পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪৩
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
চড়কখেলা
বসমতী
আপনমনে ধোয়া-কাচা, ঘর-সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। রান্না-বান্নার পাট
সকালেই চুকে গেছে। ছেলে-মেয়ে দুটো স্কুলে। সামনে চৈত্র সংক্রান্তি। রসবালা
হাতে করে কিছু সব্জি নিয়ে ঢুকল।
"দি, খাবু
তে নেক তো। তোরে বাদে আনলুং। এলাইতে মোর আরো সাতপুতি, কয়টা তোরোই ফলিসে।
জাঙিখানে ভাল করি অঠে দেং নাই এলাং, তাতে। দ্যাক তো।"
রসবালার কথায় খুশি ঝরে পড়ছিল। বসমতীও নতুন সব্জি দেখে খুশিই হয়। ওদের কথা-বার্তার মধ্যেই বাচ্চাগুলো বাড়ি চলে আসে। বসমতী অবাক হয়।
"আজি আরো এলাইতে আসিলেন? না পালে আসিলেন বাউ? সোইত্য করি ক,
নাহাতে সোইঞ্জাত এলায় আওয়ে মাতা না ধরিবে মোর। তোর বাপ ভোল ঠিকে খবর পাবে
এলায়। মাস্টারের নগত খাতির তোর বাপের! দ্যাখেন এলায়।"
বসমতীর কথাকে খুব বেশি পাত্তা দিল না কেউই। দুজনের চোখাচুখি হল একটু। তারপরেই মেয়ের উত্তর,
"আজি মাস্টারের মাতার বিষ। হামাক বাড়ি প্যাটে দিল সোগাকে।"
কথাটা
ডাহা মিথ্যে। কিন্তু তার আগেই ঢাকের আওয়াজ শোনা গেল। সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের
কোনো সুযোগ না দিয়েই দুজনেই ছুটল বাইরের দিকে। ঢাক বেজেই চলেছে। এবার
বসমতী আর রসবালার মনও আনচান করে উঠল। পাড়ার ভেতর যে কোনো একজনের খোলানে হবে
চড়ক খেলা। তবে সাধারণত অবস্থাপন্ন বাড়িতেই খেলা দেখানো হয়। তাতে আশেপাশের
সকলেই একসঙ্গে জড়ো হতে পারে। জায়গা বড় থাকে। মেয়ে-বউ, বাচ্চা-বুড়ো সবাই কাজ
ফেলে এসে গোল হয়ে বসবে, কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে। আমোদের এর বেশি আয়োজন তো সবসময়
হয় না! তাই না দেখলে আফশোসের অন্ত থাকবে না।
বাইরে এসে দেখে পাড়ার একমাত্র হরি মন্দিরের সামনেটায় মানুষজনে ভর্তি।
গায়ের কাপড়টা শুধু ঠিকঠাক করে দুজনেই বেরিয়ে পড়েছে। বসমতীর লম্বা চুলের
খোঁপা ধাপে ধাপে খুলে পিঠে গড়াচ্ছে, এতই জোরে হাঁটছিল দুজনে। রসবালার চুল
কম, ছিলিম খোঁপা করে উঁচু করে রেখেছে শক্ত করে।
নানারকম সাজের মানুষ দেখে বাচ্চাগুলো চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে
তাকিয়ে আছে। দুজন সেজেছে শিব-পার্বতী। পার্বতীর মাথায় মুকুট, গালে লাল রঙ।
কিন্তু শিবের দিকে সবার দৃষ্টি। মাথায় চূড়া করে বাঁধা চুল, জটা নেমে এসেছে
ঘাড় ছাড়িয়ে কাঁধ পর্যন্ত। হাতে বালা। সারা গায়ে ছাই মাখানো। পরনে বাঘছাল।
একজন লাল শালু মোড়ানো একটা মোটা কালো কাঠ মাথায় নিয়েছে। সাথে একটা ত্রিশূল।
আরো দুজন মাথায় শিং নেড়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে। ঢাকের বাজনায় আস্তে আস্তে
পুরো জায়গাটা ভরে উঠেছে। এবার ওই দলটা থেকে কিছু মানুষ এগিয়ে এসে খোলানের
মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালো। তাদের পরনে ছোট করে নেংটির মতো পরা খাটো ধুতি, খালি
গা। পরস্পরের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেন কিসের প্রস্তুতি।
ছেলে-মেয়েগুলো উত্তেজনায় ছটফট করছে। বেশিক্ষণ লাগল না। এবার পরস্পরের সাথে
অভিনয়ের মাধ্যমে এরা নানান শারিরীক কসরৎ শুরু করল আর উপস্থিত সবাই হাততালি
দিয়ে তাদের উৎসাহিত করতে লাগল। একজন এসে দলের মোটা মতো লোকটাকে জিজ্ঞেস
করল,
"কি রে ভোলা। কী করিছিত?"
ভোলা নামের ছদ্মবেশি মহাদেব বলে উঠল,
"কী আর করোছোং, দেখিন্না, পার্বতী মাছ নিগির কইসে, মাছ মারোছোং।"
এবার
অন্যান্যরা নানা রকম ভঙ্গিমায় কাঁকড়া বা মাছের আকার নিল আর মহাদেব সেই
শুকনো খোলানেই মাছ মারছেন। এভাবে ছোট ছোট কথোপকথন আর অভিনয়ের মধ্যে প্রচলিত
শিব মাহাত্ম্যে সবাই মুগ্ধ। মাঝে মাঝে খালি গলায় গানও গাইছে সবাই একসঙ্গে।
আসলে ভোলা বা বাবা মহাদেব স্বয়ং যেন তাদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ। সমবেত
হাততালি আনন্দের মধ্যে একসময় অভিনয় শেষ হল। এবার একজন একটা কাপড় সামনে
বাড়িয়ে ধরে মাগন তুলতে লাগল। নিজেদের সব্জি, চাল আর সঙ্গে সাধ্যমতো কেউ দশ
পয়সা, কেউ পঁচিশ কেউ আধুলি, যাদের আর একটু ভালো ক্ষমতা তারা চালের সাথে
একটা কাঁচা টাকা দিয়ে দিল। আবার ঢাক বাজাতে বাজাতে দলটি পাশের পাড়ার দিকে
রওনা হল। চড়কের আরো কয়েকদিন বাকি আছে। চড়কের আগের দিন থেকে আর মাগন তুলতে
পারবে না। সময় পাবে না। এখনি যত ব্যস্ততা।
বসমতী আর
রসবালা বরাবরের হুজুগে মানুষ। প্রতিবছর এই দিনটার জন্য তাদের একটা অপেক্ষা
থাকে। না এলে মনে মনে হিসেব করতে থাকে, আঙুলে কর গুণে দেখে চড়কের আর কদিন
বাকি। খুঁটি তোলা থেকে খুঁটি বসানো দেখতে দলবেঁধে সেজেগুজে চড়কের মাঠে যায়
একসঙ্গে।
চড়কখেলা দেখার প্রাথমিক ঘোর কাটিয়ে বসমতী প্রথমে জিজ্ঞেস করে,
"তোর ধোয়া-পাকলা হইসে মাই?"
"নাই হয় দি। কালি ধুইম। কালি এখেরে সাক্কালে ধরিম। আগোত ছেকাপাড়া
দিয়া উসাইম। ছেকার পোহনি বসে দিয়া আচ্চুং। এত্তোকোনা ছাবনও দিবার নাইগবে।
উড়ানি কেতালা নাই হয় বেশি মইলা। বিছানিগিলা এখেরে ওপাতে গেইসে। মোটা মোটা
দাগিলি গিলা নদী না নিগালে ভাল করি পরিস্কারে না হয়।"
বসমতীও মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
"বিষুমাত ঘর-দুয়োর, গরু-ছাগল মানষি-দুনষি সোগাকে পরিস্কার হোবার
নাগে। বিস মাতা ঘষেক, বিস গাও ধো। নাহালে চলে না। গোটায় বছরখানের মোইলা
পালাবে। তাবে সিনি নয়া সাল আসিবে।"
রসবালার বাড়ি আগে পড়ে, ও ঢুকে গেল। বসমতী আর দাঁড়ায় না। অর্ধেক কাজ ফেলে বেরিয়েছে। গিয়ে বাকি কাজে হাত লাগায়।
..........................................................
সাতপুতি - সাত পুত্রের মা আক্ষরিক অর্থ। ঝুমকো ঝিঙেকে সাতপুতি বলে।
তোরোই - ঝিঙে
পোহনি
- নারকেলের মালার ছিদ্রের মুখে পাটের সুতলি রেখে তাতে ছেকার ধুলা রেখে
অল্প অল্প জল দিয়ে রাখা হয়। সেই জল পরিশ্রুত হয়ে পাটের সুতলি পেরিয়ে নিচে
রাখা গ্লাসে জমা হয় যেটা ক্ষার হিসেবে বা ছেকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
দাগিলি - মোটা কাঁথা