শালসিঁড়ি-৪২/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-৪২
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
প্রচণ্ড হৈ হট্টগোলে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায় বিকাশের। নাইট ডিউটি থাকলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে সাধারণ সময় থেকে অল্প দেরি করে বিকাশ। আজ আবার কী হলো এত সকাল সকাল একটা আতঙ্কিত চেঁচামেচি হচ্ছে অফিস কমপ্লেক্সে! রাতে কী সব স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের কথা মনে হতেই চটপট উঠে পড়ে বিকাশ। পরিশ্রম কী পরম শান্তির ঘুম এনে দেয় শরীরে-মনে। বিকাশ ভুলেই গেছিলো ও দেবারুর চৌকিতে কাল রাতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সকাল সকাল এই বিশ্রী চিৎকার চেঁচামেচি না হলে হয়ত এই ঘুমটা এখন ভাঙ্গত না বিকাশের।
শেষ রাতে গজরাজ নিজের মর্জিতে বিকাশদের নিয়ে আসে ওর নিজের ক্যাম্প লালিবাড়িতে। বৃষ্টিতে ভেজা পোশাক শুকিয়ে গেছে শরীরে। গ্রীষ্মে হঠাৎ বৃষ্টির পর কেমন একটা গরম বাতাস বয়। এই গরম বাতাস যেন বনের মাটির রাগের বহিঃপ্রকাশ। সারাদিন মানুষ কত অত্যাচার করে বনের উপরে! সেই উত্তাপ ছেঁকা দেয় বিকাশদের মনে। সেই সেঁকা ছাই করে দেয় কত আশা, বোঝা যায়না রাতের অন্ধকারে। গজ মুক্তার হাতি, নাকি হাতি মেরে মুক্তো কেনার ফন্দি। যে হাতি ছিলো মানুষের একান্ত বন্ধু, অপার ভার বহন ক্ষমতার জন্যে; সেই হাতি এখন বাণিজ্যের লক্ষ্যবস্তু তার সুন্দর দাঁতের জন্য। এক প্রজাতির মানুষের কত ভিন্ন মত। কখনো কখনো সময় কত ভীষণ কঠিন হয়ে ওঠে। কত দিন হয়ে গেল কবোষ্ণ নরম বাতাস পায়নি বিকাশ। অন্ধকার রাতের গরম হাওয়ার মতো হু হু করে ওঠে বিকাশের মন।
অন্ধকারে গজরাজ এসে একটা রাইডিং স্ট্যান্ডের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। বিকাশ পা তুলে নামতে গিয়ে দ্যাখে- পা ওঠাতে পারেনা। পা দুটো যেন লক হয়ে গেছে। তাপস নেমে যাওয়াতে পিছনের খালি জায়গায় গদিতে হেলে পড়ে একহাতে পা টেনে টেনে তুলে সোজা করে নেয়। রাতের অন্ধকার সম্মান রক্ষা করলেও কষ্ট লাঘব করেনি একটুকুও। পায়ে যেন ঝিঝি লেগে আছে। এতক্ষণ নানা চিন্তায় পা দুটোর কথা মনেই ছিলোনা। চিন্তা কী ভয়ানক - সঙ্গের অঙ্গের কথাও ভুলিয়ে দেয়। দেবারু কি কিছু অনুমান করলো? এসে হাত বাড়িয়ে দেয় বিকাশের দিকে।
- আমার হাত ধরুন স্যার।
বিকাশ আস্তে নেমে আসে দেবারুর হাত ধরে। পা টা ঠিক হতেই মনে হয়- বড্ড খিদে পেয়েছে।
- দেবারু তোমাদের এই ক্যাম্পে কি আর কেউ থাকে?
- হ্যাঁ স্যার। আমাদের পাতাওয়ালা আর এক জন কর্মী আছে।
- কোন যে সাড়াশব্দ নেই।
- রাইত শেষ হইয়া আইস্লো, এখন ওরা গভীর ঘুমে স্যার।
- ডাক, আর টি তে একবার খবর দেওয়ার চেষ্টা করো।
দেবারু ক্যাম্পের দরজা ধাক্কা মারে। জোরে জোরে ডাকে-
- খগেন ও খগেন, ওঠ ওঠ…
খগেন দরজা খোলে। হাতে একটা সোলার লণ্ঠন। সেই আলোয় খগেনের মুখ দেখা যায় না। দেখা যায় পা আর সিঁড়ি। বনে রাতে সিঁড়ি আর পা দেখে চলার রীতি। বনে যে বিপদ পায়ে পায়ে ঘোরে। সাপ কাঁকড়াবিছা তেঁতুলবিছা কত কী পড়ে থাকে সিঁড়িতে মাটিতে। বিকাশের মনে পড়ে সেবার বুলবুল নাইনের একটি ঘটনা। দুর্জয় রাতের রান্না চাপিয়েছিল টং ঘরের নিচে কাঠের উনানে। সবজির পোড়া গন্ধ নাকে যাওয়াতে টং ঘর থেকে দৌড় লাগায়। চোখ ছিল সবজির কড়াইতে। খেয়াল করতে পারেনি সিঁড়ির পাশে যে শুয়ে ছিল একটা শাঁখামুঠি/ শঙ্খিনী (Banded krait) সাপ। সন্ধ্যা রাতে যে এদের আনাগোনা বেশি থাকে শিকারের জন্য। টং ঘর থেকে নামতে গিয়ে পা দেয় শাঁখামুঠির গায়। রেঞ্জে খবর আসে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি দুর্জয়কে। রাতের ভাতের একটা সবজি বাঁচাতে গিয়ে নিজে পুড়ে গেল বিষে। গাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিষ স্তব্ধ করে দেয় দুর্জয়ের হৃদপিণ্ড। অভিজ্ঞতা কী সুন্দর অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে লালিবাড়ি ক্যাম্পের স্টাফদের। বুকের সঞ্চিত সূর্যের আলো দেখিয়ে খগেন পথ দেখিয়ে বিকাশদের নিয়ে যায় ক্যাম্পের টং ঘরে।
- তোমাদের আর টি টা খোল।
- স্যার আর টি খারাপ হইয়ে গেছে। - খগেন বলেন।
- মানে।
- সন্ধ্যায় খুব বিদ্যুৎ চমকাইছিল। তখন আর টি টা খারাপ হইয়ে গেছে।
- তাহলে…
বিকাশ নিজের ফোনটা বের করে। সিগন্যাল আছে কিনা দেখবে বলে। কিন্তু সিগন্যাল কী দেখবে! বৃষ্টিতে ভিজে মোবাইলের ব্যাটারি পুরো শেষ হয়ে গেছে। তাপসের মোবাইলের অবস্থা সেই একই রকম।
- স্যার, রাইতটা এখনে থেইকে যান। আমাদের ক্যাম্পের স্টাফরা পান্তাভাত করে রাখে।
সকালের চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই পান্তা পিঁয়াজ লঙ্কা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমানোর পর কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে! চোখ রীতিমতো জ্বালা করছিল।
- দেবারু কী হয়েছে।
- স্যার গজরাজকে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা এইখানে থাকেন। আমরা বাইর হচ্ছি। হাতি খুঁজতে।
- কালকে যে বস্তাটি পাওয়া গেছিল সেটা কোথায়।
- স্যার আপনার চৌকির তলায়।
- ঠিক আছে।
বস্তা খুলে রক্তের চাপ ও তাপ বেড়ে যায় বিকাশের। রাতের অন্ধকার সরে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকচক্রবালে। সূর্যাস্তের কত সুন্দর দৃশ্য দেখেছে বিকাশ। কিন্তু রাতের ঘন কালো অন্ধকার ডুবে যাবার দৃশ্য কী সুখের হয় এত দিন জানা ছিলোনা-বিকাশের। দেখা যায় বনের দূরপ্রান্ত থেকে ফিরে আসছে মেনকা আর গজরাজ। গজরাজের শুঁড় দিয়ে ওঠে আসে নতুন সূর্য আর একটি নতুন দিন।
- দেবারু, কোথায় পেলে গজরাজকে।
- ঘাসবাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল।
- ওখানে কেন গিয়েছিলো।
- সেই এক কাণ্ড স্যার। একটা জংলী দান্তাল মাঝে মাঝে পিলখানায় আইসে মেনকাকে ডিস্টার্ব করে। গজরাজ বাধা দিলে গজরাজকে দাঁত দিইয়া গুঁতা মারতো। ধর্নাতে বাঁধা থাকার জন্য গজরাজ তেমন কিছু করতে পারতোনা। কালকে শেষ রাইতে গজরাজকে মাও খুঁটির সাথে হালকা করে ধর্না লাগাই রাখা হইছিলো। দান্তালটি কালকে রাইতে আবার আসছিলো। গজরাজ কাইল রাইতে খুব দিছে। জংলীটাকে মারতে মারতে ঘাসবাড়ি নিয়া যায়। তারপর জংলীটা পালায় যায়।
- কী করে বুঝলে।
- পুরা ঘাসবাড়ি তছনছ হইয়ে গেছে। পিলখানা থেইকে পুরা দণ্ডী আছে। তাছাড়া আমরা তো এটা জানি। কত রাইতে দাঁতালটিকে তাড়ানোর জইন্য আমার দোনলা বন্দুক থেইকে গুলি করছি- আকাশে, ওর পায়ের সামনে মাটিতে।
- গজরাজ তো তোমাদের বনের রাজা। ওকে রাতে ছেড়ে রাখলে কী হবে। ও তো খুব ভালো হাতি।
- এইটা আমাদের পুরানো অভ্যাস। আর এই রকম কোন দিন ভাবি নাই। আরেকটা ঘটনার কথা বলি স্যার।
- বল।
- একদিন কর্মা ওড়াও – গজরাজের আগের মাহুত আর গণেশ, গজরাজ ও মেনকাকে নিইয়া বিকালে ঘাস আনতে যায় নদীর পাড়ে। ঘাস তোলা হইলে গণেশ ফিরে আইসতে থাকে। কর্মা বলে –তুই যা। আমি আসছি। আমার পেট গুড় গুড় কইরছে। কর্মা হাতি দাঁড় করে রাইখে হাতি থেকে দূরে ঘাসবাড়ির ভিতরে গিইয়া জামাকাপড় খুইলে ফেলে বসি পড়ে। গণেশ পিলখানায় হাতি নিয়া আইসে হাতি বান্দি দেয়।
- তারপর।
- আমরা সবাই বসে বসে ভাবছি কখন কর্মা গজরাজকে নিইয়া আসে। এই আইসবে এই আইসবে করতে করতে রাইত প্রায় আটটা বাজি যায়। আমরা খাওয়া দাওয়া সাইরে মেনকা নিয়ে ঘাসবাড়ি রওনা দিই।
গণেশ লাল লবন চা আর চাউল ভাজা নিয়ে আসে। কাঁচা ঘুম ভাঙার পর লবন লাল চা মচমচে চাউল ভাঁজা বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছে বিকাশের। চা চাউল ভাজা খেতে খেতে বিকাশ বলে-
- তারপর
- আমি যেখানে কর্মাকে ছাইড়ে আসছিলাম সেইখানে গেলাম। গিয়া দেখি সেইখানে কর্মা নাই গজরাজও নাই। - গণেশ বলে।
- আমরা সবাই কর্মা কর্মা কইরে ডাকি। কোন উত্তর পাই না। গজরাজকে ডাকি কোন সাড়াশব্দ পাই না। -দেবারু বলে।
- আমরা মেনকার পিঠে বইসে নদীর পাড় ধইরে সার্চ লাইট মাইরে মাইরে খুঁজতে থাকি কর্মাকে। রাইতে নদীর পড়ে ঘাসের মধ্যে যে গণ্ডার ঘুমাই থাকে। কিছুক্ষণ খুঁজার পর ঘাসবাড়ির মধ্যে কর্মার হাফ পেন্ট আর গেঞ্জিটা পাওয়া যায়। কিন্তু গামোছাটা নাই।
- আচ্ছা!
- তারপর আমরা আরও উত্তর দিকে যাই। দেখি নদীর পাড়ে কর্মার গামোছা পইড়ে আছে। সেইখানে দেখা যায় একটা গণ্ডারের পায়ের ছাপ। নদী থেকে গণ্ডারের দণ্ডী চইলে যায় ঘাসবাড়ির ভিতর। দণ্ডীর উপর দেখা যায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। আমরা সেই দাগ ধরি ঘাস বনের মধ্যে ঢুইকে পড়ি। প্রায় ১০-১৫ মিনিট যাইবার পর দেখি গজরাজ দাঁড়াই আছে। কাছে যাইতেই দেখা যায় গজরাজের পায়ের পাশে পড়ে আছে কর্মা। কর্মার পেট ফাইটে ভুঁড়ি বাইর হইয়ে গেছে।
- ইস্! তারপর কী করলে।
- আর টিতে খবর গেল বিট অফিসে রেঞ্জ অফিসে। সিধাবাড়ি ক্যাম্প থাইকে আরো দুইটা হাতি নিয়ে আসলো বিট বাবু বড়বাবু (রেঞ্জ অফিসার)। সাথে নিয়া আইসলো থানার অফিসার। তখন রাইত ৩ টা। থানার লোক বডি তোলা পর্যন্ত গজরাজকে এক ইঞ্চিও সরানো যায় নাই। ও একদম ঠাঁই দাঁড়াই ছিল। কর্মার বডি তোলার পর কার্ত্তিক গজরাজের পিঠে ওঠে। তখন থেকে কার্ত্তিক গজরাজের মাহুত হয়ে যায়।
- কর্মাকে কী গণ্ডার মেরে ছিলো।
- হ্যাঁ স্যার। গণ্ডার মাইরেছিলো।
- কি মনে হয় তোমাদের, গণ্ডার কেন মেরেছিলো।
- মনে হয় কর্মা ঝারা সাইরে নদীতে জল নিতে আসছিল। ঝারার পর ভালো করে পরিষ্কার না হয়ে যে হাতির পিঠে ওঠা যায়না। ঐ রকম বেলাডুবার সময় গণ্ডারও নদীতে জল খাইতে আসে। হয়তো দুই জনে মুখামুখি হইয়ে যায়। গণ্ডারকে হঠাৎ দেখে কর্মা ভয় পাইয়ে দোড়াইতে যায় আর গণ্ডার ওকে তাড়া করে। গণ্ডারের যে গোঁ। একবার তাড়ানো শুরু করলে আর থামেনা।
- গজরাজ কী করছিল।
- এমনিতে হাতি গণ্ডারকে ভয় পায়।
- কেন।
- গণ্ডারের উঁচা তো হাতির থাইকে কম। তাই গণ্ডার হাতি তলার দিকে খড়গ দিয়া পেট ফুটা কইরে দেয় বা কামড়াই দেয়। তবে গজরাজ গণ্ডার ভয় পায়না। ওর দাঁত দেইখে গণ্ডার ভয় পায় খুব। সেই এক ঘটনা আছে গজরাজ আর গণ্ডারের।
- তাহলে গজরাজ কেন বাঁচাতে পারলোনা কর্মাকে।
- ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটে যায়। হয়তো কর্মার চিৎকার শুইনে ছুটে যাবার আগেই গণ্ডার তার কাজ সাইরে চলে যায়।
- মারাত্মক! ভয়ানক!!
গজরাজ-কীর্তন শুনতে শুনতে লাল লবন চা আর মুচমুচে চাউল ভাজা শেষ হয়ে যায়। বিকাশ বলে
- দেবারু এখান থেকে বের হবার উপায় কি? এতক্ষণ আমাদের খবর না পেয়ে ঐ দিকে যে কী হচ্ছে। তোমাদের আর টি খারাপ; আমাদের মোবাইল ভিজে বন্ধ হয়ে গেছে। কোন যোগাযোগ যে করা যাচ্ছেনা।
- স্যার আর কিছুক্ষণ। এখনি সিধাবাড়ি ক্যাম্পের সকালের পেট্রোলিং হাতি আইসবে। তারপর ওদেরকে দিয়ে খবর দেওয়া যাইবে।
খবর থেকে বেখবর হলে চিন্তা বাড়ে প্রিয়জনের। চিন্তা বাড়ে প্রশাসনের। প্রশাসনের চিন্তার কারণ মান আর প্রিয়জনের চিন্তার কারণ মন। চারদিন হয়ে গেল অপরূপার সাথে কোন কথাবার্তা হয়না। অংশুর পড়া শোনা যে কেমন হচ্ছে- কে জানে। ময়ূখ যে কেমন আছে। মাধুরী কেমন আছে। কিছুই জানে না বিকাশ। তারপরে যদি শুনতে পায় যে গতকাল রাতে হাতি সহ হারিয়ে গেছে বিকাশ। তাতে যে নিন্মচাপ তৈরি হবে যেই নিম্ন চাপ কী ধরণের ঝড় তুলবে তা খুব ভালোকরে জানে বিকাশ।
কিছুক্ষণ পর উত্তর পূর্ব কোন থেকে বেরিয়ে আসে দুটি পোষা হাতি। একজন স্টাফ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে-
- দেবারুদা, সব খবর ঠিক আছে?
- ঠিক নাই, শুনি যা। দেবারু বলে-
- ঐ হাতিগুলা সিধাবাড়ি ক্যাম্পের। ওদের কাছে ওয়াকিটকি থাকে। সেইটা দিয়ে স্যার আপনি খবর দিতে পারবেন। সিধাবাড়ি আর লালিবাড়ি ক্যাম্প ভাল্লুকমারি বিটের মধ্যে পড়ে। ভাল্লুকমারি বিট কাঁঠালডাঙ্গা রেঞ্জের মধ্যে পড়ে। ভাল্লুকমারি বিটে আর টি টাওয়ার আছে। ঐখানে খবর দিলে ওরা আপনার খবর দিয়ে দিবে।
- আচ্ছা। হাতি দুটোর কি নাম।
- মেঘরাজ আর লীলাবতী। মেঘরাজের মাহুত হচ্ছে মন্টু আর লীলাবতীর মাহুতের নাম নরেশ। মেঘরাজ কিন্তু ভালো কাঠের লগ টাইন্তে পারে। এখন অভয়ারণ্যে বিক্রি করার জইন্য গাছ কাটা হয়না। কিন্তু গাড়ি নদিতে ফাঁইসে গেলে গাড়ি ঠেলে তুলে দিতে ওস্তাদ।
- আচ্ছা বেশ তো।
- লীলাবতী খুব মায়াবী হাতি। যেকোন বাচ্চা হাতিকে খুব ভালোবাসে।
- তোমাদের একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগছে।
- কী স্যার।
- এখনো পর্যন্ত যতগুলো হাতি দেখলাম, সব জোড়ায় জোড়ায়। স্ত্রী হাতি আর পুরুষ হাতি একসাথে থাকলে ওদের মন ভালো থাকে।
- ঠিক স্যার। আগে ক্যাম্পে ক্যাম্পে একটা করে হাতি রাখা হতো। তখন হাতিগুলা খুব গণ্ডগোল করতো। মাঝে মধ্যে শরীর খারাপ কইরতো। এখন হাতিগুলা খুব ভালো আছে।
- দেবারুদা কও কি খবর আছে। - মন্টু বলে।
- মন্টু, ওনি মাঝগ্রাম রেঞ্জের বড়বাবু। - দেবারু বলে
- নমস্কার স্যার।
- আর টিতে ভাল্লুকমারিতে খবর দে - মাঝগ্রাম রেঞ্জের বড়বাবু লালিবাড়ি ক্যাম্পে আছে। মাঝগ্রামে যেন খরটা দিয়ে দেয়।
- আচ্ছা
- ওই দিকের খবর কী? - দেবারু জিজ্ঞাসা করে।
- খবর ঠিক আছে। কিন্তু কাইল ভোর রাইতে পেট্রোলিং গাড়ি টিকবাড়ির ধাদিনার গোলাই থেইকে তিন জন লোককে ধরে বিটে নিইয়ে আসে।
- কী বললে- বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
- হ্যাঁ স্যার। ওদের তিনজনের মধ্যে একজন বাংলা কথা বোঝেনা।
- তাই নাকি। আর টি তে বল- তোমাদের কাঁঠালডাঙ্গা রেঞ্জের বড়বাবুকে লালিবাড়ি ক্যাম্পে আসতে। এখানে আমি আছি। আমার কাছেও একটা খবর আছে।
- ঠিক আছে স্যার। দেবারুদা আর কোন খবর আছে?
- বিট বাবুকে বলিস আমরা অনেক রাইতে ফিরছি। রাইতে গজরাজ জংলীর সাথে লড়াই করছে। এখন পিলখানায় আছে। ক্যাম্পের আর টি কাইল্কে সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ পইড়ে খারাপ হইয়ে গেছে। সকালে ডিউটি হয় নাই। বিকালে হবে।
- ঠিক আছে, দা।
- তোমরা কি কোন হাতি দেখেছ। আজকে সকালের ডিউটিতে।
- হ্যাঁ স্যার। একটা বড় গণেশ দেখেছি। ওটা মাঝগ্রামের দিক থেকে আসছিলো।
- আচ্ছা।
- আসি স্যার। নমস্কার।
হাতিদের কত কথা। দাঁতের কথা ভাবলেই কয়েক দিন চলে যাবে। এক প্রজাতির পুরুষ হাতির কারো দাঁত থাকে কারো দাঁত থাকেনা। যাদের দাঁত থাকে তাদের আবার সবার দুইদিকে দাঁত থাকেনা। ভগবান গণেশের মতো শুধু ডান দিকে দাঁত থাকলে তাকে গণেশ বলে। শালসিঁড়ির দায়িত্ববান বন্ধু। আবার শুধু বাঁ দাঁত থাকলে বাঁয়া। বড় বদমাইশ। দাঁতাল হাতিরা আবার মানুষের মতো - কোনটা ডান দাঁত বেশী ব্যবহার করে আবার কোন হাতি বাঁ দাঁত বেশী ব্যবহার করে। মানুষরা সব্যসাচী হলেও দাঁতাল সব্যসাচী হয়না। তাই দাঁতাল হাতির কোনটার বাঁ দাঁত ভাঙ্গে আবার কারো ডান দাঁত ভাঙ্গে। মাকনারাই ভালো- দাঁতও নেই সমস্যাও নেই। তাহলে গজমুক্তা কার থাকে। মণি মুক্তো তো ভগবান দেবতাদের থাকে। শালসিঁড়ির কোন বিশেষ বন্ধু গণেশ কি বয়ে নিয়ে চলেছে গজমুক্তা। বিকাশ ডুবে যায় হাতিদের দাঁতে। দেবারু ডাকে
- স্যার।
- হ্যাঁ বল। ওই দেখেন দুইটা জিপ আসছে।
বিকাশ টং ঘর থেকে নেমে আসে। মানব এগিয়ে এসে বলে –
- হ্যালো বিকাশ। তোমার যে কালকে অনেক কষ্ট হলো।
- আর বলোনা। সচরাচর তো হাতির পিঠে ডিউটি করা হয়না। একবার যখন সুযোগ এলো তাই…
- বিশেষ কিছু খবর আছে।
- সেই জন্যইতো তোমাকে ডাকলাম। বাজারে কী খবর চলছে।
- তোমরাতো সচরাচর হাতির পিঠে ডিউটি করোনা, বড় সাহেব খুব চিন্তা করছিলো। আমাকে স্টেটমেন্ট দিতে হয়েছে যে গজরাজ বনে কোন গণ্ডগোল করার হাতি নয়। দেখ আমার কথা সঠিক প্রমাণিত হলো।
- তোমারা কি কোন আসামি ধরেছ।
- হ্যাঁ। ভাল্লুকমারি বিটে আছে। তুমি কি খবর দেবে বল।
- চল টং ঘরে।
বিকাশ মানব টং ঘরে ওঠে। বিকাশ দেবারুর চৌকির তলা থেকে একটা সিমেন্টের বস্তা টেনে বার করে। বস্তার গায়ে অহমীয়া ভাষায় কী সব লেখা আছে। বস্তা খুলে আর একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট খুলে বের করে একটা ভাঙ্গা ৩০৩ রাইফেল আর ১৪টি তাজা বুলেট। মানবের তখন চোখ চড়ক গাছ। বলে-
- বিকাশ তোমার কষ্ট কত বন্যপ্রাণকে বাঁচিয়ে দিল। এই বস্তাটি আসামের। শুনলাম যে তিন জন আসামি ধরা পড়েছে তাদের একজন উত্তর পূর্ব ভারতের।
সকালের সূর্য তখন দুরন্ত আঠারোর বালক। তার তেজ স্পষ্ট করে দেয় সব কিছু। বিকাশ বলে-
- এই নাও বস্তাটি। তোমার কাছে রাখ। দেখ সেই আসামির সাথে কোন যোগাযোগ আছে কিনা। যদি থাকে শাস্তি দিও কঠোরতম।
দেবারু জিজ্ঞাসা করে-
- স্যার সেই বস্তাটিতে কি আছে।
- গজমুক্তার তালা চাবি। - বিকাশ বলে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴