শালসিঁড়ি-৪১
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
বিকাশের বাড়ির সামনে এসে শিরীষ গাড়ির হর্ন বাজায়। অপরূপা বলে
- শিরীষকে চা খেতে বল।
- শিরীষ চা খেয়ে যাও।
- না না দেরী হয়ে যাবে।
বিকাশ নেমে আসে নিচে। অপরূপা, অংশু বারান্দা থেকে হাত দেখায়। অংশু বলে –
- বাবা গজমুক্তার ক্লোজআপ ছবি তুলে আনবে। আংকেলকে বলবে আমরাও একবার যাবো গজমুক্তা দেখতে।
- ঠিক আছে ।
শিরীষ বিকাশের থেকে বয়সে কয়েক বছরের বড়। বন পাগলামির জন্যে কখন যে বিকাশের বন্ধু হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। ও ফিজিক্সের প্রফেসর। দারুণ চালায় নিজের সেডান কার। ড্রাইভারের সিটে বসে খুশীতে হাসছে। বিকাশ সামনের সিটে উঠে বসে। পিছনের সিটে জল ও নানা খাবার রাখা আছে। শিরীষ যেমন ভোরাসিয়াস রিডার, তেমন মনে রাখতে পারে পড়ার মধ্যকার বিশেষ বিশেষ কথাগুলো। ও সব ধরণের বই পড়লেও বন ও বন্যপ্রাণের বই পড়তে বিশেষ মজা পায়। একটা করে বনের বই পড়ে আর বিকাশের পরীক্ষা নেয়- আচমকা প্রশ্ন করে। শিরীষ খুব বন পাগল মানুষ। এই রকম মানুষ আর দুইটা পায়নি বিকাশ তার কর্ম জীবনে। কত মানুষ আছে যারা বনকে শুধু বিনোদনের উপাদান ভাবে। বন সংরক্ষণ নিয়ে সেই মানুষগুলোর একটা দেখনদারিত্ব থাকে। শিরীষ কিন্তু সংরক্ষণ নিয়ে খুব সিরিয়াস। এই জন্য বিকাশের সাথে কেমিস্ট্রি মিলে যায় গভীরভাবে।
- আর বলো না। শেষ পর্যন্ত ছুটিটা হল।
- একটা দিন তো মাত্র ছুটি- শুক্রবার। তারপরতো শনি-রবি। রবিরাতেই তো ফিরবে। তাতেও…
বিকাশ শিরীষের মুখ কথা থেকে টেনে নেয়… শিরীষ গাড়ি স্টার্ট করে। আজ ওদের গন্তব্য নুরপুর জমিদার বাড়ি। নুরপুরের জমিদারের বংশধর রূপনারায়ণ বিকাশের বন্ধু।
- আমরা বন দপ্তরের অফিসাররা হলাম বট গাছের মতো। শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের বট গাছটা দেখেছ? ঠিক সেই রকম।
- মানে?
- আমরা যত বাড়বো আমাদের ঝুরিমূল তত বাড়বে। সেগুলো মাটি পেয়ে স্তম্ভমূলে পরিণত হবে; বিস্তার বাড়াবে বটে, নড়তে দেবেনা।
- আর আমরা?
- তোমরা হলে রাস্তা। যত চলবে মিলবে ফলকের পর ফলক। কত গ্রাম কত শহর তোমাদের ছোঁয়ায় ধন্য হয়।
- না, তোমার সাথে পারা যাবে না।
হা হা করে হেসে ওঠে দুজনে। গাড়ি নিয়ন্ত্রিত গতিতে ছুটে চলে জাতীয় সড়ক ধরে। এখন জাতীয় সড়ক নতুন ফোর-লেন রাস্তা। শিরীষ আত্মতুষ্টিতে স্টিয়ারিঙের আঙুলে তাল তুলে গাইতে শুরু করে- ও আকাশ সোনা সোনা … এ মাটি সবুজ সবুজ … নতুন রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রেঙ্গেছে… আলোর জোয়ারে খুশির বাঁধ ভেঙ্গেছে… শিরীষ গান থামিয়ে বলে-
- দেখ গাড়িটা মাখনের মতো চলছে। আগে গাড়ি নিয়ে বার হতে ইচ্ছা করতো না।
- নুরপুরে সরাসরি রেল যোগাযোগ নেই। এখান থেকে বাসও সরাসরি নেই। তিনবার বাস পাল্টে যেতে সময় লাগে অনেক। তাই তোমার …
- এটাতো আমার সৌভাগ্য; গজমুক্তা দর্শনের সুযোগ হবে তোমার দৌলতে।
- আর কিছু নয়!
- নয় মানে? তোমার সাথে পুরো দুই দিন বুনো হয়ে বুঁদ হয়ে থাকবো। তবে গজমুক্তার ব্যাপারটা যে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট।
- তুমি কি তোমার ঝাঁপি খুলবে না।
- আমি তো কালকে সারা দিন খুব টেনশনে ছিলাম। তোমাদের ছুটির এত অসুবিধা জানতাম না।
- আচ্ছা, রূপনারায়ণের কাছে যে গজমুক্তা আছে সেটা কি করে জানলে।
- হা হা হা। সেটাই তো রহস্য।
- রহস্যটা কি?
- একটা বিদেশী পুরনো শিকারের জার্নাল পড়ছিলাম। সেই জার্নাল থেকে জানতে পারলাম লর্ড কার্জন রাইঢাকের জংগলে রূপনারায়ণের প্রপিতামহ সহ একটা দাঁতাল শিকার করেছিলো।
- আচ্ছা।
- তুমি রূপনারায়ণবাবুর সাথে কথা বলেছ।
- সে বলেছি। রূপনারায়ণ তো অবাক। বলে – সে কি করে জানলে যে আমার কাছে গজমুক্তা আছে।
- তাই! তুমি কি বললে।
- আমি বললাম আমার একজন শার্লক হোমস আছে, সে এই সব খোঁজ খবর রাখে। ও বলে, সে তো খুব সাংঘাতিক। আমার কাছে গজমুক্তা আছে সেটা ব্রিটেনের একজনের সন্দেহ ছাড়া আর কেউতো কিছু জানেনা।
একটা জনবহুল এলাকায় ঢোকার মুখে গাড়িটা রেল লেবেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঢাক্ ঢাক্… ঢাক্ ঢাক্ করে একটা লম্বা মাল গাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। মাল গাড়িটি পার হতেই গাড়ি চলতে শুরু করে। শিরীষ বলে-
- সে আর কি বলল।
- বলে ব্যাপারটি খুব গোপনের, আমাদের দুই জনের বাইরে যেন কেউ না জানতে পারে।
- এত গোপন জিনিষ তোমাকে কেন দেখাচ্ছে?
- সেটা আমার সম্পর্কের রহস্য। হা হা হা…
গাড়ি ছুটে চলে ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে, ছোট ছোট বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে।
- বলতো দিন দিন কার উচ্চতা কমে যাচ্ছে।
- মানুষ থেকে এভারেস্ট, সবার তো উচ্চতা বাড়ছে।
- বলতে পারলে না তো, বনের উচ্চতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
- সেটা কেমন?
- আমি যখন ২০-২৫ বছর আগে এই রাস্তা দিয়ে যেতাম তখন আকাশ দ্যাখার এঙ্গেল ছিল অল মোস্ট নাইনটি ডিগ্রী। আর এখন এঙ্গেল হয়ে গেছে ৩০ ডিগ্রী।
- বন দ্যাখাতেও পদার্থ বিদ্যা!
- পদার্থ আছে বলেই তো অপদার্থ দেখতে পাই।
- তুমি যে কি বল সব সময় ধরা যায় না।
- দেখ বনের আকাশ যত প্রশস্ত হয়েছে, বনের পাশের শহরগুলোর আকাশ সংকীর্ণ হয়েছে। মানে উঁচু উঁচু বিল্ডিঙের মধ্যে সরু সরু গলি আকাশ করেছে ফালি। আবার বনের লম্বা লম্বা গাছগুলো চলে যাওয়াতে বনের আকাশ হয়েছে অনেক প্রশস্ত।
- হুম।
- বনের উচ্চতা যত কমেছে শহরগুলোর বিল্ডিঙের উচ্চতা বেড়েছে।
- তোমার মতো করে কয়জন মানুষ ভাবে বল।
- সেটাইতো সমস্যা। ধনী ও শিক্ষিত মানুষ শুধু নিজের ঘর বাড়ি আর নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবে। মানব জাতির আবাস্থলের (Habitat) কথা ভাবেনা। মানব জাতির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে গেলে কি হবে বুর্জ খলিফার।
- না না এত নেতিবাচক হওয়ার কারণ নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক সংস্থা কাজ করছে। ভালো কিছু হবেই।
- তাই যদি হতো গত ২৫০ বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ ২৮০ পি পি এম থেকে ৪১৫ পি পি এম হতোনা। আর সমুদ্রের অম্লত্ব ৩০% বৃদ্ধি পেতোনা।
- তোমার দেখি সব তথ্য ঠোঁটে লেগে আছে।
- কি লাভ তাতে। এত আলোচনার পরেও কি কোন রাজনৈতিক দল পরিবেশকে রাজনৈতিক আলোচ্যসূচিতে রেখেছে। রাখেনি। কারণ পরিবেশ হলো কমন রিসোর্স। যে যেমন করে পার লুটে নাও। কমন রিসোর্স নষ্ট হয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে কমন জীবন। এক একটি মানুষ শুধু নিজের উত্তরসূরির কথা ভাবতে গিয়ে শেষ করে দিচ্ছে মানব জাতির উত্তরসূরির ভবিষ্যৎ। অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে বহন করে কি জীবন যাপন করা যাবে? আর কত দিন?
- তোমরা কি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে কথা বলো?
- দিলে তো ব্রহ্মাস্ত্র ছেড়ে।
- না না এটা পুরো সমাজের সমস্যা। সমাজের মধ্যে তো তোমরাও পড়।
- দেখ আমরাও সিলেবাসে বাঁধা। সিলেবাসের বাইরে যে সকল সিম্পোজিয়াম হয় তার বিষয় কিন্তু মকর রাজা ঠিক করে না। মকর রাজাকে চিনতে পারলে তো, সেই রক্তকরবীর মকর রাজা।
- তাহলে।
- ঠিক করে সান্ডা গুণ্ডারা। যারা এখনো লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে হিরা খোঁজে। হিরার কি কোন মূল্য আছে যদি সূর্য না থাকে। গাছই একমাত্র প্রাণ যে সূর্য ধরে আনে মানুষের বুকের কাছে।
- উন্নয়ন তো করতে হবে।
- দেখ উন্নয়ন দুই রকমের হয় প্রকৃতি নিয়ে আর প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে।
- তাতো ঠিক।
- ঠিক বললে হবেনা। সঠিক পলিসি বানিয়ে প্রয়োগ করলে ২০ বছরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- কি বল? সেটা কি ভাবে।
- জান, পৃথিবীতে বার্ষিক কত কাঠ এক জন মানুষ গড়ে ব্যবহার করে। মাত্র ১৮ কিউবিক ফুট। আবার এর মধ্যে ৮০% জ্বালানির জন্য।
- ঠিক বলছ?
- গবেষণা তো সে রকম বলে। আর যদি তুমি তোমার সন্তানের জন্য তার জন্মের দিন একটি গাছ লাগাও, ২০ বছরে সেই গাছ কমপক্ষে ৬০ কিউবিক ফুট কাঠ দেবে।
- গাছ যদি কাটতেই হবে লাগিয়ে কি লাভ।
- তোমাদের এই মানসিক সংরক্ষণশীলতা একটা সমস্যা। শোন গাছ দুই ধরণের রিসোর্স। বনাঞ্চলের গাছ বনের জমি আমার কাছে নন- রিনিউএবল রিসোর্স। বনের বাইরের নতুন লাগানো গাছ আমার কাছে রিনিউএবল রিসোর্স। বনের বাইরের গাছ বা গাছ গুচ্ছ (Sacred group) একটা মাইক্রো ক্লাইমেট তৈরি করে। সেটা সেখানকার মানুষকে ইকোলজিকাল সার্ভিস দেয়। এই সবের গাছের জন্য দরকার হলে সরকার বাহাদুর সাবসিডি দিতে পারে।
- তাইতো।
- দেখ বনের জমি তো আর রবারের মতো লম্বা হবেনা। বন এলাকা যা আছে তা আর বাড়ানো যাবেনা আমরা জানি। কিন্তু বনের ঘনত্ব বাড়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। বনের বাইরেও অনেক অনেক গাছ লাগিয়ে পৃথিবীর সবুজ বাড়ানো যায়। আচ্ছা তোমাদের একটা দপ্তর আছেনা- সোশালফরেস্ট্রি।
- আছে। তবে …
- জান কানাডাতে প্রতিটি মানুষ প্রতি প্রায় ১১০০০টি গাছ আছে, অস্ট্রেলিয়াতে আছে প্রায় ৩০০০ টি, অ্যামেরিকায় আছে প্রায় ৭০০টি, চিনে আছে প্রায় ১২৫টি, ব্রিটেনে ৪৫ টি আছে, আর ভারতে জন প্রতি মাত্র ২৫টি গাছ আছে। আর এই ২৫ টি গাছ থেকে জন প্রতি ২৫০০ টি গাছে আসতে হলো তোমাদের সোশালফরেস্ট্রির অনেক কাজ করতে হবে।
- জানোতো আমাদের ফরেস্ট্রিতে গ্রীনম্যান বলে একটা কথা আছে।
- সেটা কি?
- আমাদের সবার হাতে গাছ লাগালে গাছ ভালো হয়না। কিন্তু গ্রীনম্যান নার্সারি করলে, নার্সারির চারা হয় খুব হৃষ্টপুষ্ট। প্লান্টেশনে গাছ লাগানোর উদ্বোধন করালে প্লান্টেশন হয় খুব ভালো।
- এখন তো সবাই গাছ লাগায়। শীতকালেও রাস্তার পাশে গাছ লাগাতে দেখি। গাছ লাগানোতে যে সময়-সীমাবদ্ধতা থাকে সেটা কেউ বোঝেনা। একটা চারা গাছ আর একটা শিশু একদম এক।
- শিরীষ বাইরে দেখ।
- গ্রামের মধ্যে ডাম্পিং গ্রাউন্ড! সব যে ননবায়োডিগ্রেডেবল।
- জান শিরীষ গ্রামীণ ভারতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট মাত্র ০.৮৫ টন সেখানে শহুরে ভারতে কার্বন ফুটপ্রিন্ট ২.৫ টন। শুধুমাত্র গাছ কার্বন লক করে। তাই ভারতের মতো ট্রপিকাল/ সাবট্রপিকাল কান্ট্রিতে যেখানে গাছের গ্রোথ খুব ভাল, সেখানে বনের বাইরে বেশী বেশী গাছ লাগিয়ে কাঠের ব্যবহার বাড়ালে দূষণ অনেক কমে যাবে। কাঠের আসবাব অনেক বেশী ভালো ষ্টীলের আসবাবের থেকে। কি বল।
- ঠিকই। এতে বায়োডাইভারসিটি অটুট থাকবে, বাড়বে; দূষণ কমবে আয় বাড়বে।
গ্রামীণ বাংলার বুক চিরে চলে যায় ফোরলেন রাস্তা। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলছে সেডান। কখনো সিরিয়াস কখনো হালকা কথা বার্তা চলতে থাকে বিকাশ ও শিরীষের। স্বপ্নের জগতের মতো পাশে ঘুরে ঘুরে চলে যায় গ্রাম বাংলার ঘরবাড়ি কিছু ছন্নছাড়া গাছ, রুগ্ন গরু আর সেচহীন জমি। নুরপুর আর বেশী দূর নয়। শিরীষ যেন গাড়ির স্পীড বাড়ায়।
- কি হল? বিকাশ জিজ্ঞাসা করে।
- আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। কখন যে গজ মুক্তা দেখব!
নুরপুর আর গ্রাম বাংলার মধ্যে কোন তফাত চোখে পড়ে না। নুরপুরে ঢুকে ওরা পৌঁছে যায় রূপনারায়ণের বাড়ি। নুরপুরে রূপনারায়ণের বাড়ি নামে যত বিখ্যাত এখন আর কাজে কর্মে তেমন প্রসিদ্ধ নয়। রূপনারায়ণ যেন রক্ষা করে চলেছে একটা ভগ্নপ্রায় রাজপ্রসাদ। জমিদার বাড়ির মূল ফটক দেখে শিরীষ গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়। রূপনারায়ণ সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে কাঠের দোতালা প্রাসাদসম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে । গাড়ি থেকে বের হতেই রূপনারায়ণ বিকাশের সাথে কোলাকুলি করে। শিরীষের সাথে পরিচয় পর্ব শেষ করে ওরা বসে নিচে একটা বড় হল ঘরে। হল ঘরের দেওয়ালে লাগানো আছে বাঘের মাথা সহ পুরো শরীরের চামড়া। প্রায় ৪-৫ ফুট লম্বা হাতির দাঁত। হরিণের চামড়া। হরিণ গাউর বুনো মহিষের স্টাফ্ড মাথা। শিরীষ একটা হাতির পায়ের টুলে বসতে গিয়ে ওঠে আসে। বসে পড়ে বেতের চেয়ারে। ও মনে হয় হাতির পায়ের টুলের পিছনের দেওয়ালে লাগানো চকচকে অজগরের চামড়া দেখে ভয় পেয়েছে! শিরীষ বিস্ময়ের চোখে বিকাশের দিকে তাকালে, রূপনারায়ণ বলে-
- এই সব আমাদের পূর্ব পুরুষরা ১৯৭২ সালের আগেই শিকার করেছিল। বনদপ্তরে হিসাব দেওয়া আছে।
শিরীষ অস্বস্তি কাটায় চাপফুলের মতো হেসে। এই হাসি শিরীষের ট্রেড মার্ক। যেমন সুন্দর তেমন সুবাসিত। খাকি হাফ প্যান্ট পরা এক মাঝ বয়সী পুরুষ জল চা এনে দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা জলের মতো শিরীষ প্রশ্ন করে-
- আপনার প্রপিতামহ তো বাঘ শিকার করতে গিয়েছিলো। হাতি শিকার করল কেন?
- সে অনেক কথা। শুনলাম আপনি সব জানেন।
- সেটাতো কাগজে অক্ষরের মধ্যে জানা। অক্ষরের মাধ্যমে জানা আর শিকারির বংশধরের মুখে শিকারের বিবরণ শোনার মধ্যে যে অনেক ফারাক।
- জমিদার তার ব্রিটিশ বন্ধুর জন্য শিকারের ব্যবস্থা করেছিলো। আয়োজন ছিলো এলাহি। সাথে ছিলো ২৫ টি হাতি আর ১৫০ জন লোকলস্কর। জঙ্গলে গিয়ে পেয়ে গেছিল এক মস্ত বাঘ। সেই মতো টঙের কাছে বাঁধা হয়েছিলো হরিণের মতো একটা বাছুর। টোপ হিসাবে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালো এক মস্ত দাঁতাল হাতি। সেই হাতিটি পোষা হাতিগুলোকে জংগলে বাঘ খেদার কাজে খুব ডিস্টার্ব করছিলো। মনে হচ্ছিলো, হাতিটি যেন সেই জংগলের মালিক।
- আচ্ছা।
- হাতিটি একবার টঙ বাঁধার গাছটিকে এমন ধাক্কা মারে যে ব্রিটিশ বন্ধু উল্টে যাবার উপক্রম হয়। তখন সেই হাতিটিকে গুলি করে মারে ব্রিটিশ বন্ধুটি।
- তারপর।
- হাতিটি কিছুদূর গিয়ে পড়ে যায়। সারা দিন ওরা বসে থাকে গাছে। শেষে বিকাল ৩ টায় আসে এক মস্ত বাঘ… বাছুরটি খেতে। বাঘ শিকার করে ওরা হাতিটির দাঁত কেটে ফিরে আসে। কিন্তু হাতির দাঁত কাটতে গিয়ে সন্দেহ হয় রাজা কৃষ্ণনারায়ণের বিশ্বস্ত মাহুত গণেশের। ব্রিটিশটি চলে যায় শিকার করা গরম বাঘ আর হাতির দাঁত নিয়ে মেমসাহেবকে দেখাতে। গণেশ কৃষ্ণনারায়ন আবার ফিরে আসে মৃত হাতিটির কাছে। সংগ্রহ করে গজমুক্তা। কৃষ্ণনারায়ণ ফিরে এলে মেম সাহেব জিজ্ঞাসা করে-
- কৃষ্ণনারায়ণ, টুমার ডেরি কেন হইলো? হাতিটির মাথায় কি গজ মুক্টা পাইয়াছ?
- নানা, সেই রকম কিছু নয়।
- টবে এটো ডেরি হইলো কেন, টুমি আমাকে কিছু হাইড করিতেছ। তারপর হেসে ওঠে হি হি হি করে।
- আমি দেখতে গেছিলাম, মৃত হাতিটিকে ঠিক করে রাখা হয়েছে কিনা- শকুনে খাবার জন্য।
- আচ্ছা।
- এই যে দাঁতগুলো দেখছেন এইগুলো সেই হাতির দাঁত।
শিরীষ হাতির দাঁত দুটি ধরে কেমন যেন আবেগ তাড়িত হয়ে যায়। বিকাশ উঠে গিয়ে দাঁতগুলো ছুঁয়ে দেখে। শিরীষ বলে-
- আর বাঘটি?
- বাগটির ছাল ছাড়িয়ে ওরা নিয়ে গেছে।
- আচ্ছা এই দাঁতের ভিতরে কি গজমুক্তা ছিল।
- না না এই দাঁতের গোড়ায় মাথার ভিতরে।
- চলুন না একবার দেখি- গজমুক্তা। আমি আর থাকতে পারছি না।
শিরীষ, রূপনারায়ণ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠছে। বিকাশ পায়ের পর পা ফ্যালে কিন্তু ভাঙ্গতে পারেনা সিঁড়ির ধাপ। ও হাঁপিয়ে ওঠে। চিৎকার করে ডাকে শিরীষকে, রূপনারায়ণকে। শিরীষ, রূপনারায়ণ শুনতে পায় না বিকাশের ডাক। গলায় যেন বোবায় ধরে। মনে হলো ফোন বেজে ওঠে।
- স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
- কী হয়েছে।
- স্যার একটা হাতি শিকার হয়ে গেছে। দাঁত দুটো কেটে নিয়ে গেছে। মাথাটিকে চিরে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। আমার কি হবে স্যার।
বিকাশ “না” বলে চিৎকার করে ওঠে। দেবারু ভগবান ছুটে আসে। দেবারু বলে –
- স্যার কি হয়েছে।
- না কিছু হয়নি। দেবারু কালকে কোথায় শুয়েছিলে?
- স্যার হাতির গদি নিয়ে বারান্দায় শুয়েছিলাম।
- স্যার আপনি “না” বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন।
- মনে হয় স্বপ্ন দেখছিলাম। আচ্ছা বস্তাটি কোথায়।
- আপনার চৌকির তলায়।