পইলা সাঞ্ঝির কথা/শুক্লা রায়
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ৪০
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
ঢুলিয়া
বসমতী দুপুরে বিশেষ ঘুমায় না। সেজন্য রসবালার সঙ্গে বসে দুটো সুখ-দুঃখের গল্পও করছিল, জাঁতি দিয়ে সুপারিও কাটছিল। ঘরময় তামাকের গন্ধ। বড় বড় খাচারিতে তামাক রেখে বস্তা দিয়ে ঢাকা দেওয়া। দাম আর একটু উঠলে হাটে নিয়ে যাবে। কিছু বেচা-বিক্রি হয়েছে, কিছু রেখে দিয়েছে। কার বাড়ির তরকারির কেমন স্বাদ, কে কত তাড়াতাড়ি কাজ করে -এসব নিয়ে দুজনে গভীর আলোচনায় মগ্ন। কিন্তু বাধ সাধলো মেয়ের গলা,
"বাবা ডেকাছে তোক মা। হাট যাবে বলে।"
রসবালা অবাক হয়ে বলে,
"তোর বাপ আরো এত জোগোতে হাট যাবে মাও! ঝালিটায় এলাং গোড়ায় নাই।"
বসমতী বিরক্ত মুখে মেয়েকে বলে,
"যা, মুই যাছোং। আজি আরো আদগোত বেলাতে হাট সাজিসে। এইটা মানষির কামগিলা মোক ভালোয় নানাগে।"
মুখে বললেও বসমতী আস্তে-ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সব গুছিয়ে নিয়ে রসবালার দিকে তাকিয়ে বলে,
"যাং মাই। হাটুয়া হাট করির যাবে, এখেনা চাহা করি দ্যাং যায়া।"
কান্তেশ্বর পরিস্কার লুঙ্গি আর একটা টেরিকটের পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়ে চায়ের জন্য বসে আছে। বসমতী সুপারি, জাঁতি রেখে চায়ের জল চড়ায়। উনুনে ফুঁ দিতে দিতে বলে,
"আজি আরো এত জোগোতে হাট যাছেন যে! কোনো আনিবেন? মোটা মাছ? না মসং?"
কান্তেশ্বর হাসে।
"কালি পুন্নিমার দিনটা মাছ-মসং খাবার চাছে! মুই যাং কনেক জোগোতে, আসি ভেড়ার ঘর ছুবির নাগে যে! সব জোগাড় করি থুসুং। নাল বেলাতে এলায় ছুবিমু।"
হাট থেকে ফিরেই বাড়ির সামনে খোলা জায়গাটায় কান্তেশ্বর বাঁশের চারটা খুঁটি পুঁতে উপরে কিছু খড় দিয়ে ঘরের মতো বানায়। একটা লম্বা বাঁশ খড় পেঁচিয়ে উঁচু করে রাখে। বাচ্চাগুলোকেও জড়ো করেছে ততক্ষণে। কলার ঢোনায় খই, দুধ, কলা, বাতাসা দিয়ে প্রসাদ দিয়েছে ঘরটার ভেতর। তারপর ফুলজল দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে পুজো দিয়ে প্রণাম করে প্রসাদগুলো বের করে নিয়েই ঘরটায় আগুন দিয়ে দিল। আশেপাশের অনেক জায়গাতেই ভেড়ার ঘর বা বুড়ির ঘর পোড়ানো হচ্ছে। হালকা অন্ধকারে সবকিছুই স্বচ্ছ দেখা যাচ্ছে। এখানে ওখানে আগুনের আঁচে লাল হয়ে আছে জায়গাগুলো। সবটা পোড়া হলে আগুনে জল ঢেলে দিয়ে কান্তেশ্বর বাচ্চাদুটো নিয়ে বাড়ি ফিরল, বাকিরাও গেল।
সকাল সকাল স্নান সেরে গোলাপী আভা আবির দিয়ে তুলসী মঞ্চ আর উত্তর ঘর বা বড়ঘরে মাটির ঢিবি দিয়ে বানানো নানান দেবতার চারপাশে সুন্দর করে রঙ ছড়িয়ে দেয়। তারপর পুজো দিতে বসে। কান্তেশ্বর কলার পাতা কেটে এনে দিয়েছে সকালেই। বাচ্চাদুটো ফুল, তুলসিপাতা আর দুর্বাঘাস তুলে এনেছে। পুজো শেষে হাতে আবির নিয়ে কান্তেশ্বরের পায়ে দিয়ে প্রণাম করে। কান্তেশ্বরও বসমতীর ঠোঙা থেকে আবির নিয়ে গালে, কপালে লাগিয়ে দেয়। অলক্ষ্যে দুজনের চোখে একটু বিদ্যুচ্চমকের মতো হাসি খেলে যায়। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে বসমতী আদেশ করে,
"নে বাউ, নে মাই তোর বাপোর ঠ্যাঙোত অং দিয়া ভক্তি দ্যাও।"
ছেলে-মেয়ে দুজনে বাপ-মা দ্যজনের পায়েই আবির দিয়ে প্রণাম করে। তারপর নিজেরা নিজেদের রঙ মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদের কান্ড দেখে বসমতী রেগে যায়।
"মাই! বাউ! আজিয়ে অং মাখো তো গাত? মাইর খাবেন এলায়। মাই, মাতাটাত না দিস তো অং। । বিষাবে এলায়।কালি খেলান সাকাল থাকি। তার চায়া এইলা অং ধরি যাও দোনোঝনে, তোর মামা-মামিক, ওদি জ্যাটোঘরোক ঠ্যাঙোত দিয়া ভক্তি দিয়া আইসো।"
আবির ভাগাভাগি করে নিয়ে দুজনেই ছুট। পাড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে রঙ দিয়ে প্রণাম করে ফিরতে ফিরতেই ভূত দুজনেই। ওর মা দেখে হায় হায় করে ওঠে।
"আজিয়ে এমতোন ভূত হয়া আইচ্চেন, কালি ফির কী খেলাবেন তোমরা! অংগিলাক বোদায় শ্যাষে কইল্লেন!"
কান্তেশ্বরের তখন স্নান-খাওয়া একপ্রকার শেষ। বসমতীর চেঁচানো থামাতে ওকে আশ্বস্ত করে বলে,
"নে খেলাইসে তে খেলাউক। কালিকার জইন্যে থুসুং দুই পেকেট আলদা করি।"
তাতেও বসমতীর মন শান্ত হয় না। মেয়েটার ঝাঁকড়া মাথা ধুয়ে না দিলে ঠান্ডা লেগে সর্দি, জ্বর অবধারিত। গজ গজ করতে করতে সজিমাটি সাবানটা হাতে নিয়ে কূয়োর পাড়ে যায়। মেয়েকে ধরে সাবান ঘষে ঘষে মাথার রঙগুলো তুলে ফেলে।
পরদিন সকালেই মাংস এনে দিয়ে কান্তেশ্বরও রঙ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির মানুষগুলো কে কোনদিকে যায় বসমতী তাল পায় না। কান্তেশ্বরেরও আনন্দ কম না, বাচ্চাগুলোকে বকে আর কী হবে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো রাধা-কৃষ্ণ সেজে মাগন নিতে এসেছে। বসমতী সবার ঝোলায় চাল ঢেলে দেয় আর একটু করে রঙ মাখায়। বাচ্চাগুলোও ওকে পায়ে দিয়ে প্রণাম করেই লাফিয়ে লাফিয়ে ওর গালে মুখে মাখিয়ে দেয়। রান্না শেষ করে সব গুছিয়ে রাখতে রাখতেই মহিলাদের দলটাও ঢুকে পড়ে। রসবালা ঢুকতে ঢুকতে ডাক দেয়,
"ও দি, আন্দন হয় নাই এলাং! বিরা। সোগায় আচ্চি এত্তি।"
বসমতী দোনোমনা করে।
"বাড়িটাক একেলকায় থুয়া কেংকরি যাং! ছাওয়ালা ঢুলিয়া খেলে বেরাছে, আসিবে এলায়, ভিক্ষা দিবার নাগেছে!"
রসবালা এসব অজুহাতকে পাত্তা না দিয়ে বসমতীর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে বলে,
"ঝালি গড়ি গেইসে। এলানি কী ছাওয়ালা আছে? এলা খালি বড় দলটা খোল-কত্তাল নিয়া বেরাইসে ঢুলিয়া খেলের। তে ওটে দাদাও না আছে! তোমার বাড়ি দেরী আসিবে এলায়। কলে না হবে!"
বসমতীর মনটাও আসলে ঘরে থাকতে ইচ্ছুক না। সুতরাং কোচড়ে রঙের প্যাকেট নিয়ে সেও দলে যোগ দিল। এ বাড়ি ও বাড়ি সব ঘুরে ঘুরে রঙ খেলে ভূত হল। বসমতী ফিরে যখন দলবেঁধে স্নান করতে নদী যাবে যাবে করছে তখনি পুরুষ মানুষের দলটা ঢুকল। খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন করে মাগন তুলছে। তবে কেউ আর গান গাওয়ার অবস্থায় নেই। নেশায় দুলছে অনেকেই। এই দলেও থেকেও অবশ্য কান্তেশ্বর আর কয়েকজন একদম স্বাভাবিক আছে। দেখে বসমতীও নিশ্চিন্ত হয়। ঘর থেকে থালায় করে চাল এনে উঠোনের মাঝখানে রেখে শাড়ির আঁচলটা গলায় জড়িয়ে দশের উদ্দেশ্যে একটা প্রণাম করল বসমতী। ছোটরা সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম ফিরিয়ে দিল। বয়োজ্যেষ্ঠ যারা ছিল আশীর্বাদ করে বলে উঠল,
"ভালে ভালে থাকেন বারে ছাওয়া-ছোটোক নিয়া। তোমার ডুলি উথুলি পড়ুক আর বছরে হামাক এংকরি বেশি বেশি করি ভিক্ষা দ্যান।"
বসমতী হাসে।
"দিমুকে না তে বা। আশুবাদ কর, আর বচ্ছরও ঝুনি এমতোনে চলির পাই।"
মাগন করে ভালোই চাল উঠেছে। কিছু চাল বিক্রি করে নুন, তেল, ডাল আনাজ-পাতি কিনে গোটা পাড়াসুদ্ধ খাওয়ার আয়োজন। পাড়ার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে কীর্তন, বাতাসা লুট দিয়ে পূজোর আয়োজন হল। পাশেই মাটির বড় বড় চৌকো খুঁড়ে উনুন বানিয়ে রান্না। গল্পে, গানে, দোতারায় বটতলার মন্দির জমজমাট হয়ে উঠল। পাড়ার ছেলে-পিলেদের উদ্যোগে একটা হ্যাজাকও ভাড়া নিয়ে এসে সে এক এলাহী আয়োজন। নানা বর্ণের ও নানা চেহারার চালের মোটা ভাত, মুগের ডাল, মোটা করে আলুভাজা, নানি সব্জি মিশিয়ে একটা তরকারি! যেন অমৃত। কলার পাতা ভরে ভরে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সুবাসে বাতাসও মোহিত হয়ে উঠল।
.........................................................
আদগোত বেলাতে - অর্ধেক বেলাতেই বা তাড়াতাড়ি অর্থে
ঝালি গড়ি গেইসে - বেলা পড়ে যাওয়া বোঝায়
ঢুলিয়া - দোলের দিন রঙখেলা সাথে খোল-করতাল বাজিয়ে মাগন করা।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴