স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/চতুর্থ পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
চীন ভারতের যুদ্ধ শান্ত হতেই শিলিগুড়ি কলেজ থেকে রাজা রামমোহন পুর ক্যাম্পাসে ফিরে এল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় । বলা যায় ১৯৬৪ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত সোনালি বিস্তার। উপাচার্য বিনয়েন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি-একটি নতুন বিভাগের দরজা খুলে দিচ্ছেন। নতুন নতুন জ্ঞানীগুণী অধ্যাপকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করছেন। উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হচ্ছেন নতুন আশা-উদ্দীপনায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চায় জোয়ার এল। খুলল রসায়ন, কমার্স, ইতিহাস, দর্শন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, জীবন বিজ্ঞান বিভাগ, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা। আরো কয়েকটি বিভাগও খুলবার অপেক্ষায় তখন - সমাজবিজ্ঞান /সামাজিক নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান /আইন/ হিমালায়ান স্টাডিজ সেন্টার। বর্তমানে তো আরো অনেক বিভাগ খুলেছে কম্পিউটার সাইন্স, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান, নেপালি-হিন্দি ভাষা সাহিত্য বিভাগ, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান, ফুড টেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি বায়োটেকনোলজি, লাইভ লং এডুকেশন, ফার্মাসিটিক্যাল টেকনোলজি, বিশ্ববিদ্যালয় এখন বহু বিষয়ী, বহু বিস্তারী। বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। বর্তমানের এসব খবর তো আর বিশেষ কারো অজানা নয়, আমি পুরনো কথায় ফিরে যাই ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথে কত কি বদলে গেল। কাঠেরপুল, চাঁদমণি চা-বাগান তো অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীর তখনো হয়নি। হিউম্যানিটিস বিল্ডিংটাই ছিল তখনও অব্দি পঠন-পাঠনের একমাত্র জায়গা। বিজ্ঞান-বাণিজ্য-কলা সব বিভাগের ক্লাস, ল্যাবরেটরি-লাইব্রেরী সব কিছুই একসাথে ওই একই বাড়িতে। এর বাইরে ঘরবাড়ি বলতে ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল আর কয়েকটি স্টাফ কোয়াটার আর গেস্ট হাউস। রাস্তাঘাটও তেমন তৈরি হয়নি। হলোব্রিক্সএর লম্বা একতলা বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস, যার উপান্তে উপাচার্যের দপ্তর।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রথম পর্বের কথা, ভারী সুন্দর করে সযত্নে লিখে রেখেছেন আমার পূজনীয় অধ্যাপক পুলিন দাস। বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে তাঁর অসামান্য স্মৃতিকথা -"স্মৃতি জাগানিয়া", বাংলা বিভাগের প্রাক্তনী ও বর্তমান অধ্যাপক নিখিলেশ রায় এই বইটির প্রকাশ করেছেন, যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশিয়ে তার কোন তুলনা হয় না। ২০০৮এ বাংলা বিভাগের পুনর্মিলনী উৎসবে "স্মৃতিজাগানিয়ার" প্রথম প্রকাশ। নিখিলেশের উদ্যোগে পুলিনবাবু স্যারের "স্মৃতিজাগানিয়া" উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরকালের সম্পদ হয়ে আছে। এমন সত্যনিষ্ঠ স্মৃতিকথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়কে জানবার আশ্চর্য আকর গ্রন্থ, আর দ্বিতীয় নেই ।
আবার ফিরে যাই কিছু পুরনো প্রসঙ্গে, ক্যাম্পাসে তখন পোস্ট অফিস হয়েছে, ব্যাংক হয়নি। অধ্যাপকদের মাস মাইনের চেক ভাঙ্গাতে যেতে হয় শিলিগুড়ি শহরের ইউনাইটেড ব্যাংকের শাখা অফিসে। স্থানীয় বাজার বলে কিছু নেই, ব্লেড বা টুথপেস্ট কিনতে হলেও শিলিগুড়ি ছুটতে হত। মুড়ির টিনের মত বাসগুলো শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগরা যাতায়াত করে পেট ভর্তি প্যাসেঞ্জার নিয়ে। ঝুপ করে দাঁড়াত ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে, প্যাসেঞ্জার ওঠাত-নামাত।
গল্প শুনেছি ইউনিভার্সিটির জন্য "রাজা রামমোহনপুর হল্ট স্টেশন" তৈরি হয়েছিল ।জাতীয় সড়কের দক্ষিনে ১ ও ২ নম্বর গেটের মাঝখানে যে অঞ্চল আজ ঘনবসতিপূর্ণ, সে সময় তা ছিল ফাঁকা মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করা জমির সীমানা ছিল রেল লাইন পর্যন্ত। ওই সীমানার গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল "রাজা রামমোহনপুর হল্ট
স্টেশন"। স্টেশন ঘর প্ল্যাটফর্ম সব তৈরি হয়েছিল টিকিট বিক্রির কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। ট্রেন দাঁড়াত কিন্তু তিন মাসের বেশি সেই স্টেশন আর স্থায়ী হল না। ভেঙেচুরে সব লোপাট হয়ে গেল, আজ আর সেই স্টেশনের কোনো চিহ্ন নেই।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্পাসে অনেক অসুবিধা। আধুনিক জীবনযাপনের নেই তেমন কোনো ব্যবস্থা। শিক্ষকেরা থাকতেন কন্টিনিয়াস ব্লকের ব্যারাকে। পুলিনবাবু তাঁর সেদিনের ব্যারাক প্রতিবেশী শিক্ষকদের অনেকের কথা লিখেছেন। বিশেষ করে বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক রাকেশ শর্মা, ঈশান চট্টোপাধ্যায় ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শান্তি বসুর কথা। ঈশান চট্টোপাধ্যায়কে আমি পরে দেখেছি, খুব জনপ্রিয় অধ্যাপক ছিলেন ।এক থাক বই কাঁধে করে নিয়ে লাইব্রেরীতে যেতেন। ফুটবল খেলার মাঠে প্রায়ই দেখতাম, কমার্স ফুটবল খেলায় হেরে গেলে খুব রাগ করতেন। প্রতি শনিবার তিনি নাকি পড়িমরি করে দার্জিলিং মেল ধরতেন, কলকাতাতে যেতেই হবে। ওকে নিয়ে কমার্সের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অনেক গল্প শুনেছি। রাকেশ শর্মা, শান্তি বসু, বাংলা বিভাগের অলক রায় সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হোস্টেল আর কোয়ার্টার্স গুলোতেই ইলেকট্রিক বাতি ছিল। ক্যাম্পাস জুড়ে থাকত নিঝুম অন্ধকার।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-শিক্ষাকর্মীদের মনে সব সময় ছিল আলো। কোনো মালিন্য, অন্ধকার ছিল না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল আন্তরিকতার সোনায় মোড়া। বিশ্ববিদ্যালয় চলত তার নিজস্ব গতিতে। সেদিন অনেক কিছুর অভাব থাকলেও প্রাচুর্য তো কম ছিল না। প্রকৃতি অকৃপণভাবে ঢেলেছিল সবুজ। নীল আকাশের তলে জেগে উঠত পাহাড়। রাতে তিনধারিয়া পাহাড়ে জ্বলে উঠত জোনাকির মতো মিটমিট করা আলো। বসন্তে আগুন রাঙা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ফাগুয়া রং, হলদে সোনাঝুরি। এই সব কিছু নিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘার পদতলে এক বিদ্যাপীঠ জেগে থাকত। স্বপ্ন লেগে থাকত অগণন চোখের তারায়। আর শাল কুঞ্জে বাজত ঋকবেদের আলোর মন্ত্র-
" সমানো মন্ত্র: সমিতি: সমানী
সমানাং মন: সহ চিত্তমেষাম্।"
সকলের মত এক হোক। মিলন ভূমি এক হোক। মন এক হোক। সকলের চিত্ত এক হোক।
বিশ্ববিদ্যালয় তো এই মন্ত্রেই সকলকে একসাথে বাঁধতে চেয়েছিল। জানি না আজ সেই বন্ধন কতটা শিথিল হয়ে গেছে?