পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৬
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
নয়া বৈরাতি
সব
হুপ-হাপ করে নদীতে স্নান করেই যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। এদের আবার সবাইকে
ডেকে ডেকে সকালের খাবার চা, খাস্তা-নিমকি, খই খাইয়ে তবে মারেয়ার ছুটি। রাত
জেগে আর কেঁদে কেঁদে মারেয়া মিনতির মায়ের আজকে চোখ-মুখ ফোলা, গলা ভেঙে
আওয়াজ ফ্যাসফেসে হয়ে আছে। তবু তাকে বিশ্রাম নিলে চলে না। চলছেই সমানে।
মিনতীর বড় মামিকে দেখে ডাক দিল,
"মাই, অবিনের মাও, দেকখেনে চেংরালাক চা-পানি। ওদি পৌটি বসে দেক। খাউক।"
তারপর ছেলেদের দিকে ঘুরে বলল,
"বাউ তোমরা চা খায়া কলার গছ টছগিলা কাটি আনি ওদি বায়রাত ওত্তি পোটুয়ালা ওটে ফেলাও। তার পাছে ভাল করি ধুয়া নিগরির দ্যান।"
দলের ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে,
"ন্যাও জেটাই, হবে এলায়। তোমা হুলা চিন্তা না করেন। হামরা কাহো যামু
এলায় কলার গছ কাটির আর ছাওয়ার দলটাক প্যাটে দিমু এলায় আটখড়ি জড়েবার। হামার
হুটা মনোৎ আছে।"
তারপর ঝপঝপ করে উঠোনে বসবার জন্য ফেলে রাখা কাঠের তক্তাগুলোয় বসে হাঁক পাড়ে,
"দ্যাও বারে, ভোক নাইগসে।"
সুকারুর বৌ স্নান-টান সেরে একটা পরিস্কার ধোয়া কাপড় পরে বিয়ে বাড়িতে ঢুকল। ওকে দেখে মিনতীর মা বলে,
"হ্যাঁ বারে বৌমা! তোমা এলাসিনি আইসেছেন? কতটা বেলা হোইসে, বামন-অধিকারী আইসেছেকে আর।"
সুকারুর বৌ সলজ্জ হেসে বলে, বাড়িত কনেক খাবার করি দিলুঙ বারে। হামার বুড়াটা দেখেন না সাকালে না আইসে আরো। উমাক খোয়া এই আইসোছোং।"
সুকারুর বৌ অবশ্য বসে না। সঙ্গে সঙ্গেই কাজে লেগে পরে। তার মাঝে একবার মানতীর মামিকে জিজ্ঞেস করে,
"মাইক কোনো খোয়াইসেন?"
মিনতীর মামি বলে,
"হরগোরি না পূজিতে হোটে কেংকরি খোয়াইস? হোউকখেনে পৃজাখান, আলোয়া চূড়া না হয়তে চাইট্টা খই খাবার পাবে এলায়।"
কথা
ঠিক। সুকারুর বৌ ভাবে তারই মাথার ঠিক নাই। ভাবতে ভাবতে কাদামাটি ছেনে বড়
ঘরের বেড়ায় মাটি দিয়ে দুটো ছোট ছোট ঢিবি বানালো। এবার ওই ঢিবির উপর কড়ি
বসিয়ে হয়ে গেল নাক। সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলল। কয়েকদিন
আগেই মাকলা বাঁশের কাঠিতে আঙুলে চেপে চেপে মাটির ফুল বানিয়ে খড়ি মাটি, আলতা
দিয়ে রঙ করে দুটো ফুলঝুরি বানিয়ে রেখেছিল। সেগুলো এখন একটা চালুনের মধ্যে
সাজিয়ে নিল। কলার পাতায় চাল, পাঁচটা মাটির প্রদীপ, কলা এক ছড়া, গাছ কৌটো,
পেতলের আয়না, কাঠের চিরুনি আর একটা কাঠের মালা। পূজার পর এই কাঠের মালাটাই
পরিয়ে দেওয়া হবে মালতীকে। একটা কুলা ধানে ভর্তি করে ওখানে একটা ঘটে পাঁচ
পাতার আমের পল্লব দিয়ে সাজিয়ে রাখে, আর দেয় নতুন গামছা।
সুকারুর
বৌ মতিবালা সব গুছিয়ে উঠতে না উঠতেই ব্রাহ্মণ ঠাকুর উঠোনে এসে দাঁড়ায়।
মালতীর মামি চট করে পিঁড়ি পেতে দেয়। ঠাকুর মশাই আসামিয়া টানে হাঁক পাড়ে,
"আর একখান পিঁড়া দেও বারে, মোর ঝোলাটা রাখিবার নাইগবে।"
মতিবালা
পিঁড়িটা এগিয়ে দিয়ে হাত ধোবার জল, কলার ঢোনা সব একেবারে দিয়ে আসে। ঠাকুর
মশাই ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে অভ্যস্ত হাতে কলার ঢোনা কেটে ছোট
ছোট সুন্দর প্রসাদের জন্য ঢোনা তৈরি করতে থাকে। মালতীর মামা রান্নাঘরের
দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়,
"কায় আছেন বারে, আন্দনঘরোত, ঠাকুরটাক চাহা-টাহা দ্যাও। কাইচের কাপোত দ্যান, মাটিয়া কেপোত ঠাকুর চাহা না খায়।"
ঠাকুর মশাই ঢোনা কাটতে কাটতে বলে,
"না হয়তে ইস্টিলের গিলাসোত দিবেন। মুই বেশি চাহা না খাও।"
সব
রেডি করে বড় ঘরেই ঠাকুরমশাই গুছিয়ে পুজো করতে বসলেন। মালতীর বড় মামি খুব
হাসি-মস্করা পছন্দ করে। মতিবালার সাথে পূজার কাজ করতে করতে ঠাকুর মশাইকে
শুনিয়ে শুনিয়ে গান ধরে,
"বামন কেনে নড়ে বামন কেনে চড়ে। চান্নি কূলার কলা দেখিয়া নোকর পোকর করে।"
ওর গান শুনে ঠাকুর মশাইও হেসে দেয়।
"তোমা বেশি গান করেন না, মোক দেওয়ারিগিলা ধরে দ্যাও ভাল করি। ত্যাল বেশি করি দ্যাও।"
পূজার
মধ্যে মালতীকে লাল পাড় কোড়া শাড়ি পরিয়ে মতিবালা নিয়ে আসে। পাঁচটা কুমারী
মেয়েকে দিয়ে হলুদ বাটায়। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েগুলো এমন দায়িত্ব পেয়ে হেসেই
গড়িয়ে পরে এ ওর গায়ে। বিরক্ত হয়ে মতিবালা বলে,
"যাও, ভাগো। হোইসে এইবার। মুইয়ে বাটোং ঘিসির ঘিসির করি। তোমারলার দাঁত নিসরানি হাসি। কাজে ফাবিবে না।"
মালতীর মাথাটা হাত দিয়ে ঢেকে মেয়েগুলোকে নির্দেশ দেয়,
"ন্যাও, দুবাঘাস দিয়া মাতাত ত্যাল দেও। বেশি করি না দেন আরো, চুপচুপা নাগিবে। সাজালে সেলা মুকখান এলায় এত্তোকেনা নাগিবে।"
পূজা
শেষে স্নান করার পালা। হলুদ ছাড়াও পাসারির দোকান থেকে সোন্দাপোড়া এনে বেটে
রেখেছে। এবার জলছিটার খোঁজ পরে। বসমতী জল ছিটাবে আগেই ঠিক করা ছিল। বসমতী
সময় মতো এসে বসেই আছে অবশ্য। বসে বসেই বলল,
"ন্যাও আগোত জোগাড় কর, মাইক আনো। মুই না আছোংকে।"
মতিবালা গিয়ে মালতীর পাড়াতুতো এক জামাইবাবুকে ধরে আনল ঘাট খোঁড়ার জন্য। সে বেচারা মুখ কাঁচুমাচু।
"আর কাহো নাই? মুইয়ে আছোং। দেখেক তো মাই। গাও ধুবার নাইগবে এলায়।"
মতিবালা ধমকে ওঠে,
"মাইর আরো কয়টা বোনু আছে তুই ছাড়া! নেক ওঠে কোদালখান।"
সবাই হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। শিবেন বিয়েতে পাওয়া হাতের ঘড়িটা যত্ন করে খুলল, রুমালে পেঁচিয়ে বৌয়ের হাতে দিল।
"দ্যাও তে, এখান গামছাটামছা দ্যাও। সাটটা, পায়জামাটা খুলি থং।"
ঘাট খুঁড়তে না খুঁড়তেই মতিবালা এক বালতি জল এনে শিবেনের গায়ে ঢেলে দেয়। বেচারা, হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে।
"নোইস, তোকো এলায় নেতরাইম ধরি।"
আসলে
শিবেন বড় গোবেচারা। ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে একচোট জল ঢালাঢালি হয়েই যেত।
ঘাট খুঁড়ে পুকুরটার মধ্যে মতিবালা পাঁচটা মাকলা বাঁশের কুশি, পাঁচ পাতার
আমের পল্লব দিয়ে দেয়। দুটো ঘট। একটা বালু ছড়িয়ে পাশে বসিয়ে রাখে।
"ন্যাও বারে জলছিটা আইসো এলা। নাকি তোমাকো কোলাত করি আনির নাইগবে!"
বসমতী উঠতে উঠতে বলে,
"নন, নন, আর কয়দিন। বিছিনাত পোইল্লে না বেটি ভাতিজিগিলায় কোলাত করি ওঠাবে, খোয়াবে।"
মতিবালা শিবেনকে ডাক দেয়,
"কোটে গেল কোইনার বোনুটা। আসি কোলাত করি নিগা।"
মানতী লজ্জা পায়।
"নানাগে তো, নানাগে তো। হাঁটি যাইম বৌদি।"
সুকারুর বৌ তাও রসিকতা করতে ছাড়ে না।
"কেনে হাঁটিবু! বোইনাগিলা থাকাতে!"
মালতীকে
এনে পিঁড়িতে বসিয়ে দেয় আগে। বসমতী দুইহাত ক্রশ করে ধূপ হাতে নিয়ে মালতীর
মুখের কাছে ধরে তিনবার শোঁকানোর ভঙ্গী করে পেছন দিকে ফেলে দেয়। এভাবে দুধ
শোঁকায়। হলুদ, সোন্দাপোড়া শোঁকায়। তারপর প্রদীপসহ চালুনটা তিনবার কপালে
ঠেকিয়ে নামিয়ে রাখে। এরপর খাওয়ানোর পালা। একটা স্টিলের বাটিতে দই, মিষ্টি
রাখা ছিল। চামচ দিয়ে খাইয়ে জল খাওয়ায়। মতিবালা এবার জোরে জোরে বলে,
"ন্যাও, এইবার তোমার আঞ্চলখান দিয়া মুখ মুছি দ্যাও। তাহালে তোমার বেটি তোমার পাছে পাছে বেড়াবে।"
হাসতে হাসতে বসমতী তাই করে। করে আচমকা আঁচলটা টেনে মতিবালার মুখে চেপে ধরে। বলে,
"তোমারও মুকখান মুছি দ্যাং। তালে তোমরাও মোর পাছে পাছে বেড়াবেন।"
এবার
মুখ নীচু করে মালতীও হেসে ফেলে। মতিবালা হাসতে হাসতে মালতীকে দিয়ে বসমতীকে
প্রণাম করায়। তারপর বাটা হলুদ সন্ধাপোড়া দিয়ে মালতীকে স্নান করায়, তেল
মাখায়। স্নান করিয়ে একেবারে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়।
ঘরে
এসে বসার কিছুক্ষণ পরেই প্রফুল্ল শাঁখারিয়া সাইকেলের ঘন্টি বাজাতে বাজাতে
এসে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে সব মেয়ে-বৌরা তাকে ঘিরে ধরে। একেকজনের একেক রকম
পছন্দ। পোকা আছে নাকি, মোম ভরা নাকি সব দেখে বেছে অবশেষে মকরমুখের একজোড়া
শাঁখা পছন্দ হল। সবাই উলুধ্বণি দিল। শাঁখারিয়া মালতীর হাতে নতুন শাঁখা পলা
পরিয়ে দিতেই মালতী হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগল। সবার চোখই অশ্রুসজল হয়ে
ওঠে। আনন্দ আর স্বজন ছেড়ে যাবার কষ্টে মালতীর বুক মুচড়ে ওঠে। বয়স্ক একজন
দিদিমা স্থানীয় মালতীকে বুকে টেনে নিয়ে শান্ত্বনা দেয়,
"আজিকার দিনোত এতোবারি কান্দা না যায় মাও। চুপ হ।"
বলতে বলতে তারও বুক মুচড়ে ওঠে। চোখ দিয়ে জল গড়ায় নীরবে।
................................................................
পৌটি - খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন
পোটুয়া - কলার ঢোনা কেটে পেছনটা চেঁছে পাতলা করে ভাত খাওয়ার জন্য উপযূক্ত করা।
আলোয়া - আতপ