পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৪
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বিষুমা
কোন সকাল থেকে রসবালার মুখ চলছে।
"বাছা বাউ, সুষেণ, বিষেণ, উটোখেনে রে। কতটা বেলা হইল। মানষি কাজোত নাগি পোইচ্চে, তোমরায় থাকি নও কয়ো বাপ-বেটায়।"
ওর চিৎকারের ঠ্যালায় থাকতে না পেরে সবাই উঠেই পড়ে। বিষেণ একটু ঘুমকাতুরে। চোখ ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে মার উপর রেগে যায়।
"তোর টুটিটার খিবে জোর মা! এখেনা নিন পাড়ির না দিস। দ্যাখ তো ভাল করি বেলাটায় উটে নাই এলাং!"
"নাই উটে। কুত্তিকার মানষি কুত্তি গেল। আর তোমরায় বিছিনাত পড়ি আছেন। সেজারির খ্যার গুন্ডা করেছেন এখেরে।"
চৈত্র সংক্রান্তি মানেই বছরসালের বাড়ি-ঘর পরিস্কার করা। যদিও সব
পুজো-তিথীতেই একই কাজ। কিন্তু রসবালা কিছুতেই তা মানবে না। ওর কথা হল
বছরকার আজকের দিনটাতেই গতবছরের সব নোংরা ধুয়ে-মুছে নতুন বছরে প্রবেশ করতে
হয়। সেজন্য সকাল থেকে শুরু হয়েছে ওর নানান ধরণের সংসারী কাজ। সেই ভোর থেকে
লেপা-পোঁছা, মাজা-ঘষা। বাড়ির লোকগুলোর শুয়ে থাকা ওর পছন্দ হবে কেন!
সরেন
একটা কোদাল নিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে যায়। আজকে বাঁশের গোড়ায় মাটি দিতে লাগে।
বড় ছেলে সুষেণও আর একটা কোদাল, খোন্তা নিয়ে চলল বাপের সাথে। কুয়োতলার
পেছনটায় কলার চারা লাগাবে। আজকের দিনেই তো গাছ-গাছালি লাগাতে হয়, গাছের
গোড়ায় মাটি দিতে হয়। কোমরে একটা গামছা বেঁধে দুই বাপ-ব্যাটায় লেগে গেল
কাজে। রসবালা ছোট ছেলে বিষেণকে ডেকে বলে,
"কী
বাছা বাউ! বসি নোবু? ওইলা আজি কনেক জড়ের নাইগবে না? বিস্তি, পানিমুথারি,
ব্যাতের কুশি? বসি নোইলে হবে? তোর পিসাইকো না নাইগবে। তোর পিসা আরো কোটে
চান্দের যাবে তোমরা বেটা-ভাতিজালা থাইকতে?"
বিষেণ
মুখে কিছু বলে না। একটা ছোট দা নিয়ে গামছাটা কোমরে বেঁধে দরিয়ার সুর গলায়
ভাঁজতে ভাঁজতে বেরিয়ে পড়ে। ওর যাওয়ার ধরণ দেখেই মনে সন্দেহ জাগে। সুষেণ
চৌকো করে কলার চারা মাটি থেকে তুলে এনে কলপাড়ের দিকে যেতে যেতেই মাকে বলে,
"ইয়ার কিন্তুক ভাব-গতিক ওইন্য মতোন দেখেছোং মা। বিরালে এলায় দিন দুনিয়ার খবর করিবে না। দ্যাখেক তুই ক্যামন হেলিদুলি যাছে!"
রসবালা একটু সেদিকে দেখে আপনমনে বলে,
"যাউকখেনে কুত্তি যায়। মুইও দেখিম এলায়। ওইল্যা বাড়ি না আনিলে আজি
উয়ার খাবার নাই। সেলা দেখিম এলায় উয়ার কুন মাও ড্যাকে খোয়ায়।"
লেপা-পোঁছা
শেষ হলে রসবালা রান্নাঘরের কাজ ধরে। আগের দিন রাতে ছোলা, মটর ভিজিয়ে
রেখেছিল। ওগুলো সব জল থেকে তুলে রাখে। তারপর চাল, চিড়া ঝাড়তে বসে।
"সাতশাগি জোড়াসিত মাই? কী করিস হোটে? চাউল ঝাড়িছিত? মুই ওইলা
ঠিকঠাক করি আসিলুং। কাটোলের মুচি, আমের জালা আনি থুলুং কয়টা।"
রসবালা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে বসমতী হাতে পাট শাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
"হ, আসিলু তে খাড়া হয়া আছিত দি! বোইসখেনে আগোত।"
বলেই বেড়ার গায়ে হেলানো পিঁড়িগুলি থেকে একটা পেতে দেয়। তারপর বলে,
"কার না পাটা আনলু? মঙ্গলু ঘরের? কালি মোকো কয়া গেইসে পাটা
আনির, তে সোমায়টায় পাছোং না। আনসিস তে হবে। অতলায় নানাইগবে এলায়। বাছাবাউ
গেইসে ব্যাতের কুশি আনির। সাতশাগিত মিশোল দিমু এলায়।"
রসবালা হাতের কাজ থামিয়ে উনুন ধরিয়ে চা বসায়। বসমতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
"এলাইতে আখা ধোরাছিত। কী আন্দিবু আরো?"
রসবালা হাসে।
"এখেনা চাহা জ্বালাং দি। তুইও খা, বাউর বাফোকো দ্যাং। গছের গোড়োত
মাটি-টাটি ফেলাছে আজি। কলার গছ একটা হেলি পোইচ্চে, ওটে বাঁশের ঢোকা বান্দি
দিল একটা।"
রান্না ঘর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে সরেন
উঠোনে এসে দাঁড়ায়। খুশি খুশি মুখ হাসিতে ভরিয়ে রসবালার কাছে চা করছে কিনা
জানতে চায়। রসবালাও বুঝতে পারে। হেসে বসমতীকে বলে,
"চাহা দেখি কেমতোন আলন্দ দ্যাকখেনে দি। কুলবুলাছে এখেরে। হিটা মানষিক চাহা আর গুয়া হোইলে ভাত-চুড়ায় নানাগে।"
বসমতীও হাসে সরেনের আনন্দ দেখে। তারপর রসবালাকে বলে,
"কাটোলের মুচি, আম-টাম জোড়াসিত মাই?"
"জোড়াসুং না। সাকালে আনি থুসুং। বাড়িরে গছের না দুইটা ছিঁড়ি আনিলুং।"
বেলা
বাড়তে রসবালা উনুন ধরায়। উনুনে কটা চাল ফেলে দেয়। তারপর খোলা গরম করে নদী
থেকে এনে রাখা পরিস্কার বালি গরম করে। এবার গরম বালির উপর বাঁশের একগোছা
কাঠি দিয়ে বানানো ঝাঁটা দিয়ে পর পর প্রথমে চিড়ে, একটু চাল, ছোলা, মটর, গম
দক্ষ হাতে ফুলিয়ে ফুলিয়ে ভাজতে থাকে। এগুলোর পরে সর্ষে, কাঁঠালের জালি,
আমের জালি গোল গোল করে কেটে ভাজতে থাকে। আপন মনেই বলে,
"নয়া চ্যাল্লোটা বানালুং, এলাইতে ভাঙি যাবার ধোইচ্চে।"
রান্নাঘরে
বসে বসে রসবালা গরমে ঘামতে থাকে। আঁচলে মুখ মুছে এবার রসুন, দেশি পেঁয়াজ
শুকনো খোলায় ভেজে তুলে সব একসাথে একটা বড় ঝুরিতে মিশিয়ে নেয়।
বিষেণ বাইরে বেরিয়ে দেখে বটগাছটার নিচে বেশ আড্ডা বসে গেছে। ওকে দেখে মঙ্গলু বলে,
"কোটে বিরালু বাউ? এটে আয় বোইস।"
বিষেণ দোনোমনা করে। আসলে মাকে ও ঠিকই ভয় পায়। তারপর হেসে বলে,
"কাছারিত বসিলে এলায় কোনোয় জোগাড় করা না হোবে। মাও এলায় বাড়িখান
তুলি দিবে দা। যাং ওদি নদীর পাড়। কী আছে ব্যাতের কুশি, গাঞ্জা, পানিমুথারি,
বিস্তি ধরি আইসোং আগোত। বাবাক বলে আরো বিষ ঢেকিয়া, বিষকুন্ডুলির পাতও
নাগে।"
মঙ্গলু মহা উৎসাহিত হয়ে বলে,
"সবলায় আছে হুলা। আয়খেনে বোইস।"
বিষেণ
এবার একটু খুশি হয়। বটগাছের নিচে ঘাসের উপর বসে। ওখানে একটা বাঁশের চাংরা
পাতা। কেউ উপরে, কেউ ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। বিষেণ এবার মনের
ক্ষোভটা আড়াল করতে পারে না। বলে,
"হিলা যে কী নিয়াম হামার! এতলা জিনিস এখেরে জড়ের নাগে।"
ওর কথা শুনে সবাই হাসে। একজন বলে,
"তুই কী পাগলা রে! এইলা নিয়াম চলি আইসেছে যুগ যুগ থাকি। হামাক না এলা মানিরে নাইগবে।"
বুধেশ্বরের বাপ গলাটা খাঁকরে বলে,
"ওই তো রে বাউ। তোমরালা কী বুঝিবেন। বাপ-ঠাকুদ্দার ঘর হামার মানি আইচ্চে। এমনি মানিসে। ইয়ার পাছোত মেলা কাথা আছে।'
গল্পের গন্ধ পেয়ে সবাই নড়েচড়ে বসে। বুধেশ্বরের বাপ উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে খুশি হয়। একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে শুরু করে,
"আজিকার দিনোত মেলা ঘটনা। অয় যে হামরা বাড়ি-ঘরোত অসুন-পিঁয়াজি
ঝুলি থোই, হিটা হোইল পরশুরামোক বোকা বানের জোইন্যে। কেনে? অয় যে পরশুরাম!"
বলে
একটু থামে। আবার তাকায় সবার দিকে। উপস্থিত সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে বুধেশ্বরের
বাপের কথা শুনছিল। সেটা বুঝে আবার শুরু করে, আগের কথাটাই আবার রিপিট করে,
"অয় যে পরশুরাম নিক্ষত্রিয় করিবে ক্ষিতি!"
তারপর সুর করে বলে,
"নিক্ষত্রি করিল ক্ষিতি তিন সপ্তবার। তিন সপ্তবার মানে হোইল
এ্যাকোইশ বার। তে উয়ায় এ্যাকোইশ বার ক্ষিতি নিক্ষত্রিয় কোইচ্চে। উয়াকে মনে
কর ফাঁকি দিবার জোইন্যে আজিকাল দিনটা মানা হয়। বাড়ির ঘরোত অসুন-পিঁয়াজি
ঝুলি থয় যাতে পরশুরাম বুঝির না পায় যে এইটা ক্ষত্রিয়র বাড়ি। আর বাড়ির
মোহিলাগিলাক শিকি দিসে যে পরশুরাম আসিলে কবে যে বাড়ির পুরুষগিলা শিকার করির
গেইসে। আসলে তো সব পুরুষ যুদ্ধোত গেইসে। এংকরি পরশুরামোর ফাঁকি দিসে। তায়
ওইটাকে মনে করির জোইন্যে আজি অসুন-পিঁয়াজি ঝুলি দেওয়ার নিয়াম আর বাড়ির
পুরুষগিলা আগোত আজিকার দিনোত শিকারোত গেইসে। তে এলা তো আর কাহো শিকার করে
না। তে নিয়ামলা আছে!"
এবার বিষেণ বলে,
"হুটা না বুজা গেল। কিন্তুক এই অ্যাতো ব্যাতের কুশি, পানিমুথারি, বিস্তি ঝুলির নাগে কেনে?"
বুধেশ্বরের বাপ মনে মনে খুশিই হয়।
"ভালে কাথা পুছিলু বাউ। এইলা না পুছিলে ফির জানিবু ক্যাংকরি। হামরা বুড়া-মাঠ্ঠা মানষি মরিলে এইলা কাথা কোবারে মানষি নাই।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"আজি বিষ ঝাড়ে। দেখিস না, আজিকার দিনটাক কয় বিষুমা, কাহো কয়
বিষুয়া। বিষ মানে বিষ। জায় জানে তায় আজি বিষকুন্ডুলির পাত আর বিষ ঢেকিয়ার
পাত দিয়া জল ছিটিয়া বাড়ি-ঘরোক সাপের, পোকা-মাকড়ের বিষ ঝাড়ে। তারে ত্যানে
এইলা নিয়াম।" সবাই তাকায়। কেউ একজন বলে,
"হিটাও কী অয় পরশুরামের ত্যানে?"
বুধেশ্বরের বাপ এবার একটু থমকায়। তারপর মাথাটা একটু চুলকে নেয়। তারপর একটু হাসে। ঝিম ধরা হাসি। তারপর বলে,
"এইলা জোড়া-পোল্টা নিয়াম বাহে! এইলা বেশির ভাগে চলি আইচ্চে।
আগিলা দিনের মানষির কাথা। হিলা কোনো শাস্তরে নাই। হিলাক তোমরা হামারলার
নিজেরে ধরির পান। এই যে আজিকার দিনে বীচি ফেলায়, গছ নড়েয়া গারে, গছের গোড়োত
মাটি দেয়। হিলা হোইল অইন্য কাথা। আজি থাকি মনে কর ধীরে ধীরে ফসল করার
চিন্তা। এলা মোইদ্যে মোইদ্যে জল হবে, মাটিত অস হবে। গছ টছ নগতে বাড়িবে। আজি
থাকি মানষি হিদি মন দিবে। এইলা মনে কর সবে নিয়াম। হামার আগিলা দিনের
মানষিলা এইলা নিয়ামের মোইদ্যে সব কাজ-কামের কাথা জানে থুয়া গেইসে।"
সবাই মনে মনে ভেবে দেখল কথাটা মিথ্যে নয়। বুধেশ্বরের বাপ যেন কতকটা স্বগতোক্তির মতোই বলে,
"অ্যাতো বিষ ঝাড়ির কেনে নাগে। এলা তো গরমের দিন। বাইশ্যালি দিন
আইসেছে। সাপ-খোপ বাড়িবে। কী, মানষিক এইলা নিয়ামের মোইদ্যে সবোধান করি
দেওয়া।"
দেখতে দেখতে বেলা দুপুর। বিষেণ বাড়ি এসে
দ্যাখে মা গজগজ করছে। ও তাড়াতাড়ি সব গোছা করে রাখে। স্নান করে সব ঘরের চালে
তুলসীতলায় বেঁধে দেয়। রসবালা সব ভাজাভুজি দিয়ে আগে পুজো দেয়। তারপর সবাইকে
খেতে ডাকে। লাল চা দিয়ে ভাজাভুজি। একটু দই পেতেছিল। সেই দইটা সবার পাতে
একটু করে দেয়। দিয়ে নিজেও খেতে বসে। সুষেণ একটু বিরক্ত।
"মোক ভাজাভুজার দিনটা ভালে নানাগে তো। চাইট্টা ভোত্তা ভাত হোইলেও খাবার ভাল ছিল।"
বিষেণ বলে,
"আজিকার দিনোত হামার আগিলা মানষিলা শিকারোত গেইসে। জঙ্গলোত কী ভাত
পাওয়া যায়? বাড়ির মানষিলাও ভাত খায় না। তোর আরো এখিনাতে কষ্ট হছে?"
রসবালা বলে,
"কোটে বা শুনি আসিল। দেওয়ানি বেটা মোর।"
বিষেণ বলে,
"বটের গোড়োত শুনিলুং। আতিত না সাতশাগি দিয়া ভাত খামুকে।"
রসবালা
বিকেল বিকেল ভাত চড়ায়। চড়কমেলায় যাবে। তাছাড়া সারাদিন ভাত খাওয়া নেই।
এমনিতেই সব অস্থির হবে খাওয়ার জন্য। চাল একটু বেশি নেয়। পরের দিন আবার
চৈত্রের ভাত বৈশাখে খাওয়ার নিয়ম। নিয়ম হলেও এই গরমে পান্তা অবশ্য ভালোই
লাগে। তবু, রসবালা ভাবে সব নিয়মের শুরুই যেন এখন থেকে।
তথ্যসংগ্রহ - নারায়ণ রায়, বানিয়া পাড়া, খগেন হাট, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার।
ছবি : ময়ূখ রায়
..............................................................
সাতশাগি - সাত শাক। নামে সাত শাক হলেও সব ধরণের শাক, সজনে ডাঁটা, কুমড়ো সব মিশিয়ে সব্জি।
কাছারি - কাছারি বা কাচারি হল অনেকজন মিলে আড্ডা দিতে বসা।