পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪১
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
শুবোচোনি মাও
সেই
ভোর থেকে রসবালা আজকে ধান সেদ্ধ করতে লেগে গেছে। উঠানের এক পাশে একটা বড়সড়
উনুন পাতাই থাকে সবসময়। মচমচে হয়ে যাওয়া কিছু পুরনো খড়, গাছের পাতা,
বাঁশপাতা, সরু সরু বাঁশের কঞ্চি পাতাসুদ্ধ। সব আগের দিনই উঠোনের এক কোণে
জমিয়ে রেখেছিল। আজ ভোর হতে না হতেই সেসব দিয়ে দাউ দাউ করে উনুন ধরিয়ে
ধানসেদ্ধ বসিয়েছে। আগেরদিন হাঁড়ি, বালতি যেখানে পেরেছে ধান ভিজিয়ে রেখেছে।
আজ একাই জল থেকে তুলে তুলে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে সেদ্ধ বসিয়ে
দিল। একটু করে জ্বাল এগিয়ে দেয় লাঠি দিয়ে আর অন্যদিকে বসে না থেকে উঠানটাও
ঝাঁট দিতে থাকে। তখনও পাখির ডাক শুরু হয়নি, তার আগেই উঠোনে ঝাঁটার খরখর
শব্দ পৌঁছে যায় ঘুমন্ত পাড়াটার বাড়ি বাড়ি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে আকাশ
পরিস্কার হতে থাকে আর রসবালার উঠোন, বাইরের উঠোন, পেছনের সুলকিপথ বা সরু
রাস্তাটাও ঝাঁট দেওয়া হতে থাকে। ঝাঁট দেয়, জ্বাল এগিয়ে দেয় একটা বাঁশের
লাঠি দিয়ে, আবার ধানে ভাপ উঠল কিনা সেটাও পরখ করতে থাকে। কখনো হাত দিয়ে
উপরের ধানগুলো এদিক ওদিক করে দেয়, কখনো বাঁশের তৈরি খুন্তির মতো দেখতে
লম্বা 'ঘাটা'টা দিয়ে ধানগুলো ওলোট-পালোট, ওপর-নিচ করে দেয়। তারপর কূপিটা
সামনে ধরে ধানের মুখটা ফাটল কিনা দেখতে থাকে। প্রথম হাঁড়িটা সেদ্ধ হতে
সুষেণ-বিষেণের বাপকেই ডাকে। ছেলেদের অত সকালে ডাকতে মন চায় না। সরেন উঠে
কাপড়ের ন্যাতা দিয়ে ধরে দুজনে ধানের হাঁড়িটা নামিয়ে উঠোনের একপাশে ঢেলে
দেয়। তারপর রসবালা হাঁড়িটা আবার বসিয়ে ধান ঢালতে থাকে। সরেন গরুগুলো বের
করে পুঞ্জিতে লাগিয়ে দিয়ে দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজতে থাকে। ততক্ষণে আকাশ বেশ
ফর্সা হয়ে এসেছে। রসবালা মুখ ধুয়ে ওদিকেই গায়ে জল ঢালে। ভেজা গায়ে বালতিতে
জল নিয়ে এসে তুলসিতলা লেপে দিয়ে ছোট্ট ঠাকুরঘরে ঢোকে। সব লেপা হলে দুটো
সাদা ফুল তুলে ঠাকুরকে একেবারে দিয়ে নিয়ে তবে শুকনো কাপড় পরে। সরেন তার
মধ্যেই তাগাদা দেয়।
"ন্যাও, হইসে। এলা কনেক চাহা-টাহা বানাও।"
রসবালা ছোট্ট করে বলে,
"দ্যাছোং চড়ে"
তারপর কাপড় মেলতে মেলতে বলে,
"তোমরা ওদি আখার জ্বালটা দ্যাখোখেনে তাবত্তে।"
চা খাওয়া হলে চায়ের গ্লাসগুলো তুলে নিয়ে যেতে যেতে রসবালা সরেনকে বলে,
"ন্যাও, মোর হিটা হান্ডিও হয়া গেইল। তোমরা কনেক খোলানখান মাঠে
দ্যাও। ঘাসে সার হইসে। মুই গোবরজল দিয়া কনেক মুচি দ্যাং। কালিয়ে কত করি
কলুং। তোমার টাইমে নাহয়।"
সরেন মনে মনে প্রমাদ গণে।
তাই তো! আগেরদিন অনেক খুঁজেও কোদালটা কোত্থাও পায়নি। বিকেল থেকে রসবালা
গজগজ করেছে। খোলানটা মানে বাইরের উঠোনের ঘাসগুলো তুলে দিলে কালকেই রসবালা
লেপে দিতে চেয়েছিল। শুকানোরও ব্যপার আছে! ও আর কিছু না বলে সুড়সুড় করে
গোয়ালঘরে ঢোকে। আঁতিপাতি করে কোদালটাই খুঁজতে থাকে। রসবালার ইতিমধ্যে
তিনহাঁড়ি ধান সেদ্ধ হয়ে গেছে। ভিজিয়েছে চার হাঁড়ির অল্প বেশি। বিশ কেজি করে
দুই মণ ধান। শেষের দুটো হাঁড়িতে একটু বেশি করে ধান নিয়েছে। ধান একটু সেদ্ধ
হতেই চারদিক থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। সেজন্য রসবালা এখন উনুনের পাশ থেকে
নড়তে পারছে না। মালতীর বিয়েতে পঁচিশ কেজি চাল দেবে বলেছে সরেন। বিয়ে প্রায়
চলে এসেছে। সেজন্যই এত তাড়া। শীত যাই থাই করছে, তাড়াতাড়িই শুকাবে। কিন্তু
ভানতে সময় লাগবে। বুধেশ্বরের বউকে বলে রেখেছে। দুজনে মিলে করলে তাড়াতাড়ি
হবে। সরেন গোয়ালঘর, শোয়ার ঘর, ছেলেদের ঘর তোলপাড় করেও কোথাও কোদালটা দেখতে
পায় না। কী আর করা! অবশেষে বলেই ফেলে,
"সুষেণের মাও! কোদালখানে যে চান্দে পাছোং না কালি থাকি। চাইরো পাখে দেখিলুং, একঠেও নাই। কী হইল তে ক তো কনেক!"
রসবালা অবাক হয়।
"কোটে আরো যাবে! পুলি ফেলের সোমায় নাইগসে। ইয়ার পাছোত তো আর কোদালের
কাজে করি নাই। বাইষ্যালি দিনোত সিনি কোদাল নাগে! ওটে আছে কোটে বা। ভাল করি
দ্যাখো কনেক।"
"নাই। দেখিলুং না! কালি থাকি
চান্দাং। মনে মনে সরে সরে চাইরোপাখে দেখি বেরালুং! এলা নাই তে দিদি ঘরেরে
খান আনোং। পাছোৎ সেলা দিয়া আইসা যাবে। বেলাটা উঠিসেকে। কত্থন আরো মুছিবু
ফির! না শুকালে তো ধানও দিবার না পাবু।"
সরেনের কথায়
রসবালা এবার বুঝতে পারে, এত বলার পরেও সরেন কেন খোলান পরিস্কার করে দেয়নি।
আসলে কোদাল পাচ্ছে না। আর কোদাল তো ও ই রেখেছে। হারালেও সরেনেরই দোষ!
বসমতীর কাছ থেকে কোদাল এনে সরেন তাড়াতাড়ি খোলান পরিস্কার করতে বসে।
একটু পরে হাতে আধখানা লাউ নিয়ে বসমতীও আসে। রসবালা তখন সকালের খাবার করতে
ব্যস্ত। বসমতী জিজ্ঞেস করে,
"সাকালে কী খাইলেন মাই?"
"নাই দি, কোনোয় নাই আজি। এলানি চাইট্টা ভুবুরা ভাজি নাল চা দিয়া খামু।"
বসমতী নিজেই একটা পিঁড়ি ফেলে বসে পড়ে। তারপর ধীরে সুস্থে বলে,
"তে ভুবুরা হইসে? দে চাইট্টা। কাঁচা পিঁয়াজি আর মরুচ দিস তো বেশি করি। কনেক ঝাল খাবার মনটা গেইসে।"
রসবালা
দ্রুত হাতে চাল ভেজে পেঁয়াজ লংকা কেটে দেয়। তেলের শিশির মুখে আঙুল দিয়ে
সাবধানে অল্প তেল ঢেলে চালভাজাটা সুন্দর করে মাখে। তারপর বাটিতে বাটিতে
ঢেলে সবাইকে লাল চা সহ হাতে হাতে দেয়। বিষেণ এসব মোটে খেতে চায় না। মুখ
গোমড়া করে বলে,
"মোর ত্যানে না চাইট্টা ভোত্তা ভাত আন্দির পালু হয় মা?"
রসবালা ঝাঁঝিয়ে ওঠে,
"কতলা হোটে ধান উসাসুং দেখির পাছিত না বাউ? পখি-পয়াল না উঠিতে মুই
আগোত উঠিসুং। খোলানখান মুছির নাগে, তারে ত্যানে বলে মুই হাকুদাকু নাগাসুং
আর ইয়ার পেরাসনি খান।"
বসমতী অবাক হয়।
"তুই আজি ধান উসাবু জানিসকে তে কালি খোলানখান মুছি থুবার পাইস নাই!"
"ক্যাং করি থং! বিষেণের বাপ যে খোলানখানে মাঠে না দিল। আজি
শুনোছোং, কোদালখানে বলে নাই। হারাইল, না আরো কাহো নিগাইসে! নিগালে তো আনি
দিবে।"
রসবালার কথার উত্তরে চালভাজা চিবোতে চিবোতে বসমতী বলে,
"না হারায়। কোটে আর যাবে! হোটা ঠাকুরে বোদায় নুক্কি থুসে। পূজা
পাবার আল। ওই শুবোচোনিক মানাচিনা কর, আপনে বেরাবে ভুস করি এলায়।"
সরেন
খাওয়া হয়ে গেছে। জল খেয়ে, মুখ ধুয়ে পরনের গামছাটাতেই মুখ মুছে। তারপর
হাসিমুখে কিছুটা কৌতুকের ছলেই জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে অর্নিদ্দিষ্ট দিকে
তাকিয়ে বলে,
"ন্যাও বারে শুবোচোনি মাও। মোর
কোদালখান কোটে নুক্কি থুসেন দ্যাও হিরিস করি কনেক বাইর করি। পালে সেলা দিম
এখান পূজা। একঝুঁকি কোলা, একপোয়া বাতাসা আনি দিম এলায়। কেনে তোক পূজায়
নাগে!"
রসবালা গজগজ করে।
"ঠাকুরটাক তাও কনেক ভাল করি মানাচিনা করির না পায়। কাথা কোবার ঢং!"
সরেন সে কথার জবাব না দিয়ে বসমতীর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা কোদালটা হাতে নিয়ে বসমতীকে বলে,
"দি, বোইস তে তুই। মুই খোলান মাঠাং।"
বিষেণ বসমতীকে জিজ্ঞেস করে,
"হিটা আরো কী ঠাকুর তে পিসাই। ইয়ায় আরো জিনিস নুক্কি থুইয়া পূজা চান্দায়!"
বসমতী হাসে। তারপর টেনে টেনে বলে,
"ঠাকুর হামার মেলা বাফো। আগিলা দিনের মানসিলা এইলা পূজিসে!"
তারপর একটু থেমে সরল বিশ্বাসে বলতে থাকে,
"এই কী কবু বাবা, এইলা মনসা ক, চন্ডী ক -ইমিরা একে। মনে করেক
চন্ডীয়ে হইল শুবোচোনি। মেলাদিন পূজা না পালে ইমার আগ হয়। সেলা কয়, কী রে
ভক্ত, তুই মোক ভুলি গেসিস! এখেনা পূজা-পানি কোনোয় না দিস! সেলা উমরা পূজা
পাবার ত্যানে কোনো একখান জিনিস নুকি থয়।"
বিষেণ বলে,
"কী কী নুকি থয়? বড় বড় জিনিস?"
বসমতী হাসে।
"বড় ছোট তামাল্লায় নুকায়। কাহোরো বাসিলা। কাহোরো কোদাল, যেমন
তোমারখান নাই। কাহোরো কাটাই, পাছুনি যার যেইটা হোউক হারায়। পূজা দিলে সেলা
আপনে জিনিসখান বিরায়।"
বিষেণের কৌতুহল দারুণ। আবার প্রশ্ন করে,
"সেলা কোটে নুকি থয় তে পিসাই?"
ও
আসলে মনে মনে ভাবছে ঠাকুর এসে হাতে করে জিনিসটা লুকিয়ে রাখে। সেজন্য ওদের
কোদালটাও মা শুবোচোনি লুকিয়ে রেখেছে ভেবে মনে মনে রোমাঞ্চিত হয়। বসমতী ওর
প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে।
"কোটে আরো থয়।
ওটেখেনায় না জিনিসখান নয়। তুই যেটে থুসিস সেটে নবে, কিন্তুক তুই দেখির পাবু
না। চোক্কুর আগালোত থাকিলো একখান জিনিস নগতে নজরোত সুজিবে না। তুই
চান্দাখেনে। আওদে চান্দা। আর জিনিসখান না ওটেখেনায় আছে!"
বিষেণ
এবার বুঝতে পারে। এটা আসলে ঠাকুরের মায়া। এত প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে
বসমতী একেবারে নাজেহাল। রসবালা বাসনগুলো মেজে রেখে ছেলেকে ধমকায়,
"কোপালোত কাম নাই আর পঞ্চ হাজারি আও! বড় বাউ বসি না নয়। এলা কাম
নাই তে ভ্যানখান ধলি বিরাইল। আর ইয়ায় খালি গোপ্পুদার। গরুগিলা দোলা নিগা
কনেক। বান্দেক। তোর বাপ খোলান মাঠাছে।"
বসমতীও রসবালাকে কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলে,
"না কোইস তো কোনো মাই। পুছুকখেনে, পুছা ভাল। না জানিলে না
পুছিবে। তার পাছে সেলা উমরাও বড় হয়া দুই চাইরজনকাক কবে। এংকেরি না কাথা
বাড়ে।"
তারপর একটু থেমে সুর করে বলে,
"শুভ কাজে শুবোচনিক দেয় গুয়া পান
শুভোচনি হইলেক চন্ডী মাও শুনো দিয়া মন। তে এই শুবোচোনি আর কাহোয় না হয়, হামার মাও চন্ডীয়ে।"
কথা শেষ করে বসমতীও এবার উঠে পড়ে। অনেক কাজ। রসবালা বালতিতে করে
গোবরজল আর একটা ঝাঁটা নিয়ে খোলানে যায়। একটু করে গোবরজল ঢালে আর ঝাঁট দিয়ে
দিয়ে পরিস্কার শুকনো শুকনো করে জলটাকে ছড়িয়ে লেপে দেয়। এভাবে ঝাঁটা দিয়েই
উঠোন লেপা শেষ করে। শীত শেষের দিকে। চড় চড় করে রোদ উঠতে থাকে। রসবালা ডেলি
বা ঢাকিতে করে ধান নিয়ে এসে খোলানে শুকাতে দেয়। কিছুক্ষণ নিজেই ঘুরে ঘুরে
পা দিয়ে ধানগুলো ছড়িয়ে দেয়। তারপর বিষেণকে পাহাড়ায় রাখে।
"দেখিস তো বাউ। ছাগল-ছেলি, গরু-বাছুর মুখ নাগাবে। মুই কনেক শাক
পিতার জোগাড় করং আর আসি আসি ঘাটিও দিম এলায়। এঃ, নাউখানে আন্দিম। তোর পিসাই
আনি দিসে। আর একখান কোনোখান আইন্না হলে হয়া যায় আজিকার দিনটা।"
বিষেণ
খোলানের একপাশে বসে পড়ে। হাতে একটা গাছের ডাল, ছুরি, টায়ারের ছেঁড়া অংশ।
ছুরি দিয়ে গাছের ডালটাকে চেঁছে মসৃণ করতে থাকে। আসলে বাঁটুল বানাবে। রসবালা
এসে বাঁটুল বানাতে দেখে ধমকায়,
"বাঁটুল আরো কী করিবু তুই বাছা বাউ? পকি টকি মারা না যায় ভোল, মোক ওইলা ভাল না নাগে।"
বিষেণ হাতের কাজ না থামিয়েই জবাব দেয়,
"না মারোং পকি। বানে থং। গুয়া টুয়া একটা দুইটা পাড়াইম। আমের টাইম আইসেছে, কাঁচা আম পাড়াইম সানা খাবার জইন্যে।"
রসবালা
আর কিছু বলে না। সময়ও নাই অত। একদিকে ধান, অন্যদিকে দুপুরের ভাত রান্না।
বড় ছেলেটা ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছে, এসে এখন ক্ষিদেয় ছটফট করবে।
.......................................................
তাবত্তে - ততক্ষণ
কত্থন - কখন
হিরিস করি - চট করে
নজরোত সুজিবে না - নজরে পড়বে না
আওদে - হয়রাণ হয়ে
আইন্না - অল্প তেলে ফোরন দিয়ে রান্না করা শাক
সানা - মাখা