ভগতপুর চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
ভগতপুর চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
________________
রাজনীতির কচকচানি ওনারা বোঝেন না। নেতাদের মারপ্যাঁচও তাঁদের মাথায় ঢোকে না। কিন্তু দলবেঁধে ভোটটা দেন। আর তাঁদের ভোটের উপর নির্ভর করছে নাগরাকাটার ভাগ্য। ওরা নাগরাকাটার চা বাগানের শ্রমিক পরিবার। সবুজ বাগানে দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি তোলা-ই মূল জীবিকা। বছরের পর বছর ধরে পেটের তাগিদে সেই কাজটাই করে চলেছেন চা বাগানের হাজার হাজার আদিবাসী মহিলা। বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনকালে উত্তরবঙ্গে এরাই ছিলেন লাল পার্টির ভোটব্যাঙ্ক। নাগরাকাটার কাছে ভগতপুর চা বাগিচার শ্রমিক মিলি ওঁরাও বলছিলেন এখন তো লালের দল নেই। তাদেরকে তো দেখতেই পাই না। ঘরে বাইরে সবাই মমতা দিদির কথা বলছে। আমরা মমতা দিদিকেই আপন বলে মনে করছি। আর কমল ফুল? জবাব এল, ওদের প্রতিশ্রতি তো অনেক শুনছি। কিছুই তো করতে দেখছি না। কি করছে তা আগে দেখি। তারপর ভাবব। এসেছি নাগরাকাটার ভগতপুর চা বাগিচাতে। ঠিক পঞ্চায়েতের আগে আগে এসেছি। তাই রজনৈতিক নির্যাস নেবার চেষ্টা করছিলাম। জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের ভগতপুর চা বাগানটির পরিচালক গোষ্ঠী ভগতপুর টি কোম্পানি লিমিটেডকে ডিবিআইটিএ সম্পূর্ণরূপে প্রশাসনিক এবং ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত সহযোগিতা করে থাকে। ভগতপুর টি কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। বর্তমান কোম্পানির মালিক তথা বোর্ড অফ ডিরেক্টর অনিল কুমার নাহাটা ২০০০ সালে কোম্পাণীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। অন্যান্য ডিরেক্টরেরা হলেন বাবুলাল নাহাটা এবং গৌরভ জৈন। বাগানটির মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ সংখ্যা ১০ জন। বাগানে প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নগুলি হল সিবিএমইউ, এনইউপিডব্লিউ, পিটিডব্লিউইউ, এবং টিডিপিডব্লিউইউ। জনগণনা অনুসারে জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা বিধানসভা কেন্দ্রে প্রায় ৪৬ শতাংশ আদিবাসীর বাস। আর ওই সম্প্রদায়ের ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। মূলত ভোটের ফল নির্ধারণ করেন এরাই। এই কেন্দ্রের অধীনে ৪৯ টি চা বাগান রয়েছে।
জন্মলগ্নে জলপাইগুড়িতে ছিল দুটি মহকুমা, যে দুটি হল জলপাইগুড়ি সদর এবং ফালাকাটা। জলঢাকা নদী ছিল দুই মহকুমার বিভাজন রেখা। জলঢাকা নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত নাগরাকাটা তখন ছিল ফালাকাটা মহকুমার অন্তর্গত। প্রশাসনিকভাবে নাগরাকাটার গুরুত্ব স্বীকৃত হয় ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ জুলাই তারিখের সরকারি প্রজ্ঞাপনে। ওই তারিখ থেকে নাগরাকাটা সদর মহকুমার অন্তর্গত ময়নাগুড়ি থানার অধীন একটা পুলিশ ফাঁড়িতে পরিণত হয়। অবশ্য রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয় আলিপুরদুয়ারের উপরে ন্যস্ত থাকে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুলাই সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নাগরাকাটা পূর্ণাঙ্গ থানার মর্যাদা পায়। অবশেষে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে নাগরাকাটা আনুষ্ঠানিকভাবে জলপাইগুড়ি সদর মহকুমার অন্তর্গত থানারূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই থানা পূর্বে ফালাকাটা তহশিল ভুক্ত এলাকা ছিল। জানা যায় ফালাকাটার তহশীলদার প্রতি মাসে একবার এখানে এসে রাজস্ব সংক্রান্ত দায়িত্ব নির্বাহ করতেন। পরবর্তীকালে এই থানা এলাকা ধূপগুড়ি তহশীল এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতীতে নাগরাকাটা জনপদে নাগরা ভুটিয়া নামে এক জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই জনগোষ্ঠীর নাম অনুসারে এই জনপদের নামকরণ করা হয়েছে বলে আঞ্চলিক ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বর্তমানে নাগরাকাটা নামে যে স্থান পরিচিত তা নাগরাকাটা চা বাগান মৌজার কিছু অংশ, কিছুটা ভগৎপুর চা বাগান মৌজার অংশ এবং কিছুটা অংশ সুখানি বস্তির অঞ্চল নিয়ে গঠিত। নাগরাকাটা থানার জন্মলগ্নে যে জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস করত তাদের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। এই এলাকায় উর্বর কৃষিজমির প্রতুলতা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনার আকর্ষণে অন্যান্য এলাকা থেকে প্রচুর জনগণ এখানে বসতি স্থাপন করে চা বাগান পত্তনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। এই রকমই একাধিক চা বাগিচা হিলা, জিতি, হোপ টি এস্টেট।
মালবাজার, মেটেলি, জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জ সার্কিটের চা বাগিচাগুলিতে করোনার সময়কালে যখন কাজ করছিলাম তখন দেখেছিলাম আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশীয় বাজারে চায়ের দাম পড়ে গিয়েছিল। তার ওপর করোনার কোপ এড়াতে ৫০ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে রাজ্য সরকারের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট মহলের ভোগান্তি আরও বেড়েছিল। অর্ধেক সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ চালাতে গিয়ে বাগানগুলি সমস্যায় পড়েছিল। যে সমস্ত শ্রমিক কাজ পাচ্ছিলেন না তারাও খুবই সমস্যায় ছিল। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার চালাতে তাদের খুবই সমস্যা হয়েছিল। অন্য কোনও উপায় না থাকায় তারা ভিনরাজ্যে যাওয়া শুরু করেছিল। রেডব্যাংক, রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকদের একটি বড় অংশই রাজ্যে কার্যত লকডাউন শুরুর আগেই অন্যত্র পাড়ি দেন। এই প্রবণতা এখনো আছে। চা বাগিচাগুলিতে কাজ করতে করতেই খবর পেয়েছিলাম ১০০ দিনের কাজে এবার চা শ্রমিকদেরকেও নেওয়া হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ শ্রমিকেরই সর্বশেষ মজুরী দিনে ২৩২ টাকা। ১ লা জুন থেকে এই মজুরী হবার কথা ২৫০ টাকা। সেই কারণে শাসকদলের প্রতি সহানুভূতির চোরা স্রোত। ভগতপুর চা বাগানের এক সর্দার রঞ্জন মুর্মু জানালেন আদিবাসীরা এককাট্টা। ৩৪ বছর বামেদের জিতিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে তৃণমূলের সঙ্গে আছে। বিনা পয়সায় রেশন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তো রয়েইছে। জয় জোহার প্রকল্পেও সুবিধা হচ্ছে। আগে তো এসব ভাবতেও পারেনি চা শ্রমিকেরা। এটা ঠিক খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পে বাগানে শ্রমিকদের মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে বাগানে চা বগিচার রেশন সরবরাহ কেন্দ্র থেকে সরবরাহেও সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাই যে ভয়ানক বৈষম্য আজ চা শ্রমিক এবং তাদের পরিবারবর্গকে মৃত্যুর কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা নির্মূল করতে সরকার, চা কোম্পানির মালিক এবং তাদের ম্যানেজমেন্টের অবিলম্বে মানবিক হয়ে ওঠাটা এখন সময়ের দাবি।
নাগরাকাটা হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক পিণাকী সরকারের সঙ্গে ভগতপুর চা বাগানের দিকে যেতে যেতে অতীতের নাগরাকাটার গল্প শুনছিলাম। অতীতে জলঢাকা এবং সংকোশ নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করত মেচ উপজাতি বা বোডো সম্প্রদায়। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল এবং গড়ে তুলেছিল নিজস্ব কৃষ্টি আর সংস্কৃতি। এই উপজাতি কৃষিকাজ, বয়ন শিল্প, কাঠ শিল্প ইত্যাদি অনেক উন্নতি সাধন করেছিল। তারা কৃষিকাজ এবং শিকার করেই দিন গুজরান করত। নিকটবর্তী ভগৎপুর চা বাগানে অবস্থিত মুদির দোকানেও কিছু কিছু সামগ্রী পাওয়া যেত। প্রথম দোকানের পরিচয় হিসাবে পাওয়া যায় এক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সোডা ওয়াটারের দোকান। এই দোকানে সোডা ওয়াটার ছাড়া পাউরুটি, বিস্কুট এবং কিছু কিছু বিলাস সামগ্রীও পাওয়া যেত। এই দোকানটিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে নাগরাকাটায় আধুনিক বাজার স্থাপিত হয়। তবে চা বাগানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্যই যে হাট দুটি স্থাপন করা হয়েছিল এ কথা অনস্বীকার্য। নাগরাকাটাকে কেন্দ্র করে আশেপাশের সৌন্দর্যখনিগুলি বেড়াতে যাওয়া যায়। থাকার জন্য নাগরাকাটায় রয়েছে বন বিভাগের বাংলো কিংবা চা বাগানের অতিথিশালা। কোন ভিআইপিদের ভিড় নেই। যখন মন চায় বেরিয়ে পড়া যায়। থাকা খাওয়ার চিন্তা করে লাভ নেই। একটু বোহেমিয়ান হলেই ভ্রমণে আনন্দ। পৌছালাম ভগতপুর চা বাগিচার অফিসে। বড়বাবুর দেওয়া তথ্যে জানলাম ভগতপুর চা বাগিচার আয়তন এবং চাষযোগ্য আবাদিক্ষেত্র ৬৩২.০১ হেক্টর। আপরুটেড এবং নতুন বপনযোগ্য আবাদীক্ষেত্র ২২.৯১ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ১২০ হেক্টর। অর্থাৎ বাগিচায় সেচ ব্যাবস্থা উন্নত। চাষযোগ্য উৎপাদনক্ষম আবাদিক্ষেত্র ৬২৩.০১ হেক্টর। প্রতি হেক্টর উৎপাদনযোগ্য এবং সেচযুক্ত প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে ১৯৬২ কেজি করে চা উৎপাদিত হয়। জলঢাকা ব্রিজ, টিলাপাহাড়, থালঝোরা যাবার সরু পথ। নাগরাকাটাতে রয়েছে কয়েকটি ক্লাব। খেলাধূলা, দলাদলি, আড্ডা সবই আছে। যারা বেড়াতে ভালোবাসেন তাদের ভাল লাগবে।
ইউরোপিয়ান ক্লাবের মাঠে দিনের শেষে নরম রোদের আলোয় ভগৎপুর চা বাগানের কর্মক্লান্ত ওঁরাও, মুন্ডা যুবক যুবতীদের ফুটবল খেলা দেখলাম। ডুয়ার্সের চা বাগানে লালমুখো সাহেব আর চোখে পড়ে না। ব্রিটিশরা চলে গেলেও চা বাগানের বৃত্তিগত স্তরবিন্যাস আগের মতোই আছে। ম্যানেজারস ক্লাবে বাবুরা এবং বাবুদের আড্ডায় শ্রমিকেরা আসে না। সকাল ৭ টা থেকে চা পাতা তোলার কাজে নেমে পড়ে শ্রমিকেরা। চলে বিকেল তিনটে পর্যন্ত। মাঝখানে সাড়ে ১১ টার সময় খাওয়ার সময়টুকু ছাড়। ওই সময়ের মধ্যে ২২ কেজি চা পাতা তুলতে হবে। তার বেশি তুললে বাড়তি কেজি প্রতি ৩ টাকা করে মিলবে। সেই হিসেব দিয়ে বাগিচার শ্রমিক পিঙ্কি ওঁরাও বলেন কয়েক মাস আগেও বেতন ছিল ১৭৬ টাকা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা বাড়িয়ে করেছেন ২০২ টাকা। তারপর হল ২৩২ টাকা। ১ লা জুন থেকে পাব ২৫০ টাকা। দেখলাম মোটের ওপর এককথাতে অধিকাংশ শ্রমিক মন্দের ভালো হিসাবে শাসকদলের পক্ষে। ভগতপুর চা বাগিচার স্টাফের সংখ্যা ১১২ জন। করণিক ১৯ জন। ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ৯ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১২৩০ জন এবং মোট জনসংখ্যা ১৫৪১৩ জন। বাগিচায় স্থায়ী শ্রমিক ১৫২৯ জন যারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ পাতা তোলার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মজুরি পায়। বিগত আর্থিক বছরে অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল গড়ে ২৫০ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা জানা যায় নি। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সংখ্যা বিগত বছরে ছিল প্রায় ৩৫০ জন। কমপিউটর অপারেটর ১ জন। সর্বমোট সাব স্টাফ ১১২ জন। ক্ল্যারিক্যাল, টেকনিক্যাল এবং স্থায়ী শ্রমিক মিলে মোট শ্রমিক সংখ্যা ২০ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৬৬২ জন এবং শ্রমিক নয় এমন সদস্যদের সংখ্যা ১৩৭৫১ জন। ছোটো হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে উন্নত মানের এই বাগানে ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত কাচা চা পাতা ৫২-৫৩ লাখ কেজি। সংগৃহিত কাঁচা পাতায় তৈরি চা ১১-১২ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা চা পাতায় তৈরি চা ধরলে মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ১৬-১৭ লাখ কেজি।
বাগানটি ইউকো ব্যাংকের কাছে আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাংক এবং নিজস্ব অর্থনৈতিক সোর্স থেকে। বাগানটির লিজ হোল্ডার ভগতপুর টি কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেড। লিজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। দেখলাম ভগতপুর চা-বাগিচায় ব্যক্তিগত ইলেকট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৫৬৮ টি। আধা পাকা বাড়ি ৬২, অন্যান্য বাড়ির সংখ্যা ৬২৫। মোট শ্রমিক আবাস ১২৫৫ টি। মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৬৬২ জন। বাগিচায় শতকরা ৭৬ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। চা সুন্দরী প্রকল্পে সরকার শ্রমিক আবাসন গড়ে দিচ্ছে যেমন বন্ধ চা বাগিচাগুলিতে, সেইরকমভাবে সমস্ত বাগিচাগুলিতে চা সুন্দরী প্রকল্পের মাধ্যমেই বাসস্থান মেরামতির জন্য একটা টোকেন গ্র্যান্ট দিক। বাগিচাগুলির আবাসন মেরামতির খরচে বাগিচা মালিকদের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগরাকাটায় প্রচার করতে এসে বলে গিয়েছিলেন বাংলায় বিজেপির সরকার এলে চা শ্রমিকদের বেতন ৩৫০ টাকা করে দেওয়া হবে। চম্পাগুড়ির বাতাসি ওঁরাও এর এক দিদি ধুবড়িতে থাকেন। বাতাসি’র কথায়, আমার দিদি থাকে আসামের ধুবড়িতে। চা বাগানে কাজ করে। গেল বার ভোটের আগে ওদের ওখানেও বলেছিল সাড়ে তিনশো টাকা বেতন করা হবে। এখনও হয়নি। তাই এসব বিশ্বাস করতে পারেন নি তাঁরা। পানিঝোরা বস্তির বাসিন্দা ছায়া রায় এবার এডুকেশন নিয়ে স্নাতকের ছাত্রী। নিতান্তই গরীব পরিবারের মেয়ে ছায়া মায়ের সঙ্গে শুকনো কাঠ জোগাড় করতে বেরিয়েছিল চা বাগানে। ২০১৯ এ প্রথম ভোট দিয়েছিলেন। জানালেন গতবার কমল চিহ্নে ভোট দিয়েছিলাম। জিতে ওরা আমাদের জন্য কী করেছে তা আজও বুঝতে পারিনি। জিনিসপত্রের দাম তো হু হু করে বাড়ছে। উজ্জালা গ্যাস তো পাই না। তাই তো কাঠ কুড়োতে বেরিয়েছি। এসব দিয়েই তো রান্না করছি। তবুও ভাল মাসে চাল, গম বিনা পয়সায় দিচ্ছে রাজ্য সরকার।
নাগরাকাটা বিধানসভা কেন্দ্রে মোট ভোটার দু লক্ষ ২৫ হাজার। এই ভোটারের প্রায় ৯৫ শতাংশ গ্রামের মানুষ। শহরবাসী মাত্র ৫ শতাংশ। সিংহভাগই আদিবাসী। তাই আদিবাসীরা যে নাগরাকাটা ভাগ্য নির্ধারণ করবে তা সকলেই জানেন। তাই আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলি উঠেপড়ে লেগেছে। রাণীচেরা চা বাগানের রাজু ওঁরাও, সুলকাপাড়ার সুশীলা ওঁরাও, টিলাবাড়ির কমলি ওঁরাও সকলেই একবাক্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপর খুশি। বলছেনও চা বাগানের শ্রমিকের উপর এত দরদ আগে কখনও কাউকে করতে দেখিনি। এর আগে অনেকেই ভোট নেওয়ার জন্য বাগানে, আমাদের বস্তিতে গিয়েছেন। কিন্তু ভোট চলে যাবার পর তাঁদের আর দেখা মেলেনি। কিন্তু মমতা দিদির দল করোনার সময় আমাদের খাবার দিয়েছে। বিনে পয়সায় রেশন দিয়েছে। আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। শুনেছিলাম চা বাগিচাতে জয়েন্ট ফোরামের ভাল প্রভাব আছে। কিন্তু কার্যত দেখলাম বাগিচা শ্রমিকেরা আড়াআড়িভাবে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য শাসকদলের ছত্রছায়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। মালবাজার, মেটেলি, জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জ, নাগরাকাটা বা ভগতপুর চা বাগিচাতে দেখলাম প্রত্যেকটি চা বাগিচাতে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে একাধিক। সেখানে শিক্ষার পাশাপাশি মিড ডে মিলের মাধ্যমে শিশুরা দুপুরবেলা তাদের ক্ষিদের কষ্ট মেটাতে পারে। তবুও বেশ কয়েকটি বাগানে কোন স্কুল নেই। ফলে বাচ্চাদের মিড ডে মিল পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি চা বাগানের স্বল্প দূরত্বে সরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র করে দিয়েছে যেখান থেকে বাগিচা শ্রমিকেরা চিকিৎসার সুযোগ পায়। ফলে বহু বাগানে কোন হাসপাতাল বা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। শিশুদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। বর্তমানে বন্ধ বাগানগুলির শ্রমিকদের উপার্জনের একমাত্র বিকল্প পথ নদীতে পাথর ভাঙ্গা। যে সামান্য টাকা এর থেকে পাওয়া যায় তাতে তাদের প্রয়োজন তো মেটেই না, বরং দূর্দশা আরো বাড়তে থাকে। এই অঞ্চলে ক্রমাগত অনাহারে মৃত্যুর কারণের সঙ্গে খাদ্য এবং পুষ্টির উৎসের অভাবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এই দিকটিতে গুরুতর আপোস করা হয়। এখানে পুষ্টিকর এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য পাওয়া যায় না।
এই সীমিত খাদ্য এবং নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধির পরিণতি যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অর্থাৎ ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানি। থাকার জায়গা, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা এবং চা-শ্রমিকদের যে রেশন দেওয়া হয় তা প্রয়োজনের নিরিখে কোন তুলনাতেই আসে না। এর সঙ্গে যদি সেখানকার থাকবার জায়গার ভয়াবহ অবস্থা যুক্ত করা হয় তাহলে এটা অত্যন্ত জরুরি বর্ধিত মজুরি এবং আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের যা যা সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য সেগুলোর সঙ্গে তাদের চিকিৎসারও যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে শ্রমিক পরিবারগুলি সঠিক চিকিৎসা এবং ওষুধের সুযোগ পায় এবং তাদের জীবন না খোয়াতে হয়। ভগতপুর চা বাগিচায় হাসপাতাল ১ টি। ডিসপেনসারিও ১ টি। আবাসিক এমবিবিএস ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্সের সংখ্যা ৭ জন। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ৩ জন। কম্পাউন্ডার ২ জন। স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। মেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১০ টি, ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ৮ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড ৮ টি, মেটারনিটি ওয়ার্ড ৬ টি। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার আছে। অ্যাম্বুলেন্স নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। চিকিৎসার জন্য শ্রমিকদের বাগানে অবস্থিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেফার করা হয়। বাগিচায় ওষুধ সরবরাহ হয়। উন্নত মানের পথ্য সরবরাহ এবং নিয়মিত ডায়েট চার্ট অনুসরণ করা হয় অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। ক্রেশের সংখ্যা ২ টি। ক্ৰেশে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় আছে। অ্যাটেনডেন্ট দেখলাম মাত্র তিনজনকে। আরো অ্যাটেনডেন্ট বাড়ানো প্রয়োজন। বাগিচায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বাংলা ও হিন্দী মাধ্যমের। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা ট্রাক আছে। বাগানে বিনোদনমূলক ক্লাব, খেলার মাঠ আছে। ভগতপুর টি গার্ডেনে নিয়মিত পি এফ বা গ্র্যাচুইটির টাকা জমা পড়ে। বোনাস চুক্তি অনুযায়ী মিটিয়ে দেওয়া । শ্রমিকদের মজুরি, রেশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চুক্তি অনুযায়ী দেওয়া হয়।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴