পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৫
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সাইটোন-বিষহরি
"আইসো মাতা ভগবতী, বোইসো আসন নিয়া/বোইস্তে দিসি সিংহাসন, উপরে আসন/যখন
কালে দিবে মাগো সাজ সারিঞ্জার খোল, ভবানী পূজিতে নাগে মাগো চোদ্দ দ্যাবের
কোল/যখন কালে দিবে মাগো সাত চহরের বাও, আমার আসর আইসা মাগো নোহরি খেলাও/এও
আসর ছাড়িয়া মাগো ওইন্য আসর যাবু, দোহাই নাগে ভগবতী কাত্তিকের মুন্ড খাবু/
এও
আসর ছাড়িয়া মাগো, তুই ওইন্য আসর যাবু/দোহাই নাগে ভগবতী গণেশের মুন্ড
খাবু/ধবল আসন ধবল ব্যসন, ধবল সিংহাসন/ তোমারো নামে দিসি মাগো ফুলেরো আসন/জয়
শব্দ দিয়া বোইসো মাগো আসরের উপর, দিতে পারো ধনজন, হোইতে পারি রাজা/ভবানী
পূজিতে নাগে মাগো চৌদ্দ দ্যাবের পূজা/দইও দিসি খইও দিসি আরো দিসি
কোলা/সন্তোষ করিয়া ন্যাও মাগো গরীবেরও পূজা।"
মূল গিদালী বানেশ্বরী। গলায় নতুন লাল গামছা জড়ানো। বয়স হয়েছে, তবু উৎসাহের
অন্ত নেই। সাইটোন বা সাইটোল বিষহরি ঠাকুরের শোলার তেরী কাগজের পটমূর্তি
ধূপগুড়ি হাট থেকে কিনে এনেছে মালতীর বাপ। ওই একদিনেই কাপড়-চোপড়, পূজার
খরচা-পাতি সব একসাথেই কিনে আনা হয়েছে। বিয়ের ঠিক আগের দিন সাইটোন বিষহরি কে
পূজায় সন্তুষ্ট করাটাই নিয়ম। সেই কোন কালে বেহুলার বাসর ঘরে মা মনসার কোপে
লক্ষীন্দরের প্রাণ গেছে, তখন থেকেই বিয়ের আগে মা মনসাকে তুষ্ট করে তবে
বিয়ের অনুষ্ঠান করার রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে।
সাইটোন বিষহরি বাড়িতে এনে বাঁধতে হয়। পূজার দিন তুলসীতলায় একটা কলার ঢোনায়
বাঁশের কঞ্চি গেঁথে বিষহরির মূর্তিকে বসিয়ে বানেশ্বরী মালতীর মাকে দিয়ে
মূর্তিকে ঘরে এনে বসায়। ঢাক আর উলুধ্বণিতে বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। মালতীর মা
প্রণাম করে বেরিয়ে এলে বানেশ্বরী আরো ঠিক করে ভালোভাবে বসায়। প্রথমে
"বালা-বালি"র মূর্তি কঞ্চিতে বেঁধে দেয়। তারপর বিষহরা মূর্তি। রসবালা বরাবর
পূজো-পার্বণ উৎসব ভালোবাসে। রসবালা, বসমতী বানেশ্বরীর সঙ্গে থেকে থেকে
পুজোর রীতিনীতি অনেকটাই শিখে গেছে। মূল গিদালীর সাথে হাতে হাতে কাজ করতে
থাকে দুজনেই। ঠাকুর বসাতে বসাতে গিদালী গুনগুন করে,
"ষাইট মাও মোর ষাটিয়া/কলা খায় আটিয়া।"
তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে বলে,
"দ্যাও বারে আটিয়া কলার ঝুকিটা, থাতিত দ্যাং"।
বলতে
বলতে নিপুণ হাতে সারি সারি করে ঠাকুরের নামে নামে পুজো বসায়। সাইটোন
বিষহরির পূজার সময় সব ঠাকুরকেই পুজো দিতে হয়, কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না,
এটাই নিয়ম। "যখন কালে দিবে মাগো সাজ সারিঞ্জার খোল, ভবানী পূজিতে নাগে মাগো
চোদ্দ দ্যাবের কোল"। চোদ্দ দেব মানেই চেনা-জানা যত দেব-দেবী আছেন। সেজন্য
বানেশ্বরী অভ্যস্ত হাতে সব গোছায়। সাইটোন-বিষহরিকে অবশ্যই বীচি কলা একছড়া
করে, বাকি সবাইকে চিনি কলা এবং বামনদেশি কলা বাদে যে কোনো কলা ছড়া উৎসর্গ
করা যায়। বিষহরির বাম দিকে বাহুস্ত বা বাস্তু, ধরম ঠাকুর, তিস্তা বুড়ি,
কালি, লক্ষ্মী, সুবোচনি সব ঠাকুরকেই একছড়া করে কলা দিয়ে পুজো বসাতে হয়।
প্রত্যেককে এক জোড়া করে হাঁসের ডিম। আর পূজার অন্যান্য উপকরণ তো আছেই। দই,
খই, চিনি সব দিয়ে প্রসাদ সাজানো হয়। এরপর বানেশ্বরী "বারো আউলিয়া" ঠাকুরের
আসন বসালো। এ ঠাকুরের পূজার উপকরণ সামান্য আলাদা। তাকে নিয়জ পাতায় করে
গুয়া-পান, চুন, তামাক সাজিয়ে দিতে হয়। গোটা কলার ছড়া নয়, দিতে হয় খোসাসহ
পাকা কলা গোল গোল করে কেটে সুন্দর করে চাকাগুলো বসিয়ে দিতে লাগে। সাজানো
হয়ে গেলে বানেশ্বরী পিছন ফিরে ডাক দেয়,
"কোটে গেইলেন মারেয়ার ঘর। ভুজ্য আনি দ্যাও। বস্ত্র কি আনিসেন দ্যাও সোগাকে এখান করি।"
মালতীর
মামি একটা কলা পাতায় চাল, ডাল, সব্জি দিয়ে সাজিয়ে ভুজ্য এনে দেয়। মালতীর
মা ঠাকুরের সংখ্যা মিলিয়ে লাল গামছা এনে রেখেছে আগে থেকেই, বানেশ্বরীর হাতে
এগিয়ে দেয়। বানেশ্বরী গিদালী উলুধ্বণি দিয়ে পুজো শুরু করে। বাকিরাও যোগ
দেয়। ঢাক বেজে ওঠে উলুর সাথে সাথে। প্রদীপের মৃদু আলো আর ধূপ, ধূপচীর
ধোঁয়ায় মালতীর মায়ের ভাঙা ঘর ভরে ওঠে এক অন্যরকম রহস্যময়তায়। সব ঠাকুর
দেবতাকে পুজো দেওয়ার পর গিদালীর মালতীর মাকে ডাকে,
"ন্যাও, তোমরা এলা আইসো। ছাওয়াটা ঝ্যান ভালে ভালে থাকে মনে মনে কয়া কনেক ফুল-জল ঘুরি দ্যাও।"
মালতীর
মা খোলা চুলে গলায় নতুন গামছা জড়িয়ে ফুলজল দিয়ে প্রণাম করে। মালতীকেও এনে
প্রণাম করানো হয়। পুজোর প্রাথমিক কাজ শেষ হলে মূল গিদালী গান ধরে, সঙ্গে
সঙ্গে কোরাসে গেয়ে ওঠে বাকিরাও। এই গান শেখার কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই।
উৎসাহীরা গিদালীর সঙ্গে থেকে থেকে মুখস্ত করে ফেলে। তবে ঘর ভরে ওঠে
বাচ্চা-কাচ্চা, গান শুনতে উৎসাহী মহিলা, বয়স্ক বুড়িদের দিয়ে। এখানে কোনো
পুরুষ থাকে না সাধারণত। গান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই একজন চা নিয়ে এসে
সবাইকে চা দিয়ে যায়। সামান্য বিরতি, গান চলতেই থাকে।
ক্রমশ রাত গভীর। মাটিতে পাতা চটের উপর বাচ্চাগুলো অকাতরে ঘুমাচ্ছে।
ছোট্ট ঘর। তার ভেতরেই গাদাগাদি করে বসে মা বিষহরির গানে মগ্ন সবাই। ঘুম
তাড়ানোর জন্য বানেশ্বরী কোমরের কোঁচড় থেকে একটা বিড়ি বের করে। ঘরের ভেতর
ঠাকুরের সামনে নিভু নিভু মাটির প্রদীপ জ্বলছে, কিন্তু সেখান থেকে তো আর
বিড়ি ধরানো যাবে না। আগত্যা একটু হেলে রসবালাকে ডাক দিল,
"মাই অস, ওদি কনেক নম্ফটা দে তো। বিড়িটা ধোরাং। গান কইতে কইতে আরো নিন ধরেছে বা!"
রসবালা কেরোসিনের কূপিটা বানেশ্বরীর হাতে দিয়ে আপন মনে বলে,
"এখেনা চাহা-টাহা হলে হামারো নিনখান কাটে।"
বানেশ্বরী
কোনো কথা বলে না। বিড়ি ধরায়। খক খক করে কাশে। তারপর কয়টা টান দিয়ে পাশের
জনকে দেয়। এবার বুধেশ্বরের মার ও নেশা ওঠে। কোঁচড় থেকে তামাক আর কাগজ বের
করে। তারপর কাগজের ভেতর তামাক পুরে গোল করে পাকিয়ে বঙ্কেট বানায়। বানিয়ে
বানেশ্বরীকে বলে,
"দে তো কনেক বিড়িটা, মোর বঙ্কেটটা ধোরাং!"
বিড়ির
আগুন থেকে বঙ্কেট ধরিয়ে সুখটান দিতে থাকে। ধীরে ধীরে ঘরটা ধূম্র কবলিত হয়ে
পড়ে। যাদের ধোঁয়া টানার অভ্যাস নেই তারা মুখে বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে।
"কী যে হিলা ইমার নিশা। মাতাটা মোর ঘুরেছে।"
এসবের মধ্যেই একটি কমবয়সী বৌ কেটলিতে চা আর হাতে কয়েকটা কাপ, দস্তার গ্লাস নিয়ে ঢুকে কলকল করে ওঠে,
"ন্যাও বারে, কাক কাক নিন ধোইচ্চে, আইসো, চা-পানি খায়া নিন খেদাও।"
ভুরু কুঁচকে আবছা কূপির আলোয় মুখটা চেনার চেষ্টা করতে করতে মতিনের মা জিজ্ঞেস করে,
"তোমরা কায় তে বারে, চিনায় পাছোং না। মনটা কয় তোমরা হিদিকার
মানষি না হন, ওত্তি দুরান্তরিকার মানষি হবেন। গালাটাও ওইন্য মতোন!"
বৌটা এবার হাসে।
"চিনির না পাছেন বারে! মুই মামি হং মাইন্না! কত আচ্চুং, দেখেন নাই!"
তারপর সবাইকে চা দিতে দিতে বলে,
"চাহা খায়া কও, কেমোন বানাসুং।"
মধ্যরাতে চা পাওয়া সোজা কথা নয়। সেজন্য অনেকেই অস্ফুটে কেউ জোর গলায় বলে,
"ভালে না হোইসে।"
ঘুমন্ত
পাড়াটার উপর দিয়ে হালকা বায়ুপ্রবাহের মতো গানের সুর বইতে থাকে সারারাত।
লোকে ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে শোনে সমস্বরে গেয়ে ওঠা এক সুর, এক তালের
সেই গান। গানের সুর আর ঘুমের আবেশের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য সখ্যতা। মাঝে মাঝে
কখনো থেমে চায়ে চুমুক কিংবা কোঁচড়ে রাখা বিড়িতে টান দেবার বিরতি। তারপর
আবার শুরু হয়। বিরতি যাতে দীর্ঘতর না হয় সেজন্য কেউ একজন বলে ওঠে,
"ন্যাও বারে, ধর। কত আর দম নেন। আতিটায় পোয়াছে।"
বলে
নিজেই আগে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও গলা মেলায়। এর ফাঁকে ফাঁকে
উলুধ্বনি রাত্রির আকাশকে মথিত করে যায় এক অদৃশ্য ভালো লাগার আবেশে।
দেখতে দেখতে কখন রাত ভোর হয়ে এসেছে। বেশির ভাগই ঘুমিয়ে কাদা। মূল
গিদালী আর দুই একজন জেগে গান করছে তখনও। কিছুটা থেমে থেমে, বিশ্রাম নিয়ে।
সকাল বেলা ঠাকুর ভাসাতে যাওয়াটাই আনন্দের। ঘুমিয়ে থাকা ঢাকিকে ডেকে তুলে
বানেশ্বরীসহ সবাই ঠাকুর ভাসাতে গেল। বাচ্চা-কাচ্চার একটা দল লাইন করে চলল
নদীতে। ঠাকুর ভাসিয়ে নদীতে একটা করে ডুব দিয়ে সবাই বাড়ির পথ ধরল।
রাত
জেগে আর কেঁদেকেটে মালতীর মার গলা বসে গেছে। অনেকেরই অবশ্য গলা বসে গিয়ে
ফ্যাঁসফ্যাঁস করে আওয়াজ বের হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে বসে থাকলে কী চলে। আজকেই
তো বিয়ের দিন। আজকের ব্যস্ততা আরো বেশি।
................................................................
চহর - চামর
আটিয়া কলা - বীচি কলা
থাতি - গোটা কলার ছড়া দিয়ে পুজো বসানোর পদ্ধতিক থাতি দেওয়া বলে।
নম্ফ - কেরোসিন কুপি।
................................................................
তথ্যসূত্র - চাম্পা রায়, কলোনি পাড়া, খগেন হাট, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার।
ছবি শেফালি রায়