হিলা টি এস্টেট (দ্বিতীয় পর্ব)/গৌতম চক্রবর্তী
হিলা টি এস্টেট (দ্বিতীয় পর্ব)
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------------------
বাগিচা সফরের আজ আমার ডেস্টিনেশন চা বাগিচা সার্কিটের শ্রমিক মহল্লা। তাই নাগরাকাটার হিলা চা বাগিচা সফর শেষ করে আর নতুন কোন বাগিচাতে যেতে পারিনি ডুয়ার্সের ভোটের রাজনৈতিক উত্তাপে এবং তীব্র বৃষ্টির জন্য। তাই আগামী দুই সপ্তাহ বাগিচা সফরে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে তুলে ধরব আমার বিগত একবছর ধরে জলপাইগুড়ি সদর, রাজগঞ্জ, মালবাজার, মেটেলি, ময়নাগুড়ি এবং নাগরাকাটা-বানারহাট সার্কিটের চা বাগিচা মহল্লার পাওয়া না পাওয়ার অকথিত কাজিনী। আমার সামর্থ্য, সোর্স, পকেটের রেস্ত খরচ করে স্রেফ নিজের লেখালেখি এবং জানার স্বার্থেই ঘুরে বেড়াচ্ছি ডুয়ার্সের চা মহল্লাতে। বর্ষার এই ভয়ঙ্করতম সময়কালেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। আকাশের মুখভারের কারণে প্রচারে বিঘ্ন, রাজনৈতিক দলগুলোর দুশ্চিন্তা, প্রবলতর বন্যার আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বুথে আগমনের অনিশ্চয়তা, হাইকোর্টে মামলার পর মামলা, নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত আচরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবিবেচনার অভিযোগ এসবের মধ্যেই আগামী ৭ ই জুলাই একদিনে রাজ্যের সর্বত্র পঞ্চায়েত ভোট। বাঙালির ড্রইংরুমে ইনফিউশন, সাবেকি আড্ডার হ্যাংওভার, রাতভরের তর্ক, টেস্ট ক্রিকেট থেকে রাজনৈতিক মঞ্চ, যুযুধান বিরোধী নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ, ক্যাবিনেট মিটিং থেকে কর্পোরেট জগত অথবা নিখাদ আড্ডাতে কিংবা পঞ্চাশ টাকার দিনমজুরের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে সর্বত্রই চালু চা পান। কিন্তু বেশ কয়েক যুগ চা বাগিচা অধ্যুষিত এই ডুয়ার্স তথা উত্তরবঙ্গ বিভিন্ন বিষয়ে অবহেলিত রয়েই গেল। বিগত বাম আমলে সুন্দরবন উন্নয়নের জন্য পৃথক দপ্তর থাকলেও উত্তরবঙ্গের জন্য তেমন কিছু ছিল না। ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা ডুয়ার্সের চা শিল্প বিভিন্ন কারণে রুগণ থেকে রুগণতর হয়েছে। ভাঙাচোরা পথঘাট, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে গয়ংগচ্ছ ভাব, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, হতাশা এবং নৈরাজ্যের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছিল বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি আর ঘন ঘন বনধ-হরতালে নাভিশ্বাস উঠেছিল এই এলাকার মানুষজনের।
রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদলের পর ডুয়ার্স এলাকার মানুষ নতুনভাবে আশার আলো দেখতে শুরু করেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চা বলয়ের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রুটিরুজির আশায় নিত্যদিন ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন এই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। নারী ও শিশু পাচারে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে রয়েছে চা বলয়। পিছিয়ে পড়া এই এলাকা হয়ে উঠেছে কাঠচোর ও চোরাশিকারির মৃগয়া ক্ষেত্র যার লোকাল মডিউল হিসাবে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে এলাকার গরিবগুর্বো মানুষগুলি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসী আমলে এই অঞ্চল ছিল উপেক্ষিত, সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিক। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল এই ভূখন্ডকে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও হিন্দি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সুযোগ না থাকার জন্য অনেক আদিবাসী ছাত্রছাত্রীকে মাধ্যমিক পাশের পর পড়াশুনায় ইতি দিতে হচ্ছিল। চা-বাগানগুলি পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার বাইরে থাকার জন্য চা শ্রমিক পরিবারের লোকজন আইআরডিপি, এসসিপি ট্রাইবাল সাবপ্ল্যান (টিএসপি) ইত্যাদি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সুবিধা, ঋণ ও অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। বাগিচাগুলি পঞ্চায়েতের অধীনে আসার ফলে শ্রমিক সমস্যা কিছুটা সমাধান হয়। আসলে চা বলয়ে ট্রেড ইউনিয়ন মানে ‘ট্রেড’ নয়। শ্রমিকদের সত্যিকারের নায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা, কথাবার্তা হতে পারে। এটা ঠিক পাট্টা ছাড়া রাজ্য সরকার বাগানে ১০০ দিনের কাজ শুরু করেছে। বন্ধ বাগানে দেড় হাজার টাকা করে ফাউলাই দেওয়া হয়ছে। শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য শিবির করা হয়েছে। চা শ্রমিকরা মালিকদের তৈরি বাগানের যে শ্রমিক বস্তিগুলিতে থাকেন সেই বাগানের জমি মালিকদের লিজ দিয়েছে সরকার। তা কিভাবে শ্রমিকদের পাট্টা দেওয়া যাবে সেটা নিয়ে অবশ্য জটিলতা আছে। রাজ্য সরকারের ৪-৫ টি রুগ্ন বাগান নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। অনেক বাগান মিলিয়ে সাজিয়ে বড় বাগান রেখে বাকিটা ইকো-ট্যুরিজম করা যেতেই পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ক্যারন - লুকসান- রেডব্যাঙ্ক - ডায়না - ধরণীপুর - সুরেন্দ্রনগর সার্কিট।
জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে চা বাগানের সংখ্যা কমবেশি ৮৬ টি। স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দুই লক্ষেরও বেশি। এর বাইরেও প্রচুর অশ্রমিক রয়েছে চা বাগানগুলিতে। পঞ্চায়েত, বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনের এরা অন্যতম নীতি নির্ধারক। বাম আমলে তাদের দূর্জয় গড় ছিল চা বাগান। পাহাড় জঙ্গলের মাঝে সবুজ দেখতে যত সুন্দরই হোক না কেন, আদতে চা বাগিচার শ্রমিক মহল্লাগুলি যেন এক একটি ধূসর পৃথিবী। চা বাগান পঞ্চায়েতের আওতায় আসার পর থেকে শ্রমিক মহল্লার রাস্তা ঢালাই হয়েছে। কিন্তু বড়ই জীর্ণ শ্রমিক আবাসগুলি। বেশিরভাগ চা বাগান মালিকেরা শ্রমিকদের মাথা গোঁজার ঠাঁই এর দিকে ফিরেও তাকান না। চিকিৎসার কোনো পরিকাঠামো নেই। সব চা বাগানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ নেই। পানীয় জলের হাহাকার রয়েছে বহু চা বাগানে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর কৃতি ছাত্র বানারহাটের সংশ্লিষ্ট চা-বাগিচার শ্রমিকদের ব্যথা-বেদনার সঙ্গী জিয়াউল আলমের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানলাম শিক্ষা ও সচেতনতার প্রসার না ঘটার জন্য এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার, অন্ধ-বিশ্বাসের শিকার। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতনতা, বিজ্ঞান মানসিকতার বিকাশ ও কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি জিয়াউল আলমের মতে, অনেকেই চিকিৎসার বিষয়ে ওঝা, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কবজের ওপর নির্ভরশীল। উত্তরবঙ্গে চা শিল্প আজ নানা কারণে রুগণ। রয়েছে নদী ভাঙ্গন বন্যা। ফি বছর আসে ম্যালেরিয়া। কান্নার রোল ওঠে চা বাগিচায় বনবস্তিতে। শবের মিছিল দীর্ঘ হলে ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরির কথা শোনা যায়। আবহাওয়া-পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে এলে আবার সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম কথাই হয়ে থাকে, কাজে রূপায়িত হয় না। এর পাশাপাশি রয়েছে বহু সৃজনশীল প্রতিভার অপমৃত্যু। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার ও প্রচারের অভাবে যা তিলেতিলে নিভে যায়। ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর উৎসাহ ম্লান হয়ে যাচ্ছে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হবার আশংকায়।
আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে ৫৫ টি বনবস্তির প্রায় চুয়ান্ন হাজার ভোটার। আপাতত স্থগিতাদেশ দিলেও গোটা ভারতে জঙ্গল এলাকায় বসবাসকারীদের উৎখাতের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। উদ্বেগ বাসা বেধেছে বনবস্তির ঘরে ঘরে। এলাম বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত পাম্পু বস্তিতে। বস্তির বাসিন্দা সরস্বতী লোহারদের জন্ম, কর্ম, জীবিকা সবই এখানে। তাদের প্রশ্ন কোথায় নিয়ে ফেলবে তাদেরকে। রাষ্ট্রীয় বনজীবী শ্রমজীবী মঞ্চের আহ্বায়ক লাল সিং ভুজেল তাই বলেন ‘দরকারে গুলি খেয়ে মরবো। কিন্তু জমি দেব না।' পেট ভুখা নেই কারো। কিন্তু জীবিকা, অস্তিত্ব বিরাট বড় প্রশ্ন। নাগরিক সংশোধনী আইনের জন্য সবচেয়ে বিপাকে পড়বে বনবস্তিবাসী এবং চা-বাগানের মানুষেরা। কারণ তাদের জমির উপরে অধিকার নেই। সরকার আজও সকল বস্তিবাসী এবং সকল চা-শ্রমিকদের জমির পাট্টার ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে এই আইন কার্যকর করা হলে সর্বনাশ হবে চা বাগিচা এবং বনবস্তির মানুষের। চা বাগিচাগুলিতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সকলে একসঙ্গেই আছে এবং তারা একসঙ্গেই থাকতে চায়। বরং নতুন করে বাইরে থেকে আর যাতে কোনো লোক আমাদের দেশে ঢুকতে না পারে তা দেখা সরকারের কর্তব্য। সেটা না করে ধর্মে-ধর্মে দেশের মানুষের মধ্যেই বিরোধ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা কাম্য নয়। নাগরিকপঞ্জি অবশ্যই দরকার আছে। প্রকৃত যারা নাগরিক তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা হোক। আর যারা প্রকৃত নাগরিক নন তাদের বিরুদ্ধে ধর্মের বৈষম্য না করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বনবস্তির বাসিন্দারা চান নাগরিকপঞ্জি আইন বা নাগরিক সংশোধনী আইন নিয়ে দেশব্যাপী মানুষের মনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তার অবসান হওয়া দরকার। এর সমাধানের স্পষ্ট কোনো জবাব নেই রাজনৈতিক দল অথবা নেতাদের কাছে। ভোটের বাজারে সবাই আশ্বাসের ঝুলি নিয়ে হাজির হয়। তবে ওই প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়িতে কতটা চিঁড়ে ভিজবে সেটা সময় বলবে আগামী দিনে।
নাগরাকাটার একাধিক চা বাগান সীমান্তঘেঁষা। করোনাকালের আগেও অবাধ যাতায়াত ছিল দু'দেশের বাসিন্দাদের। কাঁটাতারের বেড়া ও ভারী বুটের দাপটহীন সীমান্তে ভুটানের বাসিন্দারাই ছিলেন এদেশের ব্যবসায়ীদের মূল খদ্দের। জিতি, গাঠিয়া, চ্যাংমারি, লুকসানের মতো একাধিক বাগানের শেষ প্রান্তে কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছিল আস্ত বাজার। করোনা সংকট শুরু হতেই ভুটানেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় সীমান্ত পারাপারের ওপর যা এখনও চলছে। শুধু তাই নয়, সীমান্ত বরাবর কোথাও দীর্ঘ গর্ত খোঁড়া হয়েছে। আবার কোথাও কাঁটাতারের বেড়া লাগানোর কাজ শুরু করেছে ভুটান। এন্ট্রি পয়েন্টে যুক্ত হয়েছে সিসিটিভি ও নিরাপত্তাকর্মীদের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা যার জেরে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে এদেশের দোকানদারদের। পরিস্থিতি যে আর সহজে স্বাভাবিক হচ্ছে না এমনটা আঁচ করে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। ঝাঁপ পড়া কিছু দোকানের ব্যবসায়ী আবার দিনমজুরের কাজ করছেন। জিতি চা বাগানের সীমান্ত এলাকার গোপাল লাইনের বাসিন্দা অনিল প্রসাদ, নাথুনি প্রসাদ, ইসরাইল হুসেন বা কৃষ্ণ প্রসাদের মত ব্যবসায়ীরা কেউ জুতোর দোকান করে আবার কেউ মুদিখানার সামগ্রী বিক্রি করে সংসার চালাতেন৷ তারা দোকান বন্ধ করে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন। এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ ফিরোজের মতো আরও অনেকেই পাততাড়ি গোটানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বিক্রিই যদি না হয়, সেই দোকান আর খুলে রেখে লাভ কী? স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানলাম জিতি সীমান্তের ওই বাজার একসময় গমগম করত ভুটানের শিবচু, চারঘারে, গোলা, বিন্দুর মত নানা পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দাদের আনাগোনায়। গাঠিয়া চা বাগানের আপার ডিভিশনের ঠিক ওপারেই গুমানী ভুটান। সেখানকার কেউ আর গাঠিয়ার বাজারে আসেন না। তার ওপর সীমান্ত বরাবর গর্ত খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে।
কেড়েছে রুটিরুজি। ভুটান সীমান্তের চা বাগানে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। পরিস্থিতি এমনই অনেকে একেবারে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আজন্মের প্রিয় চা বাগান। এলাকার যুবক মোহন ওরাওঁ এর কাছ থেকে জানলাম আগে বাগানের অনেকে ভুটানে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করতেন। সেসব বন্ধ। ফলে এখানকার অনেকেই নতুন জীবিকার খোঁজে বাইরে চলে গিয়েছেন। ভোট নিয়ে নয় তাদের চিন্তা বেঁচে থাকা নিয়েই। একই পরিস্থিতি চ্যাংমারি চা বাগানের আপার ডিভিশনের সীমান্তেও। ওই এলাকার নেপালি লাইন, কোঠি লাইন, দর্জি লাইনের মত আরও কয়েকটি শ্রমিক মহল্লার অনেকেই ভুটানে গিয়ে কাজ করতেন। নেপালি লাইনের বাজারে এসে কেনাকাটা করতেন। চ্যাংমারি ভুটানের বাসিন্দা বিদুর ছেত্রী, অনুপ দাহাল, আকাশ ছেত্রী, কপিল দাহালরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তাদের দোকান বন্ধ। তাই চা বাগানে গিয়ে বিঘা শ্রমিকের কাজ জুটলে করেন, নয়ত বসে থাকেন। তাদের বক্তব্য ভোট দিয়ে কি এই সমস্যার সমাধান হবে? আপার চ্যাংমারির এক বৃদ্ধার কাছ থেকে জানতে পারলাম পানীয় জলের সংকটও এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আগে ভুটানের ঝোরা থেকে জল নিয়ে আসতে সমস্যা হত না। এখন দৌড়োতে হয় দূরের ডায়না নদীতে। পিএইচইর প্রকল্প তৈরি করা হলেও তা চালু তখনও পর্যন্ত হয় নি। একদিকে বাগান বন্ধ থাকায় যখন শ্রমিকদের পেট চালানো দায় হয়ে পড়েছে, সে সময় পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাব যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে তাদের। এই নদীর জলেই গোরু-ছাগলকে স্নান করানো হচ্ছে। আবার জামাকাপড় কাচা এবং পানের জন্য অপরিশ্রুত জলই বাসিন্দাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। শয়ে শয়ে মানুষকে তীব্র জলকষ্টে কাটাতে হচ্ছে। পানীয় জলসংকটে জেরবার ডুয়ার্সের অধিকাংশ চা বাগান। নলকূপ এবং পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীন মনোভাবকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন ডুয়ার্সের বিভিন্ন চা বাগিচা এলাকার বাসিন্দারা।
ঠিক ১০ বছর আগে ডুয়ার্স-তরাই-পাহাড়ের আঞ্চলিক লেবার কমিশনার দফতর থেকে ২৭৬ টি চা-বাগানের ২৭৩ টি-তে এক সমীক্ষা চালানো হয়। ১০ মে ২০১৩ প্রকাশিত সমীক্ষাপত্রে জানা গিয়েছিল অন্তত ১০টি বঞ্চনার ছবি। এক, আড়াই লক্ষেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে এখনও ৯৫,৮৩৫ জন ঘর পায়নি। দুই, প্রায় ত্রিশ হাজার বাড়িতে বিদ্যুত সংযোগ নেই। তিন, মাত্র ৬১টি চা-বাগানে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। চার, চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে মাত্র ১০৭ টি চা-বাগানে। পাঁচ, ১৭৫ টি চা-বাগানে কোনও লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। ছয়, ক্যান্টিন নেই ১২৫ টি বাগানে। সাত, স্কুল নেই ৪২ টি চা-বাগান মহল্লায়। আট, ১৮ টি চা-বাগান শ্রমিকদের প্রাপ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে টাকা জমা দেয়নি। নয়, ৪৬ টি বাগান এক পয়সাও গ্র্যাচুইটি দেয়নি শ্রমিকদের। দশ, কোনও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখাতে বা জমা দিতে পারেনি ৮৭ টি চা-বাগান। গত ১০ বছরে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন হয়নি। এখনও অনেক বাগানেই প্রভিডেন্ট ফান্ডের ১০০ কোটি টাকারও বেশি বকেয়া। শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে চা-বাগান বেড়ানোর জায়গা। বর্তমান ব্যবস্থায়, ডুয়ার্স-তরাই ও দার্জিলিং অঞ্চলে চা-শ্রমিকদের দিনমজুরি ১৫৯ টাকা। ১৯৫১ সালের টি প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী মজুরি ছাড়াও আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে প্রত্যেকের প্রাপ্য ভর্তুকির রেশন, নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি কাঠ, বিনামূল্য আবাসন, পানীয় জলের জোগান, চিকিৎসার সুবিধা, অনূর্ধ্ব ১২ বছরের সন্তানদের জন্য প্রাইমারি স্কুলের বন্দোবস্ত। বাগানে দৈনন্দিন কাজ করার জন্য প্রত্যেকের ৭২ গজ থান কাপড় পাওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের বেশিরভাগ চা-বাগানে এই সব সুবিধা নেই। প্ল্যানটেশন লেবার অ্যাক্ট (১৯৫১) অধিকাংশ বাগানেই যথাযথ ভাবে কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুসারে বাগিচা শ্রমিকদের রাজ্য সরকার দু’টাকা কিলো চাল দিয়ে থাকে। মালিকদের আর রেশন দিতে হয় না।
এমন বঞ্চনা যেখানে সেখানে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু তো হবেই। শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হবেই। হচ্ছেও। ইউনিসেফ-এর রিপোর্টে দেখেছি ২০১০-এ রেড ব্যাঙ্ক গ্রুপের এক চা-বাগান থেকে নিখোঁজ হয়েছিল তিনশোর বেশি নারী। দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির পাঁচটি সংগঠন শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, ডুয়ার্স জাগরণ, ফোরাম ফর পিপলস হেল্থ আর ডাঃ বিনায়ক সেন আর তাঁর পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর সহযোগে সৃজন অনাহার-অপুষ্টি পীড়িত চা-বাগানে সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। তার পরে আবার বিগত কয়েক মাস ধরে চালানো হয় তুলনায় বড় সমীক্ষার কাজ। সংগঠনগুলি উত্তরবঙ্গের রেড ব্যাঙ্ক, বান্দাপানি, ডায়না, কাঁঠালগুড়ি, ঢেকলাপাড়া এবং রায়পুর চা-বাগানে অনুসন্ধান চালায়। ওই সব বাগান থেকেই মৃত্যুর খবর আসছিল। সমীক্ষায় দেখা গেল যা ভাবা গিয়েছিল বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক খারাপ। খাবার নেই, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ নদীর বুকের পাথর ভেঙে খুবই সামান্য রোজগার করেন। তা দিয়ে খাওয়া চলে না। অতএব, অপুষ্টি, অনাহার। চুপচাপ অনাহারে মারা যাওয়া অচেনা, নামগোত্রহীন আদিবাসীদের জন্য আমাদের সহানুভূতি কতটাই বা জেগে ওঠে? অথচ দিনের পর দিন অনাহারে চোখের সামনে বউ-বাচ্চাকে মারা যেতে দেখে, নারীপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে পরিবারের মেয়েদের নিখোঁজ হতে দেখে আদিবাসী শ্রমিকেরা খেপে উঠে যদি কোনও বাগান-ম্যানেজারকে পিটিয়ে মেরে দেয় তখন আমাদের যাবতীয় বিবেক জেগে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে। সংবাদমাধ্যমে বয়ে যায় সহানুভূতির বন্যা। হিংসা মানে কি শুধু দৈহিক নিগ্রহ, রক্তপাত? লাগাতার বঞ্চনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ছিন্নভিন্ন করা অপরাধ নয়? শহুরে সভ্যতার ধারক ও বাহক আইন প্রণেতা, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, লাখ লাখ টাকা রোজগার করা এনজিওর দল একটু ভাববেন কি?
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴