শূন্য আমি পূর্ণ আমি/৪
শূন্য আমি পূর্ণ আমি /পর্ব-৪
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
"এখন লেসার খাব,
পাখিরা উড়ে যাবে শোকচিহ্ন নিয়ে।"
- কেন লিখেছিলাম জানি না! হয়তো এটাই সত্য হবে ২০৫০এ। বোধহয় নারু মোয়া খাবার সাধ জেগেছিল তাই! দুর্গাপুজো পরে লক্ষ্মীপুজো অঢেল মোয়া মুড়কি নারু। প্রায় সব বাড়িতেই। আমি দেখেছি মা এক এক করে সব জিনিস কিনেছিল নিজের পেট কেটে না খেয়ে কম খেয়ে। শেষে খাদ্যনালী শুকিয়ে যায়। দু'মাস হাসপাতাল অপারেশন স্যালাইন। তখন স্যালাইন চললে জল নিষিদ্ধ। এখনো কানে বাজে "বাবা একটু ঠোঁট ভিজিয়ে দে।" মেডিকেল ওয়ার্ডের দরোজার বাইরে লুকিয়ে থাকতাম। মাগো আজও চোখের জল ফেলি আমার শূন্য জীবনের বার্তা এসে গেল। মাগো তুমি যে এক এক করে ঢেঁকি মুড়ি ভাজার হাড়ি কড়াই বেড়ি কিনেছিলে। মোয়া মুড়কি লক্ষ্মী পুজো। সব বাড়ি থেকেই লক্ষ্মী পুজোর প্রসাদ নেবার নেমতন্ন। পেট বুকে উঠে যেত। সেই প্রথম বার লক্ষ্মী পুজো হল না। হবে কি করে, রাত থেকে শোবার চৌকি জলে ভাসছে। রাতে বিরামহীন বৃষ্টি। সকালে কোমড় জল। শুনলাম জলপাইগুড়িতে বন্যা। ভয়ঙ্কর অবস্থা। তিস্তা শহর ডুবিয়ে দিয়েছে। ১৯৬৮ জ্ঞান বুদ্ধির পর প্রথম বন্যা উপলব্ধি করলাম। পরে অসাধারণ এক গল্পের বই পড়েছি। 'বন্যার পরে বাড়ি ফেরা'। লেখক সমীর রক্ষিত। উত্তরবঙ্গের যে ক'জন লেখক বাঙলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত সমীরদা তাদের মধ্যে অন্যতম। আমার গল্প লেখার গুরু। তিনি সেই শুরুর সময়ে যাদবপুর থেকে আমার গল্প পড়ে লেখায় প্রাণিত করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রথিতযশা গল্পকার ঔপন্যাসিক সমীরদার কাছে আমার অনন্ত ঋণ। পরে বিস্তারিত ভাবে বলব ওঁর কথা।
মা কি পরিপাটি করে লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করতেন। তখন মোয়ার জন্য আখি গুড় জ্বাল দিতেন আমরা ভাইরা গোল করে পিড়ি পেতে বসে থাকতাম। মা একটু সর্ষের তেল মেখে পিড়িতে জ্বাল দেওয়া গুড় দিতেন। আমরা ওটা তুলে মুখে নিতাম দাঁতে চিবোতাম কিন্তু শেষ হয় না। এর নাম নৈ। আমাদের চুইংগাম। লক্ষ্মী পুজো। কার্তিক পূর্ণিমা নির্মল আকাশ। আকাশে বড় থালার মতো চাঁদ। থালা আমাদের ট্রাঙ্কে ছিল। বাবা শেষদিন পর্যন্ত কাঁসার থালায় আর আধসের জল ধরে এমন গ্লাসে জল খেয়েছেন। স্টিলের বাটিও নয়। মা পাঁচালি পড়ছেন মৃদুমন্দ বহিছে বাতাস...। আমরা ঘরে একটু প্রসাদ নিয়ে ছুটব অন্য বাড়ি। আমি তাকিয়ে দেখি বিশাল চাঁদ। ঘরে একটা ক্যালেন্ডার ছিল লক্ষ্মী নারায়ণের পুজো করছেন চৈতন্যদেব। আমার মনে হল চৈতন্যদেবের মুন্ডিত মস্তকের মতো চাঁদ। তখন ঘরের ভাঙা বেড়া ঢাকা দেবার একমাত্র উপায় ক্যালেন্ডার। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদ। বন্ধুরা ডাকছে, বাইরে এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। আরে চাঁদও আমাদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে!
কোজাগরী পূর্ণিমা প্রতিটি ঘরে শঙ্খধ্বনি
আমাদের ঘরে বাজেনি
লক্ষ্মী পেঁচা নয় কাল পেঁচা উড়ে এসে বসেছে
আমাদের কদম গাছ এন্টেনায়।
তিন বছর পরেই এই চিত্র। মা চলে গেলেন। মা যাকে আঁকড়ে সন্তান বড় হয়। আমার কৈশোর শেষে তখন আর এক যুদ্ধ শুরু হয় যৌবনের লড়াই, কর্মের প্রতিষ্ঠা সেখানে মা নেই। বাবা ব্রাহ্মমুহূর্তে গীতাপাঠ করছেন 'মা ফলেষূ কদাচন'! পদ্মাসনে ছুঁয়ে পৃথিবী। আমি দেখছি মা হাসছেন মুখে সূচ হাতে সুতো। ফুটন্ত ফুলের মাঝে দেখরে মায়ের হাসি। মা সাদা কাপড়ে ক্রুশকাটায় একটা পদ্মফুল তুলে লিখেছেন ফুটন্ত ফুলের মাঝে দেখরে মায়ের হাসি। দেখি মাকে দেখতে পাই।
নাজিম হিকমতের কবিতায় আছে বিশ শতাব্দীর শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।আমার এ শোক তো ফুরোয়নি!প্রতিমাসে তখন মাইনের টাকা হাতে পেতাম মনে হত মায়ের হাতে তুলে দিই। মা নেই শূন্যতা জগৎজুড়ে শূন্যতা। আমি লিখলাম 'বৃষ্টি ভেজা টিনের চালে মরচে ধরেছে ইতস্তত যেন যক্ষারোগীর নষ্ট ফুসফুস প্রলেপ পড়েছে রক্ত কত।'
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴