
মালতীর বড়মামাকে দেখিয়ে বলছে,
"তোমরা কি করেন কর দা। মোর মাতাত কোনোয় আইসেছে না।"
মালতীর
মামা পরিস্থিতি বুঝতে পারে। একদিকে এত আয়োজন, টাকাপয়সার চিন্তা অন্যদিকে
মেয়ে চিরদিনের জন্য বাড়ি থেকে বিদায় নিচ্ছে - সব মিলিয়ে ভেতরে ভেতরে
চিন্তায়, মনখারাপে লোকটা ভেঙে পড়েছে। সেজন্য ওর বড়মামা নিজেই অবস্থার হাল
ধরে। সকালেই ওর ছোট ভাই আরো দূজনকে ধূপগুড়ি হাটে পাঠায়। ভাইকে বলে নিজে
দাঁড়িয়ে থেকে মাছ কাটিয়ে নিতে। মাছের টুকরো ঠিক কতবড় হবে সেটাও বুঝিয়ে বলে।
সঙ্গে নিজের পকেট থেকে কিছু বাড়তি টাকাও দিয়ে রাখে। তারপর পই পই করে বলে
দেয়,
"বাউ, ফালতু খরচ করেন না। বাঁচিলে পাইসা কয়টা ধরি আইসেন। বাড়িত হেটে নাগিবে।"
তারপর নিজে বরযাত্রীর বসার জায়গা, খাবার জায়গা, কলার পোটুয়া ধুয়ে কোথায় রাখবে সব খোঁজ-খবরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সুকারুর বৌ মালতীর বড়মামিকে জিজ্ঞেস করে,
"হ্যাঁ মা, জল না দুপুরে বরি আনি গাও ধোয়ালি। আর তো গাও ধয়ের
নানাইগবে কও! তাহালে জোগোতজাগাত কাপড়াখান প্যান্দে সাজে পাড়ে থুলি হয়!"
মালতীর বড়মামি গলায় একটু অতিরিক্ত জোর দিয়ে বলে,
"সাজাও। কত আতি আসিবে বরযাত্রীই, অত আতি নোয়া যায়! এলা সোগায়
সোইন্দাতে কোইনা সাজে থয়। আতিত উমার বাজি আসিলে সেলা গেরাম পূজেন খালি তালে
হোবে।"
অনুমতি পেয়ে সুকারুর বৌ একটা ডাক দেয়,
"কোটে গেইলেন চেংরিগিলা। হামার কোইনাটাক কনেক আলতা-টালতা ঠ্যাঙোত
পেন্দাও, নোকপালিশ পেন্দাও। কাহো খোঁপা বান্দির পান তে কও। মুই এলায়
কাপড়াখান পেন্দাইম।"
ছোট্ট প্রায়ান্ধকার ঘরটায় মালতী
জড়সড় হয়ে বসে আছে। হাতে নতুন শাঁখা-পলা, নতুন শাড়ি জড়িয়ে কেমন আড়ষ্টভাব।
সুকারুর বৌ মতিবালা নিজেও একদিন এই দিনটি পেরিয়ে এসেছে, তাই মালতীর
অনুভূতিটা ভালো করেই অনুভব করতে পারছে। একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর
জোর গলায় পরিস্থিতি হালকা করার জন্যই যেন বলে,
"দেখোং মাই, নিন যাছিত না কী! আজি আইতোত বোল নিনে হবে না, কালিও হবে না। দিনোত কনেক নিন পাড়ির পালু হয়।"
মালতী
কিছু বলে না। ওর চোখ কান্নায় লাল হয়ে আছে। ফোঁস করে কয়েকবার নাক টেনে চুপ
করে থাকে। মতিবালার ডাক শুনে অনেকেই হুড়মুড় করে ওই ছোট্ট ঘরটায় ঢোকে। চেনা
মেয়েটাকে হঠাৎ নতুন বৌ রূপে দেখা এটাও একটা কৌতুহলের বিষয় বটে। তবে
বেশিক্ষণ নয়, মতিবালা ধমক দিয়ে বাচ্চাগুলোকে বের করে দেয়।
"নন তো ছাওয়ার ঘর, ফেলাও তো আলতা-টালতাগিলা এলায়। যাও যাও, বিরাও বিরাও বারে, ঘরটাত এখেরে ঢিকিসে।"
বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে বের হয়ে যায়। বড়রা কয়েকজন থাকে। মালতীর খেলার সাথী মিনুবালা বলে,
"দে বৌদি, মুই আলতা প্যান্দে দ্যাছোং।"
মিনুবালা
আলতা পরাতে বসলে মালতী কেমন র্নিজীবের মতো পা দুটো এগিয়ে দেয়। প্রথমে
লম্বা টান দিয়ে তারপর উপর দিয়ে একটু ডিজাইন করে মিনুবালা আলতা পরায়। সবার
চোখে একটা নীরব প্রশংসা ফুটে ওঠে। মতিবালা বলে,
"ভালে তো পেন্দালু! নেক তো, নোকপালিশখানও পেন্দা। মোরটে এলায় ছ্যানব্যান হবে।"
মতিবালাও
ভালোই সাজাতে পারে, কিন্তু মিনুবালার হাত যথেষ্ট দেখে নিজেই দায়িত্ব ভাগ
করে নিল আসলে। মিনুবালাও উৎসাহী হয়ে মালতীকে সাজাতে উদ্যোগী হয়। লাল
নেলপালিশ দু হাতের আঙুলেই পরিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে কোথাও ধেবড়ে গেল
নাকি। সুকারুর বৌ এবার মালতীর চুল বাঁধতে বসে। চিরূণী দিয়ে চুলটা পেছন দিকে
টেনে আঁচড়াতে আঁচড়াতে মিনুবালাকেই বলে,
"সীতাটা পারিম যেলা, সেলা দেখিস তো ভেকেরা হছে নাকি! আর মোক পরে গোর খিঁচাখান দিস। অয় যে ওটে দেখেক কালা ইঞ্চি ফিতাখান আছে।"
মিনুবালা
মাথা নাড়ে। একে একে শাড়ি,গয়না সব পরানো হল। মাথায় চুলে জড়িয়ে দিল সাদা
খইয়ের মালা। চেনা মানুষটাই যেন আজকে অচেনা বড়। সবাই এসে একে একে নানা
অছিলায় মালতীকে দেখে যাচ্ছে। সাজাতে সাজাতেই বেলা গড়িয়ে গেছে। এক ফাঁকে
মিনুবালা ভাত খেয়ে নিয়েছে। একসঙ্গে খেলাধুলার সঙ্গী আজ বিদায় নিচ্ছে। ওর ও
দেখাশুনা চলছে, এ বছর ঘর বর না মিললে সামনের বার ওর বিয়ে দিবেই ওর বাবা মা।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। মিনুবালার ভাবনাটাকে যেন মতিবালা
পড়তে পারে। বলে,
"তোরও আর সন বিয়াও হলে সেলা
দেখিবেন দেকা সাক্কাইতখানে না হবে আর। কুন বা ভাদরে আসিবেন বাপের বাড়ি!
তুই আসিবু তে উয়া না পাবে, উয়ায় আসিবে তে তুই না পাবু মাই।"
তারপর একটু থেমে গলাটায় আরো বিমর্ষ ভাব এনে বলে,
"মোকে দ্যাকখেনে। মোর ছোট বোইনটার সতে তিনবছর থাকি দেকা হয় না।
উয়ায় কয়বার আসি গেল সেলা মুই না পাং। মুই গেলুং তে উয়ায় নাই। অয় যে কয় না,
নদী নদী মিল হয় তাও বোইনি বোইনি মিলে না। হিমার হোইল সেই মতোন।"
বাইরে উলুধ্বনির আওয়াজে ওদের কথা থেমে যায়। কেউ একজন ডাকে,
"মতিবালা, মতিবালা! কোটে মাই বৈরাতী! আয় হিদি নারদের ভার আইচ্চে।"
সঙ্গে
সঙ্গে একটা হালকা কান্নার রোল ওঠে। কিন্তু অভিজ্ঞ বয়স্ক মহিলারা তাড়াতাড়ি
বিষয়টা সামলে নেয়। মতিবালা বাইরে এসে দেখে একমুখ পান খেয়ে উঠোনে ঘটক
দাঁড়িয়ে আছে সঙ্গে দুটো বাচ্চা ছেলে নারদের ভার কাঁধে নিয়ে। লজ্জায় মুখদুটো
লাল, চোখ মাটির দিকে নামানো। মতিবালা হেসে আন্তরিকভাবে বাচ্চাদুটোকে কাছে
ডেকে নিল।
...............................................................
হাতাস - ভয় পাওয়া
ঝাকুয়া আন্দন - অনেক লোকের রান্না
জোগোতজাগাত - বেলা থাকতেই
ছ্যানব্যান - এলোমেলো হওয়া বা ধেবড়ে যাওয়া