সানিয়া/পর্ব-চার
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
""""""""""""""""
চোখ
বন্ধ হয়ে গেছে সানিয়ার। ঘনঘনই মনে পড়ছে তাচ্ছিল্যমাখা সেই শব্দগুলি। এক
ঝটকায় উঠে পরে বালির উপর থেকে। অদ্ভুত এক শক্তি কোথা থেকে এসে ঢুকে পরে
তার পাঁজর মাঝে। মুষ্টিবদ্ধ হয় তার যন্ত্রণা কাতর হাত। নিমেষেই সে যেন হয়ে
ওঠে তিস্তাচরের ক্ষুদে বাহুবলি। অর্ধেক ঘাস ভরা সলঙ্গীটাকে প্রবল শক্তিতে
টানতে থাকে বাথানের দিকে। রাজা-রানী যথারীতি তার পেছন পেছন। অন্যান্য দিনের
তুলনায় আজ বরং সময় লাগে কম। ঘাস নিয়ে সে পৌঁছে যায় বাথান-ঘাটে। নৌকা থেকে
ঘাস মাথায় নিয়ে প্রবেশ করে পরুর ঘরে। পরুদের ঘরে গোছা যে তাকে সময়মতো
ঝোলাতেই হবে। ওরা খেতে না পেলে হাসি ঠাট্টা তামাশার পাত্র হবে সে। তারপর
মৈষালী আলাপের সেই হেঁয়ালি শব্দতীরগুলির আঘাত সহ্য করবে কি করে? বুকটাকে যে
এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাবে সব।
ঘরময়
দই-ঘি এর গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে সানিয়ার। পরু-আলতাপরুরা মহানন্দে নলঘাস
চিবিয়ে চলে পাশের ঘরেই। ঘাস চেবানোর কচকচ আওয়াজে তৃপ্তি আসে সানিয়ার।
বাঁশের মাচায় উপর আধশোয়া হয়ে পরে রয়েছে সানিয়া। আঙুলের ব্যথাটা এতক্ষণে কমে
গেছে অনেকটাই। গোল গোল চোখ জোড়া নিস্পলক হয়ে ঘোরাঘুরি করছে এদিক সেদিক।
কয়েকটি চড়ুই পাখি লম্ফঝম্প করছে ঘরের ভেতর। ওরা মাটিতে পড়ে থাকা ভাত খুটে
খুটে মুখে তুলে নিচ্ছে আবার উড়ে উড়ে বসছে ঘরের আনাচে কানাচে। বাথানের এই
শোবার ঘর যেন আজ শুধু তাদেরই। গোটা কয়েক চড়ুইয়ের এই আস্ফালন মোটেই পছন্দ
হয়না ঘরের এক কোণে বাঁধা মুরগি দুটির। ওদের এই বাঁধন ছাড়া উল্লাস দেখে
তাদের হিংসে হয়। তাই চড়ুইয়েরা গুটি গুটি পায়ে কাছে এলেই গলা ফুলিয়ে কক কক
করে ছুটে যায় ওদের দিকে। আর পায়ে যখন দড়ির টান লাগে থেমে যায় বাধ্য হয়ে। সব
হম্বিতম্বি নিমেষেই গলে জল হয়। কিন্তু বড্ড তেজ তাদের। পায়ে বেড়ি নিয়েই এক
ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। চড়ুই আর মুরগির এই কান্ড কারখানা দেখে মনে মনে
হাসে সানিয়া। আবার কখনও কচি মনটা হয়ে ওঠে আবেগতাড়িত। চড়ুইয়ের মত উড়ে বেড়াতে
বেড়াতে কখন যে পেটের ক্ষিধেটা এসে নিঃশব্দে তার দু’পায়ে ডোর বেঁধে যায়
বুঝে উঠতে পারেনা কোনমতেই।
রাজা-রানী
দরজার কাছে আসতেই চড়ুইয়েরা পগারপার। চুপটি করে বসে পরে দরজার কাছে। সানিয়া
বোঝে ওদের মনের কথা। রান্না ঘরে রাখা হাড়ি থেকে কয়েক হাতা ভাত নিয়ে দেয়
বাথানের উঠোনের নির্দিষ্ট জায়গায়। নিজের ক্ষিধে পেলেও অপেক্ষা করতে থাকে
মৈষালদের। অপেক্ষা করে ভগলু কাকার। আজ ডিমের ঝোল রান্না হয়েছে বাথানে।
যে-কজন লোক খাবে সে’কটি ডিমই রান্না হয়েছে। রান্না করেছে রান্নার দায়িত্বে
থাকা মৈষাল কাকা আন্ধারু। ডিমগুলি বড্ড ছোট ছোট। আসলে এই ডিমগুলি ঘরের ওই
মুরগি দুটোর। ডিমের জন্যই ওদের বেঁধে রাখা হয় ঘরের ভেতর । শিয়াল-কুকুরের
থেকেও রক্ষা করা যায় সহজে। সত্যি কথা বলতে- চরের মুরগির ডিমের স্বাদই
আলাদা। ডিমের ঝোলের গন্ধে পেটের ক্ষিধে বেড়ে যায় ছোট্ট সানিয়ার। নিজের হাতে
বেড়ে নিয়ে খাওয়ার কোন বারন নেই বাথানে। যে যখন আসে সে তখনই খেয়ে নেয়।
কিন্তু আজ তার মোটেই ইচ্ছে করছেনা একা একা খেতে। আন্ধারু কাকাও আশেপাশে
নেই। সে মাছ ধরতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন নদীর অনেকটা উজানে।
বাথানে
খাবারের কোন অভাব নেই। দুধ, দই, ছানা, চিড়া, মুড়ি, গুড়, আটিয়া কলা, মাছ,
মাংস মজুদ থাকে সারা মাস। মালিক এলে তো কথাই নেই। এলাহি আয়োজন হয় খাওয়া
দাওয়ার। শুধু দুধের মধ্যে গুড় আর চা-পাতা দেওয়া কফি-চা সে খায় প্রতিদিন। যত
পার খাও ক্ষতি নেই তাতে। কিন্তু এসবে পেট ভরলেও মন ভরেনা সানিয়ার। সে চায়
সকলের একটু স্নেহ ও ভালোবাসা। ঠাট্টা-তামাশা যে তার ভালো লাগেনা মোটেই।
মহিষের
পায়ের শব্দ আর হুড় হুড় আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। একে একে মৈষালেরা আসছেন
বাথানে। ভগলু কাকা ও আন্ধারু কাকাও চলে এসেছে। হাত-পা ধুঁয়ে যে যার মতো করে
খাবার নিয়ে বসে যায় এদিক সেদিক। কেউ বসে খাচ্ছে আবার কেউ দাঁড়িয়ে। ভগলুর
নজর যায় সানিয়ার দিকে। পরুর ঘরের দরজায় একটা পিঁড়ি পেতে বসে রয়েছে সে।
-কিরে সানিয়া ভাত খাইছিস?
-না
-কেন রে? এখনও খাইসনাই কেন?
-খিদা পায় নাই। তাই খাই নাই।
-এদিকে আয় থালটা নিয়া।
থালাটা নিয়ে কাছে আসতেই কাপড় বাঁধা আঙুলটা দেখতে পায় ভগলু কাকা।
-কিরে হাত কাটলি কেমন করে? কতটা কাটছিস? দেখি দেখি আঙুলটা।
সানিয়া
হয়তো মনে মনে এটাই চাইছিল এতক্ষণ। বিস্তীর্ণ এই চরের বুকে তার দুঃখে
সমব্যথি হবার এই একজন মানুষই তো আছে। আঙুলের কাপড় সরাতেই আঁতকে ওঠে ভগলু
কাকা।
-আরে বাপরে বাপ। গর্ত হয়ে গেছে তো। দাড়া দাড়া।
ভগলু
ছুটে যায় ঘরের পেছনের জঙ্গলে। লতা-পাতা হাতে ডলে লাগিয়ে দেয় সানিয়ার
ক্ষতে। ইতিমধ্যে সানিয়ার হাত কাটার খবর জেনে যায় সবাই। সানিয়াকে অবাক করে
দিয়ে একে একে ছুটে আসে সব মৈষাল। ভাঙ্গাবেড়া, আন্ধারু, চালু, ট্যাপরা,
গজেন, ল্যাপা, কাইচালু সব্বাই। কেউ বাদ নেই। বড্ড অবাক হয় ভয়ার্ত মনটা। আজ
আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নয়। সকলে মিলে ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দেয় সানিয়াকে। হাউ
হাউ করে কেঁদে ওঠে সানিয়া। তার কালো কুচ কুচ দু’গাল বেয়ে নেমে আসা দুই
সুখের নদী ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকে তিস্তার বেলাভূমিতে।