কুর্তি চা বাগিচা : সবুজের গালিচায় গেরুয়ার রং/গৌতম চক্রবর্তী
কুর্তি চা বাগিচা : সবুজের গালিচায় গেরুয়ার রং
গৌতম চক্রবর্তী
----------------------------------------------------------
সহজ উঠোন-এর বাগিচা সফরে জুন থেকে শুরু করেছি পঞ্চায়েত সফরনামা। আপাতত জুন-জুলাই মাসের চারটে সপ্তাহ পঞ্চায়েত ভো্টের আগে সমীকরণ কি চা বাগিচার তারই রূপরেখা তুলে ধরার সন্ধানে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্তদন্ত করতে প্রয়াসী হয়েছি। নাগরাকাটা চা বাগিচায় নয়া সাইলির পরে গত সপ্তাহে এসেছিলাম কুর্তি চা বাগানে। কুর্তি, হিলা, জিতি একটার পর একটা বাগান সার্ভে করে বেড়িয়ে পড়েছি প্রাক ভোটপর্ব ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে জনমত সমীক্ষার প্রতিফলন সার্ভে করতে। আর পেলাম চোরাস্রোতের সন্ধান। অনুভব করলাম এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সমীকরণের প্রাকপ্রস্তুতি লগ্ন। টের পাচ্ছিলাম চা বাগিচা বলয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে জাতপাত এবং সাম্প্রদায়িকতা এক বিচিত্র কম্পোজিশন তৈরি করেছে। এমনিতে পঞ্চায়েত স্তরে বিরোধীরা সব আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। শাসক দল তৃণমূল সব আসনে প্রার্থী দিলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গোষ্ঠিকোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। প্রায় ২০০ আর এস এস কর্মীকে পাঠানো হয়েছে চা বাগিচা বেল্টে যারা নীরবে কাজ করছেন এবং রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন খোদ নাগপুরের সদর দপ্তরে। বামপন্থীরা বিশেষত সিপিএম তাদের জনভিত্তি অনেকটাই বাড়িয়েছে ন্যায্য মজুরীর দাবির কথা তুলে। কিন্তু ন্যুনতম মজুরীর দাবি নিয়ে সব সম্প্রদায়ের শ্রমিক নেতাদের ভূমিকাতে প্রবল ক্ষুব্ধ চা শ্রমিকেরা। তার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চা শ্রমিকদের ১৮ টাকা করে মজুরী বাড়ানোর পর মালিকপক্ষ এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে কোর্টে যাওয়ার ফলে ১ লা জুন থেকে ১৮ টাকা করে বাড়তি মজুরী পাওয়ার যে সম্ভাবনা প্রস্তুত হয়েছিল সেই নির্দেশে গুড়ে বালি হবার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই শুরু করেছি আমার একক ক্ষমতা অনুযায়ী আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার লোকসভা কেন্দ্রের বাছাই করা কিছু চা বাগান ঘিরে ক্ষেত্রসমীক্ষা। অধিকাংশ তথ্য নির্ভযোগ্য সূত্র থেকে যাচাই করা হলেও খুব স্বাভাবিক কারণেই নিরাপত্তার কারণে তথ্যদাতার আসল নামধাম গোপন রাখলাম।
বানারহাট থানার গয়েরকাটার আমাডিপা গ্রাম। বাইরে হিন্দিতে লেখা “শ্রী রাম বনবাসি আশ্রম”। শিলিগুড়ির গর্গ পরিবারের সাহায্যে নির্মিত। গেট খোলার আওয়াজে ঘর থেকে বাইরে এলেন এক মাঝবয়সী লোক। শক্তপোক্ত লোহার গেটের ভেতর থেকে আমাকে দেখে উঁকি দিচ্ছে বেশ কয়েকজোড়া আদিবাসী শিশুর অবাক করা চোখ। জানালাম আমি একজন মাস্টারমশাই, লেখালেখি এবং গবেষণা করি উত্তরবঙ্গের চা বাগিচা ও জনজাতিদের নিয়ে। পঞ্চায়েতের আগে বাগিচার জনজাতিরা এবং শ্রমিক মহল্লা কি ভাবছে তার জনমত সমীক্ষার জন্য এসেছি। এখানে এরকম একটি আশ্রম চলছে খবর পেয়ে দেখতে এলাম। সন্দেহভাজন দৃষ্টিকে স্বাভাবিক করার মানসিক অনুপ্রেরণায় বের করলাম তথ্য হিসাবে পেশ করলাম ডিবিআইটি-এর প্রাক্তন সচিব সুমন্ত গুহ ঠাকুরতা এবং প্রখ্যাত চা বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক তথা সুলেখক রাম অবতার শর্মাজীর আমাকে দেওয়া লেখক হিসেবে তাদের অ্যাসোসিয়েশনের নামাঙ্কিত প্যাডে স্বীকৃতিপত্র এবং চা বাগিচা নিয়ে আমার লেখা এখন ডুয়ার্সের প্রথম বইটি “চায়ের ডুয়ার্স কি চায়”। কুঞ্চিত ভুরু সহজ হল। জানলাম গেট যিনি খুললেন তাঁর নাম রাম পাহান, আদিতে বালুরঘাটের বাসিন্দা। বছর চারেক আগে বালুরঘাট থেকে ছাত্রাবাসের দায়িত্ব নিতে এসেছিলেন রাম পাহান। রাম পাহান প্রথমে মুখ খুলছিলেন না। আমি নিজেও বিজেপি সমর্থক বলাতে এবং আরএসএসের প্রার্থনা সংগীত “নমস্তে সদা বৎসলে মাতৃভূমে” গড় গড় করে মুখস্থ বলাতে একটা শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের ভাব চোখে পড়লো। বুঝতে পারলাম ওষুধ ধরেছে। তারপরেই রাম পাহান এর কাছ থেকে জানতে পারলাম আসল তথ্য। বনবাসী কল্যাণ আশ্রম গত চার বছর আগে ছাত্রাবাস খুলে বসেছে সাকোয়াঝোরা ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে। আশ্রমের কাজের এলাকা ডুয়ার্স জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জানলাম অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম আরএসএসএরশাখা। লক্ষ্য ছাত্রাবাসকে সামনে রেখে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের প্রচার বাড়ানো।
দেখলাম বাদ যায়নি চা বাগান থেকে উঠিয়ে আনা শিশুরাও। ছাত্রাবাস খুলে চলছে হিন্দুত্বের প্রচার। হোস্টেলের ভেতরে শিশুদের থাকার ব্যবস্থা। ছবি তুলতে গিয়ে বাধা পেলাম। বুঝলাম কিছু একটা অদৃশ্য নির্দেশ রয়েছে। শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন সেবার আড়ালে ঢালা হচ্ছে হিন্দুত্বের বিষ। সংঘ পরিবারের কাছে এটা কোন অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। কারণ এটাই আরএসএস এর হিডেন এজেন্ডা। ৩৫ জন আদিবাসী শিশুকে রাখা আছে সংঘের ছাত্রাবাসে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের কয়েকজনও আছে। তখন গরমের বন্ধের কারণে বেশ কয়েকজন বাড়িতে। খরচ আসে বানারহাট, বীরপাড়া, এবং শিলিগুড়ির বেশ কিছু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। তবে ছাত্রাবাস নয়, আসল লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে আরএসএস। ছাত্রাবাসকে সামনে রেখে বাড়াতে হবে বিজেপিকে। আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়ি এবং ডামডিমে কার্যালয় আছে এবং সেখান থেকেই আসে নির্দেশ এবং সেই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যায় সংঘ কর্মীরা। ছাত্রাবাস তো লোক দেখানোর জন্য ঠিক আছে। তাহলে আসলে কি ধরনের কাজ হচ্ছে? প্রশ্ন শুনে জবাব, ভেতরের কাজের কথা বলছেন তো? ওটা তো হচ্ছে এবং ওটা তো হবেই। গ্রামে গ্রামে যাচ্ছি। বিজেপিকে ভোট দিতে বলছি। জানায় বালুরঘাট থেকে গয়েরকাটাতে আসা আরএসএস কর্মী। খাওয়ার জন্য অনুরোধ রাখলেন রামপাহান। কিন্তু চামূর্চি যাবো শুনে আর কিছু বললেন না। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। যেতে যেতে যখন ভাবছি কিভাবে আরএসএস বাড়াতে পারল তাদের জমি ঠিক তখনই আবার গেটের ভেতর থেকে আচমকাই ডাক দিলেন আরএসএস কর্মী। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফাঁস করলেন বেড়ে ওঠার গোপন রহস্য। শেষবেলায় বার্তা পেলাম সিপিএম, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল, কংগ্রেসের অনেক নেতাও যেখানে যেখানে তারা প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপিকে সমর্থনের জন্য গোপনে গোপনে আরএসএস এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। জানিয়ে সটান ভেতরে ঢুকে গেলেন আরএসএস কর্মী।
ছাত্রাবাসকে দেখে বাইরে থেকে যেমন বোঝার উপায় নেই যে সেটা আরএসএস এর চালিকাশক্তি। তেমনি আমি ধারণাও করতে পারিনি তৈরি হচ্ছে ডুয়ার্সে এক অদ্ভুত রামধনু জোট শাসক তৃণমূলকে হারাবার জন্য। গয়েরকাটা থেকে বের হয়ে চললাম আলিপুরদুয়ারের পথে। মফস্বলের রাস্তা হেলান দিয়ে থাকে ভুটান পাহাড়ের গায়ে। শহর ঘিরে ডুয়ার্সের জঙ্গল আর চা বাগান। মনোরম সৌন্দর্য আর তার আড়ালে থাকা মন খারাপ নিয়ে সম্বৎসর পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানায় আলিপুরদুয়ার আর জলপাইগুড়ির সবুজ গালিচা। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে ৬২ টা চা বাগান। তার মধ্যে কয়েকটা বন্ধ। যেগুলি খোলা সেগুলোতেও শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরি এবং চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শ্রমিক সন্তানেরা স্থানীয় সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়। কিন্তু সেসব স্কুলের পরিকাঠামো ভাল না থাকার ফলে পড়াশোনা বেশিদূর এগোয় না। অনেক শ্রমিক মা বাবা কষ্ট করে বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেন। কিন্তু তার খরচ অত্যন্ত বেশি বলে বেশিদিন টানতে পারেন না। তাই স্কুলছুট বাড়ে। অথচ দেশের চা বাগান সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী স্বাস্থ্য, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা এসব কিছুই চা শ্রমিকদের প্রাপ্য। তাই যে লোকসভার একটা বড় অংশ বিপন্ন চা শ্রমিক, তার মন বিষণ্ন হওয়াই স্বাভাবিক ঘটনা। বিধানসভা বা লোকসভা ভোটের মাঠে তৃণমূল, বিজেপি, আরএসপি এবং কংগ্রেস প্রধান চারটি দলকে পড়তে হয়েছে চা বাগানের শ্রমিক কর্মচারীদের অভাব-অভিযোগ, ক্ষোভ এবং প্রশ্নের মুখে। প্রত্যেকটি দলের প্রার্থী আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি জিতলে চা শ্রমিকদের দূর্দশা মিটবে। তাই বাগিচার হাল ফেরাবার দায়ভার নিতেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন সকলে। কিন্তু কোথায় বাস্তবায়িত হল প্রতিশ্রুতি? আসলে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের বাগিচা বলয়ে অর্থাৎ দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে এবারের ভোটপর্বে এক নতুন লড়াই। প্রতিশ্রুতি রক্ষার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের। চা বলয় অধ্যুষিত ডুয়ার্সের আনাচে-কানাচে চর্চা এখন এটাই।
বিজেপির সাতটি চা বাগান খুলতে না পারার প্রতিশ্রুতিভঙ্গের পাশাপাশি রয়েছে রাজ্যের উদ্যোগে একের পর এক বাগান খুলে দেওয়ার লোকদেখানো নাটক। বাগান খোলে ঠিকই, আবার ভোটপর্ব সাঙ্গ হয়ে গেলে বাগান বন্ধ হয়ে যাবে এটা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোক থেকে বুঝতে পারেন চা শ্রমিকদের একাংশ। একদিকে ভূমিপুত্র তথা চা বাগানের ঘরের ছেলে জন বারলা যখন আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতা ছিলেন তখন তিনি ছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিরোধী। পরবর্তীকালে মোর্চার নেতা বিমল গুরুং যখন সমতলের ১২৬ টি মৌজা সমেত গোর্খাল্যান্ডের দাবি তোলেন তখন তিনি তা সমর্থন করেন। তারপরে তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন। এমনই এদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা। বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থী মিলি ওঁরাও এর দাবি ছিল তিনি জিতলে বন্ধ বাগান খোলা, চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, ৬০০০ হাজার টাকা পেনশন, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার দাবি লোকসভায় তুলবেন। মিলির কাছে চা শ্রমিকেরা প্রশ্ন তুলেছে বাম জমানার ৩৪ বছরেও চা শ্রমিকদের দূর্দশা কেন ঘোচেনি। জয়েন্ট ফোরামের নেতাদের বক্তব্য বাম জমানায় সব চা বাগানে বিদ্যুৎ গেছে। তখন ছ মাস অন্তর রাজ্য সরকার বাগানের মালিক এবং শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করতো। ফলে রেশন চালু রাখা, হাসপাতাল এবং স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতি ইত্যাদি দায়িত্ব এড়াতে পারতেন না মালিকেরা। তাছাড়া তখন তিন বছর অন্তর প্রায় ৪০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি হত শ্রমিকদের। চুক্তির ভিত্তিতে স্থির হওয়া ন্যূনতম মজুরির টাকা নিয়মিত পেতেন শ্রমিকেরা। কিন্তু এসব পুরোনো বস্তাপচা কথা শুনতে চায় না বাগিচা শ্রমিকেরা। তাই ধ্বস নেমেছে বাম কংগ্রেসের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্কে। আদিবাসী-নেপালী কম্বিনেশনকে হিসাব কষেই কাজে লাগিয়েছে বিজেপি- আরএসএস।
তৃণমূল সরকারের আমলে কয়েকটা বন্ধ চা বাগান খুলেছে এবং চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৬৭ টাকা থেকে বেড়ে ২৩২ টাকা হয়েছে। এটা সত্যি কথা। তাই অধিকাংশ চা শ্রমিকরা জানেন তৃণমূলই চা শ্রমিকদের বন্ধু। চা শ্রমিকদের প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ডানকানসের সাতটি বাগান অধিগ্রহণ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা এখনো পূরণ হলো না কেন। চা বাগানে ন্যূনতম মজুরি দৈনিক ৩৫০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? সেই প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত করা হয়নি কেন সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন চা শ্রমিকেরা। “ইউনিয়ন তো প্রতিবারই ভোটের মুখে অনেক কিছুই বলে। কিন্তু কিছু হয় কি? এত খাটাখাটনির পরেও মালিকদের বা ‘মানিজার বাবুদের' অকথ্য গালাগালি জোটে”। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন জয়পুর চা বাগানের চা শ্রমিক রিনা মুন্ডা। চোখেমুখে রাগ। চুম্বকে এটাই চা শ্রমিকদের মূল বক্তব্য। শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার জন্য লড়াই করার সংগঠন কম নেই, তবুও যেন সমস্যাটা একপ্রকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে যার নির্যাস শ্রমিক সংগঠনগুলির ওপর আস্থা চলে যাচ্ছে চা শ্রমিকদের। পাশাপাশিভাবে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে শাসকদলের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের সঙ্গে মালিকপক্ষের বোঝাপড়া নিয়েও। এটাও প্রশ্ন উঠছে যে তাই স্বাভাবিকভাবেই ঠিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বন্ধ চা বাগিচাগুলো খুলে দেওয়ার পেছনে কোন নেপথ্য নাটক কাজ করে? এইসব বাগানগুলি তাহলে আগে খোলে না কেন? তাহলে কি কেবলমাত্র ভোট ব্যাংক সুরক্ষিত রাখার প্রশ্নেই বাগান খোলে, আবার বাগান বন্ধ হয়? প্রশ্ন ওঠে তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের ঘিরে। আসলে আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের ভোটে নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় চা বলয়ের ভোট। কারণ মোট ভোটারের ৭৫ শতাংশই চা বলয়ের মধ্যে পড়ে।
কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকার ফলে চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। বাড়ছে নারী পাচার। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে একদল নারী পাচারকারী রমরমিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছে চা বাগান সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। চা শ্রমিকদের মেয়েদেরকে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। ডামডিম চা বাগানের শ্রমিক নির্মলা ঠাকুরের কথায়, “বছরে ছয় মাস কাজ জোটে। ওই সময়টাতেই যেটুকু আয় হয়। তাও আবার সামান্য মজুরি যা দিয়ে সংসার টানা যায় না। বাকি সময় যে কষ্ট সেটা আমরাই জানি। আমাদের বাড়ি নেই, ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারছি না।“ জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের চা বলয়ে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, সিটুর চা বাগান মজদুর ইউনিয়ন, আইএনটিইউসি অনুমোদিত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স, তৃণমূল কংগ্রেসের তরাই ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের শাখা রয়েছে বিভিন্ন বাগানে। চা শ্রমিক অমৃতা কুজুরের মতে, “কোন ইউনিয়ন আমাদের দাবি মেটাবে জানি না। সবাই বলে আমাদেরকে ভোট দাও। তোমাদের মজুরি বাড়বে। কিন্তু মজুরি বাড়ে না। মালিকরা যখন তখন গালিগালাজ করে। মজুরি চাইতে গেলে বলে কাজ করতে হবে না”। বস্তুত ইউনিয়ন আছে, লড়াই করে বাঁচতে চাই স্লোগানও আছে। শুধু চা শ্রমিকেরাই ভালো নেই। তৃণমূল নেতাদের জনভিত্তি এবং গ্রহণযোগ্যতা যে দিনে দিনে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে সেই দিকে তাদের কোন হুঁশ নেই। প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে একদিকে জেলার সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে চুনোপুটি নেতাদের দাম্ভিকতা, আচরণগত ত্রুটি এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন ধরনের অনৈতিকতা যে মানুষের নজরে এসেছে সে বিষয়ে তারা হয় বুঝতে পারেননি অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে আছেন। তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার ভোট যে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে শাসক দল সেটা যদি টের পায় সেটা তাদের পক্ষে মঙ্গলের।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার স্মৃতিও ভাবাচ্ছে কিছু মানুষকে। সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস বাকিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকেই বিভিন্ন ব্লকে এবং প্রত্যন্ত এলাকায় কর্মীসভা, ছোট ছোট পাড়া বৈঠক এবং বিভিন্ন এলাকায় লম্বা মিছিল করলেও চাওয়া না পাওয়ার অপ্রাপ্তি থেকে সেই মিছিলের মন-মানসিকতা কখন যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে সেটা জনবিচ্ছিন্ন নেতারা টের পাবেন না কিন্তু। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের ওপর ক্রমেই আস্থা হারিয়ে ফেলে শ্রমিকেরা সম্প্রদায় এবং জাতপাতের রাজনীতিকেই বেছে নিচ্ছে একথা অস্বীকার করা যায় না। তাই বলা যায় ভোট আসবে, ভোট যাবে। আর বিরোধ নয়। সবকা সাথ, সবকা বিকাশ শুনতে যত ভাল বাস্তবে তা মেনে চলা খুবই কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন আমরা ওরা এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসা। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। উত্তরবঙ্গ ঢেলে সাজুক। চা বাগিচার শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরী পাক। বন্ধ কারখানাগুলিতে আবার শুরু হোক দৈনন্দিন ব্যাস্ততা। হাসি ফুটুক সহজ সরল বাগিচা শ্রমিকদের মুখে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যদি মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারে তাহলে সংগঠন কোন অবস্থায় আছে সেটা তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষে বোঝা সহজ হবে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোট লুট প্রচেষ্টা এবং যেনতেন প্রকারেণ পঞ্চায়েত দখল করার প্রতিযোগিতা যদি ২০১৮ সালের মতো হয় তাহলে তৃণমূলের কফিনে পেরেক মারতে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴